রোদফাটা, রাস্তাপোড়া গরম। কলকাতা সেদিন ৪০ ডিগ্রিতে লাফাচ্ছে।
সেই ভয়ঙ্কর কালদুপুরে কিনা অনিকেত বাবু হেলেদুলে বড়রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন!
হেঁহেঁ, কত্তা। ফিকশন মনে হচ্ছে?
কিন্তু তিনদিন ল্যাদ খেয়ে ৬টার থেকে ২ ৩০টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কলেজ না যাওয়ার পর কতকেজি গিল্টি ফিলিং হয়, তা আর আপনারা কী জানবেন?
সেই গিল্টি ফিলিং থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে চলেছি ১২টার ক্লাস করতে। রাস্তায় লোমওঠা নেড়িকুকুর আর গোঁফওঠা ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া কোনো প্রাণের সাড়া নেই।
আমি চলেছি। সুপ্রিয়াতে পেটপুরে খেয়ে ফেলেছি। তারপর আবার ক্লাস যাচ্ছি। সেই বীরত্বে নিজেই নিজের উপর হেব্বি হ্যাল খেয়ে ব্যাগ কাঁধে বড় বড় পায়ে কলেজপাড়া মাড়িয়ে যাচ্ছি।
মনের আনন্দ, আবার ফাঁকা রাস্তা—টুক করে আমার ১০৭.৩ গলা এফএমটা খুলে দিলাম। ভ্যাড়াকন্ঠে ওই সময়ের আদর্শ গানটা গাইতে গাইতে চললাম।
হঠাৎ পেছনে শুনি ঘড়ঘড় শব্দ। প্রথমে ভাবলাম এই ক্যারক্যারানিতে কারো ঘুম বোধহয় ভেঙে গেছে আর সে হাতের সামনে যা পেয়েছে, তাই তুলে মারতে আসছে। সামনেই কলেজ, মার খেলে ছুট্টে এমার্জেন্সিতে ঢুকে শুয়ে পড়ব—এই ভরসাতেই এফএমটা মিউট করে আড়চোখে তাকালাম।
হ্যাঁহ্, দেখি একটা দাড়িওয়ালা লুঙ্গিপরা আইসক্রিম বুড়ো! চোখে একখানা গান্ধীচশমা লাগিয়ে মাদার ডেয়াারির লাল আইসক্রিম গাড়ি চালিয়ে আসছে।
আমি সাহস পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার অন্তরাটা (যেন কত্তো বুঝি কোনটা অন্তরা!) ধরতে যাব, হঠাৎ আইসক্রিমদাদু মুখ খুললো।
ওই হাফ-সাইকেল-হাফ-ভ্যানের সিট থেকে নামল। মাথার লাল টুপিটা খুলে আমার দিকে ছোটো ছোটো চোখ মেলে তাকালো, তারপর বলল, “দাদাভাই, তোমার গানটা আমারে শোনাবে?”
আমি হাঁ। মুখে একখানা তিন মিমি ব্যাসার্ধের গোল্লা নিয়ে আমি খাঁটি ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, “মানে? আমি?এই গানটা?কেন?”
মাঝখানে একটুও ফাঁক না দিয়ে চারটে প্রশ্ন আমার মুখ দিয়ে গড়িয়ে গেল।
ও কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “ভাল লাগল গানটা। আমিও একসময় গান শিখেছিলাম দাদাভাই। এখন কতদিন গান শুনি নাই। শুনাবে?”
আমি বাধ্য হয়ে আরেকবার গানটা ধরলাম শুরু থেকে। তখন মেডিক্যাল কলেজের তিন নম্বর গেটের সামনে প্রায় পৌঁছে গেছি। ওখানে একটা ভিড় সবসময়ই গুজুরগুজুর করে।
লজ্জা লজ্জা মুখে ভলিউমটা দুঘর কমিয়ে গানটা গেয়ে দিলাম বেশ একটু। লোকটা আমার দিকে পুরো সময়টা তাকিয়ে চোখ পিটপিট করছিল। আর মাথার জুলফি থেকে ঘাম পড়ে লাল ইউনিফর্মটাকে কালো করে দিচ্ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
গান শেষ হয়ে গেল। লোকটা সাইকেলে আবার চেপে বসল। বলল, “যাও দাদাবাবু, পড়বে যাও। আল্লা তোমার মঙ্গল করুন।” এই বলে প্যাডেল চালিয়ে চলে গেল সামনের দিকে।
তারপর তিনঘন্টা ধরে ঘেমেঘুমে ক্লাস-প্র্যাক্টিকাল সব করলাম। কয়েকজনকে এই ঘটনাটাও বললাম। লোকজন হাসাহাসি করল বেশ খানিকক্ষণ।
ফেরার পথে আবার সেই তিন নম্বর গেট। গায়ে চুপচুপে ভেজা জামা, বাঁহাতে নোংরা অ্যাপ্রন আর ডান হাতে তিনটে পেয়ারা সাদা প্লাস্টিকে।
হঠাৎ দেখি, সেই আইসক্রিম দাদু বসে আছে রাস্তার ধারে একটা কলের পাশে। তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা পুঁচকে রাস্তার ছেলে। দুজনেই খালিগায়ে। পাশে আইসক্রিম গাড়িটা একা একা দাঁড়িয়ে। গামছাটা রাখা তার হ্যান্ডেলে।
ব্যাগ কাঁধে পেরিয়ে যেতে যেতে কানে ভেসে এল, দাদু তার ভাঙা গলায় একহাতে বিড়ি নিয়ে কোলে হেলান দেওয়া ছেলেটাকে শোনাচ্ছে,
“শহরের উষ্ণতম দিনে পিচগলা রোদ্দুরে,
বৃষ্টির বিশ্বাস…”