একটি সাম্প্রদায়িক লেখা

দুটো ইদ। এই দুটো দিনে লোকের হেব্বি প্রেম জেগে ওঠে। হিন্দু-মুসলিম একসাথে জিলিপি খাওয়ার গল্প, একসাথে বিরিয়ানি সেমুই খাওয়ার গল্প, বাচ্চা-ধাড়ি বয়সে এক শালপাতায় প্রসাদ খাওয়ার গল্পে চারদিক ছেয়ে যায়। দেখে মনে হবে, আহা একদম হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই গো! চুম্মাচাটিই না হয়ে যায় কোনোদিন!
তারপর আবার যদি এই ইদ আর রথ পরপর দিনে পড়েছে! নে ভাই, কত গলাগলি দেখবি দেখে নে! রথের চাকা, জগন্নাথের মুখ, ইদের চাঁদ মিলিয়ে পুরো সিক্সটি-নাইন হয়ে যায়।

লোকজন সমাজে মুখ দেখাবার জন্য কত কীই না করে! ধপাধপ্ ইদ মুবারকের স্ট্যাটাস পড়ছে। অথচ জানতে চায় না এটা কোন ইদ, কেন ইদ।
সারাবছর খিস্তিই খিস্তি। দাড়ি নিয়ে খিস্তি, টুপি নিয়ে খিস্তি, পাঞ্জাবি নিয়ে খিস্তি।
ধরুন, আমার কালো জামা পছন্দ। বিগবাজার থেকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে গেলাম। ঘর যেতেই খিস্তি। সবাই মিলে ঘিরে ধরে “মুসলমানদের মত জামা কিনেছিস কেন? ছিঃ!”
ওই ‘ছিঃ’টা যদি একবার শোনেন, আপনি আস্তিক-নাস্তিক যাই হোন না কেন, গা গুলিয়ে বমি আসবে। এতোটা ঘেন্না মেশানো থাকে ওই ছিঃতে।
তারপর সাদা পাঞ্জাবি। ফতুয়াতে আপত্তি নেই। সাদা পাঞ্জাবি পরলেই “এবার একটা মুসলিম বিয়ে করে ফেল, আর কী!” বা, “সঙ্গে টুপি কিনলি না একটা?” তাও তো আমার বাড়িতে মুসলিম, মুসলাতেই আটকে থাকে। কাটার বাচ্চা, নেড়ের বাচ্চাটা ঘরে কখনো শুনতে হয়নি।
আসুন দাড়িতে। দাড়ির খাঁজে খাঁজে, পাকে পাকে ধর্ম লুকিয়ে! জানতামই না। বাবা চাপদাড়ি রাখে। বাবার দেখে দেখে আমারও ইচ্ছে, রাখবো। হেব্বি উৎসাহ নিয়ে দাড়ি জমাচ্ছি গালে। এতো বড়ো অনর্থ ঘটে গেছে বুঝতেই পারিনি! বুঝলাম ঘরে এসে মায়ের চিৎকারে। গালের থেকে গলকম্বলে বেশি দাড়ির সমাবেশ হয়েছে। সে কী চিৎকার—”দ্যাখো, মুসলমানদের মতো লম্বা লম্বা দাড়ি রেখেছে! ছিছিছিছিছি ছিঃ! এমনি দাড়িও কেউ রাখে! কাট এক্ষুনি! ষা কেটে আয় ভদ্র হয়ে!”
ঘরে বাজার থেকে যে ফল আসে, তা মুসলিমদের কাছ থেকে আসে। কেননা, মুসলিমরাই সবাই ফলওয়ালা হয়। ফলগুলো এসেই চলে যায় রান্নাঘরের সিঙ্কে। কেন?
“আরে মুসলাগুলো কী নোংরা থাকে! কী নোংরা কী নোংরা বাবা! সারাদিন ওই একটাই লুঙ্গি পরে বসে আছে! হাগতে গিয়ে ধোয়াধুয়ি নেই, একটাই কাপড়ে থাকে!”
আপনি যান দিকি আর্গুমেন্টে! সোজা বলে দেবে, “যা তুই মুসলিম বিয়ে করে আলাদা হয়ে যা! ঘরে ঢুকতে দেব না আর! আশাও করিস না!”
কবীর সুমনকে টিভিতে দেখলেও ‘টাকলা’, ‘নির্লজ্জ’বলে গাল দেয়! না না, গান শুনে নয়, পলিটিক্যাল খচড়ামি দেখেও নয়, জাস্ট হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছে বলে।
“কি সুন্দর চ্যাটার্জি ছিল! উঁচু জাত ছিল। তা না, কুকুরের মতো ভৌভৌ করতে করতে কবীর হয়ে গেল!” তার সঙ্গে অ্যাডিশনাল খিস্তি, “মুসলিমগুলো কেমন জানিস? লোককে মুসলিম করাবে, নিজেরা হিন্দু হবে না!”
কালকে গেছলাম এক দোকানে। এক ভদ্রলোক মুসলিমদেরকে নিয়ে বলতে বলতে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ছাড়া অন্যকিছু সম্বোধনই করতে পারছিলেন না। ভাবতে কেবল অবাক নয়, ঘেন্নাও করে যে সেই ভদ্রলোকই আজ ঘটা করে বলবেন ‘ইদ মুবারক’!

জানেন। আপনিও জানেন। কত পরতে কত কেজি ঘেন্না জমে আছে, খুব ভালো করে জানেন। ওই ভদ্রতা আর সামাজিকতা এই দুটো আপদের দায়ে পড়ে আপনাকেও কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখতে হয় আপনার নোংরামিগুলো। যে সাদা পাঞ্জাবির পাশ দিয়ে গেলে আতরের গন্ধে আপনার গা বেঁকে যায়, নাক কুঁচকে যায়, সেই সাদা পাঞ্জাবিকে মুখোশের খাতিরে ‘ইদ মুবারক’ বলে জড়িয়ে ধরতে যাবেন না। ওটা ভন্ডামি।
ওই পায়খানার প্যানে লেগে থাকা দাগের মতো লেগে থাকা ঘেন্নাটাকে আলাদা করে চিনতে শিখুন। সন্ত্রাসবাদের আলোয় দাঁড়িয়ে ধর্মটাকে ঘেন্না করতেই পারেন, ধর্মগ্রন্থগুলোকেও, ধর্মের নিয়মগুলোকেও, কিন্তু ধর্মের মানুষগুলোকে আগে মানুষ বলে চিনতে শিখুন।
ভালোবাসা অনেক, অনেক দূরের কথা। যতদিন না কুটকুটে চিটপিটে ঘেন্নাটাকে সরিয়ে অন্ততপক্ষে নির্লিপ্ততাটুকু আনতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত আপনার ভন্ড ইদের শুভেচ্ছার প্রতি রইল
আমার মাঝের আঙুলটা। দুটো হাতেরই।

আনন্দ-বাজার

কাল একখানা আনন্দবাজার কিনেছিলাম। কিনেছিলাম, কেননা ট্রেনের সব সিট ভর্তি ছিল। মাটিতে পেতে বসা ছাড়া আনন্দবাজার কেনার কোনো কারণ দেখি না আমি।
যাই হোক, ট্রেন ছাড়ল। আমিও বাথরুমের সামনে কাগজটা পেতে গ্যাঁট হয়ে বসলাম। সঙ্গে একখানা ‘পত্রিকা’ নামের সাপ্লিমেন্ট ছিল। চোখ পড়ল একখানা লেখায়। বসন্ত নামে শ্রীজাতর একখানা লেখা।

লেখাটা সুখপাঠ্য। অবভিয়াসলি। প্রেম, মনখারাপ আর নস্টালজিয়া মিলিয়ে তরল একখানা লেখা।
কিন্তু পাঠক হিসেবে আমাকে একটা জিনিস ভাবালো, পুরো লেখাটার মধ্যে শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার আছে, কিন্তু কোনো মানে নেই লেখাটার। মানে, কনটেন্ট বলে যে কিছু হতে পারে লেখাটার, সেটা মনেই ছিল না বোধহয় লেখকের।
এটা কী কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনাকে আমরা চামচে করে গুলে নস্টালজিয়া আর প্রেম খাইয়ে দিচ্ছি, আর আপনি সোনামুখ করে সেটা খেয়ে চলেছেন। এক প্যারাগ্রাফের সঙ্গে অন্য প্যারাগ্রাফের কোনোরকম মিল নেই। কয়েকটা মনভোলানো শব্দ পরপর বসিয়ে আপনাকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সবকিছু।
‘রোদপালানো ছেলেবেলা’ এই শব্দবন্ধটা অর্থহীন বাগাড়ম্বর, আপনাকে কেবল টুকরো টুকরো ছেঁড়া কিছু দৃশ্যপট মনে এনে দেওয়ার চেষ্টা।
লেখাটায় এটা স্পষ্ট যে, লেখকের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই, বা তিনি আপনার কোনো মনের কথাকেও তুলে ধরছেন না, কেবল ফরমায়েশে পড়ে দোকানে বসে মনখারাপ বিক্রি করে যাচ্ছেন কেজিদরে।

বুঝি না মানুষ কেন এত প্রেম আর নস্টালজিয়া খায় গান্ডেপিন্ডে? উত্তর কলকাতার গলি, ছাদ, বিকেল, বসন্ত আর প্রেমিকার চুমু দিয়ে লেখক প্রেমকে বেঁধে দিলেই আপনি গলে যাবেন?
বুঝি আপনি বাস্তব জীবনের ঠোক্করে ক্লান্ত, চলতে চলতে হোঁচট খেয়ে আপনার জুতো হাঁ হয়ে গেছে, তাই আপনি এসেছেন। জুতো সেরে দিতে হবে। কিন্তু সেটা যেন রূপকথার মেঘ দিয়ে সারতে না হয়, বাস্তবের সুতোই ভালো।

পাতার পর পাতা শব্দ লিখে ফেলে আপনার মন ভোলাতে চাই না। ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ হবে না আমার দ্বারা। আমার শহরে যখন মানুষ খেতে পাচ্ছে না, পড়তে পারছে না, পরতে পারছে না, তখন সাঁঝবেলার রূপকথা লিখে আপনার চোখ বাস্তব জীবন থেকে সরিয়ে নিতে চাইনা, তাহলে আরো হোঁচট খেতে হবে।
আরো দুঃখ দেব। আরো কষ্ট দেব। সেইসবের কথাই আপনাকে ভাবাব, যা আপনার ভাবা প্রয়োজন।

জীবন রূপকথা নয়। রূপকথা শুনে লাভ নেই।আমাদের আশায় বসে থাকবেন না। চারদিকে চোখ ফেলুন। কালিঝুলি মাখা অনেক রূপকথা ছড়িয়ে আছে।
অবশ্য, আনন্দবাজারে পাবেন না।

পুনশ্চ: শ্রীজাতর প্রতি কোনও অসূয়া নেই। এটা জয় গোস্বামী বা প্রচেত গুপ্তও হতে পারতেন। 🙂

হাঁসকাহিনী


এক যে ছিল হাসপাতাল. সে ছিল মূর্খ. সে চিকিৎসা করিত, রক্ত চুষিত না. রোগীদের রোগ নির্ণয় করিত, সারাইয়া তুলিত, জানিত না পাবলিকের পকেট কীভাবে মারিতে হয়.

রাজা বলিলেন, ‘এমন হাসপাতাল তো কাজে লাগে না, অথচ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ খাইয়া রাজহাটে পকেটমারির বাজারে লোকসান ঘটায়.’

মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘হাসপাতালটাকে পরিষেবা দাও.’


রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল হাসপাতালটাকে পরিষেবা দিবার.

বিশেষজ্ঞরা ঘন্টাখানেক বসিয়া অনেক বিচার করিলেন. প্রশ্নটা এই, উক্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানের টাকা না খাওয়ার কারণ কী.

সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য ডিপার্টমেন্টের দোতলা দিয়া হাসপাতাল যে জাল পাতে,সেই জালে বেশি পাবলিক ধরে না. তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া দশতলা সুপারস্পেশালিটি বানাইয়া দেওয়া.

বিশেষজ্ঞরা ফ্রি সাইকেল পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন.


ম্যাকিনটশ বার্ন বসিল বিশাল সুপারস্পেশালিটি বানাইতে. বিল্ডিংটা হইল এমন আশ্চর্য যে,দেখিবার জন্য দেশবিদেশের পেশেন্ট ঝুঁকিয়া পড়িল. কেহ বলে, ‘পরিষেবার একেবারে হদ্দমুদ্দ.’ কেহ বলে, ‘পরিষেবা যদি নাও হয়, সুপারস্পেশালিটি তো হইল. হাসপাতালের কী কপাল!’

ম্যাকিনটশ বার্ন সুইস ব্যাঙ্ক বোঝাই করিয়া কালো টাকা পাইল. খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল দুবাই এর দিকে.

ফোর্টিস বসিলেন হাসপাতালকে পরিষেবা শিখাইতে. হুক্কা লইয়া বলিলেন, ‘অল্প চাকচিক্যের কর্ম নয়.’

ভাগিনা তখন বেসরকারি ভড়ংবাজদের তলব করিলেন. তারা চাকচিক্যের নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল. যে দেখিল সেই বলিল, ‘সাবাস! পরিষেবা আর ধরে না!’

ভড়ংবাজের দল শিভাস রিগাল লইল অডি বোঝাই করিয়া, তখনই ফ্ল্যাটের দিকে দৌড় দিল. তাদের মদের আসরে আর টানাটানি রহিল না.

অনেক দামের সুপারস্পেশালিটিটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই. এক্সটেনশন তো লাগিয়াই আছে. তারপরে বেসমেন্ট লিফট কারপার্কিং এর ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, ‌’উন্নতি হইতেছে.’

গ্রুপ ডি লাগিল বিস্তর এবং তাদের ওপর নজর রাখিবার জন্য গ্রুপ সি লাগিল আরও বিস্তর. তারা মাস মাস মুঠা মুঠা গুটখা পাইয়া গাল বোঝাই করিল.

তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জে গদি পাতিয়া বসিল.


সংসারে অন্য অভাব অনেক অাছে, কেবল জুনিয়র ডাক্তার আছে যথেষ্ট. তারা বলিল, ‘সুপারস্পেশালিটিটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু হাসপাতালটার খবর কেহ রাখে না.’

কথাটা রাজার কানে গেল. তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি?’

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন, তবে ডাকুন অ্যাপোলোদের, ফোর্টিসদের,বিএমবিড়লাদের,ডাকুন যারা পেশেন্টের পকেট থেকে টাকা খিঁচে নেয় এবং ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের ধার ধারে না. জুনিয়র ডাক্তারগুলো পকেট কাটিতে পারে না বলিয়াই মন্দ কথা বলে.’

জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখুনি ভাগিনার গলায় প্ল্যাটিনামের পেন্ডেন্ট চড়িল.


পরিষেবা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন.

একদিন তাই গোয়েঙ্কা টাটা নেওটিয়া লইয়া তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন.

দুকোটির গেটের কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘন্টা এবিপি আনন্দ কাড়া নাকাড়া সাইরেন সিটি দামামা বন্দেমাতরম করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প. অ্যাপোলো ফোর্টিসেরা অ্যাপ্রন পরিয়া, স্টেথো নাড়িয়া প্রেসক্রিপশন পাঠে লাগিলেন. তপন,তাপস,মির্নল,দেবশঙ্কু,দমন আর টাকাতুতো চেয়ারতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল.

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, কান্ডটা দেখিতেছেন?’

মহারাজ বলিলেন, ‘আশ্চর্য! ক্যেত কম নয়!’

ভাগিনা বলিল, ‘শুধু ক্যেত নয়, পেছনে গাপ হয়ে যাওয়া টাকাও কম নাই.

রাজা খুশি হইয়া গেট পার হইয়া যেই লিমুজিনে চড়বেন এমন সময়, জুনিয়র ডাক্তার ছিল এমার্জেন্সির মধ্যে গাঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, ‘ মহারাজ, হাসপাতালটাকে দেখিয়াছেন কি?’

রাজার চমক লাগিল, বলিলেন, ‘ঐ যা! মনে তো ছিল না. হাসপাতালটাকে দেখা হয় নাই.’

ফিরিয়া আসিয়া নারায়ণা কে বলিলেন , ‘হাসপাতালটাকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই.’

দেখা হইল. দেখিয়া বড়ো খুশি. জাঁকজমকটা হাসপাতালের চেয়ে এতো বেশি,যে হাসপাতালটাকে না দেখিলেও চলে. রাজা বুঝিলেন,আয়োজনের ত্রুটি নাই. সুপারস্পেশালিটিতে ডাক্তার নাই, পরিকাঠামো নাই, কেবল রাশি রাশি অ্যাকাউন্ট হইতে রাশি রাশি গান্ধীপাতা ছিঁড়িয়া ফরসেপের ডগা দিয়া হাসপাতালের মুখে ঠাসা হইতেছে. মানবিক চিকিৎসা তো বন্ধই, প্রতিবাদ করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা. দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়.

এবার রাজা লিমুজিন চড়ার সময় বাজারি মিডিয়াকে বলিয়া দিলেন, জুনিয়র ডাক্তারের ইজ্জতের যেন আচ্ছা করিয়া ফালুদা করা হয়.


হাসপাতালটা দিনে দিনে বেসরকারি দস্তুরমত চামার হইয়া উঠিল. সরকার বুঝিল, বেশ আশাজনক. তবু স্বভাবদোষে সুস্থ ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের দিকে হাসপাতাল চায় আর অন্যায় রকমে জনদরদী চিকিৎসা করে. এমন কি, একদিন দেখা যায়, সে তার দৃঢ় মনোবল দিয়া সরকারী চক্রান্তের বিরোধিতার চেষ্টায় আছে.

স্বাস্থ্য দফতর বলিলেন, ‘এ কী বেয়াদবি!’

তখন হাসপাতাল চত্বরে সাসপেনশন বদলি বরখাস্ত লইয়া মির্নল আসিয়া হাজির. কী দুমাদ্দুম পিটানি! হৃদয়হীনতার শিকল তৈরি হইল, হাসপাতালের স‌ৎ মানসিকতাও গেল কাটা.

রাজার পাচাটারা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘এ রাজ্যে হাসপাতালদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয়, কৃতজ্ঞতাও নাই.’

তখন বেসরকারি ভড়ংবাজেরা একহাতে ব্যানার, একহাতে পেশাদারিত্ব লইয়া এমনি কান্ড করিল যাকে বলে পরিষেবা.

মির্নলের পসার বাড়িয়া মির্নলগিন্নির গায়ে ডিজাইনার শাড়ি চড়িল এবং স্বাস্থ্য দফতরের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে বঙ্গবিভূষণ উপাধি দিলেন.


হাসপাতালটা মরিল. কোনকালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই. জুনিয়র ডাক্তার লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘হাসপাতাল মরিয়াছে.’

ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি!’

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, হাসপাতালটার বেসরকারিকরণ পুরা হইয়াছে.’

রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর মন দিয়ে চিকিৎসা করে?’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
-‘আর কি রোগীর কথা ভাবে?’
-‘না.’
-‘আর কি রোগীর সঙ্গে মানবিক আচরণ করে?’
-‘না.’
-‘সম্মান না পাইলে আর কি চেঁচায়?’
-‘না.’

রাজা বলিলেন, ‘একবার হাসপাতালটাকে আনো তো, দেখি.’

হাসপাতাল আসিল. সঙ্গে মির্নল আসিল, মিডিয়া আসিল, ভড়ংবাজেরা আসিল. রাজা হাসপাতালকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না.
কেবল তার পেটের মধ্যে গান্ধীর শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল.

বাহিরে নবপরিবর্তনের দক্ষিণ হাওয়ায় অভিষেক ঝাগুলি কিডনি ফেলিওরের বেদনায় আরজি করের আকাশ আকুল করিয়া দিল.

বি়.দ্র. সব চরিত্র কাল্পনিক. বাস্তবের সঙ্গে মিল নিতান্তই কাকতালীয়.

সও-গাঁট

ভ্যালেন্টাইন পরব কাছে। বাজার নানা ন্যাকামিতে ভরা। কত লাল বেলুন, কত তুলোফুলো টেডি; আর ফ্লিপকার্ট ভরা অফার, ফোন ভরে সেলফি।

প্রেমিকা গিফট পাঠাচ্ছে।

এক জানু দুচাকা তুলে বাইক চালায়; এক সোনামোনা ‘স্টাড’, ক্যেত ছাড়া সিগারেট ধরায় না; আর-কয়টি ডার্লিং ত্রিকোণ প্রেমে ঝগড়া করে পৃথক পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে; ক্রাশেরা আছে ফেসবুকের মেসেজে আর ওয়ালপোস্টে ছড়িয়ে।

সহজসরল বন্ধুত্ব সঞ্জীবের বইয়ের পাতায় দাঁড়িয়ে সারা দিন ধরে দেখছে, ভারে ভারে গিফট চলেছে, সারে সারে রেস্টুরেন্ট-মল, প্যাকেজগুলি রঙবেরঙের ডিসকাউন্টে ঢাকা।

হ্যাংলামি ফুরোলো। গিফট সব চলে গেল। দিনের শেষপাকামির ঢলাঢলির ডালি নিয়ে ল’রিয়ালের শেষ আভা শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পথে নিরুদ্দেশ হল।

বন্ধুত্ব পঞ্চমের গানে ফিরে এসে প্রেমিকাকে বললে, “বন্ধু, সবাইকে তুই গিফট দিলি, কেবল আমাকে না।”

প্রেমিকা বন্ধুতে পরিণত হয়ে হেসে বলল, “সবাইকে সব ভন্ডামি দেওয়া হয়ে গেছে, এখন তোর জন্য কী বাকি রইল এই দেখ্।”

এই বলে তার পরশুরাম রচনাবলীতে চুম্বন করল।

বন্ধুত্ব কাঁদোকাঁদো সুরে বললে, “গিফট পাবো না?“

“যখন ভড়ংবাজিতে পরিণত হবি তখন গিফট পাবি।”

“আর যখন আন্তরিকতায় মুড়ে তোর কোলের পাশে থাকি তখন তোর হাতের জিনিস দিবি নে?“

বান্ধবী তার দুহাত ধরে সঞ্জীবের একই পাতায় চলে এলো; বলল, “এই তো আমার হাতের জিনিস।”