একটা বুড়ো বয়সের গল্প

 

প্রিয়া আজকাল সবসময় জ্বলেই থাকে। কড়াইয়ের তেলে পেঁয়াজ আর ফোড়নগুলো দিলেই যেমন ঝ্যাঁস্ করে ওঠে, সেরকম চিড়বিড় করে ওঠে। স্বাগতর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে প্রায় ১২ বছর আগে। লোকে বলে, বউ যতই দজ্জাল হোক, বিয়ের ১০ বছরের মধ্যে সব সহ্য হয়ে যায়। সে মুখঝামটা হোক, বা ঝাঁটার ঝাপটা।
কিন্তু এই আপদটা নতুন।
তিনটে মানুষের জীবন বেশ ফ্লুইড চলছিল। মিষ্টির রসের মত মিষ্টি, কিন্তু প্যাচপেচে না। ক্লাস ২ এর বিষাণকে রেডি করা, স্কুলে পাঠানো, স্বাগতর ভাত বেড়ে দেওয়া, তারপর ওম্ শান্তি! কোনো হ্যাপা নেই গোটা দিনটায়। মাঝে মাঝে বাবুর প্রেম চাপলে একটু আগে চলে আসতেন, একটু হুটোপুটি হত দুজনের। নির্ঝঞ্ঝাট নির্দায় জীবন কেটে যাচ্ছিল।

হঠাৎ চাপে ফেলে দিলেন স্বাগতর বাবা। মানে, পূজনীয় শ্বশুরমশাই। “শ্বশুরমশাই না হাতি! বিয়ের সময় দুহাতে দুটো পাতলা চুড়ি পরিয়ে দায় সেরে দিয়েছিল। তার আবার শ্ব-শু-র-ম-শা-ই! হেঁহ!”, এখনো সেই প্রসঙ্গ উঠলে প্রিয়া গলার ভেতরে কথাগুলো আওড়ায়। ঠোঁটে আনে না অবশ্য। বেকার বেকার মরা মানুষটার কথা বলে ভালোমানুষ বরটাকে জ্বালাবার কোনো মানে হয় না।
হ্যাঁ, ঠিক দুবছর আগে, সাহেবি কেতার ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাক নামক শৌখিন রোগটিতে টুক করে ওপারে রওনা দিলেন। আর, তাঁর ৩২ বছরের ‘চাপ’ মালতীদেবীকে স্বাগত-প্রিয়ার কাঁধে ‘ফেলে’ দিলেন। ব্যাস!
গরমের দুপুর। পুরোনো গলি। আইসক্রিমের গাড়ি। কাঠের ব্যাট। ঝমঝম বৃষ্টি। ছাদ। বাঙালি জাতটার ন্যাকা নস্টালজিয়া নামক দুঃখবিলাসের উপাদান ‘বাংলা মায়ের আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে’ লুকিয়ে আছে। সেরকমই আরেক জিনিস হল এই দাদু-ঠাকুমার প্রজাতিটা! এখন প্রিয়ার মনে একদম বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, এই ৬০-৮০ এজ গ্রুপের লোকগুলোর অ্যান্টিক ভ্যালু ছাড়া আর কোনোরকম ভ্যালু নেই!
হবে নাই বা কেন! অন্য সব বুড়ির মতো কোথায় হরিনাম করবে, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাবে, সকালে বিকালে টুকু হাঁটবে আর দুধ-খই আর দুধ-মুড়ির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে, তা না! ৭২ হতে চলল, হাই সুগারের পেশেন্ট, চোখে দেখতে পায় না বললেই চলে—তবু মোটা মোটা বই পড়া চাই! আর তেমনি স্পিড আছে বটে! দুদিনে বই শেষ করে দেয়! সপ্তায় দুবার করে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে বই পাল্টে এনে দিতে হয়। তাক লেগে যায় প্রিয়ার। পাতলা ওই ‘সুখী গৃহকোণ’টা শেষ করতেই ওর ১৫-২০ দিন লেগে যায়!

সে পড়ছে পড়ুক। যা ইচ্ছে করুক। কিন্তু হ্যাপা কী আর একটা! যখন উনি মারা গেছলেন, তখন সরল মনে মালতীদেবীকে এনে উপরের তলায় তুলেছিল ওরা। কিন্তু দিনকয়েক বাদেই বুঝতে পারল প্রিয়া, মালতীদেবীর নাকটি আর কাজ করে না। অন্তত পেচ্ছাবের ক্ষেত্রে। সুগারের পেশেন্ট, দিনে ত্রিশবার করে পেচ্ছাব করতে যায়, আর জলটুকু পর্যন্ত মনে করে দেয় না! অদ্ভুত! সারা ঘর যে গন্ধে ম-ম করে, যে গন্ধে খেতে বসার আগে দুবার ফিনাইল না দিলে বমি চলে আসে, সেই গন্ধটা ওনার নাকেও যায়না! গন্ধের কথা বললেই বলেন, “ওসব তোমার মনের ভুল বৌমা!” শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। সেটার সুরাহা করতেই অবশ্য এই মাসছয়েক আগেই নিচের তলায় নামিয়ে দিয়েছে বুড়িকে। ওখানে যা ইচ্ছে করুকগে! এখন নিচের তলাটায় নামা যায় না। কোনোমতে খাবারটা আর বইটইগুলো নামিয়ে দিয়ে পালায় প্রিয়া।
জঞ্জাল যত জীবনে! দুপুরবেলার সুখ-শান্তি সব নষ্ট হয়েছে এখন! বুড়ির ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায়। আর তেমনি খেতে পারে বটে! অ্যাতোটা ভাত, মাছ, তিনটে তরকারি, দই, চাটনি অনায়াসে সাঁটিয়ে দেয় এই বয়সেও! পেট খারাপের ভয়ে কদিন খাবার কমিয়ে দিয়েছিল প্রিয়া, তাতে স্বাগতকে একদিন ডেকে কীসব বলে টাকা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। পারে বটে!
স্বাগত বুঝেছিল ব্যাপারটা। আস্তে করে বলেছিল, “পুরোনো দিনের মানুষ। বেশি খেতে পারে। বেশি করেই দিয়ো, ভয় পেও না।” তারপর থেকে ওমনিই দেয়। চূড় করে সাজিয়ে দেয়। মরুকগে!
তো এতো খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেলে আর ল্যাদের সময় কোথায় পাওয়া সম্ভব? জাহান্নামে গেছে সব। ল্যাদ, আড্ডা, সিনেমা, সব!

