বৃষ্টির বিশ্বাস

রোদফাটা, রাস্তাপোড়া গরম। কলকাতা সেদিন ৪০ ডিগ্রিতে লাফাচ্ছে।
সেই ভয়ঙ্কর কালদুপুরে কিনা অনিকেত বাবু হেলেদুলে বড়রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন!
হেঁহেঁ, কত্তা। ফিকশন মনে হচ্ছে?
কিন্তু তিনদিন ল্যাদ খেয়ে ৬টার থেকে ২ ৩০টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কলেজ না যাওয়ার পর কতকেজি গিল্টি ফিলিং হয়, তা আর আপনারা কী জানবেন?

সেই গিল্টি ফিলিং থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে চলেছি ১২টার ক্লাস করতে। রাস্তায় লোমওঠা নেড়িকুকুর আর গোঁফওঠা ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া কোনো প্রাণের সাড়া নেই।
আমি চলেছি। সুপ্রিয়াতে পেটপুরে খেয়ে ফেলেছি। তারপর আবার ক্লাস যাচ্ছি। সেই বীরত্বে নিজেই নিজের উপর হেব্বি হ্যাল খেয়ে ব্যাগ কাঁধে বড় বড় পায়ে কলেজপাড়া মাড়িয়ে যাচ্ছি।
মনের আনন্দ, আবার ফাঁকা রাস্তা—টুক করে আমার ১০৭.৩ গলা এফএমটা খুলে দিলাম। ভ্যাড়াকন্ঠে ওই সময়ের আদর্শ গানটা গাইতে গাইতে চললাম।
হঠাৎ পেছনে শুনি ঘড়ঘড় শব্দ। প্রথমে ভাবলাম এই ক্যারক্যারানিতে কারো ঘুম বোধহয় ভেঙে গেছে আর সে হাতের সামনে যা পেয়েছে, তাই তুলে মারতে আসছে। সামনেই কলেজ, মার খেলে ছুট্টে এমার্জেন্সিতে ঢুকে শুয়ে পড়ব—এই ভরসাতেই এফএমটা মিউট করে আড়চোখে তাকালাম।
হ্যাঁহ্, দেখি একটা দাড়িওয়ালা লুঙ্গিপরা আইসক্রিম বুড়ো! চোখে একখানা গান্ধীচশমা লাগিয়ে মাদার ডেয়াারির লাল আইসক্রিম গাড়ি চালিয়ে আসছে।
আমি সাহস পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার অন্তরাটা (যেন কত্তো বুঝি কোনটা অন্তরা!) ধরতে যাব, হঠাৎ আইসক্রিমদাদু মুখ খুললো।

ওই হাফ-সাইকেল-হাফ-ভ্যানের সিট থেকে নামল। মাথার লাল টুপিটা খুলে আমার দিকে ছোটো ছোটো চোখ মেলে তাকালো, তারপর বলল, “দাদাভাই, তোমার গানটা আমারে শোনাবে?”
আমি হাঁ। মুখে একখানা তিন মিমি ব্যাসার্ধের গোল্লা নিয়ে আমি খাঁটি ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, “মানে? আমি?এই গানটা?কেন?”
মাঝখানে একটুও ফাঁক না দিয়ে চারটে প্রশ্ন আমার মুখ দিয়ে গড়িয়ে গেল।
ও কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “ভাল লাগল গানটা। আমিও একসময় গান শিখেছিলাম দাদাভাই। এখন কতদিন গান শুনি নাই। শুনাবে?”

আমি বাধ্য হয়ে আরেকবার গানটা ধরলাম শুরু থেকে। তখন মেডিক্যাল কলেজের তিন নম্বর গেটের সামনে প্রায় পৌঁছে গেছি। ওখানে একটা ভিড় সবসময়ই গুজুরগুজুর করে।
লজ্জা লজ্জা মুখে ভলিউমটা দুঘর কমিয়ে গানটা গেয়ে দিলাম বেশ একটু। লোকটা আমার দিকে পুরো সময়টা তাকিয়ে চোখ পিটপিট করছিল। আর মাথার জুলফি থেকে ঘাম পড়ে লাল ইউনিফর্মটাকে কালো করে দিচ্ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
গান শেষ হয়ে গেল। লোকটা সাইকেলে আবার চেপে বসল। বলল, “যাও দাদাবাবু, পড়বে যাও। আল্লা তোমার মঙ্গল করুন।” এই বলে প্যাডেল চালিয়ে চলে গেল সামনের দিকে।

তারপর তিনঘন্টা ধরে ঘেমেঘুমে ক্লাস-প্র্যাক্টিকাল সব করলাম। কয়েকজনকে এই ঘটনাটাও বললাম। লোকজন হাসাহাসি করল বেশ খানিকক্ষণ।
ফেরার পথে আবার সেই তিন নম্বর গেট। গায়ে চুপচুপে ভেজা জামা, বাঁহাতে নোংরা অ্যাপ্রন আর ডান হাতে তিনটে পেয়ারা সাদা প্লাস্টিকে।

হঠাৎ দেখি, সেই আইসক্রিম দাদু বসে আছে রাস্তার ধারে একটা কলের পাশে। তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা পুঁচকে রাস্তার ছেলে। দুজনেই খালিগায়ে। পাশে আইসক্রিম গাড়িটা একা একা দাঁড়িয়ে। গামছাটা রাখা তার হ্যান্ডেলে।
ব্যাগ কাঁধে পেরিয়ে যেতে যেতে কানে ভেসে এল, দাদু তার ভাঙা গলায় একহাতে বিড়ি নিয়ে কোলে হেলান দেওয়া ছেলেটাকে শোনাচ্ছে,
“শহরের উষ্ণতম দিনে পিচগলা রোদ্দুরে,
বৃষ্টির বিশ্বাস…”

দ্যাটস্ নট ক্রিকেট

মাঠের অর্ধেকটা প্যাচপেচে গরমকাল, বাকি অর্ধেকটা মাটিফাটা গরমকাল। 

হিউমিডিটি এন্ড থেকে লম্বা রানআপ নিয়ে ছুটে আসছেন কলকাতা চ্যাটার্জি।
উইকেটের সামনে মুখে গামছা জড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়া মাহাতো।

প্রথম বল। আঙুল-টাঙুল বেঁকিয়ে কায়দা করে বলটা ছাড়লেন। বোঁদে।
ঠকাং। কড়া একটা পুল। বল দড়ির ওপারে।
পা ঘষতে ঘষতে ফিরে গেলেন কলকাতা চ্যাটার্জি। হঠাৎ মনের মধ্যে চমক খেলে গেল। এই বলটা তো করা যেতেই পারে।
মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে ছোট্টো রানআপ নিয়ে তিনি বলটা করে ফেললেন।
হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছিল। আলুপোস্ত লেংথে পড়ে গেল। তার সঙ্গে আবার নো বল। অতি উত্তেজনায় পাটা বাইরে পড়ে গেছিল আর কি!
স্টেপআউট। এবং ভটাশ্ করে একটা জায়ান্ট ছক্কা। বলটা জায়ান্ট স্ক্রিনের ওপর দিয়ে কোথায় উড়ে গেল, কেউ দেখতেও পেল না।
পুরুলিয়া মাহাতো আস্তে আস্তে হেলমেটটা খুললেন, নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যভরা ‘সিঁক’ আওয়াজ করলেন, একবার কলকাতার দিকে আড়চোখে তাকালেন। তারপর এগিয়ে এসে ক্রিজে ব্যাটটা ঠুকঠুক করে দুবার ঠুকলেন। প্রতীকী।

অ্যাতো অপমান! ওই পুঁচকে পুরুলিয়ার এতো স্পর্ধা! আর সইতে পারলেন না তিনি।
শক্ত করে মুঠোর মধ্যে বলটাকে চেপে ধরলেন। এবার হয় এসপার নয় ওসপার!
রানআপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বলটার গায়ে বুড়ো আঙুলের নখটা দিয়ে গভীর একটা দাগ কেটে দিলেন। এই ট্যাম্পারিংটা কাজে লাগবেই, এটুকু নিশ্চিত।

বল করলেন। ঠান্ডা একভাঁড় রাবড়ির লেংথে পড়ে আসছিল বলটা। হঠাৎ হাওয়ার মধ্যে একটা বনেদী বাড়ির ফাঁকা ছাদের দক্ষিণী হাওয়ার বাঁক খেয়ে গেল।
বিষাক্ত ছোবল। মাঝখানের স্টাম্পটা মাটির থেকে আলগা হয়ে গেল নিমেষে।

ক্লিন বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে যেতে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করলেন পুরুলিয়া মাহাতো, “ইটা কিরিকেট লয় বাপ। ইটা লয়।”

©জন্মজ্যাঠা অনিকেত

বেসিক

বেসিক এডুকেশন কেবল বইয়ের পাতায় আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য নয়, কীভাবে শিল্পপতিের লোভে সেই জীববৈচিত্র্য প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাও জানানো।

বেসিক এডুকেশন শুধুমাত্র আন্টার্কটিকার পেঙ্গুইন আর খনিজদ্রব্য নয়, কীভাবে পৃথিবীর পাপের বোঝা মেরুভালুকদের বইতে হচ্ছে, তার কথাও।

বেসিক এডুকেশন কেবল তিনপাতা ধরে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আর একপাতায় পুংজননতন্ত্র নয়, তার সঙ্গে যৌনচেতনা, নিরাপদ যৌনতা এবং হস্তমৈথুন সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিও।

বেসিক এডুকেশন মানে দ্বিবীজপত্রী ফলের নাম মুখস্থ করা হতে পারে, তবে ফুলকপি মাটির ওপরে হয় না নীচে, এটাও জানা দরকার।

বেসিক এডুকেশনে চড়ুইপাখির বিজ্ঞানসম্মত নাম মুখস্থ করা খুব প্রয়োজন, তার থেকেও প্রয়োজন জানা কেন চড়ুইদের আর দেখা যায় না ঘুলঘুলিতে।

বেসিক এডুকেশন কেবল মিথ্যে দেশপ্রেমে ভরা ইতিহাসের বই নয়, বরং রাজনীতির কোন নোংরা গলিঘুঁজি পেরিয়ে স্বাধীনতা এসেছে, তার আভাস।

বেসিক এডুকেশন মানে বইয়ের পাতায় ফরসা লোককে বিউটিফুল আর কালো লোককে আগলি বলে দাগিয়ে দেওয়া নয়, বরং তৃতীয় লিঙ্গের অচেনা মানুষদেরও চিনিয়ে দেওয়া।

বেসিক এডুকেশন বলতে ওব্ নদীর গতিপথ হতেই পারে, কিন্তু পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলে কীভাবে স্টিচ দিতে হয়, সেটাও জানা উচিত।

