একটা বুড়ো বয়সের গল্প

 

প্রিয়া আজকাল সবসময় জ্বলেই থাকে। কড়াইয়ের তেলে পেঁয়াজ আর ফোড়নগুলো দিলেই যেমন ঝ্যাঁস্ করে ওঠে, সেরকম চিড়বিড় করে ওঠে। স্বাগতর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে প্রায় ১২ বছর আগে। লোকে বলে, বউ যতই দজ্জাল হোক, বিয়ের ১০ বছরের মধ্যে সব সহ্য হয়ে যায়। সে মুখঝামটা হোক, বা ঝাঁটার ঝাপটা।
কিন্তু এই আপদটা নতুন।
তিনটে মানুষের জীবন বেশ ফ্লুইড চলছিল। মিষ্টির রসের মত মিষ্টি, কিন্তু প্যাচপেচে না। ক্লাস ২ এর বিষাণকে রেডি করা, স্কুলে পাঠানো, স্বাগতর ভাত বেড়ে দেওয়া, তারপর ওম্ শান্তি! কোনো হ্যাপা নেই গোটা দিনটায়। মাঝে মাঝে বাবুর প্রেম চাপলে একটু আগে চলে আসতেন, একটু হুটোপুটি হত দুজনের। নির্ঝঞ্ঝাট নির্দায় জীবন কেটে যাচ্ছিল।

হঠাৎ চাপে ফেলে দিলেন স্বাগতর বাবা। মানে, পূজনীয় শ্বশুরমশাই। “শ্বশুরমশাই না হাতি! বিয়ের সময় দুহাতে দুটো পাতলা চুড়ি পরিয়ে দায় সেরে দিয়েছিল। তার আবার শ্ব-শু-র-ম-শা-ই! হেঁহ!”, এখনো সেই প্রসঙ্গ উঠলে প্রিয়া গলার ভেতরে কথাগুলো আওড়ায়। ঠোঁটে আনে না অবশ্য। বেকার বেকার মরা মানুষটার কথা বলে ভালোমানুষ বরটাকে জ্বালাবার কোনো মানে হয় না।
হ্যাঁ, ঠিক দুবছর আগে, সাহেবি কেতার ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাক নামক শৌখিন রোগটিতে টুক করে ওপারে রওনা দিলেন। আর, তাঁর ৩২ বছরের ‘চাপ’ মালতীদেবীকে স্বাগত-প্রিয়ার কাঁধে ‘ফেলে’ দিলেন। ব্যাস!
গরমের দুপুর। পুরোনো গলি। আইসক্রিমের গাড়ি। কাঠের ব্যাট। ঝমঝম বৃষ্টি। ছাদ। বাঙালি জাতটার ন্যাকা নস্টালজিয়া নামক দুঃখবিলাসের উপাদান ‘বাংলা মায়ের আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে’ লুকিয়ে আছে। সেরকমই আরেক জিনিস হল এই দাদু-ঠাকুমার প্রজাতিটা! এখন প্রিয়ার মনে একদম বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, এই ৬০-৮০ এজ গ্রুপের লোকগুলোর অ্যান্টিক ভ্যালু ছাড়া আর কোনোরকম ভ্যালু নেই!
হবে নাই বা কেন! অন্য সব বুড়ির মতো কোথায় হরিনাম করবে, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাবে, সকালে বিকালে টুকু হাঁটবে আর দুধ-খই আর দুধ-মুড়ির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে, তা না! ৭২ হতে চলল, হাই সুগারের পেশেন্ট, চোখে দেখতে পায় না বললেই চলে—তবু মোটা মোটা বই পড়া চাই! আর তেমনি স্পিড আছে বটে! দুদিনে বই শেষ করে দেয়! সপ্তায় দুবার করে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে বই পাল্টে এনে দিতে হয়। তাক লেগে যায় প্রিয়ার। পাতলা ওই ‘সুখী গৃহকোণ’টা শেষ করতেই ওর ১৫-২০ দিন লেগে যায়!

