রাতের কথা

তুই,
হ্যাঁ, তুই। তোকেই বলছি। শেষরাতের সব জড়ানো কথা তো আসলে তোকেই বলা। কারণ জানি, রাত বললেই তুই আর আমি চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে উঠবো। রাত বলতে মানুষ বোঝে শরীর। আর আমরা বুঝি রাজত্ব। তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, মানুষ মানুষকে খোঁজে না। তুই সিগারেটের ধোঁয়াটা মুখে রেখে তাকালি। আমি বললাম, খোঁজে স্মৃতি। তারপর তুই ব্যস্ত হয়ে পড়লি ধোঁয়া ছাড়তে, ঠিক যেমন করে মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায়। সত্যি। মানুষের নামে তো স্মৃতিই ধরে বেড়াই। একসাথে একটু পথ চলাও তাই তোর। দূর থেকে দেখতে পেয়ে চোখের ঝিলিকও তোর। এই শান্ত শহরের বেভুল পাগলামিও তোর নামে লেখা। তোর, বকলমে আমার।
রাস্তাগুলো দরকার। হাঁটা দরকার। রোদ দরকার। টপটপিয়ে ঘাম সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু সময়ে সময়ে লম্বা গাছগুলোর ছায়াটা বড্ডো বেশি নিজের প্রাপ্য ধরে নিই। তারা ত্যাগের আনন্দে লম্বা হতে থাকে, কিন্তু ছায়াগুলো থেকে যায় একইরকম। না বড়ো, না ছোটো। ছায়াদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কেন করি না আমরা? জানিনা তাদের ছাড়া কীভাবে জিরোতাম এই প্রতিদিনের রোদে। তাদের নরম বন্ধুত্ব পাতা হয়ে ঝরে পড়ে টুপটাপ। কিন্তু ছায়া বড়ো হয়ে অন্ধকার করে দেয় না চলার রাস্তা।
তুই জানিস। সব কথা বলতে হয় না। আবার কতো কথা বলতে হয়। যার সঙ্গে বলি “আমি মুটেমজুর মানুষ, কবিতা পোষায় না”, তার সাথেই পাশাপাশি বসে রাতের চাতালে নীরব কবিতা পড়ি। হয়, এসবও হয়। কতোবারই তো হয়ে এসেছে। ভালোবাসা বন্ধুত্বের সমাজ বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা হেলায় কেটেছি কতোবার। কখনো উত্তেজনায়, কখনো আত্মবিশ্বাসে, কখনো কেবলই মুহূর্তের তাগিদে। সবসময় হাত ধরতেও হয়নি। হাত ছেড়ে নিজের পায়ে হেঁটে যাওয়া তো শিখতে হয়। আর একলাপনার নেশায় সে ক্লাস কখনো আমার, কখনো তোর। তোর আমার হাতে হাত মানে ব্যারিকেড। সে হাতে কাস্তেও থাকে, হাতুড়িও। দুজনেই শিখি। গড়ি। তার থেকেও দরকারি, ভাঙি। হাতুড়িটা তাই খুব কাজের।
ভাঙতে তো হবেই। না ভাঙলে গড়বো কী করে? তাই ভেঙে যাই। পায়ের শব্দের আওয়াজ কমতে থাকলে বুঝি, বিশ্রাম শেষ। নতুন হাঁটার সময় এগিয়ে আসছে। এই এটুকু পথে কম হাত ধরলাম না। নরম হাত। শক্ত হাত। ভিজে হাত। শুকনো হাত। কিন্তু যখন যে হাত পেয়েছি, তাদের সাথেই ভাঙা-গড়ার খেলা করেছি। আদর্শবিরোধ, মতবিরোধ, পথবিরোধ এরকম শত শত বিরোধে পিছিয়ে যাইনি। এড়িয়ে যাইনি। দুজনেই হাতে তুলেছি হাতুড়ি। ঠকঠকাং শব্দে রাত ভরিয়েছি।
কিন্তু ওরকম রাতও কম কাটাইনি। স্মৃতিমেদুর বিলাসিতায় টুকরো টুকরো কথার রাত। যার বেশিরভাগটাই পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ। আর ঠান্ডা বাতাসে প্রাণখোলা হাসির দল সেসব রাতের গল্প নিয়ে চলে গেছে কাজে লাগবে না ভেবে। ভবিষ্যৎচারণের অলসতা, স্ববিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার আবেগ নিয়ে সেসব কথা বরং থাক।
কথায় বলে, যার কিছু নেই তার আশা আছে। আমি আর তুই জানি, আশাদত্যির বিরুদ্ধে সরু কঞ্চি জোগাড় করে রোগাপ্যাংলা ছেলেটাকেই যেতে হয় সাহস করে। তাই ভোররাতে সাহসের কথা হয়। আর, যার কঞ্চি নেই, তার গান আছে। ঠোঁটে ঠোঁটে, শিসে শিসে, চোখে চোখে আমার তোর গানে হাজার মানুষের ভালোবাসা নিজেদের লড়াই খুঁজে পায়। সেই গানগুলো বেঁচে থাক। আমরা বরং এগিয়ে চলি।

এলাম। অতিনিজস্ব নিহিলিজমের ফাঁকে, ব্যস্ত প্রতিজ্ঞার অবসরে, পাল্টে যাওয়া দিনগুলোর জোরাজুরির মাঝে কোনো একদিন তোর মত ছায়া পেলে খুঁজেপেতে আমাদের ছায়াটাও বের করবো। মেলাবো না। কেবল পাশের ঘাসে পড়ে থাকবে।
ততদিন,
তোর কমরেড

প্যারালিম্পিকস

আসছিলাম ট্রেনে। প্রতিবারের মত এবারেও লেট করে ফেলেছি। উঠতে বাধ্য হয়েছি প্রতিবন্ধী কামরায়। বাধ্য হয়েছি, কারণ আমি সাধারণত জেনেরাল কামরাতেই উঠি।
সাধারণ কামরা আর প্রতিবন্ধী কামরার মধ্যে সেরকম দেখতে গেলে কোনো পার্থক্যই নেই, একটা ছোটো হ্যান্ডরেল ছাড়া। ওঠার জন্য স্লোপড পা দানি নেই, অ্যাটেনডেন্ট তো নেইই। প্রপার লাইটিং নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসিক্যালি কিছুই নেই।
একবার ছোটো বাথরুম যাবার দরকার হলো। আমি দরজাটা খুলে চাপে পড়ে গেলাম। একখানা কমোড আছে বটে, কিন্তু কাজ সারবো কেমনে? আলো নেই। রেলওয়ের ভারী দরজা পুরো বন্ধ করে দিলে অন্ধকারটাও দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার সাথে স্লিপারি মেঝে। নিজেকে সাপোর্ট দেবার মত কোনো অবলম্বন নেই। সব মিলিয়ে চমৎকার। আমি, একজন নিয়ার-পারফেক্ট প্রতিবন্ধী, প্যান্টের জিপ, পা আর গেট সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে গেলাম। ১০ মিনিটের চেষ্টায় সবকিছু সেরে বেরোলাম। বেরিয়ে ভাবছিলাম, যাদের প্রতিবন্ধকতার পরিমাণ আরোও বেশি, তাঁদের কী অবস্থা হয় এখানে!
প্রতিবছর রেল বাজেট হয়। একখানা বড় ফাইল নিয়ে একজন গম্ভীরমত মানুষ আসেন। অনেককিছু পড়ে শোনান। তা থেকে ভাড়া বৃদ্ধি বেরিয়ে আসে, নতুন ট্রেন বেরিয়ে আসে, এসির ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে, কেবল এই খোঁড়া-কানা-বোবা-অন্ধের দল রয়ে যায় অন্ধকারে।

অবশ্য রেলের কথা শুধু বলে লাভ কী?
আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা মেজরিটিকেই সুবিধা করে দিই, মাইনিরিটিদের মানিয়ে নিতে বলি। স্বাভাবিক। একটা সমাজ, তাতে বেশিরভাগই চৌকো; কয়েকটা খাপছাড়া লোক গোল, ত্রিভুজ, কেউ ট্যারাব্যাঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমি সব জিনিস চৌকৌদের মতন বানাবো। বাকিরা অ্যাডজাস্ট করে নেবে।
সবখানেই। স্কুল-কলেজে ব্রেইল বই পাওয়া যায় না। বলা হয়, ম্যানেজ করে নিন। কাজের জায়গায় স্লোপ বা লিফ্ট থাকে না। চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিবন্ধী। তাতে অবশ্য কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। ‘কোটায়’ পাওয়া লোক, তার জায়গায় একটা ‘নর্মাল’ লোক ঢুকলে বরং আরো প্রোডাক্টিভ হবে। কিছু বেসরকারি কর্মস্থল ছাড়া কোনো অফিস-কাছারিতেই প্রতিবন্ধীদের কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবাই হয় না। আজ. যদি কোনো সরকারি অফিসে হুইলচেয়ারে বসা কোনো মানুষ ক্ল্যারিক্যাল জব বা ম্যানেজারিয়াল জব করেন, লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে।
কারণ, আমরা প্রতিবন্ধীদের আলাদা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। এবং সেটা নীচু চোখ। একটা খোঁড়া লোক খুব বেশি হলে পিওনের চাকরি করতে পারে। কারণ, তার বেশি উঠলেই তার যে কোনো অক্ষমতায় প্রতিবন্ধকতার দোহাই টানা হবে।
রাষ্ট্রের এতো মাথাব্যথা নেই। রাস্তায় আলাদা লেন নেই। হ্যান্ডরেল নেই। পাবলিক বিল্ডিং, যেমন থানা, আদালত, স্কুল এসব জায়গায় ব্যবস্থা নেই। হুইলচেয়ারের মত প্রাথমিক চাহিদাগুলোর কথাও কেউ বলে না।
ভারত রাষ্ট্রে অন্য সব মাইনরিটির মত প্রতিবন্ধীরাও অবহেলিত। এবং তারা এভাবেই কন্ডিশনড। আজই দেখলাম, একজন অন্ধ, তিনি সিটে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিছুক্ষণ উসখুস করে মেঝেকে গিয়ে বসলেন। বহু বছরের বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তি মানুষকে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ শব্দটাই শেখায়।

প্রতিবন্ধীরা ‘রিজেক্টেড’ প্রপার্টি নয়।
তাদেরও নিজস্ব মেধা, দক্ষতা এবং আত্মসম্মান রয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে তাদেরও দাবি রয়েছে স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধার এবং সম আসনের।
৩ শতাংশ সংরক্ষণই মোক্ষ নয়।
সামনে আরো লড়াই রয়েছে।

সমাজের ভদ্র-সুশীল প্রতিনিধিদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একগাদা ক্রাচ-প্রস্থেটিক-কালোচশমার লড়াই।
[ শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথাই বলা হয়েছে]

পুনশ্চ: আজ কী একটা হাস্যকর কথা কানে এলো রাস্তায়। প্যারালিম্পিকস না কী। হাঃ হাঃ হাঃ!

সহবৎ

একটা কুকুর পুষেছিলাম। এইটুকু বয়স থেকে আমি তাকে শাসন করতাম। কুকুরজাত তো, না শাসন করলে মাথায় ওঠে। রোজ ধমকাতাম, সহবৎ শেখাতাম। ভদ্রতা শেখাতাম ভালো করে। কোনটা সমাজ ভালো চোখে দেখে না, কোনটা পছন্দ করে না, এইসব। যাতে বিগড়ে না যায়, তাই ঘরে বন্দী করে রাখতাম। বলতাম, বেশি উড়নচন্ডী হলে সবাই অসভ্য বলবে। কোনোদিন ফাঁক বুঝে বেরিয়ে গেলে বেল্টপেটা করতাম। দুমাদ্দুম মারতাম— শাসনে রাখতে হবে তো নাকি! পেটানোর ভয়েই ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। তারপর কোথায় খাবে, কোথায় খেলবে সব ঠিক করে দিলাম। ঘরের কুকুর, বিগড়ে যেতে দেওয়া যায়? ওর ভালোর জন্যই ছিল এসব! না শুনলে পেটানোর দাওয়াই আছেই।
এমনি করে আস্তে আস্তে ভদ্র সভ্য হয়ে উঠল। আমার জন্যেই হল। এতোদিনের ট্রেনিং বলে কথা, ঠিক কিনা!
আমার পাশের বাড়িতে নন্দ মেসোও এরকমভাবে কুকুর পুষতো। তার পাশের বাড়িতে পোলকি মাসিও তাই। তার পাশে জন আঙ্কেল। মেহেবুব চাচা। আমার গোটা পাড়াই এরকমভাবে কুকুর পোষ মানাতো। বছরের পর বছর ধরে এরকমভাবেই তো কুকুরদের পোষ মানানো হয়! আমার পাড়ায়। পাশের পাড়া কুলডাঙাতে। নারাণপুরে।
আমরা সবাই তো এরকমভাবেই কুকুরদের পোষ মানাই। ভদ্রসভ্য করে তুলি। সমাজের উপযুক্ত করে তুলি। কত বছর ধরে এমনিই করে আসছি গো!

কী বললে? তোমার একটা মেয়ে আছে?
তা…

বলেছিলাম

আর বেশি সময় পাবো না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রচুর সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তোমার সাথে। আমার সাথেও। কিন্তু আমাকে তো কথাগুলো বলে যেতে হবে। নইলে তুমি ভাববে অন্য কোনো মানুষের প্রেমে তোমায় একা ফেলে চলে যাচ্ছি। ব্যাপারটা সেটা নয়। সেটা ছিল না কোনোদিনই। আমি বলেছিলাম আমি প্রেমে পড়িনা। আমি বলেছিলাম আমি সম্পর্কে পড়ি না। আমি তোমাকে বলিনি সম্পর্কে পড়লে সবাই ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যায় আর মারা যায়? তুমি হেসেছিলে। আর ঝালমুড়ির লঙ্কা বেছে বেছে ফেলছিলে। শোনোনি কেন? আমি তোমাকে তারাপদর কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, মানুষের বেশি কাছে এলে আমি গন্ধ পাই। মুখোশের গন্ধ। ভ্যাপসা, বোঁটকা গন্ধ। তোমরা পাবে কী করে? কোনোদিন মানুষের কাছে গিয়ে শুঁকে দেখোনি সে মরে গেছে, না বেঁচে আছে। তাই আমি চলে যাব। আমার পছন্দ হয় না কাছে আসা। তুমি আমার অজান্তেই গায়ে চেপে বসো। চারপাশের মানুষেরা গায়ে চেপে বসে আমার। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি নিশ্বাস নিতে চাই আর আবার, আবার সেই গন্ধটা নাকে ঢোকে। আমি তোমাকে বোঝাতে বলেছিলাম, কীভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কাছে শান্তি পায়। তুমি পারোনি। পারবেও না। মানুষ ছাড়া বাঁচোনি কোনোদিন। তাই এসব শুনলে তোমার কান্না আসে। কিন্তু আমার জামার হাতা নিজে নিজেই শুকিয়ে যায়, তোমার অপেক্ষা না রেখেই। আমিও একদিন তারাপদর মতই বেরিয়ে পড়ব। কোনো এক বজরায়। কোনো এক গ্রামে। আবার কোনো এক মায়ের আঁচল ফেলে রেখে অন্ধকার রাতে পালাবো। আমি পালাচ্ছি। তুমি মানুষদের নিয়ে ভালো থেকো। আমাকে খুব গালাগাল দিয়ো। পাগল বোলো। তোমার ওয়েভলেংথে বেঁচো। বহুদিন। একঘেয়েভাবে।
আচ্ছা, কোনোদিন কি সত্যিই বোঝোনি? আমার প্রেমের কবিতার নির্লিপ্ততায়? আমার নান্দনিকতার অভাবে? আমার সূক্ষ্মতার অপর্যাপ্ততায়? মনে খটকা লাগেনি? কিন্তু তবু আমি ভালো থাকি। তোমার চেয়ে অনেকটা বেশি। হয়তো ডিলিউশনে থাকি। কিন্তু সেটাও ভালো। তোমার মতো মানুষের ছায়া খুঁজি না। একটা মানুষ কী দিতে পারে? তার বুদ্ধি, মনন, কথা। সবই তো তরঙ্গে ভেসে আসে। আসে না? তবে কাছে গিয়ে তার সাথে লেপটে যেতে চাও কেন? তোমার গায়েও ঘাম, তার গায়েও ঘাম। আর, ঘামে ঘাম মেলাতেই হয় যদি, তবে শরীর মেলাও। তার বেশি কিছু না।

হ্যাঁ, ভালো থেকো।
টিমপ্লেয়ার হও। ম্যাচ খেলো। ঘাম জমুক।
আমি গ্যালারিতে বসি আয়েশ করে। খেলা দেখে আনন্দ পাই।
আর একধাপ করে ওপরদিকে উঠতে থাকি।
আস্তে আস্তে…

তুমি

থরে থরে সাজানো অভিমানের ঠেলা থেকে কয়েকটা বেছে নিয়েছিলে তুমিও। নাওনি বলো? তরতাজা সদ্যজাত অভিমানগুলো থলিতে নির্দ্বিধায় ভরার সময় তাচ্ছিল্যে তার দাম মিটিয়ে আসোনি? ফেরার পথে মুঠো শক্ত করে পেছনে না তাকিয়েই তো বলেছিলে, ‘আমি ঠিক বুঝে নেব।’ ফিরে তাকাওনি। পায়ের শব্দের প্রত্যাশাও করোনি।
ভালো তো। আমি তো পইপই করে বলেছিলাম, নিজের জিনিসের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। অন্যরা নেয় না। নেওয়ার ভান করে মাত্র। তাই, তোমার চলে যাওয়া দেখে ভারী গর্ব হয়েছিল। বুকভরা স্বস্তি নিয়ে আমি দাঁতের পেছনে বলেছিলাম, ‘এ জিতে যাবে। এ বেঁচে যাবে।’
কিন্তু ব্যাগে রেখেছিলে শুধু আবেগ আর অভিমান। আবেগ জিনিসটা, আর যাই হোক, মনের জোরের জন্ম দেয় না। কাঁচের মত জিনিস। কেটে দেয় খুব সহজে, গভীর ক্ষতও সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু ভেঙেও যায় বড় তাড়াতাড়ি। তাও আবেগের জোরে লম্বা রাস্তা বাছার ভুলটা করলে। ব্যাকপ্যাকে জল নেই, শুকনো খাবার নেই, শুধু কিছু শুকনো অভিমান ভরে হাঁটতে শুরু করলে!
মনে পড়েনি যে মাঝরাস্তায় পথের ধারে ব্যাগ খুললে কিছু বাসি অভিমান ছাড়া কিছুই পাবে না। বড়জোর দুচারটে কালো পিঁপড়ে। আবেগটা ব্যাগের চেনের ফাঁক দিয়ে উবে গেছে।

ভয় পেয়োনা ভয় পেয়োনা, তোমায় আমি ফেরাবো না। আমি মানুষ ফেরাই না। পাশে থাকার অস্বস্তির চেয়ে আমার ঢের বেশি পছন্দ রাস্তার শেষে ছোটো হতে থাকা তোমার কালো অবয়বটা।
ব্যাগে এক কৌটো আত্মবিশ্বাস ভরো। এক প্যাকেট একাকীত্ব। ছোটো শিশিটায় একটু স্মৃতি। আর এক বোতল ঘৃণা। বোতলের ছিপিটা আঁটো ভালো করে। পড়ে না যায়। ঠিক হ্যায়?

দুগ্গা দুগ্গা।

মুহূর্তরা

—একটা মানুষকে সবথেকে বেশি কী দিতে পারিস?
—রাত আড়াইটের ময়দানের গেট টপকে ঢুকে খুঁজে পাওয়া বিশাল আকাশ আর তার নীচের ঠান্ডা ঘাসের ডগায় নীরবতা, যে আকাশ বুকে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো যায়।
— তার সঙ্গে?
— সারাদিন সভ্যতার দাবি মেনে চুপ করে নির্জীব পড়ে থাকা এসপ্ল্যানেড চত্বরের বুক খাঁ-খাঁ করা পাগলামোর হাসি, যা একবার শুনতে পেলে বাকি জীবন বুকের মধ্যে রিনরিন করে।
—এইটুকুই?
—কালো জলে নেড়িকুকুরের চিৎকার গুলে দেওয়া গঙ্গার ঘাটে বসে গাছের পাতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা, কখন তার হাসি পায় তার অপেক্ষা।
— শেষ?
— প্রথম রাত, মাঝরাত, শেষরাত এই তিনটে রঙের শেডকে চোখে রেখে মড়ার মত শুয়ে থাকা কোনো এক ঠান্ডা বেদীতে আর খেরোখাতায় রাতের হিসেব।
— সত্যি এসব দিবি?
— নাহ্। নিজে গিয়ে রাতের দালালের কাছে ভাড়া দিয়ে ঢুকিস দেহোপজীবিনী কলকাতার ঘরে। মায়াবিনী বেশ্যাবুড়ির বয়স কমতে শুরু করে রাত বাড়লেই। সারাদিন সে লুকিয়ে থাকে নিজের ঝুপড়িতে, বেরোয় না। তার অসূর্যম্পশ্যা শরীরে দিনের আলো লাগলেই চামড়া আরো কুঁচকে যায়, গাল ঝুলে যায় আর বয়স বাসা বাঁধে। তাই সে লুকিয়ে থাকে দিনমানে। রাত বাড়তে শুরু করলেই তার মায়াজালের কুহকে সময়ের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে। গভীর রাতে যখন সে খদ্দেরের মাথা চিবোবার জন্য কালো চিকচিকি শাড়ি পরে দরজার বাইরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, আর আঁচলের খুঁট থাকে মুখে, তখন সে লাস্যময়ী যুবতী। কোমর পর্যন্ত কালো চুল, শাড়ির ফাঁকে মসৃণ পেটের আভিজাত্য, ঠোঁটে টকটকে লাল পান আর চোখে সেই মায়া। সবাই সহ্য করতে পারে না। কেউ দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, কেউ সাহস করে সামনে চলে এসে তার হাতের সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে মরে। শহরবুড়িও জানে, তার শরীর নিয়ে যে কেউ খেলা করতে পারে না। আঙুল পুড়ে যায়। তাই সেও সুগভীর নাভি, উন্নত স্তন আর আবেদনে ভরা দৃষ্টি নিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে চুড়ি পরে পরস্ত্রীর নিষিদ্ধ কামনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাতের ভবঘুরের অপেক্ষায়, যে তার নিজের ছন্নছাড়া শরীরের অশান্তিটুকু তাকে দিয়ে শান্ত করবে নিজের শরীরের নিচে।
আর কলকাতার দালালরা সোডিয়াম ভেপার আলোর নীচে ফাঁকা রাস্তার গোপনতায় দাঁড়িয়ে থাকে কমিশনের আশায়।

যাস্ একদিন।

ডিলিউশন

Delusion: An idiosyncratic belief or impression maintained despite being contradicted by reality or rational argument, typically as a symptom of mental disorder.
ডিল্যুশন, একটি মানসিক অসুখ। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস, যা বাস্তবতা বা যৌক্তিক তর্ক দ্বারা পরাজিত হলেও অবচেতনে গেঁথে বসে থাকে, তাকে ডিল্যুশন বলে।
সবচেয়ে সহজলভ্য উদাহরণ? আপনার, আমার প্রত্যেকের ঘরেই পাবেন।
একটি ছোটো মেয়ে। নবজাতকের প্রথম এক-দুবছর তার সাথে অন্য শিশুদের কোনো পার্থক্য থাকে না। তারপরেই আস্তে আস্তে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে থাকে দায়িত্ববোধ। আপনি বলবেন, দায়িত্ববোধ? সে তো ভালো জিনিস! সবার শেখা উচিত। কিন্তু না কত্তা, এই যে দায়িত্ববোধ প্রতিদিন ২ মিলিগ্রাম ডোজে শিরায় ঢেলে দেওয়া হয়, তাতে ‘সংসার’ নামে এক অলীক বস্তু মিশে থাকে। তার ডলপুতুলের মধ্যে দিয়ে তাকে মাতৃত্বের পাঠ দেওয়া হয়, শেখানো হয় সেই অবলা পুতুলশিশুর সব দায়িত্ব তার। তাকে খাওয়ানোর। ঘুম পাড়ানোর। নিজের সাথে সাথে বাকি সবার দায়িত্বপালনের নামই তো নাকি ‘সংসার’।
মেয়ে বড়ো হয়। রান্নাবাটি খেলে। সেখান থেকেই শেখে, স্বামী ঘরে এলে রান্না করতে হয়। ঘরের কাজ করতে হয়। অফিস যাওয়া তো খুদে স্বামীটির কাজ! তার ‘দায়িত্ব’ ঘর সামলানো।

এপ্রসঙ্গে মনে পড়লো, আমি তখন ছোট। পুঁচকি বয়স। ছোটো থেকেই আমি ছিলাম আমার ছোটত্বে অসন্তুষ্ট, চেষ্টা করতাম বড়োদের দলে ভিড়বার। তাই সব আদেশকে ‘বড়ো কাজের দায়িত্ব’ ভেবে পালন করার অভ্যেস ছিল। এভাবেই, ছাদে গিয়ে রোদে বসে আচার পাহারা দিতাম, একা গিয়ে দোকান থেকে জিনিস কিনে আনতাম। আর এভাবেই আমাকে দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নেওয়া যেত।
এভাবেই ছোটোবেলা থেকে আমাদের সমাজেও শিখিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের। ‘সংসার’ সামলানোর ‘দায়িত্ব’ তো আসলে মেয়েদেরই। মিথ্যে রঙের ফানুস সাজানো হয় এই বলে, যে ছেলেরা তো ‘উড়নচন্ডী’, ছেলেরা ‘বহির্মুখী’, ছেলেরা ‘অমনোযোগী’ — তারা আবার ‘সংসারের গুরুদায়িত্ব’ কী সামলাবে! মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়, তারা এই ‘সংসারের কর্ত্রী’। তাদের মনে এই ভুল ধারণাকে জোরদার করে গেঁথে দেবার জন্য বিয়ের দিনই আঁচলে বেঁধে দেওয়া ঘরের চাবি। ওই ঘরের চাবির মূলো নাকের সামনে ঝুলিয়ে গৃহবধূদের দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সংসার নামক এক অসংজ্ঞাত বস্তুর দিকে।
স্বাভাবিক। একটা ছোটো মেয়ে, যে ছোটোবেলা থেকে বারণ, নিষেধ, আর চোখরাঙানি ছাড়া কিছু পায়নি, তাকে টোপ দেওয়া হয়, “চল মেয়ে তুই সংসার পাবি। নিজের সংসার। সেখানে তুই রানি। তোর টাকা। তোর চাবি। তোর দায়িত্ব। তুইই সবকিছু সেখানে।”
বেচারা মেয়ে, সে বেনারসীর জবড়জং নিয়ে ‘সংসারে’ এসে দেখে, আলমারির চাবির ঝুনঝুনি আর রান্নাঘরের দায়টুকু ছাড়া সে কিছুই পায়নি।
দায়িত্ব নয়। দায়। সকালে উঠে টিফিন গুছিয়ে দেবার দায়, ভাত বেড়ে দেবার দায়, বাচ্চার ব্যাগ গুছোনোর দায়।
এভাবে ‘সংসারটা মেয়েরাই বাঁধে’ টাইপ কথাবার্তা দিয়ে ছেলেদের ছোটোবেলা থেকে খোদার খাসি করে তোলা হয়। রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গ্যাস জ্বালাতে দেওয়া হয় না। জামাকাপড় কাচতে শেখানো হয় না। ইস্ত্রিতে হাত দিলেই হাত পুড়ে যাবে মনোভাব নিয়ে ইস্ত্রি ব্যান করে দেওয়া হয়। ফলে, সে আর মানুষ. তৈরি হয় না, তৈরি হয় একটি ফিমেল-ডিপেন্ডেন্ট ঢ্যাঁড়শ। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই ছেলে বিয়ে করলে জন্ম দেয় আরেকটা ‘সংসারের’।

পরিবার আর সংসার। পার্থক্য আছে।
পরিবারটা সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে। আর ‘সংসার’ ধারণায় খেটে মরে কেবল মেয়েটা।
মেয়েদের দায়িত্ব কেবল ‘সংসার সামলানো’ নয়।
আর ছেলেদের দায়িত্ব কেবল সকাল নটায় উঠে অফিস দৌড়নো নয়।
আসুন, ভাগ করে নিতে শিখি আমরা।
ভেঙে ফেলি পিতৃতান্ত্রিক ‘সংসার’ ধারণাটা।
পরিবার গড়ে তুলি সবাই মিলে।

বেটি বাঁচাও

“যারা গৌরী, যারা শুভ্রা, যারা উজ্জ্বলা, এবং যারা নও তাদেরও মনখারাপ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তোমাদের জন্য ওশিয়া হারবালস্ নিয়ে এলো…” এফএমটা বন্ধ করে দিলাম।
এই তো! দুভাগ করে দিতে পেরেছে সহজেই। তোমরাই তো শিখিয়েছো। আমরাই তো শিখিয়েছি। তোমার ক্লিভেজের ভাঁজে দুভাগ। তোমার ক্রিমের কৌটোর প্রতি প্যাঁচে আলাদা আলাদা স্তরের মেয়েরা। গৌরীরা একদিকে, শ্যামারা অন্যদিকে। বান্ধবীদের আড্ডায় তুমিও কালো মেয়েকে নিয়ে ঠাট্টা করেছো। বা তোমার ব্রণওলা বন্ধুকে বলেছো হিমালয়ার ক্রিম ব্যবহার করতে, করে ব্রণগুলো মুছে ফেলতে। কারণ ব্রণগুলো থাকলে সুন্দর লাগে না। ব্রণগুলো ঘষে ঘষে তুলে ফেলা উচিত। তা সে যতই গাল লাল হয়ে যাক। রক্ত বেরোক। সভ্যতার শুরু থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে, কিন্তু সমাজের বেঁধে দেওয়া ফর্সা, লম্বা, তন্বী মেয়েদের সংজ্ঞাটা বদলায়নি।
আমি আজ পর্যন্ত অনেক মেয়ের বন্ধুত্ব পেয়েছি। বেশিরভাগেরই মুখ থেকে শোনা, তারা নাকি কোনো একবেলার খাবার, দুপুরের বা রাতের, ‘স্কিপ’ করে যায়। কারণ, তারা নাকি খুব মোটা। পাতলা হতে চায়। মোটা হবার নাকি প্রচুর অসুবিধা। যতবারই জিজ্ঞেস করেছি কী অসুবিধা, তারা বলেছে ‘তোরা বুঝবি না’।
আর এভাবেই সমাজের চোখ পাকানোর তলা দিয়ে ঢুকে পড়ে ৫২ শতাংশ অ্যানিমিয়ার দৈত্য।
মোটা হলে ছেলেরা তাকাবে না। ব্রণ হলে প্রেম হবে না। কালো মুখে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি না মাখলে ডেটে যাওয়া যাবে না। বেঁটে হলে লম্বা লম্বা হিল পরে পায়ে ব্যথা সহ্য করেও হাঁটতে হবে, নইলে বান্ধবীরাই হাসবে।
তোমার শরীর ‘সুন্দর’ না হলে সমাজ তোমাকে বিয়ে করবে না, শুনছো তুমি, সুন্দরী?

বিশ্বাস করবে, কষ্ট হয় না খেয়ে আছো শুনলে?
বিশ্বাস করবে, গর্ব হয় তোমাকে মেকআপের মুখোশ না পরতে দেখলে?
বিশ্বাস করবে, মন ভালো হয়ে ওঠে সমাজকে ছিঁড়েখুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখলে?

ভালো থেকো। তোমার উস্কোখুস্কো চুলে। তোমার লম্বা অগোছালো চুলে। তোমার মোটা শরীর নিয়ে। তোমার চোখের কালিতে। ওয়াক্সিং না করা পায়ের লোমে।
শুধু, ভালো থেকো। 🙂

[লেখাটা শেষ করে এফএমটা আবার লাগালাম। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘বেটি বাঁচাও, নেহি তো বহু কাঁহাসে আয়েঙ্গে?]

শান্তিপর্ব

হাওড়া ব্রিজে একবার যেও।
রাস্তার ধারে ফুটপাথের গায়ে লাগানো রেলিংটার বুকে বুক ঠেকাতে।
যেন সারা পৃথিবী ওই ছোঁয়াটুকুর অপেক্ষাতেই লোভী ছেলের মতো বসে ছিল। ছোঁয়া লাগতেই নিমেষে চারপাশ কালো। শুধু তুমি আর নদী মুখোমুখি। একটা সাদা নদী। পুরো সাদা নয়। মাঝখানে সবুজ সবুজ গোল দাগ। তুমি ভেতরে জানো, ওগুলো কচুরিপানার মুন্ডু। যেগুলো দিনভর সাঁতার কেটে বেড়ায়।
কিন্তু এখন এরকম কিছু মনে করার সাহসও নেই তোমার মধ্যে। ওগুলো যেন প্রেমের দাগ। প্রচণ্ড তীব্র কষটে প্রেম। থিতু হতে পারেনি। ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আর সেই সাদা নদীর ওপর একটা উঁচুনীচু বেঢপ ধূসর শহর জমে আছে। থুপি থুপি। প্রচণ্ড শান্ত। ভেতরের সাইটোপ্লাজমিক অশান্তি মেঘের মেমব্রেন ছাড়িয়ে বেরোতে পারছে না।
মেঘ। কালো মেঘ। আকাশ ছড়ানো। সবকিছু চুপ করিয়ে দেয়। চোখের কোণে তুমি দেখবে কেউ সেলফি তুলছে। কেউ কথা বলছে। কিন্তু তোমার ভেতরের শান্তি তোমার হাত পা ভারী করে দিয়েছে এতোক্ষণে। কিছুই করা সম্ভব নয়। এরই মাঝে একখানা চিল শান্ত মনেই আকাশের গায়ে গায়ে লেগে ভেসে যায় নিজের মত।

হঠাৎ রেলিংখানা কেঁপে ওঠে ব্যস্ত কলকাতার চাপে। সাথে সাথে বুকটাও।
শান্তিপর্ব শেষ। পায়ে পায়ে আবার জীবনে নেমে যেতে হয়।

বিজনবাবুর রোগ

বিজনবাবু লোকটার সব ভাল, শুধু একটাই দোষ। তাঁর পাঁচ নম্বর রোগ আছে।
প্রতিদিন বিকেল চারটের সময় আধঘন্টা ধরে তিনি আসর বসান। গঙ্গার বোতল থেকে মেপে মেপে চার পেগ। পর পর। কাঁচাই খান।
লঞ্চের হইহট্টগোলের চাটের প্লেট সাথেই রাখেন। আর এক চিমটি আকাশের জলজিরা।

তারপর তিনি গোটা সন্ধ্যে নেশায় থাকেন। আধেক আলোছায়ার মাঝে গিন্নির সিরিয়াল, বাচ্চার হোমওয়ার্ক সব ভেসে ভেসে পেরিয়ে যায়।
এজন্যই বোধহয় সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তাঁর বীভৎস হ্যাংওভার হয়। মাথাব্যথা, কাঁধব্যথা, চোখব্যথা।
ডাক্তার বলে নাকি কম্পিউটারে কাজ করার জন্য হয়। বলিহারি!

আর রবিবার তিনি হুঁশ হারিয়ে পড়ে থাকেন সারাদিন। সকালে বেডটির সিরিঞ্জে এক ভায়াল পাশবালিশ শিরায় চালিয়ে দেন। কখন সন্ধ্যে নেমে যায়, টেরই পান না।

মোটকথা বিজনবাবু নেশার দাস।