বেসিক এডুকেশনে পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কোথায় কী কী কারখানা আছে তা জানতেই হবে, কিন্তু কীভাবে সেগুলো একে একে শ্রমিক অসন্তোষের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার কারণটাই বা কী, সেটা জানাও জরুরি।

বেসিক এডুকেশনে নোটভিত্তিক বাংলা-ইংরেজি পড়ে পাস করতেই হবে, কিন্তু নিজে ভাবনা-চিন্তা করে সেটা প্রকাশ করারও প্রয়োজনীয়তা আছে।

বেসিক এডুকেশনে তিন-চার বছরের সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদের ইতিহাস পড়তে তো হবেই, তার সঙ্গে সাম্যবাদ আর সমাজবাদ নামগুলোও বইয়ের পাতায় উঠে আসা উচিত।

শেষের ‘বেসিক’ এডুকেশনগুলো রাষ্ট্র কখনোই দেবে না। তাই, এগুলো স্কুলের থেকে কেনা যাবে, এমন আশা ভুলেও করবেন না! অন্তত যতদিন শিক্ষার নিয়মনীতি ঠিক করছে পুঁজিপতির দল।
তাই, হয় এসব শিক্ষার ব্যবস্থা নিজে করুন, নইলে আসু়ন, টেস্টপেপারে মুখ গুঁজে থাকি।

অচেনা বিপ্লব

ধরুন আপনি একজন মাস্টার বা ডাক্তার বা উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার বা কেরানি বা ব্যাঙ্ক । যে কেউ। আপনি আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “বলো তো বাবু আমি কী করি?” আমি মুখ ভেংচিয়ে বললাম, “তুমি? তুমি সকালবেলা উঠে হাই তোলো, পিঠ চুলকাও, তারপর বৌয়ের তাড়া খেয়ে বাজার যাও, বাসে ঝুলতে ঝুলতে ঘেমে কালো ব্যাগ ঝুলিয়ে কোথায় একটা যাও, আর সন্ধ্যেবেলা হাক্লান্ত হয়ে ফিরে বাচ্চাদের পেটাও আর বউকে ধমকাও!”
কেমন লাগবে?
ঠিক সেরকমই ওদেরও মনে হয়। ওরাও প্রতিদিন এইরকম প্রশ্নচোখ সইতে সইতে ভাবে, ‘কেন? এরা বুঝছে না কেন? কেমন করে বোঝাই, আমি যেটা করছি সেটা করা প্রয়োজনীয়।’
আপনি যখন বিপ্লব মানে বলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ। যখন বিপ্লব বলতে বোঝেন একটা মিছিল। কিছু স্লোগান। আপনার যখন মনে হয়, বিপ্লব মানেই কিছু লম্বা চওড়া কথা আর কাঠবেকারদের স্বপ্নবিলাস, তখন তারাও অবাক হয়।
যখন রাস্তার মোড়ে তারা বসে পড়ে একের পর এক সাদা কাগজে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বড় বড় করে লিখতে থাকে, তখন তারাও আশায় থাকে— এই বুঝি কেউ বুঝতে পারলো তাদের কথা।
আপনি বিকেলবেলা বাসের জানালায় স্লোগানরত পায়ের ভিড় দেখে বিপ্লব বলে যেসব জিনিসকে চিহ্নিত করেন, বিপ্লব ঠিক সেই জিনিসগুলোই নয়।

দেখবেন ‘বিপ্লবী’দের সংসার? আসুন তবে।
দেখুন ওই ঘাসে গোল করে ঘিরে একদঙ্গল তরুণ-তরুণী বসে আছে। ওদের কথাবার্তায় কান পাতুন তো! কিছু একটা নিয়ে তর্ক হচ্ছে। কী নিয়ে? কিছু কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ শোনা যাচ্ছে — শিক্ষা, গ্যাটস্ চুক্তি, WTO, বেসরকারিকরণ।
হ্যাঁ, ওরা কথা বলছে সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে এবং তার ওপর বাজারি হাতের মুঠো শক্ত হচ্ছে, তাই নিয়ে। ভালো করে কান পাতলে অনেক লেখকের উদ্ধৃতি শুনতে পাবেন। শুনবেন অনেক ডকুমেন্টের কথা।
পাবেন। কারণ আমার আপনার মত এরা কেবল আনন্দবাজার পড়ে না। বিভিন্ন বই পড়ে, নানাদিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পুরো হাতিটাকেই দেখে। শুধু শুঁড়টা নয়।

ওই দেখুন, আরেক দল। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মিলে। আসুন কাছে যাই। এরা কথা বলছে কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীরে কেন সাধারণ মানুষ বারবার মারা যাচ্ছে, বারবার ছোটো বাচ্চাদের গালে এসে বাগছে উড়ন্ত বুলেট, কেন নালার পাশে মেয়েদের ছেঁড়াখোঁড়া লাশ পাওয়া যাচ্ছে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। একজন হঠাৎ বলে বসলো, ইন্ডিয়ান আর্মিই দোষী! যেমন আপনি বিশুর চায়ের দোকানে টেবিল চাপড়ে বলে ওঠেন। কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলো একেবারে অন্যরকম হলো এখানে। বাকি সবাই তাকে একের পর এক যুক্তি দিলো, নানা বইয়ের নাম বলল আর একজন তাকে একখানা ডকুমেন্টারি পাঠিয়ে দিল ফোনে। বললো, ‘দেখিস। ভালো করে জেনে বুঝে ভাবিস, কার দোষ? গরীব পরিবারের চাকরির খোঁজে আসা ছেলেগুলোর, নাকি সরকারের বিদেশনীতি আর রাজনৈতিক অক্ষমতার?’ তা কিছুদিন পরে, তারা সবাই মিলে একখানা ঘরোয়া মিটিঙে বসলো। সেখানে কয়েকজন কয়েকটা বই দেওয়ানেওয়া করলো, একজন ডকুমেন্টারিটা চেয়ে নিয়ে গেলো আর হান্দোয়ারার ঘটনাটা নিয়ে আবার কিছু কথা হলো।