সে পড়ছে পড়ুক। যা ইচ্ছে করুক। কিন্তু হ্যাপা কী আর একটা! যখন উনি মারা গেছলেন, তখন সরল মনে মালতীদেবীকে এনে উপরের তলায় তুলেছিল ওরা। কিন্তু দিনকয়েক বাদেই বুঝতে পারল প্রিয়া, মালতীদেবীর নাকটি আর কাজ করে না। অন্তত পেচ্ছাবের ক্ষেত্রে। সুগারের পেশেন্ট, দিনে ত্রিশবার করে পেচ্ছাব করতে যায়, আর জলটুকু পর্যন্ত মনে করে দেয় না! অদ্ভুত! সারা ঘর যে গন্ধে ম-ম করে, যে গন্ধে খেতে বসার আগে দুবার ফিনাইল না দিলে বমি চলে আসে, সেই গন্ধটা ওনার নাকেও যায়না! গন্ধের কথা বললেই বলেন, “ওসব তোমার মনের ভুল বৌমা!” শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। সেটার সুরাহা করতেই অবশ্য এই মাসছয়েক আগেই নিচের তলায় নামিয়ে দিয়েছে বুড়িকে। ওখানে যা ইচ্ছে করুকগে! এখন নিচের তলাটায় নামা যায় না। কোনোমতে খাবারটা আর বইটইগুলো নামিয়ে দিয়ে পালায় প্রিয়া।
জঞ্জাল যত জীবনে! দুপুরবেলার সুখ-শান্তি সব নষ্ট হয়েছে এখন! বুড়ির ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায়। আর তেমনি খেতে পারে বটে! অ্যাতোটা ভাত, মাছ, তিনটে তরকারি, দই, চাটনি অনায়াসে সাঁটিয়ে দেয় এই বয়সেও! পেট খারাপের ভয়ে কদিন খাবার কমিয়ে দিয়েছিল প্রিয়া, তাতে স্বাগতকে একদিন ডেকে কীসব বলে টাকা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। পারে বটে!
স্বাগত বুঝেছিল ব্যাপারটা। আস্তে করে বলেছিল, “পুরোনো দিনের মানুষ। বেশি খেতে পারে। বেশি করেই দিয়ো, ভয় পেও না।” তারপর থেকে ওমনিই দেয়। চূড় করে সাজিয়ে দেয়। মরুকগে!
তো এতো খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেলে আর ল্যাদের সময় কোথায় পাওয়া সম্ভব? জাহান্নামে গেছে সব। ল্যাদ, আড্ডা, সিনেমা, সব!

বুড়ির আরেক বাতিক আছে। বুড়ি কীসের যেন অপেক্ষা করে! প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারতো না প্রিয়া, কেন একটা বুড়ো মানুষ সপ্তাহে দুতিনদিন জিজ্ঞেস করে তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা! যেখানে সারা মাসে চিঠি বলতে এলআইসির একদুটো, শেয়ারের কোম্পানির দুতিনটে চিঠি আর বিলগুলো ছাড়া আর কিছুই আসে না, সেখানে ব্যাপারটা অদ্ভুত বইকি!
প্রথমে প্রথমে ভাবতো পেনশন। তারপর একদিন জিজ্ঞেস করলো স্বাগতকে। স্বাগত প্রথমে “ওসব জেনে কী করবে, ছেড়ে দাও না” বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল, পরে চাপাচাপি করতে খুলে বলল। নাকি কলেজে মালতীদেবীদের কয়েকজন মিলে একটা প্ল্যান বানিয়েছিলেন। স্বাগতর ভাষায়, “মায়ের একখানা হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড ছিল। কি একটা নাম, ভুলে গেছি। সে আর তার বন্ধুরা মিলে একখানা প্ল্যান বানিয়েছিল, যে তারা তাদের বুড়ো বয়সে একসঙ্গে সবাই মিলে মস্তিতে থাকবে। একখানা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করবে সে। তারপর সব বন্ধুকে ডেকে নেবে বুড়ো বয়সে। সেখানে নাকি মোটেও টিপিক্যাল বুড়ো বুড়ো জিনিসপত্র হবে না। সবাই আড্ডা দেবে, পছন্দের জিনিসে মন দেবে, বই পড়বে, গান গাইবে একসাথে, সিনেমা দেখবে, ঘুরতে যাবে। শেষবয়সে সবাই মিলে ভালো থাকবে।” শুনে প্রিয়া অবাক! জিজ্ঞেস করেছিল, “আর ৪০ বছর পরে ঠিকানা পাবে কোথায়?” স্বাগত বলেছিল, “অ্যাই! এক্কেবারে! আমিও এই প্রশ্নটাই করেছিলাম মাকে। মা বলেছিল, ওই লোক নাকি সব পারে! বোঝো!”
প্রিয়া শুনে ঠোঁট উল্টেছিল। হুঁহু্! পাগলামি যত্ত! বৃদ্ধাশ্রমে হইহুল্লোড়! এই আজগুবি প্ল্যানটা মনে পড়লেই ফিক্ করে হেসে ফেলে প্রিয়া। তারপরেই ভাবে, “না বাবা। আমার বাবুটা আমাকে যত্নে রাখবে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না কক্ষনো!”

এখন তো বুড়ি নীচের তলায়। তাই বেশি কথাও হয়না। আছে নিজের মতন। এমনকি পেপারটাও আলাদা করে দিয়েছে এখন। পেপার এলেই খুঁটিয়ে পড়া অভ্যাস বুড়ির, তখন চাইতে গেলেই বিরক্ত হয়। তাই একটা আনন্দবাজার গেটের ফাঁক দিয়ে নীচের তলায়, আর একটা ছুঁড়ে উপরের তলায়। শান্তি!
হঠাৎ, একদিন রবিবার সকাল নটায় ঘুম ভাঙলো প্রিয়ার। উঠেই চমকে গেল! এতো দেরি হয়ে গেল তবু জলখাবারের তাড়া আসেনি নীচ থেকে? অবাক কান্ড তো!! তাড়াহুড়ো করে এগোতে গেল সে। পায়ে ঠেকলো দড়িবাঁধা আনন্দবাজারটা।
হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা হলুদ লিফলেট।
তাতে অবাক একটা বিজ্ঞাপন।
“দি কলেজ রকার্স”
[বঙ্গবাসী কলেজ, ১৯৬৬ ব্যাচ, ইংলিশ অনার্স। মনে পড়ে শেষদিনের আড্ডায় করা প্রমিসগুলো? আমি কিন্তু আমার প্রমিস রেখেছি। আমি, আশিস, বিবেক আর শর্মিলা এই চারজন এখন আছি। বাকিরাও চলে আয় তাড়াতাড়ি।
জমিয়ে আড্ডা হবে আবার। অনেক গল্প জমে।]
নিচে একটা অ্যাড্রেস। রাজাবাজারের। অ্যাড্রেসটা আর পড়ার চেষ্টা করলো না প্রিয়া। নিচেও গেল না আর। জানে টেবিলের ওপর লাইব্রেরির শেষ ইস্যু করা বইগুলো আর টেবিলের নীচে কাল রাতের এঁটো খাবারের থালাটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

বামপন্থা

১৯শে মে রাত্রিবেলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সারাদিন ধরে অনেক বিষ্টি-টিষ্টি হয়েছে। এখনও আকাশে অনেক মেঘ। আকাশে কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া তারা মিটমিট করছে নিতান্তই লজ্জা পেয়ে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর খড়ংখড়ং শব্দ। প্রথমে আস্তে, তারপর জোরে জোরে। রাত দেড়টা বাজছে। ঘরের সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায়। আবার খড়ংখড়ং। ঠংরঠংর। যান্ত্রিক শব্দ।
রান্নাঘরের সবচেয়ে নিচের তাকে প্লায়ার্স, স্ক্রুড্রাইভার আর একগাদা পেরেকওয়ালা থলিটা জোরে জোরে নড়ে উঠল।
মুখটা ফাঁক করে উঁকি দিল একটা চ্যাপটামুখো ঝুলমাখা হাতুড়ি। তারপর লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। ঠঙাৎ।
কোল্যাপসিবল গেটটা খিনখিন করে নড়ে উঠল। টলতে টলতে বেরিয়ে গেল সে।

পাকা বাড়িটার লাগোয়া গোয়ালেও একটা ঘসরঘসর আওয়াজ হচ্ছিল। ওটা অবশ্য ভালো শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু বিচালির গাদাটা হাল্কা হাল্কা নড়ছিল।
হঠাৎ কে একটা প্যানপ্যানে স্বরে বলে উঠল, ‘উফফ্ কী মশা বাপু!জ্বালাতন!’ নিজের বাঁকা শরীরটাকে ঝকরঝকর করে চুলকাতে চুলকাতে বাইরে বেরিয়ে এল একটা মরচেপড়া কাস্তে।

উঠানে এসে দেখা হল দুজনের। দুজনের মুখেই শ্রান্ত, পরিচিত হাসি। তারা জানে কোথায় যেতে হবে।
মাঠের মাঝে গিয়ে তারা উপরদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তৈরি? চলো আমরা যাই!’
উপর থেকে উত্তর এলো, ‘মনে আছে তো কী বলতে হবে?’

কাস্তে-হাতুড়ি-তারা তিনজনে মিলেই উত্তরটা দিলো,
“খেতে কিষাণ কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো তৈরি হও।”
চললো তারা। আলিমুদ্দিন ছাড়িয়ে অনেক, অনেক দূরে।

কালো কোট

গরমকালে ৪২ ডিগ্রির ঘেমো কলকাতা ছেড়ে ৫২ ডিগ্রির পুরুলিয়ায় পুড়তে যাবার ইচ্ছে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কেই আসা সম্ভব নয়।
কিন্তু পাগলাটে লোকেদের এই এক মুশকিল। যখন মনে মনে নিজেকে বলেছি করবো, তখন করতে হবেই। এই পাগলামির ঠেলাতেই নন্দন থেকে ১২ কেজি বই বউবাজারে নিয়ে এসেছি, একটানে সেন্ট্রাল থেকে শ্যামবাজার হেঁটে গেছি, সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন সারাদিন বইমেলা চক্কর দিয়েছি।

সেই পাগলামির ইতিহাসগুলোকেই মুড়েজুড়ে ব্যাগে ভরে চলে এলাম হাওড়া স্টেশন।
খুঁজে খুঁজে চলে এলাম প্ল্যাটফর্মে। টিকিট তো কাটাই ছিলো, হেলতেদুলতে খুঁজে পেলাম নিজের বগি। চেপেও বসলাম।
দরজা দিয়ে উঠে ডানদিকে প্রথম সাইড আপারটাই আমার। লোকে খিস্তি মারে, কিন্তু আমার মনে হয় একা একা ট্রেনজার্নি করার জন্য আর লোক দেখার জন্য এর থেকে ভালো সিট আর হয় না! যাই হোক। উঠে দেখি মুশমুশে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে দুজনের সুটকেশে হোঁচট খেয়ে কোনোমতে সিটের কোলে নিজেকে ফেলে দিলাম।
আলো-ফ্যানের আবির্ভাবের সাথে সাথেই এক বড়সড় সাইজের ভদ্রলোক ঢুকলেন কামরায়। গুছিয়ে বসলেন আমার পাশের সিটটায়। কামরার প্রায় প্রত্যেকের সম্ভ্রমভরা চোখ আর ভদ্রলোকের সেমি-ফর্মাল ড্রেস দেখে বুঝলাম, ইনিই। ইনিই তিনি। যাঁকে কেউ বলে কালা কাউয়া, কেউ বলে কালকূট (কালা কোট এর ভাংচুর আর কী), আবার কেউ স্নেহভরা স্বরে ডাকেন কালুয়া।
বসতে না বসতেই, প্রথম স্যাম্পেল।
— “স্যার দেখুন না এই সিটটা যদি একটু..”
— “বল্লাম তো দেখছি, লিস্টটা খুলতে দিন!
— “দেখুন আমি কিন্তু *** চ্যাটার্জিকে চিনি।”
— “দাদা, ওনার টাইটেল মুখার্জি।”
— “ওই হল, মুখার্জিদা আমার খুব ক্লোজ। নাম্বার আছে, কথা বলবেন?”
— “আরে, অদ্ভুত তো! আমি কথা বলে কী করবো? সিট করে দিচ্ছি বললাম তো! লিস্টটা তো চেক করতে দিন!”
লোকটা একটু নিরাশ হয়ে সরে গেল। বুঝলো এ বড়ো কঠিন ঠাঁই।

দ্বিতীয় কেস।
— “দাদা আমার বাচ্চাটার একটা স্লিপার টিকিট কেটে দিন না।”
— “দিচ্ছি।”
— “না দাদা বুঝলেন তো, আমি না পুলিশে আছি।”
— “তো আমি কী করবো?”
— “না বুঝলেন তো, আমি পুলিশে আছি। ফ্রিতেই যাই। আজ এই বাচ্চাটা..”
— “তাহলে ফ্রিতেই যান! আমার কাছে এসেছেন কেন?”
ইনিও চোরের মত পালালেন।

মোটা গোঁফওয়ালা সেই ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসি ঠোঁটে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কী বুঝলি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “বুঝলাম যে সবাই নিজের কনট্যাক্ট কতো বেশি—সেটা দেখাতে সবসময় মুখিয়ে থাকে! সেটা প্রয়োজনে হোক বা অপ্রয়োজনে!”
উরুর ওপর থেকে কালো কোটটাকে গুটিয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর?”
আমি বিজ্ঞের মত মুখ করে বললাম, “আর তোমাদের প্রতিদিন এইরকম স্যাম্পেল সামলাতে হয়।”

হাহাহা শব্দে গোটা কামরা জুড়ে হেসে উঠলেন তিনি। দমকে দমকে সেই হাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে ফিরে তাকালো এইদিকে।
আমার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে তিনি বললেন আস্তে আস্তে, “এতো কিছু বুঝে ফেললিরে! আর এটুকু বুঝলি না, যে সাথে একটা কালো কোট থাকলে যেকেউ এই মস্তিটুকু নিতে পারে?”
ছোট্টো করে বাঁচোখটা টিপে কাঁধে একটা চাপড় মেরে চলে গেলেন ‘কালো কোট’।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

অরাজনৈতিক

রাজনৈতিক দুটো দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার থেকে, রাজনৈতিক আর অরাজনৈতিক এই দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া সুবিধাবাদী লোকজনের কাছে সবসময়ই প্রেফারেবল।
কারণ, তাতে স্বভাবতই অরাজনৈতিক অংশটাকে শান্তিপ্রিয় হিসেবে প্রোজেক্ট করা যায়। আর রাজনৈতিক অংশটাকে ব্যাগড়াবাদী, ঝঞ্ঝাটপ্রিয় লোকেদের দল হিসেবে দেখানো যায়।

যেখানে প্রতিদিন রাজনীতি আমার নিজস্ব অধিকারগুলোকে কেটেছেঁটে দমিয়ে দিচ্ছে, নিজের ইচ্ছামতো হাত দিচ্ছে আমার শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা খাদ্যের অধিকারে, সেখানে অরাজনৈতিক হওয়া মানে সেই নোংরা রাজনীতির দল ভারি করা।
আপনি রাজনৈতিক হোন বা অরাজনৈতিক, রাজনীতি আপনাকে ছিঁড়ে খাবেই—কয়েকটা উপরের তলায় বসে থাকা লোক আপনাকে নিজের প্রয়োজনে দুমড়ে মুচড়ে নেবেই, বারবার। শুধুমাত্র, পার্থক্য এটাই, রাজনৈতিক হলে আপনি সেই নোংরামিগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পারবেন, বুঝতে পারবেন, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবেন, অন্যদের বুঝিয়ে একসঙ্গে এর প্রতিবাদ করতে পারবেন। এটুকুই পার্থক্য।

আর অরাজনৈতিকরা? তাদের মধ্যে বিশাল শক্তি লুকিয়ে আছে। তা ওই সুপ্রিম পাওয়ারটাও জানে। তাই, তাকে শান্তিপ্রিয় জীবনের লোভ আর নানারকম রঙিন খেলনার লোভ দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়, যেভাবে ছোটো বাচ্চাদের মুখে চুষিকাঠি গুঁজে দেয়।

আমি রাজনৈতিকই হবো। আপনাদের চোখে ‘বাজে বাজে কথা’ বলবো। সেসব কথার জন্য কিছু লোক অামাকে অপছন্দ করবে, গালাগালি করবে। অপ্রিয় সত্যি বলার জন্য আমার অনেক বন্ধু সরে গেছে, আরও অনেকে হয়তো যাবে। তাতে আমার কিছু করার নেই।
কাশ্মীরে গরিব লোকগুলোর মৃত্যু, কলেজের ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠি, একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা আর তার শ্রমিকদের আত্মহত্যা, চাষীদের মৃত্যু আর ভয়াবহ খরা, আইআইটিতে সংস্কৃত, দলিত মেয়ের আত্মহত্যা, সোনি সোরির ওপর অ্যাসিড অ্যাটাক, বাংলাদেশে ব্লগার খুন, উত্তরাখণ্ডে সুপরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, নির্বাচনের দুর্নীতি, মেয়েদের অধিকার আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ইন্টারনেটে চলা সেক্সিস্ট জোক, আফস্পা, শিক্ষাক্ষেত্রের নীতিতে ধনী ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপ, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপমৃত্যু, সুন্দরবনে জঙ্গল কেটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র— এরকম যতগুলো ব্যাপারে কথা বলা উচিত বলে মনে হবে, যতগুলো ব্যাপারে রেগে উঠব, যতগুলো ব্যাপারে ঘেন্না হবে, ঠিক ততগুলো ব্যাপার নিয়েই কথা বলবো।

কলেজে হোক, বা রাজ্যে, বা আমার দেশে— যাঁরা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দেগে দিয়ে চোখ বুজে শান্তিতে ঘুম দেবার কথা ভাবছেন, তাঁরা জেনে রাখুন— রাজনীতি আপনাকেও রেহাই দেয়নি, দিচ্ছে না এবং কোনোদিন দেবেও না।
হুঁশিয়ার!

শনির দশা

—কী? কী চাই? হজমি? লাগবে না লাগবে না!
— না না স্যার, হজমি নয়! এটা একটা অদ্ভুত প্রোডাক্ট। এই বড়িটা…
— না না বড়ি টড়ি লাগবে না!
— স্যার একবার শুনেই দেখুন! শুনতে তো পয়সা লাগে না।
— আমি কিনবো না। কেন ফালতু নিজের সময় নষ্ট করছ?
— স্যার, শুনে তো দেখুন! এই সাদা বড়িটা আপনার পকেটে রাখলেই আপনার আর একটুও গরম লাগবে না!
— বিক্রি করার জন্য যাই তাই একটা বলে দিলেই হলো?
— একদম ১০০% সত্যি স্যার! এই ঘাম প্যাচপেচে রোদে আপনি অফিস বেরোবেন, কিন্তু থাকবেন একদম ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল!
— জাদুমন্তর নাকি? দ্যাখো আমি যাদবপুর থেকে ফিজিক্সে এমএসসি। ওসব বুজরুকি আমাকে শোনাতে এসো না!
— আপনার বিশ্বাস না হয় তো আপনি ইউজ করে দেখুন স্যার! একদম দেশি পদ্ধতিতে তৈরি। আমার নিজের আবিষ্কার!
— ওইসব শুনছি না! এসব জোচ্চুরি না করে গায়েগতরে খেটে খাও না। নাকি পুলিশে খবর দেব?
— না না স্যার! পুলিশে খবর দেবেন না! আ-আমি চলে যাচ্ছি স্যার! কিন্তু জিনিসটা ভালো ছিল, একবার যদি পকেটে রেখে দেখতেন!
— গেট আউট! গেট আউট! ভরদুপুরে যত উল্টোপাল্টা সেলসম্যান জ্বালাতে আসে!
লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলা থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হতাশায় একবার টাকটা চুলকে নিলেন প্রৌঢ় প্রফেসর। তারপর চলতে শুরু করলেন পরের বাড়ির দিকে।

পোষা রোগা বেড়ালটা ম্যাঁও শব্দ করে থাবা দিয়ে মুখটা মুছে চলতে শুরু করল পেছন পেছন।

