প্রবাসে

বিধুভূষণের কাছে জানতে চাইলাম, বিদেশে না গিয়ে প্রবাসের স্বাদ কীভাবে পাওয়া যায়?

সে বললে, জানো অনিকেতদা, সেদিন রাতে হোস্টেলের খাটে বসে আছি। রাত প্রায় দেড়টা হবে। ঘড়ি-টড়ি দেখিনি। সামনে সেমেস্টার, দুলে দুলে ড্রাগের নাম মুখস্থ করছি।
হঠাৎ টক্-টক্ জানালায়। খটাস্ করে ছিটকিনিটা উঠিয়ে তাকাতেই দেথি, একটা মোটা হাত। একগাল হেসে সায়ন্তন মুখুটি গরাদের ওপাশে। আমি ভাবলুম বুঝি রাতবিরেতে পেটে আগুন জ্বলেছে, তাই নুলো বাড়িয়েছে। আমি বলতেই যাচ্ছিলাম, না বাপু কিচ্ছু নেই, সব ড্রয়ার ধুধু ফাঁকা।
তখনই আমাকে চমকে দিয়ে ও বলল, ‘নে নাড়ু খা! আজ ঘর থেকে ফিরলাম সকালে। মা দিলো সঙ্গে।’ এই বলে চলে গেল হাতে দুটো নাড়ু ধরিয়ে!
তা বেশ। আমরা হোস্টেলবাসীরা খাবার পেলেই তাকে যথাস্থানে রেখে দিই, মানে পেটে আর কী!
ঘরের খাবার তো পান্তাভাতের পর ক্যাভিয়ার খাবার সমান! আমিও জানালা বন্ধ করে জমিয়ে বসলাম। দুমাস ঘর যাইনি। পরীক্ষা শেষ হলে যাবো। এসময়ে যেটুকু ঘরের ঘাস পেয়েছি, সেটাকে ভালো করে জাবর কাটতে হবে তো!
কানে ইয়ারফোন লাগালাম। বই আর হাইলাইটার রইল টেবিলল্যাম্পের ছায়ায় পড়ে। চোখ বুজে কামড় বসালাম।
হঠাৎ এফএমের গানটা পাল্টে গেল। আচমকাই। বিনা নোটিশে। আমাকে না বলেকয়েই।
একজন তরুণ, তার ঢেউওঠানো উথালপাথাল গলায় আমার নীল ইয়ারফোনদুটোতে সমুদ্র এনে দিচ্ছিল না চাইতেই। আমি ভেসে যাচ্ছিলাম।

তখন মনে হচ্ছিল, সত্যি বড্ডো বেশি দূরে আছি ঘর থেকে। অনেক দূরে। ট্রেনে করে আর কোনোদিন পৌঁছতে পারবো না। ট্রেনগুলো শুধু স্টেশন ছুঁয়ে চলে যাবে, আমি দৌড়ব, কিন্তু গার্ড আর ট্রেন থামাবেন না। কেনই বা থামাবেন? টাইমটেবিলে সময় পেরিয়ে গেছে। যখন ঘরে ফিরতে পারতাম, তখন অভিমান করে বসেছিলাম একা। একাকীত্বের গর্বে ঘাড় উঁচু করে হনহনিয়ে চলে গেছিলাম। আজ আর ঘর ফেরা হবে না। বাথরুমের শ্যাওলাস্তরে আঁকা অস্ট্রেলিয়া আর জানালার পাল্লায় আঁকা গুপ্তধনের ম্যাপগুলো আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাবে, কিন্তু সে আর ফিরবে না। ঘর যাকে একবার ফিরিয়ে দেয়, সে কী আর ফেরে? সে প্রবাসেই ভালো থাকে। একলাটি।

তখনও কানের কাছে বয়ে চলেছে,
ওহে হারাই হারাই/ সদা হয় ভয়/ হারাইয়া ফেলি চকিতে/ আশ না মিটিতে হারাইয়া/পলক না পড়িতে হারাইয়া/ হৃদয় না জু়ড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে…..’

এভাবেই সেদিন বিদেশী হয়ে গেলুম। একনিমেষে।”

কমরেড

আচ্ছা, সবাই প্রেম নিয়ে এতো নাচানাচি করে কেন? প্রেম কি মধু সিঙ্গীর গান?

আসলে প্রেম ব্যাপারটা বড়োই একপেশে রে!
সাধারণ মানুষ যে প্রেমটার পেছনে ছোটে, সেটা বড়ই সুপারফিশিয়াল। মানে ওরা ভাবে ওদেরকে ফরেস্ট গাম্পের মত লাগছে, কিন্তু সাইডলাইন থেকে আসলে বাজারের থলি হাতে পাড়ার কিপ্টেকাকু ফটিক ঘোষের মত দেখায়!
সেই ওভাররেটেড প্রেম শুরু হয় নিমেষে, শেষও হয় ক্ষণিকের মধ্যেই! শুরুটা সবাই বুঝতে পারে, সেটা হরমোনজনিত কারণেই হোক বা ফ্রন্টাল কর্টেক্সজনিত কারণে।
কিন্তু সেই প্রেমের শেষটা তাদের চোখে পড়ে না কেন?
কারণ, যদিও সেই প্রেম বিলিতি অফশপের সামনে চাটের দোকানের মতই অ্যাকসেসরি, বা ওষুধের দোকানের সামনে ওজনের যন্ত্রের মতই অ্যাটেনশনখোর; তবু তার মোহে, তার বাহারি চটকে মানুষ চিপকে যায়, চোখদুটো তার গোল্লা গোল্লা হয়ে যায়। ব্যাস, মস্তিষ্ক প্রক্ষালন সমাপ্ত!