ওই দেখুন। ওরা কয়েকজন চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলছে। আপনি জানেন চা বাগানের শ্রমিকদের কথা? জানেন না, তাই তো? কারণ আনন্দবাজারে এই খবরগুলো বেরোয়ই না! বেরোবেও না। তাই আপনি জানবেন না, কিভাবে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর মানুষগুলো অনাহারে মারা যাচ্ছে। কীভাবে তারা মেঠো ইঁদুর আর গাছের পাতা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। খবরের চ্যানেলের বুম আর মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টারের আড়ালেই ওরা মারা গেছে। যাচ্ছে।
কিছুদিন পরে এই গার্গী, মৃন্ময়, শ্রীতমা, শুভঙ্কর, অম্লানদেরকেই দেখা গেল শিয়ালদার এক পোড়ো বিকেলে লোকজনের কাছে চা বাগানের অবস্থা জানিয়ে সাহায্যের জন্য টাকা চাইতে। তারাই কিছুদিন পরে মেডিক্যাল কলেজের কিছু বন্ধুকে নিয়ে যৎসামান্য চেষ্টায় কিছু ত্রিপল আর শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে ট্রেনে চেপে গেছিল উপরের দিকে।
অবভিয়াসলি, আপনি এসব দেখেননি। আপনার অনেক কাজ। এদের তো পড়াশোনাও নেই, কাজকম্মোটুকুও নেই।

আরে! ওই দেখুন! ওই ‘বিপ্লবী’ ছেলেটা ইউনিভার্সিটি টপারের পদক নিচ্ছে মঞ্চে উঠে। এবার এই দেখুন, ওই চশমাপরা মেয়েটার এই পেপারটা এই সেদিনই পাবলিশ হয়েছে। আর সেই যে ছেলেটা হেল্থক্যাম্পে বসে বসে ব্লাড প্রেশার মাপছিল, সে অর্থোপেডিকসে এমএস পেয়েছে ভারতের তিননম্বর মেডিক্যাল কলেজে।

ভুল বুঝবেন না মশাই। আমরা এতোটাও খারাপ নই। ভুলভ্রান্তি আপনারও হয়, আমাদেরও হয়। কিন্তু আমাদের কম বয়স, গরম রক্ত আর মুঠো করা হাত দেখেই বাতিলের দলে ফেলে দেবেন না। আমরা এই সমাজকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখি। যেমন হোককলরব। যেমন বর্ধমান। যেমন জেএনইউ। যেমন হায়দ্রাবাদ। যেমন এনআইটি শ্রীনগর। আপনাকেও চাই পাশে। বাসের জানালা থেকে, পাশের ফুটপাথ থেকে, প্রাইভেট কারের স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বড় বড় তাচ্ছিল্যমাখা চোখে নয়, চাই আপনাকে তর্কে-আলোচনায়-কথাবার্তায়। আসুন না, একসঙ্গে মিলেই দানি সেই প্রয়োজনীয় ঘটনাগুলো, যেগুলো রাষ্ট্র আমার-আপনার চোখের কাছে নিষিদ্ধ বলে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে।
আসুন, আওয়াজ তুলি। কথা বলি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রচলিত পচাগলা সমাজের উল্টোদিকে।
আসুন, কথা বলি কেন মেয়েরা এখনো সুরক্ষিত নয়। কেন সেক্সিস্ট জোক চলবে ইন্টারনেটে। কেন পাঞ্জাবিদের পাঁইয়া বলাটা ভালো নয়। আসুন জানি। কাশ্মীর নিয়ে। সেনা নিয়ে। সোনি সোরি নিয়ে। কোরান নিয়ে। জামাত নিয়ে। আরএসএস নিয়ে।
ভয় পাবেন না। সাহস আমরা ধার দেব। পরিবর্তে চেয়ে নেব আপনার, আপনাদের অভিজ্ঞতা।

এসো, কমরেড। 🙂

এসো বসো আহারে

— চল আজ যা চাস্ তাই খাওয়াবো!
— যা চাইবো, তাই?
— ইয়ো ব্রো! হোয়াটেভার ইউ উইশ!
— তবে আমি স্টার্টার গিসেবে ম্যামথের হাড়ের মটমটি, মেইন ডিশ হিসেবে ইউনিকর্নের শিংয়ের ঝাল আর আরশোলার রেজালা, আর ডেসার্টে পেঙ্গুইনের পেচ্ছাবের স্মুদি খাবো!
— পকেটে হাত দে। টিকিটটা পেয়ে যাবি। হাওড়া পৌঁছে দিয়ে আসবো?
— আচ্ছা। নো জোক। নো মজাক। কিন্তু আমার ড্রিম ডিশ তো তুই খাওয়াতে পারবি না ভাই!
— কেন ভাই? কলকাতায় না পাওয়া গেলে অবশ্য কিস্যু করার নেই!
—আরে না না। পাওয়া যায়। কিন্তু আমি পাবো না। কী বল তো?
— কী? ল্যাম্ব? ফুড স্টেশনেই পেয়ে যাবি।
—ধ্যার।
— রেড ওয়াইন? ক্যাভিয়ার? স্যালমন?
সব পাবি ভাই! নো চাপ!
— আচ্ছা বলছি তবে।
— বল বাপ বল।
— সারা দুপুর ধরে চাঁদিতে খরখরে রোদ চাপিয়ে রাস্তায় গলিতে ঠেলায় করে বস্তা বস্তা মালের বোঝা ঠেলার পরে যখন ফাটা ভেন্টিলেটরওয়ালা গেঞ্জি পরে কালো, ঝাঁকড়াচুল, পেটরোগা লোকগুলো খেতে বসে, তখন তাদের মাথা-মুখ থেকে টপটপ করে ঘাম পড়ে তাদের ভাতের থালায় মিশে যায়। তাদের মতো কেবল পেঁয়াজ-লঙ্কা আর একথুপি লাবড়া দিয়ে মুখখানা থালার ওপর নামিয়ে একটানে থালার পর থালা ভাত খেয়ে যাবার পর সেই শান্তির ঢেকুরটুকু চাই।