মে দিবস

দিনে ষোলো ঘন্টা পিঠ বেঁকে দাঁড়িয়ে কাঠচেরাই কলের মিস্ত্রি আমিনুলচাচা কাজ করে। তার ফুসফুসভরা ভবিষ্যতের ফোঁসফাঁস আর অনেকটা কাঠের গুঁড়ো।

টাটা কনসালটেন্সির শ্রীতমা এখন বিকেলের পর অফিসে থাকতে ভয় পায়। কাঁচের জানালার মধ্যে দিয়ে করিডোরের আলো-আঁধারি তাকে যেন গিলতে আসে; ঠিক যেমন সেদিন গিলতে এসেছিল একজন, অনেকটা খিদে নিয়ে।

প্রীতম’স টি স্টলের বলাইয়ের সারাদিন কাপপ্লেট ধুয়ে ধুয়ে পায়ে প্রচুর হাজা হয়েছে। হাঁটতে গেলেই ব্যথা করে। তবে সে জানে, ওই দিনে ৫০ টাকাটা না পেলে তালডাংরায় তার বোনের পেটেও ব্যথা হবে। সেটা একটু অন্যরকম।

হাড়কাটা গলির মুন্নির সেক্সি ফিগার। ডিমান্ডটাও সেরকম। কিন্তু আজ কোনো কাস্টমার নেওয়া সম্ভব নয়। কাল ওই শালা মাতাল লোকটা পেছনের ফুটোতে বোতলের মুখটা বারবার ঢুকিয়েছে। সকালবেলা গোটা প্যানটা লাল হয়ে গেছল।
তাও, রাত্রে তার ঠিকা দালালের ঠকঠক আওয়াজে আর খিস্তিতে তার ঘুম ভেঙে গেল।

যতই গরম থাকুক, সারারাত খোলা আকাশের নীচে শোয়া কী আর পোষায়! কিন্তু রাঁচির ট্যাক্সিওয়ালা প্রভীন জানে, ঘর ভাড়া করে থাকতে গেলে রেশমীর শাদিটা আরো পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তনখা বাড়ানোর কথা মালিককে বলতে গেলেই তো ইংরেজিতে গালি দেয়।

নাহয় কেরানিরই চাকরি, তা বলে কি এরকম একটা ঘুপচি দিতে হয়! আলো নেই, হাওয়া নেই। বিকেল পাঁচটায় যখন কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মাথা তোলে, চোখে কেমন ঝিলঝিল করে তপনের।

মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে ঘুমটা ভালোই হয় অসিতের। কিন্তু খাওয়াটা ঠিক পেটভরে হয় না। দিনে ৩০ টাকা মাইনের জন্য শহরে পড়ে আছে বলে কি আর খিদে পায় না? কিন্তু ১২ বছর বয়েসের সব দাবিকেই ধমক দিয়ে উড়িয়ে দেয় শঙ্করদা।

যতদিন না আমরা সবাই শ্রমিক দিবসকে যথাযথ গুরুত্ব দেব, ততদিন এরাও দিতে পারবে না। কাজের নির্দিষ্ট সময়ীমা, স্বাস্থ্যভাবনা, কাজের জায়গায় লিঙ্গবৈষম্য, সঠিক হারে মাইনে এবং আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা —এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। নিজেদের মধ্যে এবং সবার মধ্যে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকও শ্রমিক, আবার চড়চড়ে রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা সিইএসসি এর অফিসারও শ্রমিক।
মালিকপক্ষের কাছ থেকে নিজেদের দাবি কড়ায়গন্ডায় বুঝে নিতে হবে।
তাই সহ্য হয় না মে দিবস নিয়ে কোনোরকম ভাঁড়ামি বা জোকস্। সহ্য হয় না কোনোরকম লঘু আলোচনা।

ভয় লাগে, ভ্যালেন্টাইন ডের মতো কোনো একদিন পয়লা মের ভোরে উঠে দেখতে হবে পাতাজোড়া ফ্লিপকার্টের ৩০% ডিসকাউন্টের অ্যাড!