আসলে, মানুষ প্রেমিক-প্রেমিকার চিরাচরিত সম্পর্কে যেটুকু প্রেম খুঁজে পায়, সেটুকু শুরুতেই লেগে থাকে।
প্রেম, শুরুতে— ব্যাপারটা গোলমেলে, তাই না?
মানে, যেমন ধরুন, রক্ত পরীক্ষার সময় আঙুল ফোটালে ছুঁচের ডগায় যেমন লেগে থাকে, মাইক্রোবায়োলজির ইনোকুলেশন লুপের ডগায় যেমন ব্যাকটেরিয়ার কলোনি লেগে থাকে, সেরকমই সম্পর্কের শুরুটায় কেবল এক-দু ফোঁটা প্রেম লেগে থাকে। তাও ভেজাল।
কিছুটা হলেও যদি প্রেম থাকে প্রথম আড়চোখে দেখায়, তার ছিঁটেফোঁটাও থাকে না কনফিডেন্ট উড়ন্ত চুমুতে।
কিছুটা হলেও যদি প্রেম থাকে প্রথম কথা বলতে গিয়ে ভয় পেয়ে তোতলানোয়, তার ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া যায় না হেসে ফ্লার্ট করায়।
কিছুটা হলেও প্রেম মনে হয় প্রথম পাঠানো ভয়জড়ানো মেসেজকে, তার কণামাত্রও যোগ্য নয় মাঝরাতের দুরন্ত সেক্সটিং।

আসলে, সমাজ বর্ণিত প্রেমের শুরুতেই শুধু মেকি প্রেমের মোড়ক থাকে, বাকিটা শুধুই অভ্যাসের খেলা!

আর, সমাজ যখনই প্রেমের চৌহদ্দি বেঁধে দিতে চায়, তখনই সেটা স্মরণজিৎ এর লেখা রহস্য উপন্যাসের মতো হয়ে যায়। মানে, বড্ডো বেমানান।
হয়না বাপু, হয়না! নলবনে লিপষ্টিক খারাপ করে দেওয়া বা ভিক্টোরিয়ার সবুজ ঘাসে অবাধ্য হাতের বেইমানিকে প্রেম বলতে অস্বস্তি হয় আমার।
আমি প্রেমকে দেখেছি মানুষের গন্ডী ছাড়িয়ে অনেক অনেক বড় হয়ে যেতে। প্রেম দেখেছি হারিয়ে যাওয়াতে, প্রেম দেখেছি মৃত্যুতে। আমি ভালোবাসা দেখেছি পায়ে পা মিলিয়ে দূরে হেঁটে যাওয়ায়।
প্রেমের দৃঢ়তা দেখেছি হাজার মিছিলের হাতগুলো মিলেমিশে যখন ডেভিডের গল্পগুলোই পড়ে আসা বিকেলে সমাজবাদের স্বপ্ন দেখায়। প্রেমের কমনীয়তা দেখেছি কমরেডের চোখে ভেসে থাকা ভরসা আর বিশ্বাসে।

কমরেড, অরিজিৎ সিংয়ের রোম্যান্টিসিজমকে প্রেম বলে ভুল করলে হবে? এখনো অনেক পথ চলা বাকি। চলো,এগিয়ে যাই।

 

প্রাতঃকৃত্য

— এই যে আপনি! শুনুন একটু!
— আ-আবার আমি! আপনি কি বারবার আমাকেই পান? কেন ওই ওখানে মিত্তিরবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁকছেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করুন না!
— না না! আপনিই ভালো। বেশ কুচিমুচি মাচুপিচু টাইপ! আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— (ফুঁসস) বলুন আর কী! পেয়েছেন আমাকেই!
— আচ্ছা,সকালে উঠে ফ্রেশ হওয়ার জন্য কী ব্যবহার করা উচিত বলুন তো? মানে পুরো শরীর একেবারে ধুয়ে যাবে, এরকম?
— শুধু আজেবাজে প্রশ্ন। পেস্ট-ব্রাশ দিয়ে, আবার কী!
— পোকামাকড় দিয়ে মুখ ধোয়া অভ্যেস? ইউনিক তো!
— আরে বাবা পেষ্ট! যত্তোসব!
—কিন্তু পেষ্ট-ব্রাশ দিয়ে তো শুধু দাঁত আর মাড়ি পরিষ্কার হয়। ওটুকুতেই হয়ে যাবে?
—উমম্। তবে ওই কুলকুচি করার জিনিসগুলো? লিস্টারিন?
— আবার মুখ! আপনি কি অর্ণব গোঁসাই নাকি?
— আপনার কিছুতেই শান্তি হয় না বাপু!
— বাঁপকেটে জিভ আর ডানপকেটে মুন্ডুটা রেখে উত্তর দিলে কী করে শান্তি হবে?
— দাঁড়ান দাঁড়ান। ঘুম থেকে উঠে ঢকঢক করে একগ্লাস জল খাই। ওটাই তো হবে!
— শুধু ধ্যাড়াচ্ছেন! ওতে শুধু গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্টটুকু ধুতে পারে, তার বেশি না।
লাস্ট চান্স। বলুন বলুন। আপনার ওপর অনেক আশা আমার।
— হুমম। শেষ ট্রাই। বলি। ভালো করে স্নান করা?
— নাহ্, হলো না।
শুনুন। ভোর ভোর উঠবেন। ঘুমচোখেই বালিশের পাশ থেকে ফোন আর ইয়ারফোনটা নেবেন। কানে গুঁজবেন।
তারপর ওই ভানুবাবুর ‘সঙ্গীত’ ব্যান্ডটার ‘পূজা’ অ্যালবামের যেকোনো গান চালিয়ে চোখ মুদে শুয়ে থাকবেন।
আর আস্তে আস্তে টের পাবেন, ভেতরটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসছে। ধুয়ে যাচ্ছে প্রতিটি কোষ— ফ্লাশড্ হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক অন্তরায়।

এটাই হলো ফ্রেশ হবার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি!

ভাষাদিবস

ভাষা দিবস নিয়ে অনেকেই অনেক লেখা লিখে ফেলেছেন। আমারও কিছু কথা নিজেকেই আবার মনে করানো প্রয়োজন ছিল, তাই আমিও সেই পন্থাই অনুসরণ করলাম।

ভাষাদিবসের শপথ:
১. যে ভাষাই বলব বা লিখব, চেষ্টা করব সেটা সঠিকভাবে বলার বা লেখার। ‘mah’ লেখাটা যেমন অসম্মানজনক, একটা ছেলেকে ‘তু ক্যা কর্ রহি হ্যায়’ প্রশ্ন করাও সেরকমই শ্রুতিকটু।
২. কোনোরকম সাহিত্যকেই জনসমক্ষে বিচার করে আমার মতামতের দায় তার ওপর চাপিয়ে দেব না। দুর্জয় দত্ত আমার অপছন্দের লেখক হতেই পারেন, অসম্মানের লেখক যেন না হন কখনোই।
৩. সব রকমের কথ্য ভাষাকে সমানভাবে গ্রহণ করবো। আমার তির্যক হাসি আর বিদ্রূপভরা দৃষ্টির কারণে যেন পুরুলিয়ার গ্রাম থেকে আসা ছেলেটা ‘ক্যানে’ বলতে, বা জলপাইগুড়ি থেকে আসা ছেলেটা ‘যাবা’ বলতে বিব্রতবোধ না করে।
৪. কলকাতার ভাষা মার্জিত হতে পারে, কিন্তু তাকে অযথা সবজায়গায় অনুকরণ করে বন্ধুদের কাছে নিজের মান বাড়াবার চেষ্টা করব না। মফস্বলী উচ্চারণে ‘করছিশ’ বা ‘হওবে’ বলে ট্যাঁশ সাজা যায় না—ট্যাঁশগিরি জন্মসূত্রে লাভ করতে হয়।
৫. বাজারচলতি সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সাহিত্যকেও সমান গুরুত্ব দেব।
৬. বড় লেখকরাও প্রথমে ছোটো লেখক ছিলেন, একথাটা মাথায় রাখবো। তাই নতুন নামের লেখক দেখলেই এড়িয়ে যাব না, উল্টেপাল্টে দেখব এবং সাধ্যের মধ্যে হলে কিনে ফেলব।
৭. বাংলা ভাষার সঠিক নিয়মকানুন, রীতিনীতিগুলো নিয়ে পড়াশুনো করবো এবং জানবো। তবেই লোকের বানানে খুঁত ধরতে যাবো।
৮. অনেকদিন থেকে ভাবছি স্প্যানিশ শিখবো, সেই ভাবনাকে এবার বাস্তবে রূপান্তরিত করবো। বেশি বয়সে নতুন ভাষা শেখা যায় না, এটা একেবারে ভুয়ো কথা।
৯. অনুবাদ সাহিত্য একটা বিশাল ক্ষেত্র। সেটাকে ব্যবহার করে অন্যান্য ভাষার ভালো লেখকদের চিনবো।
১০. বাংলা প্রেম মানেই ইংরেজি বিদ্বেষ নয়—এটা বোঝার মত বুদ্ধি রাখব। বাংলা বলতে পারি না সেটা যেমন লজ্জার কথা, তেমনি ইংরেজি পড়তে কষ্ট হয়— একথাটাও লজ্জার।
১১. রোজ ব্যবহৃত শব্দগুলো সাহিত্যে ঢুকে পড়লে নাক কোঁচকাবো না। যৌনতা মানেই অশ্লীলতা, এমন ধারণা পোষণ করাটা নিতান্তই ছেলেমানুষি।

সর্বোপরি, বাংলা ভাষার এবং তার চর্চার অবলুপ্তি নিয়ে চিন্তিত মানুষদের জন্য একটাই কথা বলবো, মানুষের ওপর ভরসা রাখুন। জোর করে জ্ঞান দিয়ে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তর্কের ঝড় বইয়ে কাউকে দিয়ে শিব্রামের বই কেনানো সম্ভব নয়। কেনানো যদিও বা সম্ভব হয়, পড়ানো একেবারেই অসম্ভব। আর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে শিব্রাম পড়ানো মানে তাঁরই অপমান।
তাই ভরসা রাখুন। প্রত্যেক হ্যারি পটারের ক্রেতার জন্য একজন সুকুমার ক্রেতা আছেন। প্রত্যেক দুর্জয় দত্ত ক্রেতার জন্য একজন স্মরণজিৎ ক্রেতা আছেন। প্রত্যেক এডগার অ্যালেন পো ক্রেতার জন্য একজন হেমেন ক্রেতা আছেন। ভরসা থাকুক সেইসব মানুষগুলোর ওপর।
আর ভরসা থাকুক লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের প্রতি। এঁদের সক্রিয় লড়াই প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, ভাষাযোদ্ধারা এখনও আছেন।

কোনো ভাষা তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেললে লড়াইয়ে হেরে যায়। যেমন হেরে গেছিল সংস্কৃত। কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী ভাষাগুলো কালজয়ী, তাই তারা আবার ফিরে আসারও ক্ষমতা রাখে। যেমন ফিরে এসেছে সংস্কৃত।
বাংলা ভাষাতে আমার বিশ্বাস রয়েছে। 🙂

বনফুল

— আচ্ছা, বাঙালির সেরা প্রোপোজাল কোন ফুল দিয়ে হবে বলুনতো?
— প্রেম প্রোপোজাল?
— ন্যাহ্! ফুল দিয়ে বিজনেস প্রোপোজাল করবে। বলি মাথায় কি কথাঞ্জলি ভরা আছে?
— উফফ্! সরি সরি। ইয়ে, বেস্ট হচ্ছে গোলাপফুল। আমার মতে অবশ্য।
— আপনার মতটাই জিজ্ঞেস করেছি। দুর্জয় দত্তেরটা করিনি। অকারণে অতো ডিপ্লোম্যাটিক হবেন না তো!
তা, কারণটা শুনি?
— ওই যে, কদিন আগে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডেতে রাহুল বলে আমার বন্ধুটা একগাদা গোলাপ নিয়ে অস্মিতাকে প্রোপোজ করলো যে! অসাম দেখতে লাগল!
— আবার বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে? ভদ্দরলোকের মতো মুখে কথা বলছি সেটা সহ্য হচ্ছে না, না? ছোটোলোকের মতো ক্যালাবো কি এবার?
— ওই হলো। সরস্বতী পুজো।
— হুমম। কিন্তু উত্তরটা তো হলো না! আবার ট্রাই করুন দিকি।
—ইয়ে, রজনীগন্ধা? বেশ পবিত্র পবিত্র ব্যাপার!
— দুদ্দুর! নেক্সট ট্রাই।
— জুঁই ফুল? স্নিগ্ধতার প্রতীক! আহা!
— হায় ভগবান! এক কাজ করুন, হনলুলু চলে যান। বাংলা আপনার প্রতিভার মর্যাদা দিতে পারছেনা!
— (জিভ টিভ কেটে) আচ্ছা আচ্ছা লাস্ট চান্স দিন একটা। জবা ফুল?
— সেই। জবা ফুল। এক কাজ করুন তো! একটা ধারালো দেখে ছুরি নিয়ে আসুন।
— আবার ছুরি কেন?
— মা কালীর মতো আপনার মুণ্ডু কেটে বাস্কেটবল খেলব! জবা ফুল! জবা ফুল দিয়ে প্রেম?! অ্যাঁ?!
থাক আপনাকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে।
— বলে দিন না, বলে দিয়ে যান পিলিইজ!

— আরে বাঙালির প্রেমের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র হচ্ছে বনফুল!
বনফুল হচ্ছে প্রেম। প্রেম মানেই বনফুল।
প্রোপোজালে টুক করে একখানা অণুগল্প ঢুকিয়ে দেবেন, ব্যাস! অবলা সেই কন্যা আপনার জালে পড়তে বাধ্য।
প্রেমের প্রথম চ্যাপ্টারটাই হচ্ছে গ্রীষ্মের দুপুরে জানালার পাশে বসে একা একা বনফুল পড়া!

আগে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো মুরারিলাল! নিজেকে ভালোবাসতে না পারলে অন্য কাউকে ভালোবাসাটা বড্ড চাপ হে!
ভালোবাসো, ভালোবাসো। ভালোবাসা প্র্যাকটিশ করো। (:

জগন্নাথ ভোজনালয়

— কলকাতার একটা পুরোনো গলিতে ঢালু নালার ওপরে তৈরি ছোট্টো ভাতের হোটেলে একটা ফাটাফাটি পাবদা মাছের ঝোল-ভাত খেতে সবচেয়ে বেশী কী জরুরি বলুন তো?
— টাটকা পাবদা মাছ?
— উঁহু।
—ধোঁয়াওঠা ধবধবে সাদা দেরাদুন রাইস?
— ধ্যার মশাই! ভাতের হোটেলে দেরাদুন রাইস? টমেটোর চাটনি দিয়ে তন্দুরি? এয়ার্কি?
— তবে আর কী! পেটজুড়ে চনচনে খিদে?
— এ তো জেনেরালাইজড উত্তর হয়ে গেল গো। ভাবো টুকু!
— পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা?
— হলো না, হলো না, ফেল!
—আর পারছি না বাপু বকবক করতে। বলবে তো বলো, নইলে আমি এলাম!
— উফফ্! এতো অসহিষ্ণুতা দেশজুড়ে!
শোনো তবে। তোমার জন্য প্রায়োরিটি ওয়াইজ সাজিয়ে বলি।
নম্বর ১, কড়া গ্রীষ্মের ঘামঝরা দুপুরের ক্লান্তি।
নম্বর ২, সকালে অফিস যাওয়ার পথে হঠাৎ মায়ের ফোন।
নম্বর ৩, হোটেলের বাইরে লেজনাড়া খেঁকি কুকুর।তার লেজে একদুটো মাছি।
নম্বর ৪, স্টিলের থালায় সবুজ কলাপাতা আর তার জলের ফোঁটার লাজুক দৃষ্টি।
নম্বর ৫,ঘ্যাঁটের স্তূপের পাশে কুড়কুড়ে আলুভাজার মিষ্টি লুকোচুরি।
নম্বর ৬, ফ্যানের বদলে দরজা দিয়ে মাঝে মাঝে বকুলের পাতার ঠান্ডা ঝিরঝিরে হাওয়ার ডোজ।
নম্বর ৭, কাউন্টারে বসা টাকমাথা হাসিমুখ ভুঁড়িকাকু।
নম্বর ৮,সেই কাউন্টারেই ভাজা মৌরি আর গোটা মৌরির সহাবস্থান।
নম্বর ৯, এদিক ওদিক চরকিপাক খেতে থাকা বছর সতেরোর ফাজিল ছোকরা।

আর, নম্বর ১০এ, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, একজন মাঝবয়েসী বেঁটে মোটা মানুষ, যার ঠোঁটের ডগায় সেদিনের মেনু সবসম়য় তৈরী থাকে, সব টেবিলের সব অর্ডার মনে রাখতে এককুচি কাগজও লাগে না, অসাধারণ গতিতে টেবিলে টেবিলে মাছ ভাতের থালা পৌঁছে দিতে যার জুড়ি নেই, আর মুখে একটুকরো অভিভাবকস্বরূপ হাসি যার সবসময় লেগেই থাকে।
মানুষটাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়।
ছোটোবেলায় জ্বর হলে বাবা মাঝেমধ্যে খাইয়ে দিতো। আমিও সেই হোটেলটায় মাঝে মাঝেই যাই।

বেশি না।

 

বইপ্রেম

আমি যাকে তাকে দুমদাম ‘বইপ্রেমী’ বলি না।সাহিত্যপ্রেম আর বইপ্রেম আমার ডিকশনারির আলাদা আলাদা পাতায় লেখা। তারাই প্রকৃত বইপ্রেমী, যারা এই সব গন্ধগুলো নাকের রোঁয়ায় রোঁয়ায় চেনে—
১. আনন্দ প্রকাশনের সদ্য ভেজে নামানো গরম বইয়ে কুড়কুড়ে গন্ধ।
২.কলুটোলা স্ট্রিটের পুরোনো অভিজ্ঞ বুড়ো বইয়ে সোঁদা গন্ধ।
৩.রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পাতা ছিঁড়ে যাওয়া বেশ্যা বইয়ে অপূর্ণতার গন্ধ।
৪. বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেওয়া পরস্ত্রী বইয়ে নিষিদ্ধ রোমাঞ্চের গন্ধ।
৫.চা খেতে খেতে পড়া বইতে হঠাৎ পড়ে যাওয়া লেবু চায়ের অন্যমনস্কতার গন্ধ।
৬.ঘরের তাকে খুঁজে পাওয়া না পড়া বইয়ে অভিমানে শুকিয়ে যাওয়া নোনা জলের গন্ধ।
৭. বইমেলায় লুকিয়ে ব্যাগে ভরে নেওয়া বইয়ে মাঠের ধুলো আর ছেলেমানুষির গন্ধ।
৮. পুরোনো স্কুলের পড়ার বইয়ে মনখারাপ আর বন্ধুত্বের গন্ধ।
৯.উঁচু ক্লাসের না পড়া বই লুকিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখার সময় ছুঁতে না পাওয়া ইচ্ছের গন্ধ।
১০. বিছানার পাশে রাখা প্রতিদিনের সঙ্গী বইটাতে হাতে হাত রেখে ভরসার গন্ধ।

দেশদ্রোহী

আচ্ছা, একটা কথা বলি? একটা জিনিস আমাকে বলবেন কেউ?
এই যে JNU এর ব্যাপারটা.. এখানে নাকি সবাই দেশদ্রোহী স্লোগান দিয়েছে! বেশ!
তারপর নাকি ‘ভারত কি বরবাদি’ চেয়েছে!
মেনে নিলাম!
আচ্ছা, ভারত কি বরবাদিটা কীভাবে হবে?
মানে, লোকজন কি কোদাল আর শাবল নিয়ে বেরিয়ে পড়বে? কুপিয়ে মাটি কাটবে আর টন টন মাটি ভারত মহাসাগরে ফেলে দেবে?
ব্যাস! ভারতের সব মাটি সাগরে ফেলে দিলেই ভারত শেষ!
অন্য কোনোভাবে তো আমি ভারত শেষ করার উপায় দেখছি না!

মানে ব্যাপারটা হচ্ছে, আপনি এতো যে ‘আমার দেশ’, ‘ভারতমাতার অপমান’ এই বস্তাপচা সেন্টুগুলো দিচ্ছেন, তার ভিত্তিটা কী?
কোন দেশ?

মানুষের তৈরি দেশ? সেটাকে তো কেউ খিস্তি মারছে না! আপনি তো মানুষ দিয়ে তৈরি যে ভারত, সে নিয়ে ভাবেননি কোনোদিন! এরা তো ভেবেছে! আফস্পার কবলে পীড়িতদের নিয়ে ভেবেছে! কাশ্মীরের লাঞ্ছিত মানুষদের নিয়ে ভেবেছে! আপনি কী ছিঁড়েছেন যে হঠাৎ গায়ে লাগছে?

সম্পদের দেশ? সে ত‌ো আপনিও ভোগ করছেন, সেও করছে। আপনি যেটুকু মানবসম্পদে কন্ট্রিবিউট করেন, তারাও অতোটাই করে! কাজেই খারাপ লাগলে খিস্তি মারবে না!

মাটির দেশ? সেটার বরবাদি?!
তাহলে খুরপি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি? দেশটাকে কুচি কুচি করে কেটে দেব!

ভারত কি বরবাদি কমপ্লিট, আর কী!

 

হাঁসকাহিনী


এক যে ছিল হাসপাতাল. সে ছিল মূর্খ. সে চিকিৎসা করিত, রক্ত চুষিত না. রোগীদের রোগ নির্ণয় করিত, সারাইয়া তুলিত, জানিত না পাবলিকের পকেট কীভাবে মারিতে হয়.

রাজা বলিলেন, ‘এমন হাসপাতাল তো কাজে লাগে না, অথচ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ খাইয়া রাজহাটে পকেটমারির বাজারে লোকসান ঘটায়.’

মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘হাসপাতালটাকে পরিষেবা দাও.’


রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল হাসপাতালটাকে পরিষেবা দিবার.

বিশেষজ্ঞরা ঘন্টাখানেক বসিয়া অনেক বিচার করিলেন. প্রশ্নটা এই, উক্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানের টাকা না খাওয়ার কারণ কী.

সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য ডিপার্টমেন্টের দোতলা দিয়া হাসপাতাল যে জাল পাতে,সেই জালে বেশি পাবলিক ধরে না. তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া দশতলা সুপারস্পেশালিটি বানাইয়া দেওয়া.

বিশেষজ্ঞরা ফ্রি সাইকেল পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন.


ম্যাকিনটশ বার্ন বসিল বিশাল সুপারস্পেশালিটি বানাইতে. বিল্ডিংটা হইল এমন আশ্চর্য যে,দেখিবার জন্য দেশবিদেশের পেশেন্ট ঝুঁকিয়া পড়িল. কেহ বলে, ‘পরিষেবার একেবারে হদ্দমুদ্দ.’ কেহ বলে, ‘পরিষেবা যদি নাও হয়, সুপারস্পেশালিটি তো হইল. হাসপাতালের কী কপাল!’

ম্যাকিনটশ বার্ন সুইস ব্যাঙ্ক বোঝাই করিয়া কালো টাকা পাইল. খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল দুবাই এর দিকে.

ফোর্টিস বসিলেন হাসপাতালকে পরিষেবা শিখাইতে. হুক্কা লইয়া বলিলেন, ‘অল্প চাকচিক্যের কর্ম নয়.’

ভাগিনা তখন বেসরকারি ভড়ংবাজদের তলব করিলেন. তারা চাকচিক্যের নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল. যে দেখিল সেই বলিল, ‘সাবাস! পরিষেবা আর ধরে না!’

ভড়ংবাজের দল শিভাস রিগাল লইল অডি বোঝাই করিয়া, তখনই ফ্ল্যাটের দিকে দৌড় দিল. তাদের মদের আসরে আর টানাটানি রহিল না.

অনেক দামের সুপারস্পেশালিটিটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই. এক্সটেনশন তো লাগিয়াই আছে. তারপরে বেসমেন্ট লিফট কারপার্কিং এর ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, ‌’উন্নতি হইতেছে.’

গ্রুপ ডি লাগিল বিস্তর এবং তাদের ওপর নজর রাখিবার জন্য গ্রুপ সি লাগিল আরও বিস্তর. তারা মাস মাস মুঠা মুঠা গুটখা পাইয়া গাল বোঝাই করিল.

তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জে গদি পাতিয়া বসিল.


সংসারে অন্য অভাব অনেক অাছে, কেবল জুনিয়র ডাক্তার আছে যথেষ্ট. তারা বলিল, ‘সুপারস্পেশালিটিটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু হাসপাতালটার খবর কেহ রাখে না.’

কথাটা রাজার কানে গেল. তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি?’

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন, তবে ডাকুন অ্যাপোলোদের, ফোর্টিসদের,বিএমবিড়লাদের,ডাকুন যারা পেশেন্টের পকেট থেকে টাকা খিঁচে নেয় এবং ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের ধার ধারে না. জুনিয়র ডাক্তারগুলো পকেট কাটিতে পারে না বলিয়াই মন্দ কথা বলে.’

জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখুনি ভাগিনার গলায় প্ল্যাটিনামের পেন্ডেন্ট চড়িল.


পরিষেবা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন.

একদিন তাই গোয়েঙ্কা টাটা নেওটিয়া লইয়া তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন.

দুকোটির গেটের কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘন্টা এবিপি আনন্দ কাড়া নাকাড়া সাইরেন সিটি দামামা বন্দেমাতরম করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প. অ্যাপোলো ফোর্টিসেরা অ্যাপ্রন পরিয়া, স্টেথো নাড়িয়া প্রেসক্রিপশন পাঠে লাগিলেন. তপন,তাপস,মির্নল,দেবশঙ্কু,দমন আর টাকাতুতো চেয়ারতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল.

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, কান্ডটা দেখিতেছেন?’

মহারাজ বলিলেন, ‘আশ্চর্য! ক্যেত কম নয়!’

ভাগিনা বলিল, ‘শুধু ক্যেত নয়, পেছনে গাপ হয়ে যাওয়া টাকাও কম নাই.

রাজা খুশি হইয়া গেট পার হইয়া যেই লিমুজিনে চড়বেন এমন সময়, জুনিয়র ডাক্তার ছিল এমার্জেন্সির মধ্যে গাঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, ‘ মহারাজ, হাসপাতালটাকে দেখিয়াছেন কি?’

রাজার চমক লাগিল, বলিলেন, ‘ঐ যা! মনে তো ছিল না. হাসপাতালটাকে দেখা হয় নাই.’

ফিরিয়া আসিয়া নারায়ণা কে বলিলেন , ‘হাসপাতালটাকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই.’

দেখা হইল. দেখিয়া বড়ো খুশি. জাঁকজমকটা হাসপাতালের চেয়ে এতো বেশি,যে হাসপাতালটাকে না দেখিলেও চলে. রাজা বুঝিলেন,আয়োজনের ত্রুটি নাই. সুপারস্পেশালিটিতে ডাক্তার নাই, পরিকাঠামো নাই, কেবল রাশি রাশি অ্যাকাউন্ট হইতে রাশি রাশি গান্ধীপাতা ছিঁড়িয়া ফরসেপের ডগা দিয়া হাসপাতালের মুখে ঠাসা হইতেছে. মানবিক চিকিৎসা তো বন্ধই, প্রতিবাদ করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা. দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়.

এবার রাজা লিমুজিন চড়ার সময় বাজারি মিডিয়াকে বলিয়া দিলেন, জুনিয়র ডাক্তারের ইজ্জতের যেন আচ্ছা করিয়া ফালুদা করা হয়.


হাসপাতালটা দিনে দিনে বেসরকারি দস্তুরমত চামার হইয়া উঠিল. সরকার বুঝিল, বেশ আশাজনক. তবু স্বভাবদোষে সুস্থ ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের দিকে হাসপাতাল চায় আর অন্যায় রকমে জনদরদী চিকিৎসা করে. এমন কি, একদিন দেখা যায়, সে তার দৃঢ় মনোবল দিয়া সরকারী চক্রান্তের বিরোধিতার চেষ্টায় আছে.

স্বাস্থ্য দফতর বলিলেন, ‘এ কী বেয়াদবি!’

তখন হাসপাতাল চত্বরে সাসপেনশন বদলি বরখাস্ত লইয়া মির্নল আসিয়া হাজির. কী দুমাদ্দুম পিটানি! হৃদয়হীনতার শিকল তৈরি হইল, হাসপাতালের স‌ৎ মানসিকতাও গেল কাটা.

রাজার পাচাটারা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘এ রাজ্যে হাসপাতালদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয়, কৃতজ্ঞতাও নাই.’

তখন বেসরকারি ভড়ংবাজেরা একহাতে ব্যানার, একহাতে পেশাদারিত্ব লইয়া এমনি কান্ড করিল যাকে বলে পরিষেবা.

মির্নলের পসার বাড়িয়া মির্নলগিন্নির গায়ে ডিজাইনার শাড়ি চড়িল এবং স্বাস্থ্য দফতরের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে বঙ্গবিভূষণ উপাধি দিলেন.


হাসপাতালটা মরিল. কোনকালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই. জুনিয়র ডাক্তার লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘হাসপাতাল মরিয়াছে.’

ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি!’

ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, হাসপাতালটার বেসরকারিকরণ পুরা হইয়াছে.’

রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর মন দিয়ে চিকিৎসা করে?’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
-‘আর কি রোগীর কথা ভাবে?’
-‘না.’
-‘আর কি রোগীর সঙ্গে মানবিক আচরণ করে?’
-‘না.’
-‘সম্মান না পাইলে আর কি চেঁচায়?’
-‘না.’

রাজা বলিলেন, ‘একবার হাসপাতালটাকে আনো তো, দেখি.’

হাসপাতাল আসিল. সঙ্গে মির্নল আসিল, মিডিয়া আসিল, ভড়ংবাজেরা আসিল. রাজা হাসপাতালকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না.
কেবল তার পেটের মধ্যে গান্ধীর শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল.

বাহিরে নবপরিবর্তনের দক্ষিণ হাওয়ায় অভিষেক ঝাগুলি কিডনি ফেলিওরের বেদনায় আরজি করের আকাশ আকুল করিয়া দিল.

বি়.দ্র. সব চরিত্র কাল্পনিক. বাস্তবের সঙ্গে মিল নিতান্তই কাকতালীয়.

জানালাটা

আমার নাম ননা। বাপ মায়ে একটা নাম রেখেছিল বটে, কিন্তু দুটো ন এর মাঝে একটা র উচ্চারণ করতে কেমন জড়িয়ে যায় না? তাই এই নতুন শহরটার কাছে আমি হয়ে গেছি ননা।

পশ্চিম মিদনাপুরের একটা না-গাঁ-না-শহর জায়গায় আমার বাড়ি। ভালোই ছিলাম। জগন্নাথ বিদ্যামন্দিরে পড়তাম। বাপ কাজ করতো লেদ কারখানায়। হঠাৎ একদিন লোকটা দুপুরবেলা ঘর চলে এল। উঠানেই বসে পড়তে যাচ্ছিল, আমি আর মা মিলে ঘরে নিয়ে আসতে গিয়ে দেখি চোখ দুটা কটকটা লাল আর শরীরটা যেন আগুন। জামিলকাকারা বললো, ‘হিটস্টোক’ না কি যেন হয়েছে। ভবা ডাক্তারকে ডাকার আগেই শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
মা আছাড়িপিছাড়ি করে অনেক কাঁদলো। তাতে আর কিই বা হয়! আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, আর পড়াশোনা হবে না আমার দ্বারা। মায়ের পাতলা যেকটা গয়না ছিল, তা দিয়ে কয়েক মাস চলল। তারপরেই শুরু হল পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা। মা বাড়ি বসে শায়া-বেলাউজ তৈরি করে কিছু কিছু পেত।
একদিন দেখলাম পাড়ার গণেশকাকা মাকে এসে কি একটা বলছে, আর মা ঘাড় নেড়ে ‘ঠিকই তো, ঠিকই তো’ বলে যাচ্ছে।
আমি হাবেভাবে বুঝলাম জিনিসটা কি। বললাম না কিছুই। জানতামই এটাই হবে!
তার তিনদিন পরে একটা বিরাট ট্রাঙ্ক ঘষটাতে ঘষটাতে হাওড়া স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখে শুনে চোখ টেরিয়ে গেল! এই না কি কলকাতা! কত ভ্যাঁ-ভোঁ, ঠনরঠনর, খচাৎ খচাৎ- জায়গা বটে একখানা!
কাজ হলো একটা ঘুঁজঘুঁজে অন্ধকার ছাপাখানায়। সকাল ৬টার থেকে ১২ টা তক্ক, আবার ১টা থেকে ৫টা। মাইনে মোটামুটি, তবে প্রথম ছমাস হাফ মাইনে- তখন কাজ শিখতে হবে। একটা জিনিস দেখলাম ভালো, থাকাটার ব্যবস্থা করে রেখেছে। একটা কালোকুলো মেসবাড়ি, ওই বউবাজার মোড়টায় ডাক্তারি হস্টেলটার পিছনে। খারাপ লাগল না, দেশের বাড়িটাও তো এমনিই ছিল।

কাজ শুরু হল. ভোর ৫টায় উঠতে হয়। কয়েকদিন পরই সকালবেলা মুখ ধুতে ধুতে হঠাৎ চোখে পড়ল, এখান থেকে হোস্টেলের বাথরুমটা পরিষ্কার দেখা যায়।
আস্তে আস্তে বাথরুমের জানালাটা আমাকে বেশি বেশি করে টানতে লাগল। ভোরে উঠে দেখতাম, আধভাঙা পাল্লাটা হাট করে খোলা। দাঁত মাজতে মাজতে তাকিয়ে থাকতাম। কাজ থেকে ফিরে এসেও আমাদের রেলিংওয়ালা নড়বড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনজরে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে রাতেরবেলা রান্না করার সময় উনুনের ধোঁয়াতে জানলাটা ঝাপসা হয়ে যেত, চোখ জ্বালা করত; তবু ঘাড় তুলে তুলে দেখতাম।
ওটা যেন আমার বন্ধু হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। কতোজন চান করতে আসতো ওখানে! শুধু ছেলে আর ছেলে। ভোর ৫ টা ১৫তে রোজ একটা মোটামত ছেলে চান করত,পৈতে পরা। চানের পর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানলা দিয়ে গলা বের করে উপর দিকে তাকিয়ে সূর্যমন্ত্র পড়ত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা,ওর চান বাদ পড়ত না। ভাবতাম ওর কি শরীর খারাপ ও করে না!
আরও অনেককে দেখতাম।
বেশিরভাগই দুপুরদিকে চান করত, যখন খেতে আসতাম। আমিও চান করতাম, ওরাও করত। নিজেদের কেমন একই মনে হতো। ওরা যেমনভাবে হাত তুলে সাবান মাখতো, আমিও সেটা দেখে নকল করতাম! একটা খোঁড়া ছেলে ছিল, সে আবার শাওয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে চান করত। একজন ছিল ফরসা, একদম পাতলা করে- সে শীতকালে মাঝে মাঝে আসত চান করতে, আর খুউব লাফাত ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে!
আমরা অনেকেই সেটা দেখে হাসতাম।

কেউ কেউ শুধু গামছা পরে আসতো, কয়েকজন আবার ঢুকে দরজা বন্ধ করে সব খুলে রাখতো। সব দেখে দেখে কেমন মুখস্থ হয়ে গেছিল। সপ্তাহের কোনদিনে কেমন লাইন পড়ে, লোকজন কিভাবে কলের হাতল ভেঙে ফেলে গোবেচারা মুখ করে বেরিয়ে যায় এরকম সব!
মাঝে মাঝে রাত ১টা ২টোর সময় ঘুম না এলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। কোনো কোনোদিন দেখতাম সিগারেটের পুঁটকি আলো আর মোবাইলের আলো দেখা যাচ্ছে। ছেলে হয়েও ছেলেদের এইসব কাজ দেখতে আমার খারাপ লাগত না! চাঁদের আবছা আলোয় আমি সবই বুঝতে পারতাম, কিন্তু ওরা বুঝতেও পারতো না।
মাঝে মাঝে কাউকে বিড়বিড় করে বইহাতে ঘুরতেও দেখতাম। তখন বুঝতে পারতাম, পরীক্ষা চলছে। রাত্রে মোবাইলের আলোজ্বলা বেড়ে যেত। একদিন মেডিকেল কলেজেও যেতে হল, পায়খানার জায়গাটায় প্রচন্ড ব্যথা করছিল; ২টাকা দিয়ে দেখিয়ে ফ্রি ওষুধ নিয়ে এলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে জ্বর-পেটব্যথা হলেই যেতাম, ওখানে অ্যাপ্রন পরা লোকগুলোকে বেশ নিজের মনে হত। যেন সবাই ওই হোস্টেলে থাকে আর সবাই ওই বাথরুমটাতেই চান করে!
এভাবেই ওই জানলাটুকু যেন এই অচেনা শহরে আমার একমাত্র চেনা জায়গা হয়ে উঠেছিল।

এমনিভাবেই একদিন সন্ধ্যেবেলা রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছাপাখানা সেদিন বন্ধ। মালিকের কোথায় যেন বিয়েবাড়ি, তাই আমাদেরও ছুটি।
বেশ ভালো হাওয়া দিচ্ছিল। অভ্যাসবশে তাকিয়েছিলাম ওইদিকে, আর মায়ের কথা ভাবছিলাম। মা কালই ফোন করে বলছিল, নাকি কদিন ধরেই পেটের বাঁদিকে একটা খিঁচ ধরা ব্যথা উঠছে। ভাবছিলাম, এনে একবার দেখিয়ে দেব নাকি এখানে। সে আবার অনেক টাকার ধাক্কা!
হঠাৎ দেখলাম অন্ধকারে একটা ছেলে ঢুকলো। সিগারেট জ্বালালো একটা। তারপর আরেকটা। আরেকটা। আরেকটা।
প্রথমে পাত্তা দিইনি, তারপর প্রায় চল্লিশ মিনিট পরেও দেখলাম জানালার ধারে একটা আগুন জ্বলছে!
অবাক লাগল বেশ। এতোসময় তো কেউ থাকে না। পাগলটাগল নাকি! আস্তে আস্তে দেখলাম, সিগারেটের আগুনটা ছোটো হতে হতে একই জায়গায় নিবে গেল. কেউ ছুঁড়ে ফেলল না! অদ্ভুত ব্যাপার তো! আমার যেন কেমন কেমন লাগছিল। আমি কৌতুহলটা মনে চেপে রেখেই রান্না করতে বসলাম। মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে তাকাচ্ছিলাম ঝুল-কালোর মধ্যে দিয়ে যদি কিছু বোঝা যায়!

রাত্রেবেলা ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়, আমি হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ার ১৫ মিনিট মতন পরেই, দুমম্ করে একটা বিকট আওয়াজ শুনলাম!
ঠিক যেন একটা বিরাট ভারী জিনিস উঁচু থেকে পড়ে গেল!
আমাদের মেসের সবাই বারান্দায় জড়ো হয়ে গেল। দেখি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সবাই বাথরুমে এসে গেছে। প্রচুর আলো জ্বলে উঠেছে। দেখলাম, ভিড়ের সবাই ধরাধরি করে গলায় পেঁচিয়ে থাকা দড়ি সমেত একটা ছেলেকে টানাটানি করে বাথরুমের বাইরে নিয়ে গেল! অনেক হইচই, হট্টগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। শাওয়ারের রডটা থেকে একটু দড়ি তখনো ঝুলছিল।
পরের দিন সকালে মুখে মুখে শুনলাম, নাকি পড়ার আর পরীক্ষার অমানুষিক চাপ সইতে পারেনি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটা। আমারই বয়েসী হবে হয়তো। বাথরুমে ঢুকে ৫টা সিগারেট টেনে মনের জোর জোগাড় করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিল। সেই জীবনটা, যেখানে খুব পরীক্ষা; অনেক পড়তে হয়।
শেষ দেড়ঘন্টা ও একাই ঝুলছিল।

আমি আর জানালাটার দিকে তাকাইনা। ইচ্ছে করে না আর। জানালাটার দিকে তাকালে আমার আর ঘরের কথা মনে পড়ে না।