দিতে পারবি?

দিবানিদ্রা

— এই গরমে আমার কাছে সবচেয়ে সুখের কী হতে পারে, বলুন তো?
— এসির ঠান্ডা হাওয়া?
— আপনার কাছে।
— বাথটাবে এককেজি বরফের ওপর শুয়ে থেকে আইস এজ দেখা?
— আপনার নিউমোনিয়া হওয়া শরীরের কাছে।
— ল্যাদ?
— কাছাকাছি।
— বন্ধ ঘরে খালিগায়ে ঘুম?
— আরো কাছে। একটা ডিটেল চেঞ্জ করুন।
— অতো পারছি না। বলবেন তো বলুন।
— উফফ্। চড়চড়ে দুপুর দুটোর রোদে নীল রঙের লুঙ্গিটা পরে খালিগায়ে ফুটপাতের পাশে বিশুদা ওর ঠেলাগাড়িটার ওপর শুয়ে মুখটা হাঁ করে যেভাবে অঘোরে ঘুমোয়, দ্যাট ইজ দ্য আলটিমেট এইম।

নাম দেওয়া হল না

আমার বিছানাটা একটু আলাদা হয়ে গেছে এই কদিন। না না, প্রেমে-টেমে পড়েনি, ধ্যাত!

আমি আসলে অপত্য স্নেহে এই কলকাতার মানুষপোড়া গরমে আমার বেচারা তোষকটার গায়ে একখানা প্লাস্টিকের জামা পরিয়ে দিয়েছি। পাগল ভাবছেন তো! প্লাস্টিক মানেই বেশি তাপ ধরে রাখবে, চ্যাটচ্যাট করবে। কিন্তু, কী করি বলুন তো? রোদে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে আমার যে রেটে ঘাম প্রোডাকশন আর ডিসপ্যাচ হয়, ঝালমুড়ি আর ফুচকাওয়ালারা যে রেটে পেঁয়াজ কাটে, আমার মাশুলওলা রুমমেট যে হারে ফচাৎ ফচাৎ করে ডন মারে, সেইরকম দুরন্ত হারে আমার কাঠের খাটের খাঁজে খাঁজে-ভাঁজে ভাঁজে ছারপোকারা সেক্স করে আর হ্যাল খায়।
আর, রাত হলেই আমি তাদের জন্য নিয়ে আসি আমার ৫৪ কেজির আ-লা-কার্তে!
কাজেই, রাত্রেবেলা ট্যাঙ্গো নাচ নাচার থেকে মানুষমুসল্লম হওয়াটাই সুবিধার বলে এই ব্যবস্থা করে ফেলেছি। কাঠের খাট, তারওপর জ্যালজেলে প্লাস্টিক, তারপর প্লাস্টিকমোড়া তোষক আর সবার ওপরে একখানা কম্বল।

যাইহোক, এরকমই এক রাত। চ্যাটচেটে গরম। আমার পেট আর পিঠ দিয়ে নীলনদ বয়ে যাচ্ছে হুহু করে। বিছানার তো এমন অবস্থা যে, এবার বোধহয় ছত্রাক জন্মানো শুরু হবে! জানলাটাও খুলতে পারিনি—যদি কেউ হাত বাড়িয়ে টুক করে ফোনটা নিয়ে চলে যায়! তাছাড়া, ইয়ে, মানে ছোটোবেলা থেকেই আমার কিনা এট্টুখানি ‘একাকীত্বের ভয়’ আছে। মানে, ওই বুঝছেন তো, ওই একা থাকলে যেসব ভয়-টয় পায় লোকজন, সেই আর কি!
হেঁহেঁ। তো আমি শুয়ে আছি। শুয়ে আছি ঠিক হরিবোল স্টাইলে। মানে, চৈতন্যদেব নামসংকীর্কনের সময় দুটো হাত রাখতেন মাথার ওপর, সেরকম। সেই পোজিশনে হাত দুটো ড্যাংডেঙিয়ে ঝুলছে উপরের কিনারা থেকে।
আর, আমি ইদিকে আমার চিন্তাটাকে কেবল পরীক্ষায় ফেল করলে কী হবে-বাঘের সংখ্যা কমছে কেন-মানুষের চারটে পা হলে কেমন হত-একটু পানু দেখলে কেমন হয়, এরকম গম্ভীর সব চিন্তায় ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কারণ একটিবার যদি আমার চিন্তার রিকশাটা ঠুনঠুন করতে করতে আত্মহত্যা-খুন-মড়ার দিকে চলে যায়, ব্যাস! সেরাতের জন্য আমার নিদ্রাদেবী গোঁসাঘরে খিল দেবেন।

হঠাৎ, বাঘ থেকে মনে পজ়ল জঙ্গল, জঙ্গল থেকে গাছ, গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে চলে এলো খাট, আর তারপরেই মনভোলানো হাসি নিয়ে এই চিন্তা মাথায় এন্ট্রি নিলো, “যদি কেউ খাটের নিচে থাকে? যদি সে আমায় হাত বাড়িয়ে টুক করে ছুঁয়ে দেয়?”
ব্যাস। যুক্তিবাদী মেডিক্যাল ছাত্র পোর্শনটা পাঁইপাঁই করে দৌড়ে পালিয়ে গেল—বোল্টীয় গতিতে ছাতটাত ফুঁড়ে পাড়ি দিল অজ্ঞাতবাসে। পড়ে রইল যুক্তিহীন ভীতু মিনমিনে ছেলেটা। সে একদুবার আমতা-আমতা করে বলার চেষ্টা করলো, “মোস্ট প্রবাবলি কেউ নেই। থাকার তো কথা নয়।”
কে শোনে কার কথা! আমি সুড়ুৎ করে আমার হাতদুটোকে কয়েক ইঞ্চি নিজের দিকে সরিয়ে আনলাম। সেফ থাকাই ভালো বাবা! দুম্ করে আমার হার্টটা পাশমার্ক না পেলে সঘোরেই মারা যেতে হবে। কিন্তু ওই যে কথা আছেনা, ‘হর্নস অফ এ ডাইলেমা!’ সেই ডাইলেমা এবার আমায় শিং দিয়ে আরামসে গুঁতোতে লাগল।
অনেকগুলো শিং বাপু! কখনো মনে হচ্ছে, হাতের দিকটাই ছুঁতে বেশি পছন্দ করবে। তখন হাতদুটোকে আরো সরিয়ে আনছি নিজের দিকে। কখনো মনে হচ্ছে, না, পায়ের দিকটাতেই সুড়সুড়ি দেবার বেশি চান্স! তখন পাদুটো একটু বাঁকিয়ে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসছি।

এই করতে করতে যখন প্রায় একখানা মাংসের গোল্লায় পরিণত হব হব অবস্থা, তখনই ঘটে গেল কেসটা! আমার ফোনের চার্জারের তারটা অবহেলায় একপাশে পড়ে ছিল নিজের মনে—হঠাৎ আমার কড়ে আঙুলের নখটা তাকে আলতো করে চুমু খেলো একটা!
তাপমোচী বিক্রিয়ায় এটুকু অনুঘটকেরই কমতি ছিল! সঙ্গে সঙ্গে একখানা মিনি-চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি খাটের মাঝখানে!

মেডিক্যাল কলেজ মেইন বয়েজ হোস্টেলের রুম নং ১০৭ এর মাঝের বেডে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ফার্স্ট ইয়ারের সৌম্যদীপ রক্ষিত। পয়লা বৈশাখে ফার্স্ট ইয়ারে ছুটি দেয়নি বারবার বলা সত্ত্বেও। সেই দুঃখে সে অর্ডার করে চিলিচিকেন-রুটি পেটভরে খেয়ে সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ শেষরাতে ক্যাঁচাৎ করে পাশের খাটটা একটা বিশাল আওয়াজ করে নড়ে উঠতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ফাঁকা বিছানাটার দিকে তাকিয়ে ভারি অবাক হলো সে। গোটা কম্বলটা এলোমেলো হয়ে কুঁচকে আছে। অবাক হয়েে সে ভাবলো, “অনিকেতদা কি ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে বিছানা-তোষকটা গুছিয়েও যায়নি?”
যাইহোক, ঘুমচোখে কে আর অত ভাবে! চুপচাপ সে আবার উল্টে পড়ল বিছানায়।
পরদিন বেলা ১২টায় ঘুম থেকে উঠে সে খবরটা পেল।
অনিকেত কাল রাতে ঘুমের মধ্যেই অজানা এক কারণে মারা গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, তার চোখদুটো বড়ো বড়ো করে খোলা ছিল—যেন কোনো কিছু দেখে সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে!

পয়লা বোশেখ

ছোটোবেলায় গ্রামের মেয়েটা প্রতি বছর পয়লা বোশেখের দিন বাক্স থেকে পাটভাঙা শাড়িটা পরে বাবার সাথে গাজনের মেলায় যেত টিনের ভটভটি আর পাঁপড় কিনতে। সবাই তার সাজগোজ দেখে যাওয়ার পথে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। সেদিন তার মুখ হাসিতে আর ধরত না!

আজও মেয়েটা প্রতিদিনের গোলাপি জামাটা ছেড়ে একটা নতুন শাড়ি পরে এসেছিল। মাড়ওয়ারি মালিক এক সপ্তাহ আগেই নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে, বাঙালি সেজে আসতে হবে। এসির ঠান্ডায় সারাদিন আজ তাকে হাসতে হয়েছে।
আজও অটোরাস্তার মোড় থেকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত বেশ কয়েকজনই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের দৃষ্টি শুধু চড়া মেকাপেই ছিল না অবশ্য।

ঠান্ডা ভাত-তরকারির সঙ্গে মিইয়ে যাওয়া পাঁপড়ভাজা খেতে খেতে হঠাৎ মাথা উঠিয়ে প্লাস্টিকের মালাঝোলানো ছবিটার দিকে চাইল।
মনে মনে বলল, ‘এটাও কিন্তু পয়লা বৈশাখ বাবা।’

কল্পনাপ্রাপ্তি: এসপ্ল্যানেড বিগবাজারের বিষণ্ণ চোখের একগাল হাসি পরে থাকা ‘বাঙালি’ সেলসওম্যান।

নড়নচড়ন

আলু আর ঈশু দুই ভাই। মা-বাবা দুজনকেই প্রতি সপ্তায় ১০টাকা করে দ্যান। বয়েস হয়েছে, কিছু হাতখরচ প্রাপ্য বইকি! তা, তারা খুব ভালো ছেলে বটে। দুমদাম খরচ করে দেয় না, জমিয়ে রাখে বেশিরভাগটাই।
সেদিন তাদের মধ্যে বিশাল তর্ক। ইশু বলে, ‘ভাঁড়টা প্রায় ভর্তি। কতদিন ধরে জমছে বলতো?’ আলুর দাবি, ‘দুর্! মাঝেমাঝেই তো চামচ দিয়ে তুলে আনি। পুরো ভর্তি হবে না নিশ্চই! ‘ কিছুক্ষণ কথাকাটাকাটি হল।
তারপর আলু বলে উঠল, ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার কেন?’ দুজনেই একসঙ্গে উঠে পড়লো। দুহাতে ধরে ভাঁড়টাকে কষে ঝাঁকালো উপর-নীচে।
ঝঁকরঝঁকর শব্দে ভাঁড়টা জানান দিল, কানায় কানায় ভরে এসেছে। ভেঙে ফেলার সময় হয়ে এসেছে আর কী!

কলকাতার লোকেরা ভয় পেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো দলে দলে।

প্ল্যান বিয়ের গপ্পো

প্ল্যান ‘এ’ হচ্ছে বিয়ে-টিয়ে করবো না। কারণ আছে। 

কারণ ১:চরম লেভেলের বিবাগী মনোভাব। ঘর-সংসারের দিকে টানটা এমনিতেই কম। অবরে সবরে ঘর যাই। চেনা পরিচিত মুখগুলোর হাসির থেকে অচেনা মুখের বিস্ময় দেখতেই আগ্রহটা বেশি। তারপর একদিন বাবা আমার নামের মানে বলতে গিয়ে আওড়েছিল—
“মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবেনা মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দুবিঘার পরিবর্তে।”
সেদিনই একটা ঢ্যারা পড়ে গেছিল। অবস্থাটা ঠিক টেনে রাখা গার্ডারের মতো। পেছনের হাতটার সঙ্গে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছি। কাজেই, বিয়ে-বউ-বাচ্চায় বাঁচা হবে না আমার।
কারণ ২: অদ্ভুত একটা সমাজবিতৃষ্ণা। জানি সবারই থাকে। শালির বাচ্চার জন্মদিনে গিফট কিনতে যেতে সবারই বিরক্ত লাগে, মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়ে হেঁহেঁ করতে সবারই ক্লান্ত লাগে—কিন্তু আমার মতো এতোটা জন্ডিস কেস বোধহয় না!
আমার যেকোনো সম্পর্কেই অ্যালার্জি আছে। নতুন কারো সঙ্গে আলাপ/বন্ধুত্ব হলে প্রথম প্রথম ভালো লাগে, তারপর যদি দেখি আমি তার কাছে থেকে কিছুই পাচ্ছিনা, তখন মানে মানে পালাই! অথবা, বাধ্যাবস্থায় সয়ে নি কোনোমতে। মা-বাবা-বন্ধু টাইপের ফেভিকলসম্পর্কগুলোর প্রতিও আমার তেমন আদিখ্যেতা নেই। ওই থাকতে হয়, আছে। ব্যস।
তো এরকম লোকের সঙ্গে খুব বেশি লোকের পটে না, বোঝাই যাচ্ছে! লোকে আড়ালে-আবডালে পাগল বলে, কেউ আবার মুখের ওপরেই বলে দেয়!
আর, দুজন নইলে তো বিয়ে হয় না!

এই তো গেল প্ল্যান ‘এ’। এবার আসি প্ল্যান ‘বি’ এর কথায়—মানে, বিয়ের কথায়। ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারি, আত্মবিশ্বাস দিয়ে দুপকেট আর পাছার পকেট ভর্তি করেও হাতে একমুঠো বাকি থাকতে পারে, তা বলে মেগালোম্যানিয়াক তো নই! জানি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে, কর্তব্যের দায়ে, কোনো একদিন বিয়ে করতে হতেই পারে। হতেই পারে।
তাই, একটু ছকে রেখেছি আমার ‘আদর্শ বিয়ে’টাকে। ছকে রাখা ভালো। কাজে দেয়।
একে একে আসি।

°আদর্শ পথসঙ্গী°
১. মগজে একটু কড়া উইট, হিউমার আর স্যাটায়ার।
২. অন্যাকা তথা বাস্তববাদী।
৩. সিম্পুল লিভিং, হাই থিঙ্কিং।
৪. এটাই একটু দাবি গোছের। তিনটে জিনিসের মধ্যে যেকোনো দুটোয় চরম লেভেলের আগ্রহ থাকতে হবে।
বই, গান বা দেশবিদেশে সফর।
ব্যাস। ছোটোখাটো ডিটেইলসে যাচ্ছিনা—কেবল বিরক্ত করাই হবে। বেসিক্যালি, এই গুণগুলো আমি সবার মধ্যেই খুঁজে বেড়াই। যাদের মধ্যে পাই, তারাই আমার পেয়ারের লোক হয়ে যায়। কাজেই, এই মানুষটার মধ্যে তো খুঁজবোই!
এবার, আসি অন্যগুলোর কথায়।

°আদর্শ বিয়েস্থান°
অবভিয়াসলি ডেস্টিনেশন ওয়েডিং! আর কিছু না হোক, ওই P.C.Chandraএর অ্যাডটা দেখেছেন? ওরকম হলেও চলবে!
(হেঁহেঁ, নোংরা পুঁজিবাদী চিন্তা। মাঝে মাঝে ইনফিলট্রেট করে যায় আর কী!)

