রাতের কথা

তুই,
হ্যাঁ, তুই। তোকেই বলছি। শেষরাতের সব জড়ানো কথা তো আসলে তোকেই বলা। কারণ জানি, রাত বললেই তুই আর আমি চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে উঠবো। রাত বলতে মানুষ বোঝে শরীর। আর আমরা বুঝি রাজত্ব। তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, মানুষ মানুষকে খোঁজে না। তুই সিগারেটের ধোঁয়াটা মুখে রেখে তাকালি। আমি বললাম, খোঁজে স্মৃতি। তারপর তুই ব্যস্ত হয়ে পড়লি ধোঁয়া ছাড়তে, ঠিক যেমন করে মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায়। সত্যি। মানুষের নামে তো স্মৃতিই ধরে বেড়াই। একসাথে একটু পথ চলাও তাই তোর। দূর থেকে দেখতে পেয়ে চোখের ঝিলিকও তোর। এই শান্ত শহরের বেভুল পাগলামিও তোর নামে লেখা। তোর, বকলমে আমার।
রাস্তাগুলো দরকার। হাঁটা দরকার। রোদ দরকার। টপটপিয়ে ঘাম সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু সময়ে সময়ে লম্বা গাছগুলোর ছায়াটা বড্ডো বেশি নিজের প্রাপ্য ধরে নিই। তারা ত্যাগের আনন্দে লম্বা হতে থাকে, কিন্তু ছায়াগুলো থেকে যায় একইরকম। না বড়ো, না ছোটো। ছায়াদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কেন করি না আমরা? জানিনা তাদের ছাড়া কীভাবে জিরোতাম এই প্রতিদিনের রোদে। তাদের নরম বন্ধুত্ব পাতা হয়ে ঝরে পড়ে টুপটাপ। কিন্তু ছায়া বড়ো হয়ে অন্ধকার করে দেয় না চলার রাস্তা।
তুই জানিস। সব কথা বলতে হয় না। আবার কতো কথা বলতে হয়। যার সঙ্গে বলি “আমি মুটেমজুর মানুষ, কবিতা পোষায় না”, তার সাথেই পাশাপাশি বসে রাতের চাতালে নীরব কবিতা পড়ি। হয়, এসবও হয়। কতোবারই তো হয়ে এসেছে। ভালোবাসা বন্ধুত্বের সমাজ বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা হেলায় কেটেছি কতোবার। কখনো উত্তেজনায়, কখনো আত্মবিশ্বাসে, কখনো কেবলই মুহূর্তের তাগিদে। সবসময় হাত ধরতেও হয়নি। হাত ছেড়ে নিজের পায়ে হেঁটে যাওয়া তো শিখতে হয়। আর একলাপনার নেশায় সে ক্লাস কখনো আমার, কখনো তোর। তোর আমার হাতে হাত মানে ব্যারিকেড। সে হাতে কাস্তেও থাকে, হাতুড়িও। দুজনেই শিখি। গড়ি। তার থেকেও দরকারি, ভাঙি। হাতুড়িটা তাই খুব কাজের।
ভাঙতে তো হবেই। না ভাঙলে গড়বো কী করে? তাই ভেঙে যাই। পায়ের শব্দের আওয়াজ কমতে থাকলে বুঝি, বিশ্রাম শেষ। নতুন হাঁটার সময় এগিয়ে আসছে। এই এটুকু পথে কম হাত ধরলাম না। নরম হাত। শক্ত হাত। ভিজে হাত। শুকনো হাত। কিন্তু যখন যে হাত পেয়েছি, তাদের সাথেই ভাঙা-গড়ার খেলা করেছি। আদর্শবিরোধ, মতবিরোধ, পথবিরোধ এরকম শত শত বিরোধে পিছিয়ে যাইনি। এড়িয়ে যাইনি। দুজনেই হাতে তুলেছি হাতুড়ি। ঠকঠকাং শব্দে রাত ভরিয়েছি।
কিন্তু ওরকম রাতও কম কাটাইনি। স্মৃতিমেদুর বিলাসিতায় টুকরো টুকরো কথার রাত। যার বেশিরভাগটাই পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ। আর ঠান্ডা বাতাসে প্রাণখোলা হাসির দল সেসব রাতের গল্প নিয়ে চলে গেছে কাজে লাগবে না ভেবে। ভবিষ্যৎচারণের অলসতা, স্ববিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার আবেগ নিয়ে সেসব কথা বরং থাক।
কথায় বলে, যার কিছু নেই তার আশা আছে। আমি আর তুই জানি, আশাদত্যির বিরুদ্ধে সরু কঞ্চি জোগাড় করে রোগাপ্যাংলা ছেলেটাকেই যেতে হয় সাহস করে। তাই ভোররাতে সাহসের কথা হয়। আর, যার কঞ্চি নেই, তার গান আছে। ঠোঁটে ঠোঁটে, শিসে শিসে, চোখে চোখে আমার তোর গানে হাজার মানুষের ভালোবাসা নিজেদের লড়াই খুঁজে পায়। সেই গানগুলো বেঁচে থাক। আমরা বরং এগিয়ে চলি।

এলাম। অতিনিজস্ব নিহিলিজমের ফাঁকে, ব্যস্ত প্রতিজ্ঞার অবসরে, পাল্টে যাওয়া দিনগুলোর জোরাজুরির মাঝে কোনো একদিন তোর মত ছায়া পেলে খুঁজেপেতে আমাদের ছায়াটাও বের করবো। মেলাবো না। কেবল পাশের ঘাসে পড়ে থাকবে।
ততদিন,
তোর কমরেড

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান