প্যারালিম্পিকস

আসছিলাম ট্রেনে। প্রতিবারের মত এবারেও লেট করে ফেলেছি। উঠতে বাধ্য হয়েছি প্রতিবন্ধী কামরায়। বাধ্য হয়েছি, কারণ আমি সাধারণত জেনেরাল কামরাতেই উঠি।
সাধারণ কামরা আর প্রতিবন্ধী কামরার মধ্যে সেরকম দেখতে গেলে কোনো পার্থক্যই নেই, একটা ছোটো হ্যান্ডরেল ছাড়া। ওঠার জন্য স্লোপড পা দানি নেই, অ্যাটেনডেন্ট তো নেইই। প্রপার লাইটিং নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসিক্যালি কিছুই নেই।
একবার ছোটো বাথরুম যাবার দরকার হলো। আমি দরজাটা খুলে চাপে পড়ে গেলাম। একখানা কমোড আছে বটে, কিন্তু কাজ সারবো কেমনে? আলো নেই। রেলওয়ের ভারী দরজা পুরো বন্ধ করে দিলে অন্ধকারটাও দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার সাথে স্লিপারি মেঝে। নিজেকে সাপোর্ট দেবার মত কোনো অবলম্বন নেই। সব মিলিয়ে চমৎকার। আমি, একজন নিয়ার-পারফেক্ট প্রতিবন্ধী, প্যান্টের জিপ, পা আর গেট সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে গেলাম। ১০ মিনিটের চেষ্টায় সবকিছু সেরে বেরোলাম। বেরিয়ে ভাবছিলাম, যাদের প্রতিবন্ধকতার পরিমাণ আরোও বেশি, তাঁদের কী অবস্থা হয় এখানে!
প্রতিবছর রেল বাজেট হয়। একখানা বড় ফাইল নিয়ে একজন গম্ভীরমত মানুষ আসেন। অনেককিছু পড়ে শোনান। তা থেকে ভাড়া বৃদ্ধি বেরিয়ে আসে, নতুন ট্রেন বেরিয়ে আসে, এসির ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে, কেবল এই খোঁড়া-কানা-বোবা-অন্ধের দল রয়ে যায় অন্ধকারে।

অবশ্য রেলের কথা শুধু বলে লাভ কী?
আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা মেজরিটিকেই সুবিধা করে দিই, মাইনিরিটিদের মানিয়ে নিতে বলি। স্বাভাবিক। একটা সমাজ, তাতে বেশিরভাগই চৌকো; কয়েকটা খাপছাড়া লোক গোল, ত্রিভুজ, কেউ ট্যারাব্যাঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমি সব জিনিস চৌকৌদের মতন বানাবো। বাকিরা অ্যাডজাস্ট করে নেবে।
সবখানেই। স্কুল-কলেজে ব্রেইল বই পাওয়া যায় না। বলা হয়, ম্যানেজ করে নিন। কাজের জায়গায় স্লোপ বা লিফ্ট থাকে না। চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিবন্ধী। তাতে অবশ্য কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। ‘কোটায়’ পাওয়া লোক, তার জায়গায় একটা ‘নর্মাল’ লোক ঢুকলে বরং আরো প্রোডাক্টিভ হবে। কিছু বেসরকারি কর্মস্থল ছাড়া কোনো অফিস-কাছারিতেই প্রতিবন্ধীদের কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবাই হয় না। আজ. যদি কোনো সরকারি অফিসে হুইলচেয়ারে বসা কোনো মানুষ ক্ল্যারিক্যাল জব বা ম্যানেজারিয়াল জব করেন, লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে।
কারণ, আমরা প্রতিবন্ধীদের আলাদা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। এবং সেটা নীচু চোখ। একটা খোঁড়া লোক খুব বেশি হলে পিওনের চাকরি করতে পারে। কারণ, তার বেশি উঠলেই তার যে কোনো অক্ষমতায় প্রতিবন্ধকতার দোহাই টানা হবে।
রাষ্ট্রের এতো মাথাব্যথা নেই। রাস্তায় আলাদা লেন নেই। হ্যান্ডরেল নেই। পাবলিক বিল্ডিং, যেমন থানা, আদালত, স্কুল এসব জায়গায় ব্যবস্থা নেই। হুইলচেয়ারের মত প্রাথমিক চাহিদাগুলোর কথাও কেউ বলে না।
ভারত রাষ্ট্রে অন্য সব মাইনরিটির মত প্রতিবন্ধীরাও অবহেলিত। এবং তারা এভাবেই কন্ডিশনড। আজই দেখলাম, একজন অন্ধ, তিনি সিটে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিছুক্ষণ উসখুস করে মেঝেকে গিয়ে বসলেন। বহু বছরের বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তি মানুষকে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ শব্দটাই শেখায়।

প্রতিবন্ধীরা ‘রিজেক্টেড’ প্রপার্টি নয়।
তাদেরও নিজস্ব মেধা, দক্ষতা এবং আত্মসম্মান রয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে তাদেরও দাবি রয়েছে স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধার এবং সম আসনের।
৩ শতাংশ সংরক্ষণই মোক্ষ নয়।
সামনে আরো লড়াই রয়েছে।

সমাজের ভদ্র-সুশীল প্রতিনিধিদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একগাদা ক্রাচ-প্রস্থেটিক-কালোচশমার লড়াই।
[ শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথাই বলা হয়েছে]

পুনশ্চ: আজ কী একটা হাস্যকর কথা কানে এলো রাস্তায়। প্যারালিম্পিকস না কী। হাঃ হাঃ হাঃ!

সহবৎ

একটা কুকুর পুষেছিলাম। এইটুকু বয়স থেকে আমি তাকে শাসন করতাম। কুকুরজাত তো, না শাসন করলে মাথায় ওঠে। রোজ ধমকাতাম, সহবৎ শেখাতাম। ভদ্রতা শেখাতাম ভালো করে। কোনটা সমাজ ভালো চোখে দেখে না, কোনটা পছন্দ করে না, এইসব। যাতে বিগড়ে না যায়, তাই ঘরে বন্দী করে রাখতাম। বলতাম, বেশি উড়নচন্ডী হলে সবাই অসভ্য বলবে। কোনোদিন ফাঁক বুঝে বেরিয়ে গেলে বেল্টপেটা করতাম। দুমাদ্দুম মারতাম— শাসনে রাখতে হবে তো নাকি! পেটানোর ভয়েই ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। তারপর কোথায় খাবে, কোথায় খেলবে সব ঠিক করে দিলাম। ঘরের কুকুর, বিগড়ে যেতে দেওয়া যায়? ওর ভালোর জন্যই ছিল এসব! না শুনলে পেটানোর দাওয়াই আছেই।
এমনি করে আস্তে আস্তে ভদ্র সভ্য হয়ে উঠল। আমার জন্যেই হল। এতোদিনের ট্রেনিং বলে কথা, ঠিক কিনা!
আমার পাশের বাড়িতে নন্দ মেসোও এরকমভাবে কুকুর পুষতো। তার পাশের বাড়িতে পোলকি মাসিও তাই। তার পাশে জন আঙ্কেল। মেহেবুব চাচা। আমার গোটা পাড়াই এরকমভাবে কুকুর পোষ মানাতো। বছরের পর বছর ধরে এরকমভাবেই তো কুকুরদের পোষ মানানো হয়! আমার পাড়ায়। পাশের পাড়া কুলডাঙাতে। নারাণপুরে।
আমরা সবাই তো এরকমভাবেই কুকুরদের পোষ মানাই। ভদ্রসভ্য করে তুলি। সমাজের উপযুক্ত করে তুলি। কত বছর ধরে এমনিই করে আসছি গো!

কী বললে? তোমার একটা মেয়ে আছে?
তা…

বেটি বাঁচাও

“যারা গৌরী, যারা শুভ্রা, যারা উজ্জ্বলা, এবং যারা নও তাদেরও মনখারাপ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তোমাদের জন্য ওশিয়া হারবালস্ নিয়ে এলো…” এফএমটা বন্ধ করে দিলাম।
এই তো! দুভাগ করে দিতে পেরেছে সহজেই। তোমরাই তো শিখিয়েছো। আমরাই তো শিখিয়েছি। তোমার ক্লিভেজের ভাঁজে দুভাগ। তোমার ক্রিমের কৌটোর প্রতি প্যাঁচে আলাদা আলাদা স্তরের মেয়েরা। গৌরীরা একদিকে, শ্যামারা অন্যদিকে। বান্ধবীদের আড্ডায় তুমিও কালো মেয়েকে নিয়ে ঠাট্টা করেছো। বা তোমার ব্রণওলা বন্ধুকে বলেছো হিমালয়ার ক্রিম ব্যবহার করতে, করে ব্রণগুলো মুছে ফেলতে। কারণ ব্রণগুলো থাকলে সুন্দর লাগে না। ব্রণগুলো ঘষে ঘষে তুলে ফেলা উচিত। তা সে যতই গাল লাল হয়ে যাক। রক্ত বেরোক। সভ্যতার শুরু থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে, কিন্তু সমাজের বেঁধে দেওয়া ফর্সা, লম্বা, তন্বী মেয়েদের সংজ্ঞাটা বদলায়নি।
আমি আজ পর্যন্ত অনেক মেয়ের বন্ধুত্ব পেয়েছি। বেশিরভাগেরই মুখ থেকে শোনা, তারা নাকি কোনো একবেলার খাবার, দুপুরের বা রাতের, ‘স্কিপ’ করে যায়। কারণ, তারা নাকি খুব মোটা। পাতলা হতে চায়। মোটা হবার নাকি প্রচুর অসুবিধা। যতবারই জিজ্ঞেস করেছি কী অসুবিধা, তারা বলেছে ‘তোরা বুঝবি না’।
আর এভাবেই সমাজের চোখ পাকানোর তলা দিয়ে ঢুকে পড়ে ৫২ শতাংশ অ্যানিমিয়ার দৈত্য।
মোটা হলে ছেলেরা তাকাবে না। ব্রণ হলে প্রেম হবে না। কালো মুখে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি না মাখলে ডেটে যাওয়া যাবে না। বেঁটে হলে লম্বা লম্বা হিল পরে পায়ে ব্যথা সহ্য করেও হাঁটতে হবে, নইলে বান্ধবীরাই হাসবে।
তোমার শরীর ‘সুন্দর’ না হলে সমাজ তোমাকে বিয়ে করবে না, শুনছো তুমি, সুন্দরী?

বিশ্বাস করবে, কষ্ট হয় না খেয়ে আছো শুনলে?
বিশ্বাস করবে, গর্ব হয় তোমাকে মেকআপের মুখোশ না পরতে দেখলে?
বিশ্বাস করবে, মন ভালো হয়ে ওঠে সমাজকে ছিঁড়েখুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখলে?

ভালো থেকো। তোমার উস্কোখুস্কো চুলে। তোমার লম্বা অগোছালো চুলে। তোমার মোটা শরীর নিয়ে। তোমার চোখের কালিতে। ওয়াক্সিং না করা পায়ের লোমে।
শুধু, ভালো থেকো। 🙂

[লেখাটা শেষ করে এফএমটা আবার লাগালাম। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘বেটি বাঁচাও, নেহি তো বহু কাঁহাসে আয়েঙ্গে?]

টমগার্ল

আমি ছোটোবেলা থেকে অনেক মেয়ে দেখেছি। সারি সারি সংখ্যায় তারা মুখ নামিয়ে পেরিয়ে যায়। দুঃখের মেয়ে। কষ্টের মেয়ে। তার অপমানিত চোখ। তার ভীতু পা। দুর্বল হাত। নিয়মের দড়ি বেঁধে তার অভ্যাস। গায়ে লাল লাল ছোপ পড়ে গেছে। সূর্যের আলোর অভাবে তার গায়ের ফর্সা চামড়া স্যাঁতসেঁতে। তাতে গুঁড়ি গুঁড়ি অবহেলার ছত্রাক জন্মেছে নরম ভেজা আবহাওয়ায়।
আমি। ছোটোবেলা থেকে। অনেক মেয়ে দেখেছি। তারা কখনো শুধুই মেয়েমানুষ। কখনো বউ। কখনো বোন। সমাজের ভেতরেও সমাজ, বৃত্তের মধ্যেও বৃত্ত তৈরি করে তারা। শেষে গোল দাগ কাটতে কাটতে এইটুকু মাটি পড়ে থাকে। কোনোমতে দুপা আঁটে তাতে। তাতে কী লজ্জা! কী লজ্জা! ও মেয়ের পায়ের পাতা লক্ষণরেখার মধ্যে আঁটে না। ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে সেই মেয়ে আরও গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে। সেই বৃত্তের মধ্যে। ছোটো হতে হতে, নীচু হতে হতে হারিয়ে যায়।
জানো, আমি মেয়েদের দেখেছি। তারা কথা বলতে পারে না। চোখ তুলে তাকাতে লজ্জা পায়। ওড়নার স্কেল দিয়ে তারা সম্মান মাপে। তাদের সাইকেলের পাশাপাশি সাইকেল চালালে তারা লজ্জা পায়। তুমি তাদের দেখেছো? যারা ক্লাস এইট থেকে ফেসবুক করে, কিন্তু নিজের একটাও ছবি তাতে দেয় না। তাদের ওই মিথ্যে ডলপুতুলের ছবিতে তোমার অস্বস্তি হয় না? মনে হয় না ছিঁড়ে ফেলে দি ওই ছবি?
আমার দুর্ভাগ্য। আমি মেয়েদের চোখে শুধু ভয় দেখেছি। লজ্জা দেখেছি। অপমান দেখেছি। চুলের ঝুঁটি ধরে মার দেখেছি। প্রেম করার জন্য ঘরবন্দী হতে দেখেছি। মাসের পর মাস। নিজের প্রতি নিজের, পরিবারের, প্রেমিকের, আর সমাজের অবহেলা দেখেছি। আমি রোগা রোগা মেয়েদের চোখ থেকে স্বপ্ন কেড়ে তাতে অ্যানিমিয়া ভরে দিতে দেখেছি।
সেই জন্যই। আজ যখন ওই হাজার হাজার নামহীন সাদাকালো মুখের মাঝে একদুটো রঙীন মুখ দেখি, হাতে স্বপ্নের নিশান নিয়ে তাদের হাঁটতে দেখি, তখন খুব ভালো লাগে। খুব আনন্দ হয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে। তারা কতো সবল। কতো স্বনির্ভর। কতোটা নির্ভীক। সমাজের বাঁধন ছেড়ে তারা নিজেদের পথে হাঁটছে।
বিশ্বের ক্ষেত্রে আমার দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠলে যেমন ঠোঁটদুটো নড়ে ওঠে, আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপে, চোখ নরম হয়ে আসে, তেমনি এইসব মেয়েদের জন্যও ভেতরটা ভরে ওঠে। এরাই যেন সেই সূর্য, যার ছোঁয়ায় প্রতিটা রান্নাঘরের কালো ধোঁয়া কেটে যাবে। মেয়েদের জীবন আর ঠিক করে দেবে না পুরুষেরা। তারাও নিজেদের ইচ্ছেমতো বিষয় নিয়ে পড়বে, নিজেদের পছন্দের ক্ষেত্রে চাকরি করবে, ঘুরতে যাবে ইচ্ছেমতো। মেয়েরা স্বাধীন হবে। সব মেয়েরা।

এই আবেগ নিয়েই নারীবাদের পক্ষে কথা বলি।
তোমার কাছে হয়তো হাজারো ‘ইস্যু’র ভেতরে একটা।
কিন্তু আমার কাছে নারীবাদ মানে আবেগ। যে আবেগে হৃদয় ভরে আসে। আমার মত বাচাল মানুষও কথা ভুলে যায়। চোখের কোণে জল চিকচিক করে। সেরকমই এক নির্বোধ, দুঃসাহসী আবেগ।

চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
দেখি আমার দামাল, দজ্জাল, দুরন্ত মেয়েরা নারী হয়ে উঠেছে। হাতে হাত ধরে এগিয়ে আসছে।
সমাজের টমগার্লরা।

অশুচি

তারপর আমরা একদিন পুরোনো হয়ে যাব। প্রত্যেকটা পরিবারের কিছু ছোটোবেলার গল্প থাকে, যেগুলো বারবার উঠে আসে কোনো এক ছুটির বিকেলে। সেই গল্পগুলোর মতো একঘেয়ে হয়ে যাব আমরা। বহুদিন আগেই বিকেলের রোদ আর ছাদের কোণকে ন্যাকামি বলে থুতু ফেলেছিলাম। জিভের ফাঁক দিয়ে ফেলা সেই থুতুটা একসময় ঘা হয়ে যাবে। খুব সরল বোঝাবুঝির মধ্যে দিয়েই আর সেদিকে তাকিয়ে থাকার মানে থাকবে বা। বরং হাঁটা যাক। দূরে, আরো দূরে।
একঘেয়ে সিনেমার মতই হয়ত পেছনে লালচে সূর্যও থাকবে একটা। কিন্তু তার বিদ্রূপ কানে বাজবে তোমার, প্রিয়তমা।
আর সবকিছু কালো হয়ে যাবার পরই আমার খুব বমি হবে। দমকে দমকে রক্তবমিতে বিপ্লবের ছিঁটেফোঁটা বেরিয়ে আসবে।
লাল আর কালোতে মিশে কী রং হয়, কমরেড?

কম্ফর্ট জোন

কম্ফর্ট জোন একটা খুব ভয়ঙ্কর কথা। কম্ফর্ট মানে স্বাচ্ছন্দ্য। অন্য অনেককিছুর মতো সমাজ আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকাও ঠিক করে দেয়।
আমরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু, সেই পড়াশোনার সিলেবাস কোথায় ভুল, কেন ভুল তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারা কেন এইরকম শিক্ষানীতি তৈরি করে, যাতে প্রতি বছর হাজার হাজার চাকরিখোঁজি কালোচশমা মানুষ তৈরি হয়, সে নিয়ে কথা তুললেই অস্বস্তিবোধের উসখুস শুরু হয়।
আমরা বৌ-শাশুড়ির কোন্দল নিয়ে লেখা সামাজিক আহা উহুতে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু কেন একটা মেয়ে তার ফুলশয্যার রাতে ফুলের মালার দোহাই দিয়ে একটা অচেনা মানুষের কাছে নিজের শরীর পেতে দিতে বাধ্য হয় সেই কথা বলতে চাইনা।
আমরা বছর বছর ধরে নিজের ‘কেরিয়ার’ তৈরি করতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। কিন্তু কে সেই সাইকেলটা চালাচ্ছে, কোনদিকে চালাচ্ছে সেটা চোখ তুলে তাকাতে গেলেই একরাশ ভয়মেশানো লজ্জা এসে জড়িয়ে ধরে। এমডি পরীক্ষার সিট কম, তাই বছরের পর বছর ধরে কোচিং সেন্টারের পায়ের তলায় টাকা বিছিয়ে দিই, কিন্তু কেন এই সিট কম, কার দোষে কম জানতে গেলেই সবাই চোখ পাকিয়ে মুখে আঙুল দিতে বলে।
আমরা ‘কোটার ডাক্তার’দের কাছে আত্মীয়দের যেতে বারণ করি, কারণ তাতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কেন ‘কোটার’ ডাক্তারেরা অন্যদের সমান হয়ে উঠতে পারবে না, সে প্রশ্নটা করার অভ্যাসটাই তৈরি হলো না এখনো।
ছেলেদের যৌনতা আর হস্তমৈথুন অদ্ভুত যুক্তির সব ‘জোকস্’ এর মাধ্যমে খুব সহজেই সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু মেয়েদের যৌনতা বা হস্তমৈথুন নিয়ে কোনো কথা বললেই সবার ‘শালীনতা’ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ছেলেরা বাক্যের মধ্যে ৫টা খিস্তি ব্যবহার করে, আমরা তাতে অতিমাত্রায় স্বচ্ছন্দ—অথচ একটা মেয়ে সোশ্যাল সাইটে বোকাচোদা বললেও তার কাছে ৫টা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, বন্ধু ভেবে নয়, ‘রেন্ডি মাগী’ হিসেবে। কারণ, মেয়েদের মুখে গালিগালাজ আমাদের ‘পৌরুষের কাছে’ অস্বস্তিকর।
কাজের মাসি হঠাৎ একদিন কামাই করলে আমরা মাইনে কাটতে অভ্যস্ত। ওরা যেহেতু অশিক্ষিত, ওরা যেহেতু ‘নীচু’জাত, তাই ওদের কোনো বাঁধা পে-স্কেল বা ছুটি থাকতে পারে না! সেই আমরাই সরকারী কর্মচারীদের ডিএ বাড়াবার দাবিতে স্ট্রাইক করতে অভ্যস্ত। অথচ কাজের ‘মাসি’ দের সঙ্গে মুখমিষ্টি করে কাজ আদায় করে নিতে আর তাদের ন্যায্য দাবিকে পায়ের তলায় পিষে দিতে আমাদের একটুও অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয় না।

বলি কি, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের বৃত্তটুকুতে কেবল হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা মালিকসুলভ মনোভাবটুকুকে স্থান দেবেন না। বৃত্তটা আঁকার চক আপনারই হাতে—তাতে একটু যুক্তিবোধ মেশান, একটু শিক্ষার ফোড়ন দিন। কোন কথাগুলো নিয়ে কথা বলা খুব প্রয়োজন সেবিষয়ে খুব স্পষ্ট হোন। সামাজিকতার ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে যে কথাগুলো বলতে পারছেন না, সেই কথাগুলোই এই পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজ আপনাকে দিয়ে বলাতে চায় না। অনেক অনেক বছর ধরে যে সামাজিক শোষণ চলে আসছে আপনার আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ‘অসভ্য’ ‘অশালীন’ ‘অসামাজিক’ ‘অভদ্র’ ট্যাগ লেগে যাবার ভয় দেখিয়ে, তাকে একসাথেই চিনতে হবে।

আসুন। কথা বলুন। কথা বলুন যৌনতার অধিকার নিয়ে, কথা বলুন রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন বেশ্যাদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন মেথরদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন কর্মক্ষেত্রে নিজের সুরক্ষা আদায়ের জন্য, কথা বলুন কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য, কথা বলুন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবহেলার বিরুদ্ধে, কথা বলুন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের হাত বাড়ানো নিয়ে। কথা বলুন স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করেই। কারণ, কথাগুলো পৌঁছনো প্রয়োজন সব স্থানে, সব কালে, সব পাত্রে।
নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের বৃত্তে একটু অস্বাচ্ছন্দ্য আনুন।
নিজের কম্ফর্ট জোনে একটু ডিসকম্ফর্ট আনুন।
এতো ভালো থাকবেন না।

এতো ভালো থাকা ভালো নয়। 🙂

বামপন্থা

১৯শে মে রাত্রিবেলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সারাদিন ধরে অনেক বিষ্টি-টিষ্টি হয়েছে। এখনও আকাশে অনেক মেঘ। আকাশে কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া তারা মিটমিট করছে নিতান্তই লজ্জা পেয়ে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর খড়ংখড়ং শব্দ। প্রথমে আস্তে, তারপর জোরে জোরে। রাত দেড়টা বাজছে। ঘরের সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায়। আবার খড়ংখড়ং। ঠংরঠংর। যান্ত্রিক শব্দ।
রান্নাঘরের সবচেয়ে নিচের তাকে প্লায়ার্স, স্ক্রুড্রাইভার আর একগাদা পেরেকওয়ালা থলিটা জোরে জোরে নড়ে উঠল।
মুখটা ফাঁক করে উঁকি দিল একটা চ্যাপটামুখো ঝুলমাখা হাতুড়ি। তারপর লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। ঠঙাৎ।
কোল্যাপসিবল গেটটা খিনখিন করে নড়ে উঠল। টলতে টলতে বেরিয়ে গেল সে।

পাকা বাড়িটার লাগোয়া গোয়ালেও একটা ঘসরঘসর আওয়াজ হচ্ছিল। ওটা অবশ্য ভালো শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু বিচালির গাদাটা হাল্কা হাল্কা নড়ছিল।
হঠাৎ কে একটা প্যানপ্যানে স্বরে বলে উঠল, ‘উফফ্ কী মশা বাপু!জ্বালাতন!’ নিজের বাঁকা শরীরটাকে ঝকরঝকর করে চুলকাতে চুলকাতে বাইরে বেরিয়ে এল একটা মরচেপড়া কাস্তে।

উঠানে এসে দেখা হল দুজনের। দুজনের মুখেই শ্রান্ত, পরিচিত হাসি। তারা জানে কোথায় যেতে হবে।
মাঠের মাঝে গিয়ে তারা উপরদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তৈরি? চলো আমরা যাই!’
উপর থেকে উত্তর এলো, ‘মনে আছে তো কী বলতে হবে?’

কাস্তে-হাতুড়ি-তারা তিনজনে মিলেই উত্তরটা দিলো,
“খেতে কিষাণ কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো তৈরি হও।”
চললো তারা। আলিমুদ্দিন ছাড়িয়ে অনেক, অনেক দূরে।

অরাজনৈতিক

রাজনৈতিক দুটো দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার থেকে, রাজনৈতিক আর অরাজনৈতিক এই দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া সুবিধাবাদী লোকজনের কাছে সবসময়ই প্রেফারেবল।
কারণ, তাতে স্বভাবতই অরাজনৈতিক অংশটাকে শান্তিপ্রিয় হিসেবে প্রোজেক্ট করা যায়। আর রাজনৈতিক অংশটাকে ব্যাগড়াবাদী, ঝঞ্ঝাটপ্রিয় লোকেদের দল হিসেবে দেখানো যায়।

যেখানে প্রতিদিন রাজনীতি আমার নিজস্ব অধিকারগুলোকে কেটেছেঁটে দমিয়ে দিচ্ছে, নিজের ইচ্ছামতো হাত দিচ্ছে আমার শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা খাদ্যের অধিকারে, সেখানে অরাজনৈতিক হওয়া মানে সেই নোংরা রাজনীতির দল ভারি করা।
আপনি রাজনৈতিক হোন বা অরাজনৈতিক, রাজনীতি আপনাকে ছিঁড়ে খাবেই—কয়েকটা উপরের তলায় বসে থাকা লোক আপনাকে নিজের প্রয়োজনে দুমড়ে মুচড়ে নেবেই, বারবার। শুধুমাত্র, পার্থক্য এটাই, রাজনৈতিক হলে আপনি সেই নোংরামিগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পারবেন, বুঝতে পারবেন, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবেন, অন্যদের বুঝিয়ে একসঙ্গে এর প্রতিবাদ করতে পারবেন। এটুকুই পার্থক্য।

আর অরাজনৈতিকরা? তাদের মধ্যে বিশাল শক্তি লুকিয়ে আছে। তা ওই সুপ্রিম পাওয়ারটাও জানে। তাই, তাকে শান্তিপ্রিয় জীবনের লোভ আর নানারকম রঙিন খেলনার লোভ দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়, যেভাবে ছোটো বাচ্চাদের মুখে চুষিকাঠি গুঁজে দেয়।

আমি রাজনৈতিকই হবো। আপনাদের চোখে ‘বাজে বাজে কথা’ বলবো। সেসব কথার জন্য কিছু লোক অামাকে অপছন্দ করবে, গালাগালি করবে। অপ্রিয় সত্যি বলার জন্য আমার অনেক বন্ধু সরে গেছে, আরও অনেকে হয়তো যাবে। তাতে আমার কিছু করার নেই।
কাশ্মীরে গরিব লোকগুলোর মৃত্যু, কলেজের ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠি, একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা আর তার শ্রমিকদের আত্মহত্যা, চাষীদের মৃত্যু আর ভয়াবহ খরা, আইআইটিতে সংস্কৃত, দলিত মেয়ের আত্মহত্যা, সোনি সোরির ওপর অ্যাসিড অ্যাটাক, বাংলাদেশে ব্লগার খুন, উত্তরাখণ্ডে সুপরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, নির্বাচনের দুর্নীতি, মেয়েদের অধিকার আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, ইন্টারনেটে চলা সেক্সিস্ট জোক, আফস্পা, শিক্ষাক্ষেত্রের নীতিতে ধনী ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপ, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপমৃত্যু, সুন্দরবনে জঙ্গল কেটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র— এরকম যতগুলো ব্যাপারে কথা বলা উচিত বলে মনে হবে, যতগুলো ব্যাপারে রেগে উঠব, যতগুলো ব্যাপারে ঘেন্না হবে, ঠিক ততগুলো ব্যাপার নিয়েই কথা বলবো।

কলেজে হোক, বা রাজ্যে, বা আমার দেশে— যাঁরা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দেগে দিয়ে চোখ বুজে শান্তিতে ঘুম দেবার কথা ভাবছেন, তাঁরা জেনে রাখুন— রাজনীতি আপনাকেও রেহাই দেয়নি, দিচ্ছে না এবং কোনোদিন দেবেও না।
হুঁশিয়ার!

মে দিবস

দিনে ষোলো ঘন্টা পিঠ বেঁকে দাঁড়িয়ে কাঠচেরাই কলের মিস্ত্রি আমিনুলচাচা কাজ করে। তার ফুসফুসভরা ভবিষ্যতের ফোঁসফাঁস আর অনেকটা কাঠের গুঁড়ো।

টাটা কনসালটেন্সির শ্রীতমা এখন বিকেলের পর অফিসে থাকতে ভয় পায়। কাঁচের জানালার মধ্যে দিয়ে করিডোরের আলো-আঁধারি তাকে যেন গিলতে আসে; ঠিক যেমন সেদিন গিলতে এসেছিল একজন, অনেকটা খিদে নিয়ে।

প্রীতম’স টি স্টলের বলাইয়ের সারাদিন কাপপ্লেট ধুয়ে ধুয়ে পায়ে প্রচুর হাজা হয়েছে। হাঁটতে গেলেই ব্যথা করে। তবে সে জানে, ওই দিনে ৫০ টাকাটা না পেলে তালডাংরায় তার বোনের পেটেও ব্যথা হবে। সেটা একটু অন্যরকম।

হাড়কাটা গলির মুন্নির সেক্সি ফিগার। ডিমান্ডটাও সেরকম। কিন্তু আজ কোনো কাস্টমার নেওয়া সম্ভব নয়। কাল ওই শালা মাতাল লোকটা পেছনের ফুটোতে বোতলের মুখটা বারবার ঢুকিয়েছে। সকালবেলা গোটা প্যানটা লাল হয়ে গেছল।
তাও, রাত্রে তার ঠিকা দালালের ঠকঠক আওয়াজে আর খিস্তিতে তার ঘুম ভেঙে গেল।

যতই গরম থাকুক, সারারাত খোলা আকাশের নীচে শোয়া কী আর পোষায়! কিন্তু রাঁচির ট্যাক্সিওয়ালা প্রভীন জানে, ঘর ভাড়া করে থাকতে গেলে রেশমীর শাদিটা আরো পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তনখা বাড়ানোর কথা মালিককে বলতে গেলেই তো ইংরেজিতে গালি দেয়।

নাহয় কেরানিরই চাকরি, তা বলে কি এরকম একটা ঘুপচি দিতে হয়! আলো নেই, হাওয়া নেই। বিকেল পাঁচটায় যখন কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মাথা তোলে, চোখে কেমন ঝিলঝিল করে তপনের।

মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে ঘুমটা ভালোই হয় অসিতের। কিন্তু খাওয়াটা ঠিক পেটভরে হয় না। দিনে ৩০ টাকা মাইনের জন্য শহরে পড়ে আছে বলে কি আর খিদে পায় না? কিন্তু ১২ বছর বয়েসের সব দাবিকেই ধমক দিয়ে উড়িয়ে দেয় শঙ্করদা।

যতদিন না আমরা সবাই শ্রমিক দিবসকে যথাযথ গুরুত্ব দেব, ততদিন এরাও দিতে পারবে না। কাজের নির্দিষ্ট সময়ীমা, স্বাস্থ্যভাবনা, কাজের জায়গায় লিঙ্গবৈষম্য, সঠিক হারে মাইনে এবং আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা —এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। নিজেদের মধ্যে এবং সবার মধ্যে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকও শ্রমিক, আবার চড়চড়ে রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা সিইএসসি এর অফিসারও শ্রমিক।
মালিকপক্ষের কাছ থেকে নিজেদের দাবি কড়ায়গন্ডায় বুঝে নিতে হবে।
তাই সহ্য হয় না মে দিবস নিয়ে কোনোরকম ভাঁড়ামি বা জোকস্। সহ্য হয় না কোনোরকম লঘু আলোচনা।

ভয় লাগে, ভ্যালেন্টাইন ডের মতো কোনো একদিন পয়লা মের ভোরে উঠে দেখতে হবে পাতাজোড়া ফ্লিপকার্টের ৩০% ডিসকাউন্টের অ্যাড!

বেসিক

বেসিক এডুকেশন কেবল বইয়ের পাতায় আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য নয়, কীভাবে শিল্পপতিের লোভে সেই জীববৈচিত্র্য প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাও জানানো।

বেসিক এডুকেশন শুধুমাত্র আন্টার্কটিকার পেঙ্গুইন আর খনিজদ্রব্য নয়, কীভাবে পৃথিবীর পাপের বোঝা মেরুভালুকদের বইতে হচ্ছে, তার কথাও।

বেসিক এডুকেশন কেবল তিনপাতা ধরে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আর একপাতায় পুংজননতন্ত্র নয়, তার সঙ্গে যৌনচেতনা, নিরাপদ যৌনতা এবং হস্তমৈথুন সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিও।

বেসিক এডুকেশন মানে দ্বিবীজপত্রী ফলের নাম মুখস্থ করা হতে পারে, তবে ফুলকপি মাটির ওপরে হয় না নীচে, এটাও জানা দরকার।

বেসিক এডুকেশনে চড়ুইপাখির বিজ্ঞানসম্মত নাম মুখস্থ করা খুব প্রয়োজন, তার থেকেও প্রয়োজন জানা কেন চড়ুইদের আর দেখা যায় না ঘুলঘুলিতে।

বেসিক এডুকেশন কেবল মিথ্যে দেশপ্রেমে ভরা ইতিহাসের বই নয়, বরং রাজনীতির কোন নোংরা গলিঘুঁজি পেরিয়ে স্বাধীনতা এসেছে, তার আভাস।

বেসিক এডুকেশন মানে বইয়ের পাতায় ফরসা লোককে বিউটিফুল আর কালো লোককে আগলি বলে দাগিয়ে দেওয়া নয়, বরং তৃতীয় লিঙ্গের অচেনা মানুষদেরও চিনিয়ে দেওয়া।

বেসিক এডুকেশন বলতে ওব্ নদীর গতিপথ হতেই পারে, কিন্তু পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলে কীভাবে স্টিচ দিতে হয়, সেটাও জানা উচিত।

বেসিক এডুকেশনে পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কোথায় কী কী কারখানা আছে তা জানতেই হবে, কিন্তু কীভাবে সেগুলো একে একে শ্রমিক অসন্তোষের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার কারণটাই বা কী, সেটা জানাও জরুরি।

বেসিক এডুকেশনে নোটভিত্তিক বাংলা-ইংরেজি পড়ে পাস করতেই হবে, কিন্তু নিজে ভাবনা-চিন্তা করে সেটা প্রকাশ করারও প্রয়োজনীয়তা আছে।

বেসিক এডুকেশনে তিন-চার বছরের সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদের ইতিহাস পড়তে তো হবেই, তার সঙ্গে সাম্যবাদ আর সমাজবাদ নামগুলোও বইয়ের পাতায় উঠে আসা উচিত।

শেষের ‘বেসিক’ এডুকেশনগুলো রাষ্ট্র কখনোই দেবে না। তাই, এগুলো স্কুলের থেকে কেনা যাবে, এমন আশা ভুলেও করবেন না! অন্তত যতদিন শিক্ষার নিয়মনীতি ঠিক করছে পুঁজিপতির দল।
তাই, হয় এসব শিক্ষার ব্যবস্থা নিজে করুন, নইলে আসু়ন, টেস্টপেপারে মুখ গুঁজে থাকি।