মুহূর্তরা

—একটা মানুষকে সবথেকে বেশি কী দিতে পারিস?
—রাত আড়াইটের ময়দানের গেট টপকে ঢুকে খুঁজে পাওয়া বিশাল আকাশ আর তার নীচের ঠান্ডা ঘাসের ডগায় নীরবতা, যে আকাশ বুকে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো যায়।
— তার সঙ্গে?
— সারাদিন সভ্যতার দাবি মেনে চুপ করে নির্জীব পড়ে থাকা এসপ্ল্যানেড চত্বরের বুক খাঁ-খাঁ করা পাগলামোর হাসি, যা একবার শুনতে পেলে বাকি জীবন বুকের মধ্যে রিনরিন করে।
—এইটুকুই?
—কালো জলে নেড়িকুকুরের চিৎকার গুলে দেওয়া গঙ্গার ঘাটে বসে গাছের পাতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা, কখন তার হাসি পায় তার অপেক্ষা।
— শেষ?
— প্রথম রাত, মাঝরাত, শেষরাত এই তিনটে রঙের শেডকে চোখে রেখে মড়ার মত শুয়ে থাকা কোনো এক ঠান্ডা বেদীতে আর খেরোখাতায় রাতের হিসেব।
— সত্যি এসব দিবি?
— নাহ্। নিজে গিয়ে রাতের দালালের কাছে ভাড়া দিয়ে ঢুকিস দেহোপজীবিনী কলকাতার ঘরে। মায়াবিনী বেশ্যাবুড়ির বয়স কমতে শুরু করে রাত বাড়লেই। সারাদিন সে লুকিয়ে থাকে নিজের ঝুপড়িতে, বেরোয় না। তার অসূর্যম্পশ্যা শরীরে দিনের আলো লাগলেই চামড়া আরো কুঁচকে যায়, গাল ঝুলে যায় আর বয়স বাসা বাঁধে। তাই সে লুকিয়ে থাকে দিনমানে। রাত বাড়তে শুরু করলেই তার মায়াজালের কুহকে সময়ের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে। গভীর রাতে যখন সে খদ্দেরের মাথা চিবোবার জন্য কালো চিকচিকি শাড়ি পরে দরজার বাইরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, আর আঁচলের খুঁট থাকে মুখে, তখন সে লাস্যময়ী যুবতী। কোমর পর্যন্ত কালো চুল, শাড়ির ফাঁকে মসৃণ পেটের আভিজাত্য, ঠোঁটে টকটকে লাল পান আর চোখে সেই মায়া। সবাই সহ্য করতে পারে না। কেউ দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, কেউ সাহস করে সামনে চলে এসে তার হাতের সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে মরে। শহরবুড়িও জানে, তার শরীর নিয়ে যে কেউ খেলা করতে পারে না। আঙুল পুড়ে যায়। তাই সেও সুগভীর নাভি, উন্নত স্তন আর আবেদনে ভরা দৃষ্টি নিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে চুড়ি পরে পরস্ত্রীর নিষিদ্ধ কামনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাতের ভবঘুরের অপেক্ষায়, যে তার নিজের ছন্নছাড়া শরীরের অশান্তিটুকু তাকে দিয়ে শান্ত করবে নিজের শরীরের নিচে।
আর কলকাতার দালালরা সোডিয়াম ভেপার আলোর নীচে ফাঁকা রাস্তার গোপনতায় দাঁড়িয়ে থাকে কমিশনের আশায়।

যাস্ একদিন।

শান্তিপর্ব

হাওড়া ব্রিজে একবার যেও।
রাস্তার ধারে ফুটপাথের গায়ে লাগানো রেলিংটার বুকে বুক ঠেকাতে।
যেন সারা পৃথিবী ওই ছোঁয়াটুকুর অপেক্ষাতেই লোভী ছেলের মতো বসে ছিল। ছোঁয়া লাগতেই নিমেষে চারপাশ কালো। শুধু তুমি আর নদী মুখোমুখি। একটা সাদা নদী। পুরো সাদা নয়। মাঝখানে সবুজ সবুজ গোল দাগ। তুমি ভেতরে জানো, ওগুলো কচুরিপানার মুন্ডু। যেগুলো দিনভর সাঁতার কেটে বেড়ায়।
কিন্তু এখন এরকম কিছু মনে করার সাহসও নেই তোমার মধ্যে। ওগুলো যেন প্রেমের দাগ। প্রচণ্ড তীব্র কষটে প্রেম। থিতু হতে পারেনি। ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আর সেই সাদা নদীর ওপর একটা উঁচুনীচু বেঢপ ধূসর শহর জমে আছে। থুপি থুপি। প্রচণ্ড শান্ত। ভেতরের সাইটোপ্লাজমিক অশান্তি মেঘের মেমব্রেন ছাড়িয়ে বেরোতে পারছে না।
মেঘ। কালো মেঘ। আকাশ ছড়ানো। সবকিছু চুপ করিয়ে দেয়। চোখের কোণে তুমি দেখবে কেউ সেলফি তুলছে। কেউ কথা বলছে। কিন্তু তোমার ভেতরের শান্তি তোমার হাত পা ভারী করে দিয়েছে এতোক্ষণে। কিছুই করা সম্ভব নয়। এরই মাঝে একখানা চিল শান্ত মনেই আকাশের গায়ে গায়ে লেগে ভেসে যায় নিজের মত।

হঠাৎ রেলিংখানা কেঁপে ওঠে ব্যস্ত কলকাতার চাপে। সাথে সাথে বুকটাও।
শান্তিপর্ব শেষ। পায়ে পায়ে আবার জীবনে নেমে যেতে হয়।