এবারে, মূল পার্ট। মানে, বিবাহ পরবর্তী জীবনের কিছু রুলজ অ্যান্ড রেগুলেশনজ। না না এভাবে বলবো না। লোকে আবার কিসব কিসব বলে বসবে। বরং বলা যাক, কোড অফ এথিক্স। বা বলতে পারেন, আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসলে, আমার পাঞ্জাবির কলারের ট্যাগে এগুলোই “*T&C apply” হিসেবে লেখা থাকবে!
যাই হোক, সেগুলো একে একে বলি।

°সাংসারিক সংবিধান°
১. বিয়ের পরের ৬ মাস/১ বছর হচ্ছে ট্রেনিং পিরিয়ড। ওইসময় আমাকে রান্না করাটা শিখিয়ে দিতে হবে। সপ্তাহে সাড়ে তিনদিন রান্নার দায়িত্ব নিতে আমার তরফ থেকে আগ্রহই থাকবে।
২.ঘরের বাকি সব কাজই মোটামুটি পারি। ঘর মোছা, ঝাঁট দেওয়া, জামাকাপড় কাচা, বাসন মাজা এইসব কাজগুলো ভালোই পারি বলে মনে হয়। সেটা মনোমত না হলে এই সময়ের মধ্যে শিখিয়ে নিতে হবে। এইসব কাজকে আমি বাজে কাজ বলে মনে করি না, বরং ভালোইবাসি করতে।
৩. নিজস্ব পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। মিউচ্যুয়ালি। একের ওপর অন্যের পছন্দ চাপানো(ইমোশনালি জোর করে হলেও) খুব বাজে জিনিস। সকালে আমি চা ভালোবাসি আর তুমি কফি, সেখানে তুমি বলতেই পারো যে, “তোমার চা আমি বানাব না। নিজে করে খাও।” তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু, ‘আমিও খাচ্ছি তুমিও খাও না’ টাইপের আবদার চলবে না।
৪. নানা রকমের ফান্ড এর ব্যবস্থা থাকবে। তা থেকে দুজনেই খরচ দেবে এবং নেবে। এবং মাসের শেষে ক্লিন অডিট দেওয়া হবে। এবং কোনখাতে খরচ বেশি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
৫. ছোটো বা বড়, সবাইকে তর্ক করতে জানতে হবে। যুক্তি দিয়ে ঠিকঠাক তর্ক করতে জানতে হবে। আবেগ দিয়ে তর্ক বা কুযুক্তিওয়ালা তর্ক একদমই আনচলেবল্।
৬. ঘরের সব সদস্যকে নিয়ে প্রতি শনিবার রাতে আদালত বসবে। সবার অভিযোগ কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই শোনা হবে এবং হাতভোট, জুরি সিস্টেম প্রভৃতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচার হবে। জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সদস্য জরুরি মিটিং ডাকতে পারে।
৭. যেকোনো ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলতে এবং প্রশ্ন করতে জানতে হবে। তা ব্যাপারটা যতই লজ্জার, রাগের বা অস্বস্তির হোক না কেন! যেকোনো প্রশ্ন,পছন্দ-অপছন্দ এবং সমালোচনা মুখের ওপর বলাটাই অ্যাপ্রিশিয়েট করা হবে। এমনকি খিস্তিও।
৮. সেকেন্ড এডিশনগণের আবির্ভাব হলেই জীবনকে বিরিয়ানি থেকে পান্তাভাত করে দিতে হবে, এমন দাবি চলবে না। ৪০ বছর বয়সেও হাত ধরা যায়, ৪০ বছর বয়সেও একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, ৪০ বছর বয়সেও চুমু খাওয়া যায়। লোকহাসির ভয় আমি এখনো করিনা, তখনো করবো না।
৯. একাকীত্বের দাবিকে মান্যতা দিতে হবে। আমার মাঝে মাঝে একা হাঁটতে বেরোতে ইচ্ছা হতেই পারে। গভীর রাতে একা টেবিলল্যাম্পে গল্পের বই পড়তেই পারি। একা কোথাও ঘুরতে বা ট্রেক করতেও যেতে পারি। পকেট ধরে ঝুলে পড়া চলবে না।
১০. শেষত, সাংসারিক বৃত্তের যাবতীয় দায়িত্ব, কর্তব্য এবং তাদের ফলাফলের বোঝা দুজনের ওপর সমানভাবে পড়বে। পড়বেই। এবং সেটা এড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে বড়জোর সিমবায়োসিস চলতে পারে, প্যারাসাইটিজম নেভারস্য নেভারম!

পুনশ্চ: ওদিক থেকেও আমি এরকম একটা লিস্টি শুধুমাত্র আশাই করবো না, ইনসিস্টও করবো। না দিলে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে।