যেমনটা কখনো হয়না

 

ছোটোবেলায় আমাদের একটা স্কুল ছিল। এই স্কুল শব্দটার সাথে ছোটোবেলাটাই মানায় ভালো। যেমন মানিয়ে যেত গরমকালের লম্বা আটঘন্টার দুপুরগুলো। টেনেটুনে এঁটেউঁটে খাপ খেয়ে যেত ঠিকই।
স্কুলটার স্কুল হবার সবরকমই যোগ্যতা ছিল। দুতিনটে মাঠ ছিল। পুরোনো বড় বড় ক্লাসরুম ছিল। চোরকাঁটার জঙ্গল ছিল, যেখানে ফুটবল আনতে গেলেই মোজা আর খাকি প্যান্ট ভর্তি হয়ে যেত চোরকাঁটায়। যেটাকে বলে জুরগুন্ডা। মাঠে প্রচুর ধুলো ছিল। সাইকেল করে বাড়ি ফেরার সময় জুতোয় কিচকিচ করতো। ভাঙা কোণের বাথরুমে ইঁটের লাল টুকরো দিয়ে অনেক কিছু লেখা ছিল। মনিটরদের নাম লেখা ছিল। শিক্ষক দিবসের বিকেলে ভারভারিক্কি স্যারের হাতে বিরাট ওভারবাউন্ডারি ছিল। নিলডাউন ছিল। পরীক্ষায় অঙ্ক ছেড়ে এসে কান্না ছিল। একটা হেডস্যারের অফিস ছিল। হেডমাস্টারকে আড়ালে হেডু বলা ছিল। একটা গোবরে ভর্তি সাইকেল স্ট্যান্ড ছিল; যাতে সাইকেল থাকতো কম, গরু থাকতো বেশি। একটা ক্লাসপালানোর আমতলা ছিল। একটা সাইকেল দিয়ে ঘিরে ক্রিকেট খেলার নিমতলা ছিল। একটা ভূতের গল্পজড়ানো শাল মেহগনির জঙ্গলও ছিল।
আর ছিল নানারকমের বন্ধু। উরেবাব্বা। ছোটোবেলায় যেদিন একসাথে এতোগুলো লোক গিয়ে ক্লাস থ্রির ঘরটায় বসে পড়লাম, সেদিন সবাইকে একইরকম মনে হয়েছিল। সব বেঞ্চে চারজন। আমি শেষ বেঞ্চে। কারণ শেষে এসেছি, দৌড়তে দৌড়তে। রিক্সাকাকু দেরি করে ফেলেছে। তাড়াতাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আবার জানালার পাল্লায় ধাক্কা খেয়েছি। প্রথমদিনেই। তাই প্রথমদিনেই সিকিমাথা আলু নিয়ে আমি বসে আছি শেষ বেঞ্চে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম চোখ গেলো ব্ল্যাকবোর্ডে। লেখা আছ‌ে, বড়ো বড়ো করে, ‘১০০ থেকে ১ লেখো উল্টোদিকে।’ আমি খাতা পেন বের করে ৭০ পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখলাম, তিননম্বর বেঞ্চ থেকে একটা পাতলা ছেলে উঠে গেল স্যারের কাছে। শুধু আমি না, গোটা ক্লাসই অবাক। স্যারও। পাশ থেকে কে একজন ফিসফিস করে বললো— ‘ঋজু সরকার। ফার্স্ট বয়। অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হয়েছে।’
প্রথমদিনেই একজন আলাদা হয়ে গেল।
নামতা, বানান, ব্যাকরণের ভিড়েই দিনগুলো কেটে যেত টুকটুক করে। ছোটোবেলা থেকেই ঘর ভালো লাগতো না। তখন ঘর পালিয়ে যাবার একমাত্র রাস্তা ছিল স্কুলবাড়িটা। প্রবল বর্ষাতেও ভিজতে ভিজতে স্কুল, আবার গ্রীষ্মের ছুটির আগে শেষ দিনের ক্রিকেটের জন্যও স্কুল।
ক্লাসমেটরাও আস্তে আস্তে বন্ধু হতে থাকলো। থ্রি থেকে ফোর। ফোর থেকে ফাইভ।
ততদিনে মাঝারি ছেলে হয়ে গেছি। মাঝামাঝি বেঞ্চে বসতাম। হাফিয়ার্লি হোক বা অ্যানুয়ালি, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড কোনোদিনই হতাম না। ভয় ছিল। পাছে স্ট্যান্ড করলে লোকে পরের বারও স্ট্যান্ড করতে বলে। আবার শেষবেঞ্চও তেমন টানতো না। ভয় ছিল। পাছে ফেল করে গেলে লোকে হাসে। তখন থেকেই আদর্শ মধ্যবিত্তের ভয় জাপটে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। শীতের দুপুরে কিপারের বাঁপাশে দাঁড়াবার সময় বেগুনি মাফলার যেমন প্যাঁচ মেরে কোমরে ঝুলত, সেরকমই সঙ্গী ছিল এই ভয়টা।
ফার্স্টবয় ছিল ঋজু সরকার। সেকেন্ড বয় উন্মেষ নামের একটা ছোট্টোখাট্টো ছেলে। ক্লাসে পড়া ধরতেন স্যার। একটা ড্যাম্প ধরা ক্লাসরুমে। বিকেল হলে একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসতো। আর আমরা পা দিয়ে ব্যাগের শেষ চেনে রাখা স্টাম্পার বলটাকে নাড়াতে নাড়াতে ভাবতাম, কখন সিক্সথ্ পিরিয়ডটা শেষ হবে। স্যারের কোশ্চেন জিজ্ঞেস করার বাই চাপলে সাঁৎলে নেমে যেতাম বেঞ্চের তলায়। মাঝে মাঝেই অতিবুদ্ধির জেরে জুটে যেতো কানচাপড় বা মাথায় চাঁটি। সেইসময়েও ঋজু, উন্মেষরা উত্তর দিয়ে যেতো। কতো কতো প্রশ্ন। তার সুন্দর গুছোনো উত্তর।
আর আমরা কাটাকুটি খেলতাম শেষ পাতায়। কেউ ক্রস। কেউ গোল্লা।
পিছনের বেঞ্চেও কতো কতো লোক ছিল। অমিত, বিপ্লব, গৌর। আরো কতো কারা। পিছনের দিকের নাম তো, ভুলে যাওয়া যায় সহজেই। কোনো অজুহাত ছাড়াই। তারা ছিল খারাপ ছেলে। অমিতকে সন্ধ্যের পর নাকি বাইকের পেছনে দেখা যেত। বিপ্লবের হোমওয়ার্কের খাতা স্যার একবার গোটা ক্লাসের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ কোম্পানির সেই জিলজিলে খাতা পড়েছিল ধুলোয় অনেকক্ষণ। সেই থেকে বিপ্লবের নাম হয়ে গেল চ্যালেঞ্জ। ওকে আর কেউ বিপ্লব বলে ডাকতো না।
বিপ্লব যখন স্কুলে ঢুকতো, তখন তার সাইকেলটাকে ঠেলে দিতো মাঠে ঢোকার সময়ই। সাইকেল একা আসত গড়গড়িয়ে গোটা মাঠ। বিপ্লব আসতো পেছনে হেঁটে। একদিনও প্রেয়ার করতো না। অমিত ইউনিট টেস্টে পেত কুড়ির মতো পাঁচ। স্যার বাঁকা হাসি ছাড়া ওর খাতা ফেরত দিতো না। কিন্তু সেই অমিতই লাট্টু খেলায় সবাইকে হারিয়ে দিত। গৌর মাসে তিরিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিন ক্লাসে আসতো। ডাইরিতে লম্বা লম্বা লাল দাগ পড়তো। কিন্তু ক্রিকেট টুর্নামেন্টের স্পিন বোলিংয়ে গৌর ছাড়া আর কেউ ছিল না!
ক্লাস বাড়তে লাগলো আমাদের। আমাদের বেঞ্চও মাঝ থেকে সরতে সরতে শেষের দিকে যেতে লাগলো।

