নির্বাণ (?)

২৫/৩/১৬
রাত ৮টা ৩০ মিনিট
ব্যাপারটা খুব ছোটো জিনিস থেকে শুরু হয়েছিল।
সে হোস্টেলের খাটে শুয়ে শুয়ে বাঁহাতে ডান নাকের ফুটো খুঁটতে খুঁটতে ফ্রেন্ডসের সিজন ৫ দেখছিল। মানে, টোটাল ল্যাদ খাচ্ছিল।
হঠাৎ ফেসবুকের নোটিফিকেশন ঢুকল একখানা স্ক্রিনের ওপর। সে খাবার ফেলে রাখতে পারে, কিন্তু নোটিফিকেশন ফেলে রাখে না। নাকের ছোটো গোল্লা করে পাকানো পুঁটকিটা বিছানাতেই ফেলে সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে খুললো। স্ক্রোল করতে করতে দেখতে পেল, একজন হিন্দু ডাক্তার, নারাং না কী নাম, তাকে মুসলিমরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে সবার সামনে।
তার খুব রাগ হল। সে কড়া ভাষায় ধিক্কার জানিয়ে সেটা শেয়ার করে দিল।
শান্ত হয়ে সিরিয়াল দেখতে শুরু করবে আবার, হঠাৎই হাত দিয়ে নাকের ময়লার গোল্লাটা খুঁজে পেল না। অদ্ভুত তো! আরেকটু পাকানো যেত ওটা! গেল কোথায়? গোটা খাট তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেল না!
দুত্তেরিকি!

২৬/৩/১৬
সকাল ১০টা
পরের দিন সকাল। মানে, এই ১০টা ১১টা।
সে ঘুমচোখে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকটা চেক করছিল। এটাই তার ঘুম থেকে ওঠার প্রথম ধাপ।
হঠাৎ, একখানা নিউজলিঙ্ক চোখে পড়লো। ইউপি না কোথায়, একটা দলিত পরিবারকে ন্যাংটো করে ৩কিমি হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে গ্রামের লোকজন। কেননা, তারা কোন্ এক কুঁয়োতে জল তুলতে গেছল। লোকজন ব্রাহ্মণ্যবাদকে খিস্তিটিস্তি মেরে শেয়ার করেছে জিনিসটা।
তারও বেশ খারাপ লাগলো। সত্যি লোকজন এরকম হয়ে যাচ্ছে! সে আচ্ছা করে আরেক পোঁচ খিস্তি বুলিয়ে দিল পোস্টটায়, দিয়ে শেয়ার করে দিল।

ব্রাশ করে ফিরে এসে ও ওর প্যাথোলজি বইটা খুঁজে পেল না। কোথ্থাও নেই! কোনো বন্ধুকেও দেয়নি, এটা তার পাক্কা মনে আছে।
তবে বোধহয় তার ঘুমের মধ্যেই কেউ এসে নিয়ে গেছে, এই ভেবেই সে আপাতত কলেজ গেল।

২৮/৩/১৬
দুপুর ৩টা
দুপুরে প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করে রোদে ঘেমে বিরক্ত হয়ে হোস্টেল ফিরছিল, দেখে ক্যান্টিনে উত্তাল ভিড়। সবাই জড়ো করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
তার আবার খেলাধুলো মোটেও সয় না। কতকাল যে একখানা পুরো ইনিংস দেখেনি! এটাকেও টিটোয়েন্টির ভিড় মনে করে রুমের দিকে এগিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ শুনল স্ক্রিনে বুম বুম করে আওয়াজ হচ্ছে!
ভিড়ে মাথা গুঁজে শুনতে পেল, ব্রাসেলস্ নামে বেলজিয়ামের একটা শহরে পরপর তিনটে সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ হয়েছে। অনেক লোকজন মারা গেছে।
এবার তার একটু একটু অবাক লাগছিলো।
এরকম এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন রোজ? বিনাদোষে মানুষ মেরে কী প্রমাণের চেষ্টা করছে ‘এরা’? উদ্দেশ্যটা কী? কেউ বলছে, আমেরিকাবিরোধী এইসব সংগঠনগুলো নাকি আমেরিকার কাছ থেকেই সাহায্য পায়? আবার এক আর্টিকেল থেকে পেল, নাকি মিডল ইস্টের দেশগুলোই এসব কান্ড ঘটানোর জন্য অস্ত্র-অর্থ চালান দেয়!
তার ভরসা এখন শুধু আর্টিকেল। পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে খুঁজেপেতে নানান আর্টিকেল পড়ে, বই পড়ে। জানতে চেষ্টা করে, কী হচ্ছে ব্যাপারটা?

ও কিন্তু রুমে ফিরে ওর বডিওয়াশ বা বডিস্পঞ্জ কোনোটাই খুঁজে পেল না। জিনিসপত্র এতো জল্দি হারিয়ে যাচ্ছে কেন, সে কোনোমতেই ভেবে পেল না।

২৯/৩/১৬
রাত ৭টা
সন্ধ্যেবেলা শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। পড়ার সময় ফোনটা অবশ্য সবসময় পাশেই থাকে, ওটা না হলে ঠিক যুত হয় না।
এখনি রুমমেটের সঙ্গে একদফা তর্ক হয়ে গেছে। ওর দাবি হলো, পাকিস্তান আফগানিস্তান এই দেশগুলোই নাকি সব নষ্টের গোড়া। ওরাই নাকি গান্ডেপিন্ডে ‘মুসলিম জঙ্গি’ তৈরি করছে! এরকম কথায় তো তর্ক হবেই! কে না জানে, সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম হয় না। এই নিয়ে এই কয়েকদিনে কতো কতো লেখা পড়ে ফেলল। বিদ্রূপাত্মক, সেন্টুখাওয়ানো, যুক্তিবাদী কত্তোরকম! এইসব জ্ঞান নিয়ে বন্ধুকে হারিয়ে দিচ্ছিলই প্রায়, হঠাৎ ও একগাদা সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের খতিয়ান আর তাদের পেছনে কাদের হাত ছিল, তা তুলে ধরলো।
ব্যাস, সে হেরে ভূত!
আরেকটা খবর এল রাত নটার দিকে। নাইজেরিয়াতে বোকাহারামি না কারা একটা ৮০ জনকে পুড়িয়ে মেরেছে! পুড়িয়ে! তার মধ্যে অনেকগুলো বাচ্চা ছিল, তাজা যুবকও ছিল, আবার শেষপ্রান্তের বুড়োও ছিল।
কিছুক্ষণ পরে, পড়তে পড়তে হঠাৎ দেওয়ালের দিকে তাকালো সে। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকতে হঠাৎ দেখলো, কদিন আগে পেন বুলিয়ে বুলিয়ে নিজের নামটা লিখেছিল, সেটা বেশ ছোটো লাগছে। কাছে চোখ নিয়ে গেল। দেওয়ালে নাক ঠেকিয়ে দিল। ছোটোই লাগছে বেশ! অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার!

২৯/৩/১৬
রাত ২ ৩০
শোয়ার আগে একবার ফোনটা খুললো।
চ্যাটচেটে গরমে জানালার পাশে খালিগায়ে শুয়ে লেখার মজাই আলাদা। সেই মজাতেই লিখছিলো, হঠাৎ বাদ সাধল পিং করে একখানা শব্দ।
‘তমোঘ্ন হালদার চেঞ্জড হিজ প্রোফাইল পিকচার।’
খুলতেই খবরটা চোখে পড়লো, পাকিস্তানের লাহোরে একখানা বোমা ফাটানো হয়েছে। ৪৫ জন মারা গেছে, আহত অনেক।
সেই পাকিস্তান, যেখানে জঙ্গী পয়দা হয় লাখে লাখে!
সেই মুসলিম পাকিস্তান!

আর সইতে পারল না।
আস্তে আস্তে ছোটো হয়ে যেতে যেতে জামা-প্যান্ট-চশমা সমেত একসময় শূন্যে মিলিয়ে গেল শ্রীযুক্ত বাবু অনিকেত চ্যাটার্জি।
পাকিস্তানের প্রোফাইলছবিওয়ালা ফেসবুক সমেত ফোনটা তখনও জ্বলজ্বল করছিল বিছানায়।

পনীরটা ভালো হয়েছিল

বাবা সারাদিন খুটখাট করে একখানা প্রেজেন্টেশন তৈরি করলেন। বিকেলে সেটা মিটিংয়ে দেখানো হল। দেখে বস সবার সামনেই উঠে এসে তারিফ জানালেন, কলিগরাও বেরিয়ে এসে পিঠ চাপড়ে দিল। 

বড়ো ছেলে পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ল। পরদিন ভাইভাতে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক বললো। স্যার খুব তারিফ করলেন, ভালো নাম্বার দিলেন।
মেজো ছেলে ফেসবুকে একখানা গল্প লিখলো। গল্পটা মোটামুটি হলেও, সবাই খুব ভালো বললো। কয়েকজন পার্সোনাল চ্যাটে এসেও উৎসাহ দিয়ে গেলেন।

মা সারাদিন ধরে, ‘মানসিকভাবে অসাধারণ’ ছোটো ছেলে আর বৃদ্ধ অশক্ত দিদার সাহায্য করলেন। কখনো ছেলের প্যান্ট পালটে দিলেন, কখনো দিদার গায়ে পড়া খাবার মুছে দিলেন।
সন্ধ্যেবেলা ঘেমেনেয়ে সুন্দর করে পনীর তৈরি করলেন— ছেলেরা হোস্টেল থেকে এসেছে যে! রাতে খাবার টেবিলে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হয়েছে রে পনীরটা?’
বড়ো ছেলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করতে ব্যস্ত ছিল, সে শুনতেই পেল না।
মেজো ছেলে গল্পের বই পড়তে পড়তে খাচ্ছিল, কোনোমতে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো, ‘উমম্’।
বাবা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আহ্! খবরটা শুনতে দাও না!’

কেবল ছোট্টো রাহুল মাথা নেড়ে তার শাদা শাদা দাঁতগুলো বের করে অকারণে একগাল হেসে বলে উঠলো, ‘মিমি খুব সুন্দর হয়েছে! তুমি পনীরটা দারুণ করো! আরো খাবো!’

নেমেসিস

সাল ২০৪৬।
একজন রিটায়ার্ড বুড়ো মানুষ একা রয়েছেন ঘরে। পুরোপুরি একা হয়ে গেছেন এখন। ছেলে রয়েছে কানেটিকাটে, দেশে ফেরে কালেভদ্রে। আত্মীয়স্বজন বলতেও তেমন কেউ নেই। শুধু দূরসম্পর্কের এক ভাইপো আছে, মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায়।
হঠাৎ সেদিন রাত্রেবেলা প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। রাস্তায় রাস্তায় জল জমে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। সন্ধ্যে থেকে তিনঘন্টা টানা বৃষ্টি চললো, তাও থামার কোনো লক্ষণ নেই।
হোম কেটারিং সংস্থাকে ফোন করলেন বুড়ো। পেশাদারি কন্ঠে তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিল, আজকের জন্য তিনি যেন অন্য কোনো ব্যবস্থা দেখে নেন। এরকম দুর্যোগের জন্য তাদের সব সার্ভিস সাসপেন্ডেড।
যাহ্ বাবা! এরকম ভাবে ঝুলিয়ে দিল?! ফ্রিজে কিচ্ছু নেই, বিকেলেও ভারী কিছু খাওয়া হয়নি, এবার গোটা রাত পেটে কিল মেরে কাটাতে হবে!

এর মধ্যেই লোডশেডিং! গোটা এলাকাটা নিমেষে কুচকুচে অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরের টেবিলচেয়ারগুলোও দেখতে পাচ্ছেন না আর সত্তোরোর্দ্ধ বৃদ্ধ।

কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে ছাতাটা খুঁজে বের করে এক দুঃসাহসিক চেষ্টায় বেরোলেন বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরের দোকানে খাবারের জন্য। একহাঁটু জল ঠেলে কালো শহরের রাস্তা বেয়ে তিনি হাঁটতে থাকলেন। একসময় এসে পৌঁছলেন ছোট্টো সেই দোকানটায়।
অনেক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, কোনোরকম মিলের ব্যবস্থা করেছ কি আজ?’
দোকানদার মুখের ওপর দোকানের শাটার বন্ধ করে চলে গেল। একটা শব্দও খরচ করলো না।
আশাহত বৃদ্ধ মাথা নীচু করে ফিরলেন বাড়ির পথে। এতটা পথ হেঁটে আসায় প্রচন্ড জলতেষ্টাতে বুক ফেটে যাচ্ছে। রাস্তায় নোংরা জল বন্যার মত বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পানীয় জলের কোনো ব্যবস্থাই নেই! হোহো করে ছুটে আসা ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা ধরে রাখতে পারছেন না শক্ত করে। আবার, ছাতার দিকে খেয়াল রাখতে গেলে রাস্তার দিকে নজর দিতে পারছেন না।

যা হবার তাই হল। জলের তোড়ে একটা আধলা ইঁট এসে লাগলো অশক্ত বাতগ্রস্ত হাঁটুতে। ধাক্কাটা আর সামলাতে পারলেন না। ঝলাস্ শব্দে রাস্তায় পড়ে গেলেন তিনি, ছাতাটা ছিটকে গেলো জলের সঙ্গে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। হা হতোস্মি! রাস্তায় একটি প্রাণী নেই!
কিন্তু ঘরে ফিরতেই হবে। কোনোরকমে নিজেই উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ফিরলেন।
দরজায় পৌঁছে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, সর্বনাশ! চাবি নেই পকেটে! হয়তো রাস্তাতেই ছিটকে পড়ে গেছে।
ফোনটাও রয়ে গেছে ভেতরে। ভিজে খারাপ হবার ভয়ে রেখে গেছলেন নিজেই। কাউকে ফোন করে সাহায্য চাইতেও পারবেন না।

আর সইতে পারলেন না।
আপাদমস্তক ভেজা, নোংরা হয়ে যাওয়া জামা আর কাদামাখা প্যান্ট পরে, অভুক্ত শ্রান্ত অবস্থায় দরজার সামনে বসে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন বৃদ্ধ আপ্পা রাও পোডিলে।

জানিনা, ইউনিভার্সিটি অফ হায়দ্রাবাদ সেই অনুতাপের কান্না শুনতে পাচ্ছিল কি না!

বৃষ্টিরা

তারপর একদিন ঝুপ্পুস বৃষ্টি পড়ল। লালচে আকাশটা ছাই-সাদা হয়ে গেল গোটা বিকেল জুড়ে। সরু গাছের কান্ডগুলোর নীচে হাওয়া বইল। লালে সবুজে হলুদে মেশানো বুড়ো অকেজো পাতাগুলো দূরে সরে গেল। উথালপাথাল হাওয়ায় তারা আর এই সমাজের যোগ্যতামান পেরোতেই পারলো না। শনশনিয়ে ঠান্ডা, শীতল বাতাসেরা কানে কানে বলে গেল, ‘তোমরা ইনভ্যালিড।’ আর তারপর গিয়ে ধাক্কা মারলো খ্যাক খ্যাক করে দাঁত হাসতে থাকা লাল ইঁটগুলোর পোড়ামুখে।
শেষে বৃষ্টি নামলো। জড়ো হওয়া অসংলগ্ন অশক্ত পাতাগুলোর চোখ বেয়ে নামলো, তাদেরই মৃত্যুপরোয়ানা হাতে। গোটা শহরটা ধূসর রং থেকে সাদা হয়ে গেল। শহরটা ভেবেই পাচ্ছিল না এমনি কেন হলো। কিন্তু ব্যাপারটা তার হাতে ছিল না। এতো বড়ো শক্তিশালী শহর আস্তে আস্তে নেশায় বুঁদ হয়ে তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললো। আর বৃষ্টিরা তার সমস্ত শরীরের আশপাশ দিয়ে ঢুকে পড়ছিল। শহরের অনিচ্ছাতেই তারা অনুপ্রবেশ করলো তার শরীরের ভেতরে। অসহায় হয়ে চুপচুপে ভেজা কলকাতা দেখলো তার গোপন সমস্ত অঙ্গ বেয়ে জল পড়ছে। সে শিউরে শিউরে উঠছিল। এতদিনের জমে থাকা পাপ তার হাইড্রান্টের কালো জল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একমাথা ভেজা চুলে নিজের শাস্তি শুনছিল সেই শহর। সাক্ষী ছিল কেবল কয়েকটা পালকভেজা চড়ুই আর অবাক কিছু মানুষ।

মানুষের একটাই দোষ। সে সবসময় যেন কী একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মুরগি যেমন মাথা নীচু করে মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়, মানুষও সারাটা জীবন তাই করে গেল অন্য মুরগিগুলোকে দেখে দেখে। সাহস করে কোনোদিন আকাশের দিকে সোজা মুখ তুলে তাকাতেই পারলো না, পাছে চোখে বৃষ্টির ফোঁটারা পড়ে তাকে কাঁদিয়ে ফেলে!
এই মানুষটাও বৃষ্টিদের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। সে বৃষ্টির মধ্যে খুঁজছিল তার ফেলে আসা গ্রামের ছেলেবেলা আর ভেজা হাফপ্যান্ট পরা বন্ধুদের। বৃষ্টিদের আয়নায় নিজেকে দেখে সে জানতে চাইছিল, কিসের সন্ধানে সে এসেছিল? জীবন খুঁজতে কি কেউ জীবনের বাইরে আসে? কিন্তু জলের দাগ পড়ে পড়ে পুরোনো আয়নায় দাগ হয়ে গেছল গোল গোল, তাই আর তাকে উত্তরগুলো কেউ বললো না।
তারপরেই কাট। এবং প্যান করে আরেকটা মানুষ। সেও কিছু চায়। ভেজানো জলের বিন্দুগুলো তার মাথার জুড়েমুড়ে যাওয়া চুলগুলো ভিজিয়ে পালাতে পালাতে জানতে চাইছিল, তার এতো দুঃখ কীসের। বৃষ্টিটা তার দুঃখ দেখে তার থুতনি ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
তখন মানুষটার গল্প নীল রঙের টিনের ছাদে টং টং করে রাগতস্বরে আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগলো। আর তার জীবনের ব্যর্থতা গলে গিয়ে টিনের চালের বাঁকগুলো বেয়ে পড়ে গেল, মানুষটার তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু যে ব্যর্থতা জড়িয়ে বেঁচে থাকে, ব্যর্থতা ভাঙিয়ে খায়, তার কাছ থেকে গল্পগুলো চুরি করে নিলে কীইবা বেঁচে থাকে, বলো? তাই সে মেঘলা আকাশের নীচে বৃষ্টিকে তাড়িয়ে দিল। তার গল্পটাও না বলা হয়েই রয়ে গেল। যদি কোনোদিন সে বলে ফেলে, তার আশায় বৃষ্টিরা আবার দিন গুণতে লাগলো।

এতোক্ষণ ধরে একটা মানুষ একাএকা ছাদের ট্যাঙ্কের ওপর বসে ছিল। সে ভিজছিল না। কিন্তু সে ভিজে যাচ্ছিল। চুল বেয়ে, কালো জামা বেয়ে তাকে আরো ছেঁকে ধরছিল বৃষ্টির দল। তবু সে একটুল নড়ছিল না। কারণ বোধহয় তার বৃষ্টির কাছ থেকে কিছু নেবার ছিলনা। সে আজকের আকাশ দেখে কিছুই আশা করেনি। কেবল বয়ে যাওয়া সোঁদাগন্ধ বাতাসে ডাস্টবিনের মতো সে তার কালো অংশটুকু উড়িয়ে দিচ্ছিলো। ঠান্ডা ভেজা বাতাসেরা অনায়াসেই তার কাছ থেকে সবকিছু শুষে নিচ্ছিল, শহরের অন্যপ্রান্তে অন্য কাউকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাই তার কাছে বৃষ্টিরা পাত্তা পাচ্ছিল না। তার লম্বা দাড়ি বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটারা লাস্যময়ী নায়িকার মতো চুমু খেয়ে যাচ্ছিল এক অসহায় আকুতিতে, আর সে কেবলই তাদের বেশ্যাবৃত্তিকে নির্বিকারভাবে গা বেয়ে পেরিয়ে যেতে দিচ্ছিল।
আমি নিচে নেমে গেলাম। একটু লিখতে হবে।

দল-আ-দলি

একদল ভাবেনা, করেও না। নিউট্রাল মাসের মত একগাদায় ধপাস করে পড়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে খাবার খায় আর সমাজের ডালে ঝুলে থাকে। সবচেয়ে সুখী জীব।

একদল ভাবে,কিন্তু করতে চায় না। ফলে তাদের ভাবনাগুলো ঘুরেফিরে খুলিতে ধাক্কা খায়, বেরোতে পারে না, একসময় ধীরে ধীরে নেক্রোসিসে মরে যায়।তারা এরপর প্রথম প্রকারে পরিণত হয় আর বুড়ো বয়সে স্মৃতি রোমন্থন করে।

একদল ভাবে না,কিন্তু করার ইচ্ছে প্রবল। ফলে সেটা কাজের বদলে অকাজ হয়ে দাঁড়ায়। কি করতে হবে, সেটা জানার মতো মানসিক পরিশ্রম এদের ধাতে নেই।

একদল ভাবে, করতেও চায়, কিন্তু জীবন আর দায়বদ্ধতা তাদের করতে দেয় না। এর মধ্যে দুটো সাবক্লাস আছে, যারা এটা মেনে নেয় আর যারা মেনে নিতে পারে না।
যারা মেনে নেয়, তারা প্রথম প্রথম একটা অস্বস্তি অনুভব করে। তারপর হতাশা। সেই হতাশা থেকে তৈরি হওয়া নির্লিপ্ততা আস্তে আস্তে জোম্বির মত মাথা খেয়ে তাদের প্রথম প্রকারে পরিণত করে দেয়।
যারা মেনে নেয় না, তারা ছটফট করতে থাকে। সেই ছটফটানির কোনো উপমা নেই। মাঝে মাঝে জীবনকে কাটিয়ে উঠতে চায়,মাঝে মাঝে দায়বদ্ধতাগুলোকে।সবচেয়ে অশান্ত জীব।এরাই মাঝে মাঝে অ্যাটম বোমার মত ফেটে যায়, আবার কখনো আগের বছরের মিইয়ে যাওয়া ধানিফটকার মতো ফুস হয়ে যায়।

একদল হলেন সারস্বতসাধক। তাঁরা আশীর্বাদপ্রাপ্ত। লেখক-বাদক-গায়ক-অাঁকিয়ে-পরিচালকের দল। তাঁদের সৃষ্টির কাছে সমাজ মাথা নত করে,দূর থেকে। তাঁরা নিজেদের জগতে সমাজের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে, কিন্তু সমাজের দোষত্রুটিগুলোর প্রতিবাদ তারা নিজেদের ভাষায় করে যান।

আর শেষের দল। তাঁরা ভাবেন সমাজের জন্য,ব্যথা পান, সেই ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করেন। হ্যাঁ, কাজ। ছোটো হোক, বা বড়ো। নিজের মতো করে একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনেন। সেটার জন্য ফেসবুকে পোষ্ট দেন না, লোকজন ডেকে ইভেন্ট ক্রিয়েট করতে হয় না এমনকি কোনো সংগঠনের ছত্রছায়ায় থেকে আর্থিক অনুদানও প্রয়োজন নেই তাঁদের। সেই যে মানুষটা তার রোজগারের ৫০% অনাথ আশ্রমে দেয়, যে তার মৃত্যুর আগে তার সব সম্পত্তি হাসপাতালকে দিয়ে যায়, যে লোকটা একটা পাহাড়ী গ্রামে গরিব বাচ্চাদের পড়ায়, কার যেন বাড়িতে রোজ ১০টা রাস্তার লোকের পাত পড়ে, সেই সর্দারজী যার অটোতে পথদুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীরা নিখরচায় হাসপাতালে যেতে পারেন, যে লোকটা নিজের বেতনের পয়সায় রোজ একটা করে চারাগাছ লাগায়, সরকারী রাস্তার গর্ত ভর্তি করে বেড়ায় নিজের পেনশনে… তাদের কিন্তু ফেসবুকে ছবি তুলে শেয়ার করতে হয় না,নিউজপেপারে তাঁদের ছবি উঠেই হারিয়ে যায়, তাঁরা ইন্টারভিউতে অস্বস্তি বোধ করেন, তাঁদের পরিজন-পাড়া-প্রতিবেশী পাগল বলে; কিন্তু তাঁরা খুব আনন্দে থাকেন,শান্তিতে থাকেন।

এদের একজন হতে চাই। ফেসবুকে লিখে চেনা বৃত্তে তরঙ্গ তুলে কী হবে, যখন জানি তা বৃথা? মেডিক্যাল কলেজ,পুরুলিয়া জিলা স্কুল, ডাক্তার-হবু ডাক্তার সমাজ আর ফেসবুক-লেখক বৃত্তে বাতেলা দিয়ে নিজের আত্মলেহনের সুখ আসতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবনে নেমে এসে কাজ করে কোনো একটা মুখে হাসি না ফোটাতে পারলে এই সেলফ-ইম্পোজড উচ্চ মোরাল গ্রাউন্ড মিথ্যা।

দিন কেটে যায়।

আনন্দ-বাজার

কাল একখানা আনন্দবাজার কিনেছিলাম। কিনেছিলাম, কেননা ট্রেনের সব সিট ভর্তি ছিল। মাটিতে পেতে বসা ছাড়া আনন্দবাজার কেনার কোনো কারণ দেখি না আমি।
যাই হোক, ট্রেন ছাড়ল। আমিও বাথরুমের সামনে কাগজটা পেতে গ্যাঁট হয়ে বসলাম। সঙ্গে একখানা ‘পত্রিকা’ নামের সাপ্লিমেন্ট ছিল। চোখ পড়ল একখানা লেখায়। বসন্ত নামে শ্রীজাতর একখানা লেখা।

লেখাটা সুখপাঠ্য। অবভিয়াসলি। প্রেম, মনখারাপ আর নস্টালজিয়া মিলিয়ে তরল একখানা লেখা।
কিন্তু পাঠক হিসেবে আমাকে একটা জিনিস ভাবালো, পুরো লেখাটার মধ্যে শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার আছে, কিন্তু কোনো মানে নেই লেখাটার। মানে, কনটেন্ট বলে যে কিছু হতে পারে লেখাটার, সেটা মনেই ছিল না বোধহয় লেখকের।
এটা কী কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনাকে আমরা চামচে করে গুলে নস্টালজিয়া আর প্রেম খাইয়ে দিচ্ছি, আর আপনি সোনামুখ করে সেটা খেয়ে চলেছেন। এক প্যারাগ্রাফের সঙ্গে অন্য প্যারাগ্রাফের কোনোরকম মিল নেই। কয়েকটা মনভোলানো শব্দ পরপর বসিয়ে আপনাকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সবকিছু।
‘রোদপালানো ছেলেবেলা’ এই শব্দবন্ধটা অর্থহীন বাগাড়ম্বর, আপনাকে কেবল টুকরো টুকরো ছেঁড়া কিছু দৃশ্যপট মনে এনে দেওয়ার চেষ্টা।
লেখাটায় এটা স্পষ্ট যে, লেখকের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই, বা তিনি আপনার কোনো মনের কথাকেও তুলে ধরছেন না, কেবল ফরমায়েশে পড়ে দোকানে বসে মনখারাপ বিক্রি করে যাচ্ছেন কেজিদরে।

বুঝি না মানুষ কেন এত প্রেম আর নস্টালজিয়া খায় গান্ডেপিন্ডে? উত্তর কলকাতার গলি, ছাদ, বিকেল, বসন্ত আর প্রেমিকার চুমু দিয়ে লেখক প্রেমকে বেঁধে দিলেই আপনি গলে যাবেন?
বুঝি আপনি বাস্তব জীবনের ঠোক্করে ক্লান্ত, চলতে চলতে হোঁচট খেয়ে আপনার জুতো হাঁ হয়ে গেছে, তাই আপনি এসেছেন। জুতো সেরে দিতে হবে। কিন্তু সেটা যেন রূপকথার মেঘ দিয়ে সারতে না হয়, বাস্তবের সুতোই ভালো।

পাতার পর পাতা শব্দ লিখে ফেলে আপনার মন ভোলাতে চাই না। ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ হবে না আমার দ্বারা। আমার শহরে যখন মানুষ খেতে পাচ্ছে না, পড়তে পারছে না, পরতে পারছে না, তখন সাঁঝবেলার রূপকথা লিখে আপনার চোখ বাস্তব জীবন থেকে সরিয়ে নিতে চাইনা, তাহলে আরো হোঁচট খেতে হবে।
আরো দুঃখ দেব। আরো কষ্ট দেব। সেইসবের কথাই আপনাকে ভাবাব, যা আপনার ভাবা প্রয়োজন।

জীবন রূপকথা নয়। রূপকথা শুনে লাভ নেই।আমাদের আশায় বসে থাকবেন না। চারদিকে চোখ ফেলুন। কালিঝুলি মাখা অনেক রূপকথা ছড়িয়ে আছে।
অবশ্য, আনন্দবাজারে পাবেন না।

পুনশ্চ: শ্রীজাতর প্রতি কোনও অসূয়া নেই। এটা জয় গোস্বামী বা প্রচেত গুপ্তও হতে পারতেন। 🙂

একটি পৈশাচিক গল্প

দৃশ্য ১:

সতীশের বাবা বিরাট উকিল। বিরাট মানে, সত্যি বিরাট। পাতি পাবলিকের গাদাগুচ্ছের অ্যাপয়েন্টমেন্টের দরখাস্তগুলো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায় তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো কালো কাঁচের ভিআইপি গাড়িগুলোকে দেখে। কোর্টে দাঁড়িয়ে যখন তিনি গলা ঝেড়ে ‘ইয়োর অনার!’ হাঁক দেন, তখন শুধু আসামী না, জজের বুকটাও একটু কেঁপে ওঠে।

এতোক্ষণ তাঁর কাজের পরিচয় পেয়ে চোখের সামনে যে মানুষটা ভেসে উঠছে, রমণীমোহনবাবু ঠিক সেরকমই। লম্বা-চওড়া, ফিটফাট, মুখে সবসময় ধমক, আর বাড়ির বারান্দা দিয়ে যখন হেঁটে যান তখন পিঁপড়েগুলোও ভয়ে ফুটোতে ঢুকে পড়ে। এমনকি, লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপারে বসে বাবার গাঁদাঝোলানো ছবির সামনে যখন বাঁহাতে সাদা খামগুলো নেন, তখনও মুখে গাম্ভীর্য ছেয়ে থাকে।
তা এমন মানুষকে ছোটোবেলা থেকে চোখের সামনে দেখলে অন্ধ অনুসরণ ছাড়া আর উপায়ই কী! বিশালত্বের মুগ্ধতায় বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে ট্রাইসাইকেল চালানোর বয়স থেকে জ্যান্ত সুপারম্যানকে দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া সতীশ তাই কখনো মুখ ফুটে বলে উঠতেই পারলো না যে, তার ইংরেজি সাহিত্য পড়তে খুব ভালো লাগে। সেটা নিয়ে পড়তে পারলে তার খুব ভালো লাগবে।

বলতেই পারলো না। তাই, ২৪ বছরের সতীশ এখন নামীদামী কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করে বাবার জুনিয়র হয়েই কোর্টে যায়। কালো কোট আর মোটা বইয়ের তাগাদায় শেলী-কীটসরা কীটদের কবলে পড়েই প্রাণ হারিয়েছে।
যাই হোক। একদিন কোর্ট থেকে ফেরার সময় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মরে আসা বিকেলে গাড়ির নরম গদিতেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা উঠলো। গাড়ির ড্রাইভার, ওহ্ সরি, শোফার নিপুকাকা রাস্তার দিকে চোখ রেখে যেটুকু শুনতে পেয়েছিল, সেটুকুই তুলে দিলাম—
– “তোমার বিয়ের কথা চলছে, বুঝলে? তোমার মা মেয়ে-টেয়ে দেখছেন।”
– “বিয়ে? এখনিই? হঠাৎ?”
– “হঠাৎ মানে! চল্লিশে গিয়ে বিয়ে হবে নাকি!
তোমার আপত্তির তো কোনো কারণ দেখছি না।”
– “ইয়ে..
– “কি? কোনো মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছ নাকি? তাই বলি, কদিন ধরে ব্রিফগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না কেন!”
– “না না বাবা! ওসব কিছু নয়! সেরকম কেউ নেই।”
– “না থাকলেই ভালো। যাকে-তাকে তো ধরে এনে ফ্যামিলিতে ঢুকিয়ে দিতে পারি না!”

ব্যাস। সতীশের মা মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। সতীশ প্রতিদিনের মতো কোর্ট যেতে লাগল। কথাটা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
দৃশ্য ২:
নিকিতা খুব ভালো মেয়ে। মা-বাবার খুব বাধ্য। পড়াশুনো করে, গান শেখে, ওরিগ্যামি শিখেছে নিজের উৎসাহে। কেবল তার একটাই লজ্জা। সে কালো। আর, কালো মেয়েদের যে বিয়ে হওয়া মুশকিল, একথা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে।
তাই সরকারি চাকুরে ভালোমানুষ বাবার কাঁধের বোঝা হবার লজ্জায় সে চেষ্টা করে যতটা সম্ভব লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে। তার জীবনে ছেলেবন্ধু নেই, প্রেম নেই, সিসিডি নেই, সাউথ সিটি নেই। শুধু আছে হলুদ, দই, বেসন আর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির একগাদা চ্যাপটা টিউব।

অাশ্চর্যজনকভাবে, নিকিতাদের দোতলা বাড়ির সামনেই একদিন রমণীমোহনের হুন্ডাইটা এসে ঘ্যাঁস করে দাঁড়ালো। অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার! কোথায় হাইকোর্টের দুঁদে উকিল রমণীমোহন সমাদ্দার, আর কোথায় রাইটার্সের সামান্য অফিসার প্রতাপ ভট্টাচার্য!
প্রতাপবাবুও প্রথমে খবরটা পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলেন। আনন্দবাজারে গত তিনমাস ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সাড়া যে পাচ্ছিলেন না তা নয়, কিন্তু কোনোটাই আর পাকাপাকি স্থির হচ্ছিল না। কারও হতাশা ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’ মেয়েকে ‘শ্যামবর্ণা’ মনে হওয়ায়, কারও নাকউঁচু গয়নার ভরিগুলো কম হওয়াতে, কারও বা ‘পরে খবর দেব পছন্দ হলে’ বুলিতে স্পষ্ট ভদ্রতায় মোড়া প্রত্যাখানের ছাপ।
হঠাৎ রমণীমোহনের ফোন, সামান্য কিছু খোঁজখবর আর ডেট ফিক্স করে মেয়ে দেখতে আসা! অবশ্য ডেট ফিক্স করার কিছু ছিল না। রমণীমোহন ‘তাহলে ৬ তারিখ বিকেল ৫টায় আপনার ঘরে আসছি’ আর ‘রাখলাম’ কথাদুটোর মধ্যে বেশিক্ষণ ফাঁক রাখেননি।

যাই হোক। কথা হলো, সিঙাড়া হলো, মেয়ের গান হলো, ওরিগ্যামির কাজ দ‌েখা হলো। উকিল সাহেবের মেয়ে পছন্দও হলো। তার আসল কারণটা কী, জানা ভারি মুশকিল!
মেয়ের গায়ের রঙের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা টাকার থোকটা কল্পনা করে, নাকি যৌবনের কাঁচামাথার প্রেম কালো হরিণ চোখের কথা মনে পড়ায় মন দুর্বল হয়ে গেছল, তা জানা যাবে না হয়তো কোনদিনই।
দৃশ্য ৩:
বিয়ে হল। ধুমধাম হল। প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে বৌ নিকিতার গাভর্তি গয়না হলো। সতীশ ওয়েডস নিকিতা লেখা গাড়ি হলো। উকিলবাবুর ক্লোজ সার্কেলে ঢুকুঢুকু হলো। বাসররাতে আদিরসাত্মক চুটকি হলো। অর্থাৎ, যা যা হবার তাই হলো।
সতীশ কী চায়, সেটা অবশ্য কেউ জানতে চাইল না। প্রয়োজনও ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই তাকে নতুন খেলনা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পেয়েছে, তাই খেলনা পেয়ে ভুলে থাকতে সে জানে।

নতুন বিয়ের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। অন্তত উপর উপর দেখলে তাই মনে হতো। সতীশের গালে নতুন চেকনাই, নিকিতার মুখে ঝুলিয়ে রাখা হাসি আসল অবস্থাটা কিছুতেই কাউকে বুঝতে দিতো না।
রমণীমোহনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজকে কপি করতে চাওয়া সতীশ যে কীরকমভাবে নিজের সারাজীবনের ফ্রাস্টেশনগুলো বের করতে পারে, বন্ধ বেডরুমের দরজাটা ছাড়া সেকথা আর কেউ জানতো না।
কথায় কথায় বিদ্রূপ, গায়ের রঙ নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় ব্যঙ্গ আর হাসি, পান থেকে চুন খসলেই মানসিক নির্যাতন এসব তো চলতোই। ভদ্রবাড়ির ছেলে তো, শারীরিক নির্যাতন সরাসরি কখনোই করতো না। সেটা শুরু হতো রাতের বিছানায় বিভিন্ন পজিশন আর বেশ্যার মত নিকিতার দেহকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে, আর শেষ হতো সকালবেলা বাথরুমের দরজার ওপারে নিকিতীর নিশ্চুপ কান্নায়। তারপর, কান্না মুছে, হ্যাঙ্গার থেকে ব্রেসিয়ারটা আর মুচকি হাসিটা নিয়ে পরতো— এভাবেই দিন শুরু হতো তার।

এরকমই চলছিল। থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। একবছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। নিকিতার ওজন আর চোখের কালির পরিধির সঙ্গে সতীশের কেরিয়ারের উন্নতি সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলল।
এবার একটা নতুন দিক থেকে চাপ শুরু হল। রমণীমোহনের ইচ্ছে হল একটি নাতিলাভের। কে জানে, তাঁর হয়তো পরিবারে আরেকজন উকিল প্রয়োজন ছিল। প্রথমে তিনি পুত্রবধূকে ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন। ইঙ্গিতগুলো প্রথমে মৃদু হলেও, আস্তে আস্তে কথাগুলো জোরের সঙ্গেই শোনাতে শুরু করলেন।
খাওয়ার টেবিলে অনাগত পৌত্রের নামকরণের আলোচনা, তার কেরিয়ার নির্ধারণের আলোচনাগুলোতে পরিবারের বাকি সবাই সোৎসাহে অংশগ্রহণ করতো, কেবল নিকিতা ভয়ে সিঁটকে থাকত এককোণের চেয়ারে।

এটাকেই বোধহয় পারফরমেন্স প্রেশার বলে, তাই না?
দৃশ্য ৪:
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নিকিতার পেটে ছেলে এল না। মেয়েও এল না। নামকরা নার্সিং হোমের গাইনিকোলজি স্পেশালিস্ট লেডি ডাক্তার বললেন, ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রবলেম আছে, তাই নিকিতা কোনোদিনই স্বাভাবিকভাবে মা হতে পারবে না।
মানে, ঠিক এতোটা সহজভাষায় বলেননি। কিন্তু মেডিক্যাল টার্মগুলো বাদ দিয়ে পাড়ার কাকিমাদের পিএনপিসি করার ভাষায় বললে এটাই দাঁড়ায়।
এরপর যা যা হবার তাই হলো। সবার থমথমে মুখ, শাশুড়ির গজগজ, শ্বশুরের খোঁটা আর সতীশের মুখখিস্তি সহ্য করে একদিন নিকিতা সতীশের হাত ধরে দাঁড়ালো ফার্টিলিটি সেন্টারের কাঁচের দরজার মুখোমুখি।
হলো না। কিছুই হলো না। অসংখ্য ম্যাগাজিন, এসি আর সাদা সাদা চেয়ারগুলোতে সিটিং আর অপেক্ষার পর যখন টেবিলের ওপার থেকে ‘অ্যাডপশন’ শব্দটা শুনতে পেল, তখনই নিকিতার মুখখানা একধাক্কায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

এরপর থেকেই কেমন যেন বদলে গেল ঘরের পরিবেশটা। সতীশ আর খারাপ ব্যবহার করে না, শাশুড়ি চুপ, রমণীমোহনকে তো দেখতেই পাওয়া যায় না। এমনিভাবে ২দিন,৩ দিন, এক সপ্তাহ চলে গেল। নিকিতা বুঝতে পারছিল এরকমই কিছু একটা হবে, কিন্তু এই দমবন্ধ পরিবেশে তার গা গুলিয়ে উঠছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে সে নিজের কপালের লিখনকে গালিগালাজ করতো, কান্নাকাটি করতো আর তারপরে নিজেকে ভোলাতে ডুব দিত ঘরকন্নার কাজে।
ঘরের অবস্থা যে কে সেই। মাঝে মাঝে ফুসফুস গুজগুজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে, সে ঘরে ঢুকলেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার সঙ্গে কেবল দরকারের কথাটুকু বাদ দিয়ে কোনো কথা হত না।
মাঝে একদিন হঠাৎ শাশুড়িমা তার সামনেই সতীশকে ডেকে বললেন, “রান্নাঘরের গ্যাসের নবটা একটু ডিস্টার্ব করছে, বুঝলি? একটু সারাবার ব্যবস্থা করিস তো।”
সময়টা সকালবেলা। সতীশ খেলার পাতা পড়ছিল। রমণীমোহন এডিটোরিয়াল। দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
সতীশ বললো, “আচ্ছা। দেখছি।”

তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা। নিকিতা ভাতটা সবেমাত্র চাপিয়েছে কি চাপায়নি, তার নাকে কেমন একটা গন্ধ লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে তার চোখে পড়ল, সিলিন্ডারের মুখটা কে যেন হাঁ করে খুলে রেখেছে! বাইরে খট্ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে। পাগলের মতো সে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
দরজা আর খুললো না।

কয়েক মিনিটের ব্যাপার। ঘরের ভেতর থেকে পাশবিক চিৎকারটা ১০ মিনিট মতন শুনে তবেই দরজা খুললেন রমণীমোহন। জল-টল সব রেডিই ছিল। আগুন নেভালেন কোনোমতে। তারপরে হাঁকডাক শুরু করলেন।
দৃশ্য ৫:
স্থান মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট। থার্ড সেমেস্টারের ছাত্রদের সার্জারি ওয়ার্ড চলছে। আজই প্রথম দিন। একদল অ্যাপ্রন পরা উৎসাহী ছাত্রছাত্রীকে পেছনে নিয়ে আরএমও ঢুকলেন। তাঁর পেছন পেছন দুজন পিজিটি, মানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি।
এসি চলছে। ঘরটা একদম ঠান্ডা।আরএমও এগিয়ে গেলেন তিন নম্বর বেডের দিকে। কেস হিস্ট্রিটা হাতে এগিয়ে দিলেন একজন জুনিয়র ডাক্তার।
পেছনের ভিড়টার দিকে ফিরে তিনি বলতে শুরু করলেন, “এদিকে তাকাও। এটা হচ্ছে একটা বার্ন কেস। এটা কত পার্সেন্ট বার্ন হয়েছে বলতো? কেউ জানো, কিভাবে শরীরে বার্নের পার্সেন্টেজ ক্যালকুলেট করা হয়?”
গোল গোল চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি একজন পিজিটির দিকে ইশারা করলেন। সে শুরু করল, “দ্যাখ, এটাকে রুল অফ নাইন বলে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মাথা ৯%, পুরো বুক নয় দুগুণে ১৮%, পিঠও ১৮%, হাত দুটো ৯% করে, প্রতি পায়ের সামনেটা ৯ আর পেছনেরটা ৯, আর শেষে পেরিনিয়াম মানে জেনিটাল এরিয়াটা ১%।” এই বলে সে থামল।
আরএমও তখন বললেন, “এই কেসে এটা ৯৯% বার্ন হয়েছে। জেনিটাল এরিয়াটা বেঁচে গেছে। আচ্ছা কেউ বলতে পারবে, এটা কতো ডিগ্রি বার্ন?”
একজন পড়ুয়া ছাত্র তখন পেছন থেকে উত্তর দিলো, “স্যার, এটা বোধহয় সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন। কারণ এপিডারমিস ডারমিস দুটোই পুড়েছে।”