বুড়ির আরেক বাতিক আছে। বুড়ি কীসের যেন অপেক্ষা করে! প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারতো না প্রিয়া, কেন একটা বুড়ো মানুষ সপ্তাহে দুতিনদিন জিজ্ঞেস করে তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা! যেখানে সারা মাসে চিঠি বলতে এলআইসির একদুটো, শেয়ারের কোম্পানির দুতিনটে চিঠি আর বিলগুলো ছাড়া আর কিছুই আসে না, সেখানে ব্যাপারটা অদ্ভুত বইকি!
প্রথমে প্রথমে ভাবতো পেনশন। তারপর একদিন জিজ্ঞেস করলো স্বাগতকে। স্বাগত প্রথমে “ওসব জেনে কী করবে, ছেড়ে দাও না” বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল, পরে চাপাচাপি করতে খুলে বলল। নাকি কলেজে মালতীদেবীদের কয়েকজন মিলে একটা প্ল্যান বানিয়েছিলেন। স্বাগতর ভাষায়, “মায়ের একখানা হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড ছিল। কি একটা নাম, ভুলে গেছি। সে আর তার বন্ধুরা মিলে একখানা প্ল্যান বানিয়েছিল, যে তারা তাদের বুড়ো বয়সে একসঙ্গে সবাই মিলে মস্তিতে থাকবে। একখানা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করবে সে। তারপর সব বন্ধুকে ডেকে নেবে বুড়ো বয়সে। সেখানে নাকি মোটেও টিপিক্যাল বুড়ো বুড়ো জিনিসপত্র হবে না। সবাই আড্ডা দেবে, পছন্দের জিনিসে মন দেবে, বই পড়বে, গান গাইবে একসাথে, সিনেমা দেখবে, ঘুরতে যাবে। শেষবয়সে সবাই মিলে ভালো থাকবে।” শুনে প্রিয়া অবাক! জিজ্ঞেস করেছিল, “আর ৪০ বছর পরে ঠিকানা পাবে কোথায়?” স্বাগত বলেছিল, “অ্যাই! এক্কেবারে! আমিও এই প্রশ্নটাই করেছিলাম মাকে। মা বলেছিল, ওই লোক নাকি সব পারে! বোঝো!”
প্রিয়া শুনে ঠোঁট উল্টেছিল। হুঁহু্! পাগলামি যত্ত! বৃদ্ধাশ্রমে হইহুল্লোড়! এই আজগুবি প্ল্যানটা মনে পড়লেই ফিক্ করে হেসে ফেলে প্রিয়া। তারপরেই ভাবে, “না বাবা। আমার বাবুটা আমাকে যত্নে রাখবে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না কক্ষনো!”

এখন তো বুড়ি নীচের তলায়। তাই বেশি কথাও হয়না। আছে নিজের মতন। এমনকি পেপারটাও আলাদা করে দিয়েছে এখন। পেপার এলেই খুঁটিয়ে পড়া অভ্যাস বুড়ির, তখন চাইতে গেলেই বিরক্ত হয়। তাই একটা আনন্দবাজার গেটের ফাঁক দিয়ে নীচের তলায়, আর একটা ছুঁড়ে উপরের তলায়। শান্তি!
হঠাৎ, একদিন রবিবার সকাল নটায় ঘুম ভাঙলো প্রিয়ার। উঠেই চমকে গেল! এতো দেরি হয়ে গেল তবু জলখাবারের তাড়া আসেনি নীচ থেকে? অবাক কান্ড তো!! তাড়াহুড়ো করে এগোতে গেল সে। পায়ে ঠেকলো দড়িবাঁধা আনন্দবাজারটা।
হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা হলুদ লিফলেট।
তাতে অবাক একটা বিজ্ঞাপন।
“দি কলেজ রকার্স”
[বঙ্গবাসী কলেজ, ১৯৬৬ ব্যাচ, ইংলিশ অনার্স। মনে পড়ে শেষদিনের আড্ডায় করা প্রমিসগুলো? আমি কিন্তু আমার প্রমিস রেখেছি। আমি, আশিস, বিবেক আর শর্মিলা এই চারজন এখন আছি। বাকিরাও চলে আয় তাড়াতাড়ি।
জমিয়ে আড্ডা হবে আবার। অনেক গল্প জমে।]
নিচে একটা অ্যাড্রেস। রাজাবাজারের। অ্যাড্রেসটা আর পড়ার চেষ্টা করলো না প্রিয়া। নিচেও গেল না আর। জানে টেবিলের ওপর লাইব্রেরির শেষ ইস্যু করা বইগুলো আর টেবিলের নীচে কাল রাতের এঁটো খাবারের থালাটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

2 thoughts on “একটা বুড়ো বয়সের গল্প

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান