প্যারালিম্পিকস

আসছিলাম ট্রেনে। প্রতিবারের মত এবারেও লেট করে ফেলেছি। উঠতে বাধ্য হয়েছি প্রতিবন্ধী কামরায়। বাধ্য হয়েছি, কারণ আমি সাধারণত জেনেরাল কামরাতেই উঠি।
সাধারণ কামরা আর প্রতিবন্ধী কামরার মধ্যে সেরকম দেখতে গেলে কোনো পার্থক্যই নেই, একটা ছোটো হ্যান্ডরেল ছাড়া। ওঠার জন্য স্লোপড পা দানি নেই, অ্যাটেনডেন্ট তো নেইই। প্রপার লাইটিং নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসিক্যালি কিছুই নেই।
একবার ছোটো বাথরুম যাবার দরকার হলো। আমি দরজাটা খুলে চাপে পড়ে গেলাম। একখানা কমোড আছে বটে, কিন্তু কাজ সারবো কেমনে? আলো নেই। রেলওয়ের ভারী দরজা পুরো বন্ধ করে দিলে অন্ধকারটাও দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার সাথে স্লিপারি মেঝে। নিজেকে সাপোর্ট দেবার মত কোনো অবলম্বন নেই। সব মিলিয়ে চমৎকার। আমি, একজন নিয়ার-পারফেক্ট প্রতিবন্ধী, প্যান্টের জিপ, পা আর গেট সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে গেলাম। ১০ মিনিটের চেষ্টায় সবকিছু সেরে বেরোলাম। বেরিয়ে ভাবছিলাম, যাদের প্রতিবন্ধকতার পরিমাণ আরোও বেশি, তাঁদের কী অবস্থা হয় এখানে!
প্রতিবছর রেল বাজেট হয়। একখানা বড় ফাইল নিয়ে একজন গম্ভীরমত মানুষ আসেন। অনেককিছু পড়ে শোনান। তা থেকে ভাড়া বৃদ্ধি বেরিয়ে আসে, নতুন ট্রেন বেরিয়ে আসে, এসির ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে, কেবল এই খোঁড়া-কানা-বোবা-অন্ধের দল রয়ে যায় অন্ধকারে।

অবশ্য রেলের কথা শুধু বলে লাভ কী?
আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা মেজরিটিকেই সুবিধা করে দিই, মাইনিরিটিদের মানিয়ে নিতে বলি। স্বাভাবিক। একটা সমাজ, তাতে বেশিরভাগই চৌকো; কয়েকটা খাপছাড়া লোক গোল, ত্রিভুজ, কেউ ট্যারাব্যাঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমি সব জিনিস চৌকৌদের মতন বানাবো। বাকিরা অ্যাডজাস্ট করে নেবে।
সবখানেই। স্কুল-কলেজে ব্রেইল বই পাওয়া যায় না। বলা হয়, ম্যানেজ করে নিন। কাজের জায়গায় স্লোপ বা লিফ্ট থাকে না। চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিবন্ধী। তাতে অবশ্য কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। ‘কোটায়’ পাওয়া লোক, তার জায়গায় একটা ‘নর্মাল’ লোক ঢুকলে বরং আরো প্রোডাক্টিভ হবে। কিছু বেসরকারি কর্মস্থল ছাড়া কোনো অফিস-কাছারিতেই প্রতিবন্ধীদের কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবাই হয় না। আজ. যদি কোনো সরকারি অফিসে হুইলচেয়ারে বসা কোনো মানুষ ক্ল্যারিক্যাল জব বা ম্যানেজারিয়াল জব করেন, লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে।
কারণ, আমরা প্রতিবন্ধীদের আলাদা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। এবং সেটা নীচু চোখ। একটা খোঁড়া লোক খুব বেশি হলে পিওনের চাকরি করতে পারে। কারণ, তার বেশি উঠলেই তার যে কোনো অক্ষমতায় প্রতিবন্ধকতার দোহাই টানা হবে।
রাষ্ট্রের এতো মাথাব্যথা নেই। রাস্তায় আলাদা লেন নেই। হ্যান্ডরেল নেই। পাবলিক বিল্ডিং, যেমন থানা, আদালত, স্কুল এসব জায়গায় ব্যবস্থা নেই। হুইলচেয়ারের মত প্রাথমিক চাহিদাগুলোর কথাও কেউ বলে না।
ভারত রাষ্ট্রে অন্য সব মাইনরিটির মত প্রতিবন্ধীরাও অবহেলিত। এবং তারা এভাবেই কন্ডিশনড। আজই দেখলাম, একজন অন্ধ, তিনি সিটে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিছুক্ষণ উসখুস করে মেঝেকে গিয়ে বসলেন। বহু বছরের বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তি মানুষকে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ শব্দটাই শেখায়।

প্রতিবন্ধীরা ‘রিজেক্টেড’ প্রপার্টি নয়।
তাদেরও নিজস্ব মেধা, দক্ষতা এবং আত্মসম্মান রয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে তাদেরও দাবি রয়েছে স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধার এবং সম আসনের।
৩ শতাংশ সংরক্ষণই মোক্ষ নয়।
সামনে আরো লড়াই রয়েছে।

সমাজের ভদ্র-সুশীল প্রতিনিধিদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একগাদা ক্রাচ-প্রস্থেটিক-কালোচশমার লড়াই।
[ শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথাই বলা হয়েছে]

পুনশ্চ: আজ কী একটা হাস্যকর কথা কানে এলো রাস্তায়। প্যারালিম্পিকস না কী। হাঃ হাঃ হাঃ!

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান