১
এক যে ছিল হাসপাতাল. সে ছিল মূর্খ. সে চিকিৎসা করিত, রক্ত চুষিত না. রোগীদের রোগ নির্ণয় করিত, সারাইয়া তুলিত, জানিত না পাবলিকের পকেট কীভাবে মারিতে হয়.
রাজা বলিলেন, ‘এমন হাসপাতাল তো কাজে লাগে না, অথচ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ খাইয়া রাজহাটে পকেটমারির বাজারে লোকসান ঘটায়.’
মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘হাসপাতালটাকে পরিষেবা দাও.’
২
রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল হাসপাতালটাকে পরিষেবা দিবার.
বিশেষজ্ঞরা ঘন্টাখানেক বসিয়া অনেক বিচার করিলেন. প্রশ্নটা এই, উক্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানের টাকা না খাওয়ার কারণ কী.
সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য ডিপার্টমেন্টের দোতলা দিয়া হাসপাতাল যে জাল পাতে,সেই জালে বেশি পাবলিক ধরে না. তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া দশতলা সুপারস্পেশালিটি বানাইয়া দেওয়া.
বিশেষজ্ঞরা ফ্রি সাইকেল পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন.
৩
ম্যাকিনটশ বার্ন বসিল বিশাল সুপারস্পেশালিটি বানাইতে. বিল্ডিংটা হইল এমন আশ্চর্য যে,দেখিবার জন্য দেশবিদেশের পেশেন্ট ঝুঁকিয়া পড়িল. কেহ বলে, ‘পরিষেবার একেবারে হদ্দমুদ্দ.’ কেহ বলে, ‘পরিষেবা যদি নাও হয়, সুপারস্পেশালিটি তো হইল. হাসপাতালের কী কপাল!’
ম্যাকিনটশ বার্ন সুইস ব্যাঙ্ক বোঝাই করিয়া কালো টাকা পাইল. খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল দুবাই এর দিকে.
ফোর্টিস বসিলেন হাসপাতালকে পরিষেবা শিখাইতে. হুক্কা লইয়া বলিলেন, ‘অল্প চাকচিক্যের কর্ম নয়.’
ভাগিনা তখন বেসরকারি ভড়ংবাজদের তলব করিলেন. তারা চাকচিক্যের নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল. যে দেখিল সেই বলিল, ‘সাবাস! পরিষেবা আর ধরে না!’
ভড়ংবাজের দল শিভাস রিগাল লইল অডি বোঝাই করিয়া, তখনই ফ্ল্যাটের দিকে দৌড় দিল. তাদের মদের আসরে আর টানাটানি রহিল না.
অনেক দামের সুপারস্পেশালিটিটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই. এক্সটেনশন তো লাগিয়াই আছে. তারপরে বেসমেন্ট লিফট কারপার্কিং এর ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, ’উন্নতি হইতেছে.’
গ্রুপ ডি লাগিল বিস্তর এবং তাদের ওপর নজর রাখিবার জন্য গ্রুপ সি লাগিল আরও বিস্তর. তারা মাস মাস মুঠা মুঠা গুটখা পাইয়া গাল বোঝাই করিল.
তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জে গদি পাতিয়া বসিল.
৪
সংসারে অন্য অভাব অনেক অাছে, কেবল জুনিয়র ডাক্তার আছে যথেষ্ট. তারা বলিল, ‘সুপারস্পেশালিটিটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু হাসপাতালটার খবর কেহ রাখে না.’
কথাটা রাজার কানে গেল. তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি?’
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন, তবে ডাকুন অ্যাপোলোদের, ফোর্টিসদের,বিএমবিড়লাদের,ডাকুন যারা পেশেন্টের পকেট থেকে টাকা খিঁচে নেয় এবং ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের ধার ধারে না. জুনিয়র ডাক্তারগুলো পকেট কাটিতে পারে না বলিয়াই মন্দ কথা বলে.’
জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখুনি ভাগিনার গলায় প্ল্যাটিনামের পেন্ডেন্ট চড়িল.
৫
পরিষেবা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন.
একদিন তাই গোয়েঙ্কা টাটা নেওটিয়া লইয়া তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন.
দুকোটির গেটের কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘন্টা এবিপি আনন্দ কাড়া নাকাড়া সাইরেন সিটি দামামা বন্দেমাতরম করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প. অ্যাপোলো ফোর্টিসেরা অ্যাপ্রন পরিয়া, স্টেথো নাড়িয়া প্রেসক্রিপশন পাঠে লাগিলেন. তপন,তাপস,মির্নল,দেবশঙ্কু,দমন আর টাকাতুতো চেয়ারতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল.
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, কান্ডটা দেখিতেছেন?’
মহারাজ বলিলেন, ‘আশ্চর্য! ক্যেত কম নয়!’
ভাগিনা বলিল, ‘শুধু ক্যেত নয়, পেছনে গাপ হয়ে যাওয়া টাকাও কম নাই.
রাজা খুশি হইয়া গেট পার হইয়া যেই লিমুজিনে চড়বেন এমন সময়, জুনিয়র ডাক্তার ছিল এমার্জেন্সির মধ্যে গাঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, ‘ মহারাজ, হাসপাতালটাকে দেখিয়াছেন কি?’
রাজার চমক লাগিল, বলিলেন, ‘ঐ যা! মনে তো ছিল না. হাসপাতালটাকে দেখা হয় নাই.’
ফিরিয়া আসিয়া নারায়ণা কে বলিলেন , ‘হাসপাতালটাকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই.’
দেখা হইল. দেখিয়া বড়ো খুশি. জাঁকজমকটা হাসপাতালের চেয়ে এতো বেশি,যে হাসপাতালটাকে না দেখিলেও চলে. রাজা বুঝিলেন,আয়োজনের ত্রুটি নাই. সুপারস্পেশালিটিতে ডাক্তার নাই, পরিকাঠামো নাই, কেবল রাশি রাশি অ্যাকাউন্ট হইতে রাশি রাশি গান্ধীপাতা ছিঁড়িয়া ফরসেপের ডগা দিয়া হাসপাতালের মুখে ঠাসা হইতেছে. মানবিক চিকিৎসা তো বন্ধই, প্রতিবাদ করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা. দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়.
এবার রাজা লিমুজিন চড়ার সময় বাজারি মিডিয়াকে বলিয়া দিলেন, জুনিয়র ডাক্তারের ইজ্জতের যেন আচ্ছা করিয়া ফালুদা করা হয়.
৬
হাসপাতালটা দিনে দিনে বেসরকারি দস্তুরমত চামার হইয়া উঠিল. সরকার বুঝিল, বেশ আশাজনক. তবু স্বভাবদোষে সুস্থ ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের দিকে হাসপাতাল চায় আর অন্যায় রকমে জনদরদী চিকিৎসা করে. এমন কি, একদিন দেখা যায়, সে তার দৃঢ় মনোবল দিয়া সরকারী চক্রান্তের বিরোধিতার চেষ্টায় আছে.
স্বাস্থ্য দফতর বলিলেন, ‘এ কী বেয়াদবি!’
তখন হাসপাতাল চত্বরে সাসপেনশন বদলি বরখাস্ত লইয়া মির্নল আসিয়া হাজির. কী দুমাদ্দুম পিটানি! হৃদয়হীনতার শিকল তৈরি হইল, হাসপাতালের সৎ মানসিকতাও গেল কাটা.
রাজার পাচাটারা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘এ রাজ্যে হাসপাতালদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয়, কৃতজ্ঞতাও নাই.’
তখন বেসরকারি ভড়ংবাজেরা একহাতে ব্যানার, একহাতে পেশাদারিত্ব লইয়া এমনি কান্ড করিল যাকে বলে পরিষেবা.
মির্নলের পসার বাড়িয়া মির্নলগিন্নির গায়ে ডিজাইনার শাড়ি চড়িল এবং স্বাস্থ্য দফতরের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে বঙ্গবিভূষণ উপাধি দিলেন.
৭
হাসপাতালটা মরিল. কোনকালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই. জুনিয়র ডাক্তার লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘হাসপাতাল মরিয়াছে.’
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি!’
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, হাসপাতালটার বেসরকারিকরণ পুরা হইয়াছে.’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর মন দিয়ে চিকিৎসা করে?’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
-‘আর কি রোগীর কথা ভাবে?’
-‘না.’
-‘আর কি রোগীর সঙ্গে মানবিক আচরণ করে?’
-‘না.’
-‘সম্মান না পাইলে আর কি চেঁচায়?’
-‘না.’
রাজা বলিলেন, ‘একবার হাসপাতালটাকে আনো তো, দেখি.’
হাসপাতাল আসিল. সঙ্গে মির্নল আসিল, মিডিয়া আসিল, ভড়ংবাজেরা আসিল. রাজা হাসপাতালকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না.
কেবল তার পেটের মধ্যে গান্ধীর শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল.
বাহিরে নবপরিবর্তনের দক্ষিণ হাওয়ায় অভিষেক ঝাগুলি কিডনি ফেলিওরের বেদনায় আরজি করের আকাশ আকুল করিয়া দিল.
বি়.দ্র. সব চরিত্র কাল্পনিক. বাস্তবের সঙ্গে মিল নিতান্তই কাকতালীয়.