এরকমই একটা ছেলে ছিল। পেছনের বেঞ্চে বসতো। মাসে দশদিন আসতো। ডাইরিও আনতো না। স্যার নামপ্রেজেন্টের পর ডাইরি না আনার কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ‘হারায় গেছে সার।’ বলেই চুপচাপ গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে যেত। স্যার রেগেমেগে বলতেন, ‘বাবাকে বলবি দেখা করতে। কালকেই। হেডমাস্টারের ঘরে।’ রাজশেখর বলতো, ‘আসতে পারবেক নাই সার। বাপ দুধ বেচে। সময় করতে পারবেক নাই দুফুরদিকে।’
হ্যাঁ, ছেলেটার নাম ছিল রাজশেখর। মনে আছে। কোঁকড়ানো চুল। কালো গায়ের রঙ। দাঁতগুলো সাদা। পড়তো বি সেকশনে। বি সেকশনের সাথে আবার আমাদের এ সেকশনের তেল-পিঁয়াজের সম্পর্ক। এমনিতে খুব ভালো ব্যবহার, কিন্তু গরম হলে চিড়বিড় করে ওঠে দুতরফই। বছরে গরম হওয়ার কয়েকটা বাঁধাধরা সময় ছিল। যেমন অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট। যেমন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। যেমন ফুটবল ম্যাচ।
সেরকমই একটা ক্রিকেট ম্যাচ। ক্লাস সেভেন তখন আমাদের। ডে স্কুল হয়ে গেছে। সাইকেল চেপে স্কুল আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। সেইসব সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে আমরা মাঠের ধারে বসে রয়েছি। এ সেকশন ব্যাটিং। বি সেকশন বোলিং। তিন ওভার হয়েছে। তাতেই ৪০ রান উঠে গেছে। অনীশ নামের একটা ছেলে লেগস্পিন করতে এসেছিল। তাকে দুটো ছয় আর একটা চার পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়েছে। আমাদের মন খুশি খুশি। আমরা স্কোরিং এর খাতায় তিন নম্বর ওভারের শেষ বলের ছয়টা লিখছি, ওমনি শুনি হইহই শব্দ গোটা মাঠে। দেখলাম ব্যাটিং এন্ডের মহারথী মুখ চেপে পিচে বসে পড়েছেন। শুনলাম নাকি ফোর্থ ওভারের প্রথম বলেই এক পেসার এসে সরাসরি বল ছুঁড়েছে ব্যাটসম্যানের থুতনি লক্ষ্য করে। আমরা তখন এরকম বলকে বলতাম ‘বিমার’। আমার দেখা প্রথম বিমার। সেই ওভারটাতেই তারপর প্রথম হ্যাট্রিক দেখলাম। একটা বোল্ড। উইকেটটা কিপারের পায়ের কাছ পর্যন্ত ছিটকে গেছল। পরের দুটো ক্যাচ। ম্যাচটা জিতে গেছল বি সেকশন। আমরা নক আউট হয়ে গেছলাম।
বি সেকশনের পরের ম্যাচ ছিল সেমিফাইনাল। ম্যাচটা হেরে গেছিল ওরা। হেরে যাবার পর ঘামে ভেজা জার্সি পরেই রাজীব প্রীতমরা অনেক গাল দিয়েছিল রাজশেখরকে। রাজশেখর আসেনি সেদিন। সবাই বার বার বলা সত্ত্বেও। বাপের সাথে দুধ বেচতে গেছল।
সেই প্রথম চিনলাম রাজশেখরকে।
তারপর আস্তে আস্তে ক্লাস পেরিয়ে যেতে থাকলো। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি। ছায়া প্রকাশনী, টিউশনি। মাধ্যমিক তখন আর একবছর। সবাই বলতো, ‘জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা বাবা। পড় এখন থেকে ভালো করে।’ রাজশেখরকে মাঝে মাঝে দেখতাম একা দুপুরের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তখন ম্যাপ পয়েন্টিং করতাম। অন্য কোনো দেশের মাঠে পেন্সিলের দাগ পড়তো।
রাজশেখরকে নিয়ে আবার একটা হইচই হল। ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ারলির পরেই। ফোর্থ পিরিয়ড শেষ করে বেরোতেই শুনলাম, রাজশেখরকে নাকি জঙ্গলের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। দিন দশ পর আবার যে কে সেই। জিজ্ঞেস করতে বললো নাকি একটা চারা পুঁততে গেছল পুকুরপাড়টায়।
হ্যাঁ, দুমাস আগেই হেডস্যারের নির্দেশে একটা পুকুর খোঁড়া হয়েছিল স্কুলে। শুনতাম নাকি মাছ চাষ হবে। রাজশেখরের মনে হয়েছিল, ‘পুকুরের পাশে গাছ না থাকলে ন্যাড়া লাগবেক নাই পুকুরটা?’

আমাদের মাধ্যমিক চলে এল। টেস্ট শেষ। টেস্টের খাতা দেখতে গেছলাম স্কুল। সাইকেলের তালা খুলবার সময় রাজশেখরের সঙ্গে দেখা। রাজশেখরের তখন টেনেটুনে সবে এইট। অ্যানুয়াল পরীক্ষা ওরও। বলল দেবে না। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘দিলি নাই। পরে দিব।’
তখন অতো মাথা ঘামাবার সময় কোথায়? টেস্টপেপার, প্র্যাকটিস চলছে। ঋজুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে আমিও যাচ্ছি। সবাই কঠিন কঠিন প্রশ্ন খোঁজে টেস্টপেপারে, কোশ্চেন ব্যাঙ্কে। উত্তরও।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। সবাই আস্তে আস্তে দুদলে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। ইঞ্জিনিয়ারিং নইলে মেডিক্যাল। অঙ্কটা পারতাম না তেমন, তাই আমিও ভিড়ে গেলাম মেডিক্যালের দলে। লোকজন আবার বলতে থাকল, ‘জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বাবা। সবচেয়ে ক্রুশিয়াল দুটো বছর।’ আবার শুরু হলো ভয় পাওয়া। জয়েন্ট বেসড কোচিং। প্রতিযোগিতা আর রেষারেষি চলতে থাকল সবার মধ্যেই। স্কুল যাওয়া কমিয়ে সবাই ঘরে পড়তে লাগলো বেশি বেশি করে। স্কুলে তেমন পড়া হয় না।
স্কুল গেলেও টিফিনের সময় আর কেউ ব্যাট বার করতো না। এমসিকিউ করতো মোটা বই বের করে। আমরা, মাঝারি বেঞ্চের দল, মাঝে মাঝে খেলতে নামতাম। লোক কম হতো। টিম ছোটো হতো। এরকমই একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা হল রাজশেখরের সাথে। দুধের ক্যান চাপিয়ে যাচ্ছে বেলগুমা পুলিশ লাইনের দিকে। দেখা হতেই সাইকেল থামিয়ে একগাল হাসি দিল। আমরা ৬-৭ জন একসাথে ফিরছিলাম। সবাই মিলে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন চলছে পড়াশুনো। বলল এবছর মাধ্যমিক। কিন্তু দেবে না। কারণটা বললো ভারি অদ্ভুত হেসে, ‘স্কুলটা ছাড়ি দিতে মন করছে নাই। স্কুলটাই ভালো লাগে।’
আমাদের উচ্চমাধ্যমিক। টেস্টের আগের শেষ দিন ক্লাস। অফিশিয়ালি, স্কুলে আমাদের শেষ দিন। মণীশ একটা ক্যামেরা এনেছে। সবার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে ক্লাসজুড়ে।
আমি জানালা দিয়ে আনমনে দেখছিলাম, রাজশেখর কয়েকটা বাচ্চা ছেলের সাথে শর্টপিচ খেলছে। হঠাৎ আউট হয়ে গেল।

স্কুল শেষ হবার পরে সবাই বলে, ফিরে আসবো। কলেজের প্রথম কয়েক বছর ঘর এলে স্কুল যেতামও। সেই সাইকেলটা নিয়েই।
থার্ড ইয়ারে সেরকমই একবার স্কুল গেছলাম। স্যারদের সঙ্গে দেখা করে ফিরছি, দেখলাম মাঠের কোণে একটা নেভিব্লু সোয়েটার পরা ছেলে কার একটা সাইকেলের পাম্প খুলে দিচ্ছে। সামনে যেতেই ছেলেটা একগাল হাসলো। রাজশেখর। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছিস রে?’ বললো, ‘ছিলাটা আমার মাকে গাল দিয়েছে সবার সামনে। পাম্পটো খুলে দিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘তোর মা?’
বললো, ‘কবে মইরে গেছে। হায় করেছে।’
রাজশেখর তখনো ইলেভেনে পড়ে। আর্টস নিয়ে। ফেরার আগে বললো, ‘স্কুলটা ছাইড়ে কুথায় যাবো বল? তোরা আসবি, দেখা করবি। আমি ঠিক থেকে যাবো ইখানে।’

আমার বয়স হয়ে গেল ত্রিশ বছর। স্কুল যাইনা বহুদিন। সাইকেলটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল, বাবা কাকে একটা বিক্রি করে দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা সবাই আছে অবশ্য। ফেসবুকে দেখতে পাই প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করলে। আড্ডা মারাটা আর হয়না। সময়ই ম্যাচ করে না কারোর। কালেভদ্রে ঘর এলেও আর কাউকে ফোন করে ডাকা হয়ে ওঠেনা।
স্কুলটাও পাল্টে গেছে। স্যারেরা প্রায় কেউই আর নেই। সবাই নতুন মুখ। পুরোনো লাল ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিংগুলো ভেঙে নতুন বিল্ডিং উঠেছে। স্কুলের দেওয়ালে কাঁটাতার লেগেছে।
হঠাৎ একদিন স্কুলের সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে ফিরছি। দেখি একটা চেনা মুখ মেন গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করছে।
রাজশেখর বললো, ‘এখন ঘন্টি বাজাই স্কুলে। আমি ঘন্টি না দিলে স্কুল ছুটি হবেক নাই।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুলেই রয়ে গেলি?’
বললো, ‘স্কুলটা ছেড়ে কুথায় যাবো বল? স্কুলটা ছাড়তে মন করে নাই। তোরা সব চলে গেলি, স্কুলটাকে কে দেখবেক বল?’ বলেই হাসলো। একগাল হাসি।

আমি বাইক নিয়ে চলে এলাম।
পেছনদিক থেকে স্কুলের গেটটা বন্ধ হয়ে যাবার আওয়াজ পেলাম।

রাতের কথা

তুই,
হ্যাঁ, তুই। তোকেই বলছি। শেষরাতের সব জড়ানো কথা তো আসলে তোকেই বলা। কারণ জানি, রাত বললেই তুই আর আমি চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে উঠবো। রাত বলতে মানুষ বোঝে শরীর। আর আমরা বুঝি রাজত্ব। তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, মানুষ মানুষকে খোঁজে না। তুই সিগারেটের ধোঁয়াটা মুখে রেখে তাকালি। আমি বললাম, খোঁজে স্মৃতি। তারপর তুই ব্যস্ত হয়ে পড়লি ধোঁয়া ছাড়তে, ঠিক যেমন করে মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায়। সত্যি। মানুষের নামে তো স্মৃতিই ধরে বেড়াই। একসাথে একটু পথ চলাও তাই তোর। দূর থেকে দেখতে পেয়ে চোখের ঝিলিকও তোর। এই শান্ত শহরের বেভুল পাগলামিও তোর নামে লেখা। তোর, বকলমে আমার।
রাস্তাগুলো দরকার। হাঁটা দরকার। রোদ দরকার। টপটপিয়ে ঘাম সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু সময়ে সময়ে লম্বা গাছগুলোর ছায়াটা বড্ডো বেশি নিজের প্রাপ্য ধরে নিই। তারা ত্যাগের আনন্দে লম্বা হতে থাকে, কিন্তু ছায়াগুলো থেকে যায় একইরকম। না বড়ো, না ছোটো। ছায়াদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কেন করি না আমরা? জানিনা তাদের ছাড়া কীভাবে জিরোতাম এই প্রতিদিনের রোদে। তাদের নরম বন্ধুত্ব পাতা হয়ে ঝরে পড়ে টুপটাপ। কিন্তু ছায়া বড়ো হয়ে অন্ধকার করে দেয় না চলার রাস্তা।
তুই জানিস। সব কথা বলতে হয় না। আবার কতো কথা বলতে হয়। যার সঙ্গে বলি “আমি মুটেমজুর মানুষ, কবিতা পোষায় না”, তার সাথেই পাশাপাশি বসে রাতের চাতালে নীরব কবিতা পড়ি। হয়, এসবও হয়। কতোবারই তো হয়ে এসেছে। ভালোবাসা বন্ধুত্বের সমাজ বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা হেলায় কেটেছি কতোবার। কখনো উত্তেজনায়, কখনো আত্মবিশ্বাসে, কখনো কেবলই মুহূর্তের তাগিদে। সবসময় হাত ধরতেও হয়নি। হাত ছেড়ে নিজের পায়ে হেঁটে যাওয়া তো শিখতে হয়। আর একলাপনার নেশায় সে ক্লাস কখনো আমার, কখনো তোর। তোর আমার হাতে হাত মানে ব্যারিকেড। সে হাতে কাস্তেও থাকে, হাতুড়িও। দুজনেই শিখি। গড়ি। তার থেকেও দরকারি, ভাঙি। হাতুড়িটা তাই খুব কাজের।
ভাঙতে তো হবেই। না ভাঙলে গড়বো কী করে? তাই ভেঙে যাই। পায়ের শব্দের আওয়াজ কমতে থাকলে বুঝি, বিশ্রাম শেষ। নতুন হাঁটার সময় এগিয়ে আসছে। এই এটুকু পথে কম হাত ধরলাম না। নরম হাত। শক্ত হাত। ভিজে হাত। শুকনো হাত। কিন্তু যখন যে হাত পেয়েছি, তাদের সাথেই ভাঙা-গড়ার খেলা করেছি। আদর্শবিরোধ, মতবিরোধ, পথবিরোধ এরকম শত শত বিরোধে পিছিয়ে যাইনি। এড়িয়ে যাইনি। দুজনেই হাতে তুলেছি হাতুড়ি। ঠকঠকাং শব্দে রাত ভরিয়েছি।
কিন্তু ওরকম রাতও কম কাটাইনি। স্মৃতিমেদুর বিলাসিতায় টুকরো টুকরো কথার রাত। যার বেশিরভাগটাই পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ। আর ঠান্ডা বাতাসে প্রাণখোলা হাসির দল সেসব রাতের গল্প নিয়ে চলে গেছে কাজে লাগবে না ভেবে। ভবিষ্যৎচারণের অলসতা, স্ববিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার আবেগ নিয়ে সেসব কথা বরং থাক।
কথায় বলে, যার কিছু নেই তার আশা আছে। আমি আর তুই জানি, আশাদত্যির বিরুদ্ধে সরু কঞ্চি জোগাড় করে রোগাপ্যাংলা ছেলেটাকেই যেতে হয় সাহস করে। তাই ভোররাতে সাহসের কথা হয়। আর, যার কঞ্চি নেই, তার গান আছে। ঠোঁটে ঠোঁটে, শিসে শিসে, চোখে চোখে আমার তোর গানে হাজার মানুষের ভালোবাসা নিজেদের লড়াই খুঁজে পায়। সেই গানগুলো বেঁচে থাক। আমরা বরং এগিয়ে চলি।

এলাম। অতিনিজস্ব নিহিলিজমের ফাঁকে, ব্যস্ত প্রতিজ্ঞার অবসরে, পাল্টে যাওয়া দিনগুলোর জোরাজুরির মাঝে কোনো একদিন তোর মত ছায়া পেলে খুঁজেপেতে আমাদের ছায়াটাও বের করবো। মেলাবো না। কেবল পাশের ঘাসে পড়ে থাকবে।
ততদিন,
তোর কমরেড