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে কালো হয়ে যাওয়া বীভৎস দেখতে শরীরটা অনেক কষ্টে উঠে বসলো বেডের উপর। আত্মীয়স্বজন যারা বেডের পাশে ছিল, তারা চোখের জল মুছে তাকালো। গোঁগোঁ করতে করতে নিকিতা কীসব বলতে লাগল, কেউ বুঝে উঠতে পারল না। খুব কষ্ট করে কান পেতে বোঝা গেল, ও বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছে, “শাস্তি দিন ওকে ডাক্তারবাবু। পুড়িয়ে মারল আমাকে। আগুন আগুন। গোটা গা জ্বলে গেল। শাস্তি দিন ডাক্তারবাবু।”
এসবের মাঝে একজন ছাত্র অবাক হয়ে ফিসফিস করে ইন্টার্ন দাদাকে জিজ্ঞেস করল, “এতটা পুড়েও বেঁচে যাবে!?”
দাদা ঠোঁট উল্টে বলল, “না না। পাগল নাকি! আজই তো ভর্তি হল। কাল পরশুই ডিহাইড্রেশন বা সেকেন্ডারি ইনফেকশনে মারা যাবে।”
দৃশ্য ৬:
দুদিন পরের ঘটনা। নিকিতা মারা গেছে। নিকিতা এখন আর নিকিতা নয়। ঘরের লোকজনের কাছে ‘ও’, ডাক্তারদের কাছে ‘বডি’ আর ডোমদের কাছে ‘লাশ’। তো, সেই ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ এখন মেডিকেল কলেজের মর্গে।
রাতের বেলা। ঠান্ডা মর্গে নিকিতার ডেডবডি শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। হয়তো সে প্রতীক্ষা করছে এক সুন্দর সকালের। যেখানে তার চামড়া খসে যাওয়া বডিটা কেটেকুটে পোস্টমর্টেম করবে হেড ডোমরা, আর পাশে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকবেন ফরসা ডাক্তারবাবুরা।

হঠাৎ সেই মড়ার আর প্রতীক্ষা সহ্য হলো না। রাতের অন্ধকারে মড়াখেকো ইঁদুর আর নাম না জানা পাখির ডাককে সাক্ষী রেখে উঠে বসল সেই মড়া!
অপঘাতে মৃত দেহের সৎকারের পূর্বেই তার প্রেতত্বপ্রাপ্তি হলে সেই অতৃপ্ত আত্মাকে পিশাচ বলে। পিশাচেরা নিজের অপূর্ণ কাজ শেষ করার জন্যই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
সাদা মার্বেলপাথরের টেবিলের ওপর সোজা হয়ে বসল ভয়ঙ্কর এই প্রেতাত্মা। তার চোখের কোটরদুটো কালো। গোটা গায়ের চামড়া কিছু খসে পড়েছে, কিছু কালো হয়ে গেছে, আর কিছু জায়গায় রয়ে গেছে।
উঠে বসে সে একখানা হাড়হিমকরা চিৎকার করল! পাশবিক সেই চিৎকার লাল দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে গেল। শুনতে পেল শুধু একখানা কালো প্যাঁচা। সে তাল মিলিয়ে ‘হু-হু-হুউউউ’ করে চিৎকার করে উঠল।

এবার টেবিলের মড়া মাটিতে নামলো। সাদা চাদর হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল একদিকে। সে হেঁটে বেড়াতে লাগল মর্গের এদিক থেকে ওদিক। তার অস্থির দৃষ্টি যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটা জিনিস তার চাই, যার সাহায্যে তাকে তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে। নইলে প্রেতদশা থেকে তার মুক্তি নেই।
খুঁজে পেল! খুঁজে পেয়েছে সে সেই জিনিস!
দেশলাইয়ের একটা বাক্স। বিকেলবেলা হেড ডোম শিবজী আর তার চেলারা বিড়ি ফুঁকছিল মনের সুখে এককোণে বসে। তারাই মনের ভুলে ফেলে গেছে।
বাক্সটা পেয়ে মড়ার চোখের কোটরে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠল।

সে দেশলাই বের করে তাকালো নিজের নিরাবরণ দেহের দিকে।
তারপর অক্লেশে পাশবিক এক প্রতিহিংসায় আগুন লাগিয়ে দিল নিজের যৌনাঙ্গে!
গোটা দেহে মাখিয়ে রাখা মোমজাতীয় পদার্থের প্রলেপের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে বিক্রিয়া করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তার দেহের একমাত্র অবিকৃত অংশটুকু।
পটপট শব্দে পুড়ে যেতে লাগল তার যৌনকেশরাশি।
রক্তজলকরা পাশবিক কন্ঠে সেই পিশাচ চেঁচিয়ে উঠল, “নে! ১% ও আর বাকি রইল না! পোড়ালি যখন, পুরোটাই পুড়িয়ে ফেল! জ্বালিয়ে দে আমায়! মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন, ১০০ ভাগ না জ্বালিয়ে ছেড়ে দিবি কেন?! জ্বলুক! সব ছাই হয়ে যাক!”
অসহ্য যন্ত্রণায় ভরা পৈশাচিক সেই কন্ঠ শুধু চেঁচিয়ে যাচ্ছিল ‘আহ্! জ্বলে গেলাম!’ ‘পুড়ে গেলাম’ ‘আহ! কী শান্তি!’ ‘পুড়িয়ে শান্তি পেলি এবার?’

আস্তে আস্তে জীবন্ত মড়া আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
দূরে তখন কোনো এক রাতজাগা ছাত্রের ঘরে বেজে চলেছে, “ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে…”
(সমাপ্ত)

ঘাটশিলা

বিভূতিভূষণের বাসস্থান তো দেখে আসা গেল না সময়ের দৌরাত্মিতে, তবে তাঁর ‘ঘর’ দেখে এলাম বইকি! সবুজে লালে মিলেমিশে একাকার ভালোবাসায় কেউ যদি একযুগ মিশে যায়, তবে সে একখানা ‘আরণ্যক’ লিখে ফেলতে পারে অনায়াসে।

ভালো থেকো বুরুডির ভোরঠান্ডা জলের ছোঁয়া।

ভালো থেকো সবুজ পাহাড়ের ছোঁয়ায় সবজে-সাদা জলের দ্বিখন্ডিত সীমারেখা।

ভালো থেকো লালমাটির ছোঁয়ায় লালচে চটি।

ভালো থেকো ২০০১ এর নানা রকমের দোলনাওয়ালা একলা জনশূন্য হলুদ রঙের পর্যটন কেন্দ্র, যার দেওয়ালগুলো লাফিয়ে বেরোনো যায় না।

ভালো থেকো খুঁজে না পাওয়া সেই বুড়়ো কালাকাঁদের দোকান।

ভালো থাকুক সেই বিশাল পাথুরে পাহাড়, যে আমাকে আবার শেখালো, ডেভিডদের লড়তেই হয়। হারিয়ে যাবার, পিছিয়ে পড়বার অলসতা এখানের নিয়মবইতে নেই।

ভালো থাকুক তারা,যারা আমায় উপর থেকে ডেকেছিল,আর আমি শৃঙ্গজয়ের দুঃসাহসিকতায় হাঁচোড়-পাঁচোড় করে ঝরাপাতা আর ছুঁচলো পাথর বেয়ে উপরে উঠেছিলাম।

ভালো থাক সেই লাল হয়ে যাওয়া হাতের তেলো আর আধছেঁড়া জিনসের প্যান্ট।

ভালো থাকুক সেই সরুচুলের ঝর্ণা আর তার বিষঠান্ডা জল, যার খোঁজে তিনটে এককাট্টা লোক মাথায় গামছা বেঁধে এগিয়ে গেছল।

ভালো থেকো সেই সাত কিলোমিটার পাথুরে এবড়োখেবড়ো রাস্তার প্রতিবন্ধকতা।

ভালো থাকবে সেই ছোট্টো গ্রামদুটো, যাদের জল-আচরণে আমাদের চরণগুলো রক্ষা পেয়েছিল।

ভালো থাকুক সেই নিকোনো দাওয়া আর সোলার প্যানেলের উন্নতির মাঝে সেই বুড়িমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ।

ভালো হোক সাদাহাসির সেই ট্র্যাক্টরচালক আর একগাদা দেবের গান গাওয়া ছেলেগুলোর।

ভালো হয়ে উঠুক ঠোক্কর খাওয়া সেই আলনার নার্ভ, যেটা এখনো মাঝে মাঝে কটাং করে উঠছে।

ভালো থাকুক ঠান্ডা স্নান আর বহুদিন পরের সেই সাঁতার।

ভালো থাক পেটপুরে মাংস-ভাতের থালা।

ভালো থাকুক বাস দেখে একদঙ্গল কচির মুখে হাত দিয়ে উল্লাসধ্বনি।

ভালো থেকো পলাশ-মহুল-শিমূলের রঙিন পাগলামি।

ভালো থেকো ঘাটশিলা। খুব ভালো থেকো। পরের দেখায় মিলনের কোলাকুলি হবে তোমার সঙ্গে।

আর হ্যাঁ, উন্নতি করতে যেও না। বলভদ্র সেঙ্গাই গিয়ে উন্নতি করুক। তার আরও মহিষ হোক।
তুমি এমনই থেকো।
ইতি,
সেই ভালোচোখের ছেলেটা

আস্তিক

আমি থাকি হোস্টেলে। জ্ঞানীগুণীরা জানেন, হোস্টেলের খাবার কী চিজ। আমি দুবলাপাতলা লোক, তায় দুমাস ধরে শসাদার খাবার খেয়ে না-কাটা চাপদাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল নিয়ে যখন বাড়ি যাই, তখন ঘরের লোক সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবে, না ঘরেই ডাক্তার ডাকবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না!
তাই আমি নাকি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারিনা, এরকম একটা ভুয়ো অপবাদ মার্কেটে ছড়িয়ে গেছে। আমি নাকি সুস্থ থাকার মিনিমাম চেষ্টাটুকুও করিনা। তো, এইসব করিনা-ক্যাটরিনার চক্কর ছেড়ে আজকাল একটা হোটেলে খাওয়া শুরু করেছি।

বেশ ভালো হোটেল। ছোটোখাট্টো। নাম হচ্ছে সুপ্রিয়া, কিন্তু আপনি কোথাও নামটা খুঁজে পাবেন না। চার-পাঁচটি পুরনো চটে যাওয়া বেঞ্চি পাতা আছে। মাঝেমধ্যেই গিয়ে খালি হবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একজন উড়িয়াকাকুই হচ্ছে ওখানের সবকিছু— ভাত বেড়ে দেওয়া থেকে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানো, মণিদা নইলে চলে না!
দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা কিন্তু এক্কেবারে সত্যি। তরকারি ফেললে যেমন ‘সব্জি ফেললে চলব?’ শুনতে হয়, তেমনি পাতের শেষে চাটনিটা মেখে যখন শেষ মুঠো ভাতটা চেটেপুটে খাই, তখন একহারা লম্বা মানুষটার সাদা দাঁতের হাসি দেখে পেটের সাথে মনটাও ভরে যায়।
তা বেশ। আজ রাতে খেতে গেছি। প্রায় সব টেবিলই ভর্তি। দাঁড়িয়ে আছি বাইরে, হঠাৎ একদিকে চোখ গেল। আমার এটা খুব বাজে অভ্যাস জানেন তো, চোখ আর কানগুলো কুটকুট করে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করে। যা দেখলাম, একটু অবাক হলাম।
দেওয়ালের দিকে মুখ করে এক বুড়োমানুষ বসে আছেন। সামনে থালা। আর পাশে বসে মণিদা। এক এক করে থালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে যাচ্ছে, “এটা ভাতঅ। এটা মাছঅ।ভাতে ডাল দিয়ে মেখে নিন। তাপ্পর খান।” বুঝলাম, আধময়লা জামা পরা মানুষটা সম্ভবত মানসিক প্রতিবন্ধী। বা হয়তো বয়সজনিত কারণেই বিস্মৃতি ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্কের কোষগুলোর।
টেবিল খালি হলো। বসলাম তাঁর থেকে একটু দূরেই। খেতে খেতে দেখছিলাম আড়চোখে। হাত কাঁপছে মানুষটার। ভাত-তরকারির গোল্লা থেকে কিছুটা অংশ পড়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে কালো কর্ডের প্যান্টের ওপর। মণিদা ঠায় বসে ছিল পাশে। হাতে থাকা ন্যাকড়াটা দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ দাদু ডালভাত মাখা দুহাত তুলে চেয়ারে বসা মালিকের দিকে মুখ করে বললেন, “বুড়ো মানুষকে বড়ো যত্ন করে খাওয়ালে বাবা। ক্ষুধার্ত মানুষকে যত্ন করে খাওয়াও তোমরা—বড়ো পুণ্য করো। বড়ো ভালো করো। ভগবান ভালো করবেন!”

কেউ দেখলো না, আমি টুক করে দেখে ফেললাম, মণিদা একবার বুড়োমানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা উঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল।

খাওয়া শেষ হয়ে গেল। আমারও। উঠে রাস্তায় বেরিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। দেখলাম, কোনোমতে উঠলেন বুড়ো লোকটা। মণিদা ধরে ধরে সিঁড়িটা নামিয়ে দিল।
এটা গল্প হলে হয়তো এবার গরীব মণিদা ততোধিক গরীব এই লোকটার খাবারের দাম দিয়ে দিত। বলত, “মুখটঅ আমার বাপের মত দেখতে অছি।”
কিন্তু গল্প আমি লিখতে পারি না যে। আমি শুধু বেসিনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলাম, ডান পাটা প্রচন্ড ফুলে আছে তাঁর। কালো হয়ে আছে। পেটটাও প্রচন্ড ফুলে উঠেছে। বোধহয় সিরোসিস।
জামার পকেট থেকে টাকা বের করে দাম মেটালেন। মণিদার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “বড়ো যত্ন করে খাওয়াও বাবা। ভগবানের সেবা করো তোমরা। ভগবান ভালো করবেন।” জানি, আপনাদের মনে হচ্ছে এসব তো পর্দার ওপারে হয়। কিন্তু আর কেউ দেখুক না দেখুক, আলো-আঁধারিতে বুড়োমানুষটার গালে জলের ফোঁটা আমি দেখেছিলাম। বোধকরি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা মণিদাও দেখেছিল।

বুড়োমানুষটা কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন অন্ধকার বেয়ে।
হোস্টেলের দিকে যেতে যেতে একটা কথাই মনে হল, এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোই আমাকে কোনোদিন নাস্তিক হতে দেবে না।