টিরেনযাত্রা

ট্রেনে বসে আছি। ১২টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম। লোকে ঘুম থেকে উঠে হাই তোলে, আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলি। যত ভোর ভোরই উঠি না কেন, এই নীল-সাদা পেষ্ট দিয়ে মিনিমাম আধ ঘন্টা দাঁত না মাজলে আমার ঠিক ঘুমটা ভাঙতে চায় না। তাই উঠতে লেট। ফলে খেতে লেট। ফলে বেরোতে লেট।
এইরকম সারি সারি ইকুয়েশন পেরিয়ে এসে ঝোলাকাঁধে জিভটিভ বের করে হাওড়া পৌঁছে দেখি, ট্রেনবাবু এসে হেঁহেঁপর্ব, ভদ্রতাপর্ব, মিষ্টিপর্ব শেষে চাপর্বে প্রবেশ করেছেন। মানে, আমার ভদ্রভাবে ট্রেনযাত্রার আশাটুকু ওই মিষ্টিসাঁটানো প্লেটে পড়ে থাকা রসের মতোই অকিঞ্চিৎকর।
উঠলাম জেনারেল কামরাতে। দেখি কত্তো ফাঁকা সিট! মনে হল, আহা, দুনিয়ায় এখনো ভালো মানুষ আছেন, ভগবান আছেন,যারা সান্তাক্লস আছেন, এমনকি জানালা দিয়ে তাকালে বোধহয় দু-চারটি কল্পতরু গাছটাছও দেখতে পেয়ে যাব! আহ্লাদী গলায় সামনের কানল্যাজাসমন্বিত তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা এই সিটটায় কি কেউ আছে?”
তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে এককথায় উত্তর দিলেন, “রিজার্ভেশন।”
ব্যাস। হয়ে গেল। চুপচাপ নেমে পড়লাম। দেখি, এটা সবে ডি-১। বুঝলাম, ডিল্লি অভি দূর হ্যায়। রেল কোম্পানির নিয়মটা আবার উলটো। পিছিয়ে পড়া, সর্বহারা মানুষের জন্য জেনারেল কামরা আর উপরের স্তরের মানুষদের জন্য রিজার্ভেশন। তাই, জেনারেল কামরাগুলোও পেছনদিকে পড়ে আছে অবহেলায়।
ডি-১ থেকে ডি-৭ পাড়ি দিলাম। পৌঁছে দেখি, ভর্তি। খুব স্বাভাবিক।এটার নিয়মটা খুব ঠোঁটকাটা। ট্রেন স্টেশনে হাজিরা দেবার আগেই তোমায় হাজির থাকতে হবে।নিজের রুমাল, নিউজপেপার, বোতল, ব্যাগ, দরকার হলে জাঙ্গিয়া (যা কিছু জানালা দিয়ে গলে যাওয়া সম্ভব) ট্রেন দাঁড়াবার আগেই সিটে রাখতে হবে। নইলে ফক্কা!
উঠে বাথরুমের কাছে দাঁড়ালাম। উল্টো গেটের সামনে লুঙ্গি পেতে বসে থাকা ফুল ব্যবসায়ী আমাকে একটু ফ্রি উদেশ প্যাকেটে মুড়ে ধরিয়ে দিলেন—
ফু- আপ ইঁহা খড়া মত রহিয়ে। দুসরে কমরে মে দেখিয়ে না!
আ- দেখেছি। নেই। (বাংলাতেই)
ফু- আপ যাইয়ে একবার দেখকে তো আইয়ে। নেহি দেখেঙ্গে তো মিলেগা ক্যায়সে? ‘বিকলাঙ্গ’ মে যাইয়ে!
আ- দেখেছি গো! ওটাও ভর্তি!
ফু- সব অ্যারাগ্যারা আদমি ওঁয়াহা ব্যৈঠা রহতা হ্যায়! আপ যাকে বোলিয়ে, উঠ যায়েগা!
[কথাটা সত্যি। যত আজেবাজে লোকে জায়গাটা ভর্তি থাকে। কিন্তু, আমার বদভ্যাসের দরুণ আমিও সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরিনা। কাজেই আমারও কোনো ভ্যালিড গ্রাউন্ড নেই।]
আমি আর বকবক না করে চুপচাপ মেঝেতে বসে পড়লাম। লোকটা বোধহয় এটা ঠিক হজম করে নিতে পারলো না, তাই পিটপিট করে খানিকক্ষণ দেখল। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে ছিলাম অবশ্য। প্রায় তিন ঘন্টা নীচে আনন্দবাজার ছাড়াই একটা হাফ নোংরা শার্ট আর ততোধিক নোংরা জিন্স পরে মাটিতে বসে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেন একটাও আধুলি ফেলে গেল না, এটা আমাকে ভাবাচ্ছিল। পরে অবশ্য বুঝলাম, নতুন জুতোটাই একমাত্র কারণ।
যাই হোক, উপার্জনহীনতার দুঃখ মনেই চেপে রেখে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। লোক-টোক দেখলাম(ওই বাথরুমের সামনে না বসলে আপনি কোনোদিনই ভ্যারাইটি লোক দেখতে পাবেন না), গান শুনলাম, পোকেমন দেখলাম।
হ্যাঁ, এই পোকেমন দেখাটা নতুন নেশা। পোকেমন গো গেমটা যখন বেরোলো, তখন থেকেই। গেমটা বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলছিলাম তখন। লোকে অবশ্য পুঁজিবাদী-টুঁজিবাদী বলে প্যাঁক দিচ্ছিল টুকটাক। কিন্তু নিন্দুকদের কথায় কান দিয়ে আর কে কবে বড় কাজ করতে পেরেছে! ওসব শুনতে নেই। হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যাওয়া লোকের পর্যন্ত ইস্পেশাল দুব্বলতা থাকে, আর আমি তো নেহাত চুনোপুঁটি! তাই, পোকেমন সিরিজ দর্শন।
কিন্তু, মানুষের অন্যের সুখ সহ্য হয় না। একটা সময় লোকটারও সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল আমার এই নির্লিপ্ততা। আমাকে বলল, ‘চলিয়ে ম্যাঁয় আপকো সিট দিলাতা হুঁ।’ চোখেমুখে আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখে বাধ্য হয়ে বললাম, ‘চলিয়ে’।

সেই থেকে এই সিটে বসে। একখানা বিস্কুট প্যাকেট ওঠার আগে ব্যাগে পুরতে পেরেছিলাম, তাকেই সসম্মানে পেটে ঠাঁই দিলাম। কিন্তু তাতেও হলো না। সময়ও কাটছে না, তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে খিদেও পাচ্ছে। কেমনতরো ট্রেন রে বাবা! অন্য ট্রেন হলে ছঘন্টায় মিনিমাম ছটা ঝালমুড়ি উঠতো। এটাতে তিনখানা জুতো পালিশ আর তিনখানা ইঁদুরের বিষ উঠেছে।
খিদের জ্বালায় দ্বিতীয়টাকেই ডাক দেবো কিনা বিবেচনা করছি, এসময়েই দূর থেকে একখান মধুর ডাক কানের গলিতে ঠুনঠুন করে রিকশার ঘন্টি বাজাতে বাজাতে মরমে প্রবেশ করল। মরমে যেন মলমের প্রলেপ বইয়ে দিলো কেউ। শুনতে পেলাম— “লেবু-মশলা-সরবত, অ্যাই লেবুউউ-মশলা-শঅঅরবঅঅত! পাঁচ টাকা!
আহা! চটপট প্রণাম ঠুকতে গেলাম খাবারের দেবতা কে। কিন্তু, নামটা আর হাতড়ে খুঁজে পেলাম না! শেষে মদনদেবকেই প্রণাম জানালাম করজোড়ে! এই চরম খিদেও তো কামের মতই তীব্র দেহজ চাহিদা, নাকি! আর, রঙিন পানীয়র ব্যাপার যখন, তখন উনিই প্রাথমিক পছন্দ।
ডাকলাম সাততাড়াতাড়ি। হেলতে দুলতে তিনি এলেন। সঙ্গে সঙ্গে, ভিড় রেলকামরার ইন্ডাকশন সূত্র অনুযায়ী আরো পাঁচখানা নোলা এগিয়ে এল। তাদেরও চাই!
বাবু তাঁর রহস্যময় ডিব্বার নল খুলে একখানা মোটা কাগজের কাপ ভর্তি করে দিলেন পানীয়ে। পয়সা নিয়ে চলে গেলেন। টাটানগর স্টেশনে তখন ট্রেনবাবু জিরোচ্ছেন।
আমিও এই তাল বুঝে পানীয়তে চুমুক দিলাম। আহা। ঠান্ডা। মশলাদার। মিষ্টি মিষ্টি। সোডা বা শরবতের প্রতিটি গুণ বিদ্যমান।
ধীরে সুস্থে পুরো কাপ শেষ করে শান্তি পেলাম! দেখলাম কাগজের কাপ, তাই অসীম দক্ষতায় এবং প্রশান্তিতে কাপটাকে মুড়তে মুড়তে এইটুকু করে ফেল্লাম। তারপর টুক করে ফেলে দিলাম ট্রেন আর স্টেশনের মাঝে।
পেট আর জিভ ঠান্ডা হওয়া মাত্রই কেমন একটু খটকা লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় ভুলটা হচ্ছে। মানিব্যাগ বের করে দেখলাম, ঠিকঠাক টাকাই দিয়েছি। দশের বদলে একশোর নোট দিইনি। তবে?

ট্রেন নড়তে শুরু করল। ট্রেন চলতে শুরু করল। স্টেশন ছাড়তে শুরু করল।
তখন শুনতে পেলাম, জানালা দিয়ে ডাক ভেসে আসছে—
“অ্যাই লেবু-মশলা-চা! অ্যাই গরম মশলা চা! পাঁচ টাকা!”

কালো কোট

গরমকালে ৪২ ডিগ্রির ঘেমো কলকাতা ছেড়ে ৫২ ডিগ্রির পুরুলিয়ায় পুড়তে যাবার ইচ্ছে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কেই আসা সম্ভব নয়।
কিন্তু পাগলাটে লোকেদের এই এক মুশকিল। যখন মনে মনে নিজেকে বলেছি করবো, তখন করতে হবেই। এই পাগলামির ঠেলাতেই নন্দন থেকে ১২ কেজি বই বউবাজারে নিয়ে এসেছি, একটানে সেন্ট্রাল থেকে শ্যামবাজার হেঁটে গেছি, সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন সারাদিন বইমেলা চক্কর দিয়েছি।

সেই পাগলামির ইতিহাসগুলোকেই মুড়েজুড়ে ব্যাগে ভরে চলে এলাম হাওড়া স্টেশন।
খুঁজে খুঁজে চলে এলাম প্ল্যাটফর্মে। টিকিট তো কাটাই ছিলো, হেলতেদুলতে খুঁজে পেলাম নিজের বগি। চেপেও বসলাম।
দরজা দিয়ে উঠে ডানদিকে প্রথম সাইড আপারটাই আমার। লোকে খিস্তি মারে, কিন্তু আমার মনে হয় একা একা ট্রেনজার্নি করার জন্য আর লোক দেখার জন্য এর থেকে ভালো সিট আর হয় না! যাই হোক। উঠে দেখি মুশমুশে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে দুজনের সুটকেশে হোঁচট খেয়ে কোনোমতে সিটের কোলে নিজেকে ফেলে দিলাম।
আলো-ফ্যানের আবির্ভাবের সাথে সাথেই এক বড়সড় সাইজের ভদ্রলোক ঢুকলেন কামরায়। গুছিয়ে বসলেন আমার পাশের সিটটায়। কামরার প্রায় প্রত্যেকের সম্ভ্রমভরা চোখ আর ভদ্রলোকের সেমি-ফর্মাল ড্রেস দেখে বুঝলাম, ইনিই। ইনিই তিনি। যাঁকে কেউ বলে কালা কাউয়া, কেউ বলে কালকূট (কালা কোট এর ভাংচুর আর কী), আবার কেউ স্নেহভরা স্বরে ডাকেন কালুয়া।
বসতে না বসতেই, প্রথম স্যাম্পেল।
— “স্যার দেখুন না এই সিটটা যদি একটু..”
— “বল্লাম তো দেখছি, লিস্টটা খুলতে দিন!
— “দেখুন আমি কিন্তু *** চ্যাটার্জিকে চিনি।”
— “দাদা, ওনার টাইটেল মুখার্জি।”
— “ওই হল, মুখার্জিদা আমার খুব ক্লোজ। নাম্বার আছে, কথা বলবেন?”
— “আরে, অদ্ভুত তো! আমি কথা বলে কী করবো? সিট করে দিচ্ছি বললাম তো! লিস্টটা তো চেক করতে দিন!”
লোকটা একটু নিরাশ হয়ে সরে গেল। বুঝলো এ বড়ো কঠিন ঠাঁই।

দ্বিতীয় কেস।
— “দাদা আমার বাচ্চাটার একটা স্লিপার টিকিট কেটে দিন না।”
— “দিচ্ছি।”
— “না দাদা বুঝলেন তো, আমি না পুলিশে আছি।”
— “তো আমি কী করবো?”
— “না বুঝলেন তো, আমি পুলিশে আছি। ফ্রিতেই যাই। আজ এই বাচ্চাটা..”
— “তাহলে ফ্রিতেই যান! আমার কাছে এসেছেন কেন?”
ইনিও চোরের মত পালালেন।

মোটা গোঁফওয়ালা সেই ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসি ঠোঁটে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কী বুঝলি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “বুঝলাম যে সবাই নিজের কনট্যাক্ট কতো বেশি—সেটা দেখাতে সবসময় মুখিয়ে থাকে! সেটা প্রয়োজনে হোক বা অপ্রয়োজনে!”
উরুর ওপর থেকে কালো কোটটাকে গুটিয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর?”
আমি বিজ্ঞের মত মুখ করে বললাম, “আর তোমাদের প্রতিদিন এইরকম স্যাম্পেল সামলাতে হয়।”

হাহাহা শব্দে গোটা কামরা জুড়ে হেসে উঠলেন তিনি। দমকে দমকে সেই হাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে ফিরে তাকালো এইদিকে।
আমার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে তিনি বললেন আস্তে আস্তে, “এতো কিছু বুঝে ফেললিরে! আর এটুকু বুঝলি না, যে সাথে একটা কালো কোট থাকলে যেকেউ এই মস্তিটুকু নিতে পারে?”
ছোট্টো করে বাঁচোখটা টিপে কাঁধে একটা চাপড় মেরে চলে গেলেন ‘কালো কোট’।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

বৃষ্টির বিশ্বাস

রোদফাটা, রাস্তাপোড়া গরম। কলকাতা সেদিন ৪০ ডিগ্রিতে লাফাচ্ছে।
সেই ভয়ঙ্কর কালদুপুরে কিনা অনিকেত বাবু হেলেদুলে বড়রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন!
হেঁহেঁ, কত্তা। ফিকশন মনে হচ্ছে?
কিন্তু তিনদিন ল্যাদ খেয়ে ৬টার থেকে ২ ৩০টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কলেজ না যাওয়ার পর কতকেজি গিল্টি ফিলিং হয়, তা আর আপনারা কী জানবেন?

সেই গিল্টি ফিলিং থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে চলেছি ১২টার ক্লাস করতে। রাস্তায় লোমওঠা নেড়িকুকুর আর গোঁফওঠা ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া কোনো প্রাণের সাড়া নেই।
আমি চলেছি। সুপ্রিয়াতে পেটপুরে খেয়ে ফেলেছি। তারপর আবার ক্লাস যাচ্ছি। সেই বীরত্বে নিজেই নিজের উপর হেব্বি হ্যাল খেয়ে ব্যাগ কাঁধে বড় বড় পায়ে কলেজপাড়া মাড়িয়ে যাচ্ছি।
মনের আনন্দ, আবার ফাঁকা রাস্তা—টুক করে আমার ১০৭.৩ গলা এফএমটা খুলে দিলাম। ভ্যাড়াকন্ঠে ওই সময়ের আদর্শ গানটা গাইতে গাইতে চললাম।
হঠাৎ পেছনে শুনি ঘড়ঘড় শব্দ। প্রথমে ভাবলাম এই ক্যারক্যারানিতে কারো ঘুম বোধহয় ভেঙে গেছে আর সে হাতের সামনে যা পেয়েছে, তাই তুলে মারতে আসছে। সামনেই কলেজ, মার খেলে ছুট্টে এমার্জেন্সিতে ঢুকে শুয়ে পড়ব—এই ভরসাতেই এফএমটা মিউট করে আড়চোখে তাকালাম।
হ্যাঁহ্, দেখি একটা দাড়িওয়ালা লুঙ্গিপরা আইসক্রিম বুড়ো! চোখে একখানা গান্ধীচশমা লাগিয়ে মাদার ডেয়াারির লাল আইসক্রিম গাড়ি চালিয়ে আসছে।
আমি সাহস পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার অন্তরাটা (যেন কত্তো বুঝি কোনটা অন্তরা!) ধরতে যাব, হঠাৎ আইসক্রিমদাদু মুখ খুললো।

ওই হাফ-সাইকেল-হাফ-ভ্যানের সিট থেকে নামল। মাথার লাল টুপিটা খুলে আমার দিকে ছোটো ছোটো চোখ মেলে তাকালো, তারপর বলল, “দাদাভাই, তোমার গানটা আমারে শোনাবে?”
আমি হাঁ। মুখে একখানা তিন মিমি ব্যাসার্ধের গোল্লা নিয়ে আমি খাঁটি ১০ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, “মানে? আমি?এই গানটা?কেন?”
মাঝখানে একটুও ফাঁক না দিয়ে চারটে প্রশ্ন আমার মুখ দিয়ে গড়িয়ে গেল।
ও কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “ভাল লাগল গানটা। আমিও একসময় গান শিখেছিলাম দাদাভাই। এখন কতদিন গান শুনি নাই। শুনাবে?”

আমি বাধ্য হয়ে আরেকবার গানটা ধরলাম শুরু থেকে। তখন মেডিক্যাল কলেজের তিন নম্বর গেটের সামনে প্রায় পৌঁছে গেছি। ওখানে একটা ভিড় সবসময়ই গুজুরগুজুর করে।
লজ্জা লজ্জা মুখে ভলিউমটা দুঘর কমিয়ে গানটা গেয়ে দিলাম বেশ একটু। লোকটা আমার দিকে পুরো সময়টা তাকিয়ে চোখ পিটপিট করছিল। আর মাথার জুলফি থেকে ঘাম পড়ে লাল ইউনিফর্মটাকে কালো করে দিচ্ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়।
গান শেষ হয়ে গেল। লোকটা সাইকেলে আবার চেপে বসল। বলল, “যাও দাদাবাবু, পড়বে যাও। আল্লা তোমার মঙ্গল করুন।” এই বলে প্যাডেল চালিয়ে চলে গেল সামনের দিকে।

তারপর তিনঘন্টা ধরে ঘেমেঘুমে ক্লাস-প্র্যাক্টিকাল সব করলাম। কয়েকজনকে এই ঘটনাটাও বললাম। লোকজন হাসাহাসি করল বেশ খানিকক্ষণ।
ফেরার পথে আবার সেই তিন নম্বর গেট। গায়ে চুপচুপে ভেজা জামা, বাঁহাতে নোংরা অ্যাপ্রন আর ডান হাতে তিনটে পেয়ারা সাদা প্লাস্টিকে।

হঠাৎ দেখি, সেই আইসক্রিম দাদু বসে আছে রাস্তার ধারে একটা কলের পাশে। তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা পুঁচকে রাস্তার ছেলে। দুজনেই খালিগায়ে। পাশে আইসক্রিম গাড়িটা একা একা দাঁড়িয়ে। গামছাটা রাখা তার হ্যান্ডেলে।
ব্যাগ কাঁধে পেরিয়ে যেতে যেতে কানে ভেসে এল, দাদু তার ভাঙা গলায় একহাতে বিড়ি নিয়ে কোলে হেলান দেওয়া ছেলেটাকে শোনাচ্ছে,
“শহরের উষ্ণতম দিনে পিচগলা রোদ্দুরে,
বৃষ্টির বিশ্বাস…”

পয়লা বোশেখ

ছোটোবেলায় গ্রামের মেয়েটা প্রতি বছর পয়লা বোশেখের দিন বাক্স থেকে পাটভাঙা শাড়িটা পরে বাবার সাথে গাজনের মেলায় যেত টিনের ভটভটি আর পাঁপড় কিনতে। সবাই তার সাজগোজ দেখে যাওয়ার পথে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। সেদিন তার মুখ হাসিতে আর ধরত না!

আজও মেয়েটা প্রতিদিনের গোলাপি জামাটা ছেড়ে একটা নতুন শাড়ি পরে এসেছিল। মাড়ওয়ারি মালিক এক সপ্তাহ আগেই নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে, বাঙালি সেজে আসতে হবে। এসির ঠান্ডায় সারাদিন আজ তাকে হাসতে হয়েছে।
আজও অটোরাস্তার মোড় থেকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত বেশ কয়েকজনই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের দৃষ্টি শুধু চড়া মেকাপেই ছিল না অবশ্য।

ঠান্ডা ভাত-তরকারির সঙ্গে মিইয়ে যাওয়া পাঁপড়ভাজা খেতে খেতে হঠাৎ মাথা উঠিয়ে প্লাস্টিকের মালাঝোলানো ছবিটার দিকে চাইল।
মনে মনে বলল, ‘এটাও কিন্তু পয়লা বৈশাখ বাবা।’

কল্পনাপ্রাপ্তি: এসপ্ল্যানেড বিগবাজারের বিষণ্ণ চোখের একগাল হাসি পরে থাকা ‘বাঙালি’ সেলসওম্যান।

প্ল্যান বিয়ের গপ্পো

প্ল্যান ‘এ’ হচ্ছে বিয়ে-টিয়ে করবো না। কারণ আছে। 

কারণ ১:চরম লেভেলের বিবাগী মনোভাব। ঘর-সংসারের দিকে টানটা এমনিতেই কম। অবরে সবরে ঘর যাই। চেনা পরিচিত মুখগুলোর হাসির থেকে অচেনা মুখের বিস্ময় দেখতেই আগ্রহটা বেশি। তারপর একদিন বাবা আমার নামের মানে বলতে গিয়ে আওড়েছিল—
“মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবেনা মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দুবিঘার পরিবর্তে।”
সেদিনই একটা ঢ্যারা পড়ে গেছিল। অবস্থাটা ঠিক টেনে রাখা গার্ডারের মতো। পেছনের হাতটার সঙ্গে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছি। কাজেই, বিয়ে-বউ-বাচ্চায় বাঁচা হবে না আমার।
কারণ ২: অদ্ভুত একটা সমাজবিতৃষ্ণা। জানি সবারই থাকে। শালির বাচ্চার জন্মদিনে গিফট কিনতে যেতে সবারই বিরক্ত লাগে, মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়ে হেঁহেঁ করতে সবারই ক্লান্ত লাগে—কিন্তু আমার মতো এতোটা জন্ডিস কেস বোধহয় না!
আমার যেকোনো সম্পর্কেই অ্যালার্জি আছে। নতুন কারো সঙ্গে আলাপ/বন্ধুত্ব হলে প্রথম প্রথম ভালো লাগে, তারপর যদি দেখি আমি তার কাছে থেকে কিছুই পাচ্ছিনা, তখন মানে মানে পালাই! অথবা, বাধ্যাবস্থায় সয়ে নি কোনোমতে। মা-বাবা-বন্ধু টাইপের ফেভিকলসম্পর্কগুলোর প্রতিও আমার তেমন আদিখ্যেতা নেই। ওই থাকতে হয়, আছে। ব্যস।
তো এরকম লোকের সঙ্গে খুব বেশি লোকের পটে না, বোঝাই যাচ্ছে! লোকে আড়ালে-আবডালে পাগল বলে, কেউ আবার মুখের ওপরেই বলে দেয়!
আর, দুজন নইলে তো বিয়ে হয় না!

এই তো গেল প্ল্যান ‘এ’। এবার আসি প্ল্যান ‘বি’ এর কথায়—মানে, বিয়ের কথায়। ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারি, আত্মবিশ্বাস দিয়ে দুপকেট আর পাছার পকেট ভর্তি করেও হাতে একমুঠো বাকি থাকতে পারে, তা বলে মেগালোম্যানিয়াক তো নই! জানি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে, কর্তব্যের দায়ে, কোনো একদিন বিয়ে করতে হতেই পারে। হতেই পারে।
তাই, একটু ছকে রেখেছি আমার ‘আদর্শ বিয়ে’টাকে। ছকে রাখা ভালো। কাজে দেয়।
একে একে আসি।

°আদর্শ পথসঙ্গী°
১. মগজে একটু কড়া উইট, হিউমার আর স্যাটায়ার।
২. অন্যাকা তথা বাস্তববাদী।
৩. সিম্পুল লিভিং, হাই থিঙ্কিং।
৪. এটাই একটু দাবি গোছের। তিনটে জিনিসের মধ্যে যেকোনো দুটোয় চরম লেভেলের আগ্রহ থাকতে হবে।
বই, গান বা দেশবিদেশে সফর।
ব্যাস। ছোটোখাটো ডিটেইলসে যাচ্ছিনা—কেবল বিরক্ত করাই হবে। বেসিক্যালি, এই গুণগুলো আমি সবার মধ্যেই খুঁজে বেড়াই। যাদের মধ্যে পাই, তারাই আমার পেয়ারের লোক হয়ে যায়। কাজেই, এই মানুষটার মধ্যে তো খুঁজবোই!
এবার, আসি অন্যগুলোর কথায়।

°আদর্শ বিয়েস্থান°
অবভিয়াসলি ডেস্টিনেশন ওয়েডিং! আর কিছু না হোক, ওই P.C.Chandraএর অ্যাডটা দেখেছেন? ওরকম হলেও চলবে!
(হেঁহেঁ, নোংরা পুঁজিবাদী চিন্তা। মাঝে মাঝে ইনফিলট্রেট করে যায় আর কী!)

এবারে, মূল পার্ট। মানে, বিবাহ পরবর্তী জীবনের কিছু রুলজ অ্যান্ড রেগুলেশনজ। না না এভাবে বলবো না। লোকে আবার কিসব কিসব বলে বসবে। বরং বলা যাক, কোড অফ এথিক্স। বা বলতে পারেন, আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসলে, আমার পাঞ্জাবির কলারের ট্যাগে এগুলোই “*T&C apply” হিসেবে লেখা থাকবে!
যাই হোক, সেগুলো একে একে বলি।

°সাংসারিক সংবিধান°
১. বিয়ের পরের ৬ মাস/১ বছর হচ্ছে ট্রেনিং পিরিয়ড। ওইসময় আমাকে রান্না করাটা শিখিয়ে দিতে হবে। সপ্তাহে সাড়ে তিনদিন রান্নার দায়িত্ব নিতে আমার তরফ থেকে আগ্রহই থাকবে।
২.ঘরের বাকি সব কাজই মোটামুটি পারি। ঘর মোছা, ঝাঁট দেওয়া, জামাকাপড় কাচা, বাসন মাজা এইসব কাজগুলো ভালোই পারি বলে মনে হয়। সেটা মনোমত না হলে এই সময়ের মধ্যে শিখিয়ে নিতে হবে। এইসব কাজকে আমি বাজে কাজ বলে মনে করি না, বরং ভালোইবাসি করতে।
৩. নিজস্ব পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। মিউচ্যুয়ালি। একের ওপর অন্যের পছন্দ চাপানো(ইমোশনালি জোর করে হলেও) খুব বাজে জিনিস। সকালে আমি চা ভালোবাসি আর তুমি কফি, সেখানে তুমি বলতেই পারো যে, “তোমার চা আমি বানাব না। নিজে করে খাও।” তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু, ‘আমিও খাচ্ছি তুমিও খাও না’ টাইপের আবদার চলবে না।
৪. নানা রকমের ফান্ড এর ব্যবস্থা থাকবে। তা থেকে দুজনেই খরচ দেবে এবং নেবে। এবং মাসের শেষে ক্লিন অডিট দেওয়া হবে। এবং কোনখাতে খরচ বেশি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
৫. ছোটো বা বড়, সবাইকে তর্ক করতে জানতে হবে। যুক্তি দিয়ে ঠিকঠাক তর্ক করতে জানতে হবে। আবেগ দিয়ে তর্ক বা কুযুক্তিওয়ালা তর্ক একদমই আনচলেবল্।
৬. ঘরের সব সদস্যকে নিয়ে প্রতি শনিবার রাতে আদালত বসবে। সবার অভিযোগ কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই শোনা হবে এবং হাতভোট, জুরি সিস্টেম প্রভৃতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচার হবে। জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সদস্য জরুরি মিটিং ডাকতে পারে।
৭. যেকোনো ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলতে এবং প্রশ্ন করতে জানতে হবে। তা ব্যাপারটা যতই লজ্জার, রাগের বা অস্বস্তির হোক না কেন! যেকোনো প্রশ্ন,পছন্দ-অপছন্দ এবং সমালোচনা মুখের ওপর বলাটাই অ্যাপ্রিশিয়েট করা হবে। এমনকি খিস্তিও।
৮. সেকেন্ড এডিশনগণের আবির্ভাব হলেই জীবনকে বিরিয়ানি থেকে পান্তাভাত করে দিতে হবে, এমন দাবি চলবে না। ৪০ বছর বয়সেও হাত ধরা যায়, ৪০ বছর বয়সেও একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, ৪০ বছর বয়সেও চুমু খাওয়া যায়। লোকহাসির ভয় আমি এখনো করিনা, তখনো করবো না।
৯. একাকীত্বের দাবিকে মান্যতা দিতে হবে। আমার মাঝে মাঝে একা হাঁটতে বেরোতে ইচ্ছা হতেই পারে। গভীর রাতে একা টেবিলল্যাম্পে গল্পের বই পড়তেই পারি। একা কোথাও ঘুরতে বা ট্রেক করতেও যেতে পারি। পকেট ধরে ঝুলে পড়া চলবে না।
১০. শেষত, সাংসারিক বৃত্তের যাবতীয় দায়িত্ব, কর্তব্য এবং তাদের ফলাফলের বোঝা দুজনের ওপর সমানভাবে পড়বে। পড়বেই। এবং সেটা এড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে বড়জোর সিমবায়োসিস চলতে পারে, প্যারাসাইটিজম নেভারস্য নেভারম!

পুনশ্চ: ওদিক থেকেও আমি এরকম একটা লিস্টি শুধুমাত্র আশাই করবো না, ইনসিস্টও করবো। না দিলে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে।

পনীরটা ভালো হয়েছিল

বাবা সারাদিন খুটখাট করে একখানা প্রেজেন্টেশন তৈরি করলেন। বিকেলে সেটা মিটিংয়ে দেখানো হল। দেখে বস সবার সামনেই উঠে এসে তারিফ জানালেন, কলিগরাও বেরিয়ে এসে পিঠ চাপড়ে দিল। 

বড়ো ছেলে পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ল। পরদিন ভাইভাতে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক বললো। স্যার খুব তারিফ করলেন, ভালো নাম্বার দিলেন।
মেজো ছেলে ফেসবুকে একখানা গল্প লিখলো। গল্পটা মোটামুটি হলেও, সবাই খুব ভালো বললো। কয়েকজন পার্সোনাল চ্যাটে এসেও উৎসাহ দিয়ে গেলেন।

মা সারাদিন ধরে, ‘মানসিকভাবে অসাধারণ’ ছোটো ছেলে আর বৃদ্ধ অশক্ত দিদার সাহায্য করলেন। কখনো ছেলের প্যান্ট পালটে দিলেন, কখনো দিদার গায়ে পড়া খাবার মুছে দিলেন।
সন্ধ্যেবেলা ঘেমেনেয়ে সুন্দর করে পনীর তৈরি করলেন— ছেলেরা হোস্টেল থেকে এসেছে যে! রাতে খাবার টেবিলে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হয়েছে রে পনীরটা?’
বড়ো ছেলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করতে ব্যস্ত ছিল, সে শুনতেই পেল না।
মেজো ছেলে গল্পের বই পড়তে পড়তে খাচ্ছিল, কোনোমতে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো, ‘উমম্’।
বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আহ্! খবরটা শুনতে দাও না!’

কেবল ছোট্টো রাহুল মাথা নেড়ে তার শাদা শাদা দাঁতগুলো বের করে অকারণে একগাল হেসে বলে উঠলো, ‘মিমি খুব সুন্দর হয়েছে! তুমি পনীরটা দারুণ করো! আরো খাবো!’

দল-আ-দলি

একদল ভাবেনা, করেও না। নিউট্রাল মাসের মত একগাদায় ধপাস করে পড়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে খাবার খায় আর সমাজের ডালে ঝুলে থাকে। সবচেয়ে সুখী জীব।

একদল ভাবে,কিন্তু করতে চায় না। ফলে তাদের ভাবনাগুলো ঘুরেফিরে খুলিতে ধাক্কা খায়, বেরোতে পারে না, একসময় ধীরে ধীরে নেক্রোসিসে মরে যায়।তারা এরপর প্রথম প্রকারে পরিণত হয় আর বুড়ো বয়সে স্মৃতি রোমন্থন করে।

একদল ভাবে না,কিন্তু করার ইচ্ছে প্রবল। ফলে সেটা কাজের বদলে অকাজ হয়ে দাঁড়ায়। কি করতে হবে, সেটা জানার মতো মানসিক পরিশ্রম এদের ধাতে নেই।

একদল ভাবে, করতেও চায়, কিন্তু জীবন আর দায়বদ্ধতা তাদের করতে দেয় না। এর মধ্যে দুটো সাবক্লাস আছে, যারা এটা মেনে নেয় আর যারা মেনে নিতে পারে না।
যারা মেনে নেয়, তারা প্রথম প্রথম একটা অস্বস্তি অনুভব করে। তারপর হতাশা। সেই হতাশা থেকে তৈরি হওয়া নির্লিপ্ততা আস্তে আস্তে জোম্বির মত মাথা খেয়ে তাদের প্রথম প্রকারে পরিণত করে দেয়।
যারা মেনে নেয় না, তারা ছটফট করতে থাকে। সেই ছটফটানির কোনো উপমা নেই। মাঝে মাঝে জীবনকে কাটিয়ে উঠতে চায়,মাঝে মাঝে দায়বদ্ধতাগুলোকে।সবচেয়ে অশান্ত জীব।এরাই মাঝে মাঝে অ্যাটম বোমার মত ফেটে যায়, আবার কখনো আগের বছরের মিইয়ে যাওয়া ধানিফটকার মতো ফুস হয়ে যায়।

একদল হলেন সারস্বতসাধক। তাঁরা আশীর্বাদপ্রাপ্ত। লেখক-বাদক-গায়ক-অাঁকিয়ে-পরিচালকের দল। তাঁদের সৃষ্টির কাছে সমাজ মাথা নত করে,দূর থেকে। তাঁরা নিজেদের জগতে সমাজের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে, কিন্তু সমাজের দোষত্রুটিগুলোর প্রতিবাদ তারা নিজেদের ভাষায় করে যান।

আর শেষের দল। তাঁরা ভাবেন সমাজের জন্য,ব্যথা পান, সেই ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করেন। হ্যাঁ, কাজ। ছোটো হোক, বা বড়ো। নিজের মতো করে একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনেন। সেটার জন্য ফেসবুকে পোষ্ট দেন না, লোকজন ডেকে ইভেন্ট ক্রিয়েট করতে হয় না এমনকি কোনো সংগঠনের ছত্রছায়ায় থেকে আর্থিক অনুদানও প্রয়োজন নেই তাঁদের। সেই যে মানুষটা তার রোজগারের ৫০% অনাথ আশ্রমে দেয়, যে তার মৃত্যুর আগে তার সব সম্পত্তি হাসপাতালকে দিয়ে যায়, যে লোকটা একটা পাহাড়ী গ্রামে গরিব বাচ্চাদের পড়ায়, কার যেন বাড়িতে রোজ ১০টা রাস্তার লোকের পাত পড়ে, সেই সর্দারজী যার অটোতে পথদুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীরা নিখরচায় হাসপাতালে যেতে পারেন, যে লোকটা নিজের বেতনের পয়সায় রোজ একটা করে চারাগাছ লাগায়, সরকারী রাস্তার গর্ত ভর্তি করে বেড়ায় নিজের পেনশনে… তাদের কিন্তু ফেসবুকে ছবি তুলে শেয়ার করতে হয় না,নিউজপেপারে তাঁদের ছবি উঠেই হারিয়ে যায়, তাঁরা ইন্টারভিউতে অস্বস্তি বোধ করেন, তাঁদের পরিজন-পাড়া-প্রতিবেশী পাগল বলে; কিন্তু তাঁরা খুব আনন্দে থাকেন,শান্তিতে থাকেন।

এদের একজন হতে চাই। ফেসবুকে লিখে চেনা বৃত্তে তরঙ্গ তুলে কী হবে, যখন জানি তা বৃথা? মেডিক্যাল কলেজ,পুরুলিয়া জিলা স্কুল, ডাক্তার-হবু ডাক্তার সমাজ আর ফেসবুক-লেখক বৃত্তে বাতেলা দিয়ে নিজের আত্মলেহনের সুখ আসতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবনে নেমে এসে কাজ করে কোনো একটা মুখে হাসি না ফোটাতে পারলে এই সেলফ-ইম্পোজড উচ্চ মোরাল গ্রাউন্ড মিথ্যা।

দিন কেটে যায়।

বইপ্রেম

আমি যাকে তাকে দুমদাম ‘বইপ্রেমী’ বলি না।সাহিত্যপ্রেম আর বইপ্রেম আমার ডিকশনারির আলাদা আলাদা পাতায় লেখা। তারাই প্রকৃত বইপ্রেমী, যারা এই সব গন্ধগুলো নাকের রোঁয়ায় রোঁয়ায় চেনে—
১. আনন্দ প্রকাশনের সদ্য ভেজে নামানো গরম বইয়ে কুড়কুড়ে গন্ধ।
২.কলুটোলা স্ট্রিটের পুরোনো অভিজ্ঞ বুড়ো বইয়ে সোঁদা গন্ধ।
৩.রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পাতা ছিঁড়ে যাওয়া বেশ্যা বইয়ে অপূর্ণতার গন্ধ।
৪. বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেওয়া পরস্ত্রী বইয়ে নিষিদ্ধ রোমাঞ্চের গন্ধ।
৫.চা খেতে খেতে পড়া বইতে হঠাৎ পড়ে যাওয়া লেবু চায়ের অন্যমনস্কতার গন্ধ।
৬.ঘরের তাকে খুঁজে পাওয়া না পড়া বইয়ে অভিমানে শুকিয়ে যাওয়া নোনা জলের গন্ধ।
৭. বইমেলায় লুকিয়ে ব্যাগে ভরে নেওয়া বইয়ে মাঠের ধুলো আর ছেলেমানুষির গন্ধ।
৮. পুরোনো স্কুলের পড়ার বইয়ে মনখারাপ আর বন্ধুত্বের গন্ধ।
৯.উঁচু ক্লাসের না পড়া বই লুকিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখার সময় ছুঁতে না পাওয়া ইচ্ছের গন্ধ।
১০. বিছানার পাশে রাখা প্রতিদিনের সঙ্গী বইটাতে হাতে হাত রেখে ভরসার গন্ধ।