বিজনবাবুর রোগ

বিজনবাবু লোকটার সব ভাল, শুধু একটাই দোষ। তাঁর পাঁচ নম্বর রোগ আছে।
প্রতিদিন বিকেল চারটের সময় আধঘন্টা ধরে তিনি আসর বসান। গঙ্গার বোতল থেকে মেপে মেপে চার পেগ। পর পর। কাঁচাই খান।
লঞ্চের হইহট্টগোলের চাটের প্লেট সাথেই রাখেন। আর এক চিমটি আকাশের জলজিরা।

তারপর তিনি গোটা সন্ধ্যে নেশায় থাকেন। আধেক আলোছায়ার মাঝে গিন্নির সিরিয়াল, বাচ্চার হোমওয়ার্ক সব ভেসে ভেসে পেরিয়ে যায়।
এজন্যই বোধহয় সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তাঁর বীভৎস হ্যাংওভার হয়। মাথাব্যথা, কাঁধব্যথা, চোখব্যথা।
ডাক্তার বলে নাকি কম্পিউটারে কাজ করার জন্য হয়। বলিহারি!

আর রবিবার তিনি হুঁশ হারিয়ে পড়ে থাকেন সারাদিন। সকালে বেডটির সিরিঞ্জে এক ভায়াল পাশবালিশ শিরায় চালিয়ে দেন। কখন সন্ধ্যে নেমে যায়, টেরই পান না।

মোটকথা বিজনবাবু নেশার দাস।

পিতাহি পরমন্তপঃ

১.
প্রত্যেকটা মানুষের একটা একান্ত নিজস্ব শারীরিক অস্বস্তি থাকে। যেটা হয়তো শারীরিকের থেকেও অনেক বেশি মানসিক। ইমানের অন্তত এরকমটাই মনে হয়। যেমন তাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে সেই পানকাকুর দাঁত খোঁচানো। এখনো মনে আছে, সারাদিন গুমটিতে বসে বসে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁত খোঁচাতো লোকটা।
তার এরকম কিছু ছিল না। কিন্তু এই কলকাতায় এসে হিউমিডিটির ঠেলায় সবসময় কেবল মনে হয়, ঘাম হচ্ছে। অবশ্য ঘাম তার হয়ও প্রচুর! তার সঙ্গে জুন মাসের দুপুরে লেকচার ক্লাস। তাই, পকেটে দুটো রুমাল রাখে সে— যখনি মনে হয় কানের লতি বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, তখনই মুছে নেয় টপ্ করে।
অবশ্য এরকম ঘাম তো সেই লোকটারও হতো। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা লোকটা যখন ভেজা পিঠ আর চকচকে মুখ নিয়ে ঘর ঢুকতো, সিরিয়ালমগ্ন সামনের ঘর আর বইপত্রে ব্যস্ত মাঝের ঘরটা খুশি খুশি হয়ে উঠতো। হাঁকডাক করে পাড়া জাগিয়ে লোকটা ঘরে ঢুকতো। তারপর রুমাল বের করে ক্লান্তিটুকু মুছে নিতে নিতে পাশে বসত তার। তারপরই অফিস ব্যাগ থেকে কখনো বেরিয়ে আসত চিঁড়েভাজার প্যাকেট, কখনো রাতের জন্য বোঁদে; বের করার কায়দায় মনে হতো যেন একদুখানা সোনার পালক কুড়িয়েই পেয়েছে বোধহয়, মনে হতো পুরুলিয়া থেকে আড়ষা যাবার পথে হয়তো এল ডোরাডোও পড়ে। ওই লোকটাই তো তার নাম রেখেছিল ইমান— আশেপাশের অনেক ফিসফাসের তোয়াক্কা না করে। একজন মাসি বলতে এসেছিল “এরকম মুসলমান নাম রাখছেন…”, কথা শেষ না করতে দিয়ে বাবা বলেছিল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না। নিজের নামটা হিন্দু রেখেছেন। তাতেই হবে।” এরকমই স্পষ্টবাদী ছিল।
কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না এসব ভাবতে। মনে মনেও আর ‘বাবা’ বলে না। ঠিক উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের কদিন আগে কয়েকদিনের রোগে চিরদিনের ছুটিতে চলে দেল মানুষটা। তাকে আর মাকে পুরুলিয়ার ওই দুকামরার ফ্ল্যাটটাকে একা রেখে। তারপরে কতকিছু হয়ে গেল। স্কুলের জুয়েল ছাত্র ইমান বসু জয়েন্টে যখন নীচুতলার, অত্যন্ত নীচুতলার একটা স্যাঁতসেঁতে র‍্যাঙ্ক করল, তখন তার পরিচিত বৃত্তের বেশিরভাগটাতেই একটা খুশির হাওয়া বয়ে গেল। তার কষ্টটা বুঝলেন কেবল স্কুলের কয়েকজন পুরোনো স্যার আর কাছের বন্ধুরা। তাঁরাই হড়কে পড়ে যাওয়া ইমানকে হাত ধরে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন এই মেডিক্যাল কলেজে।
ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিল ইমান। দুপুরবেলাটা এখানেই খাওয়াটা সুবিধা। মাকে সকালে উঠে অফিস যেতে হয়, তাই মা-ছেলের সংসারে দুপুরের খাবারটা বন্ধই থাকে। মা খায় রিসেপশনিষ্টের চেয়ারে বসে, আর ছেলে লেকচারের ফাঁকে চলে আসে এই ভাতের হোটেলে।
এসে গেছে। সুপ্রিয়া হিন্দু হোটেল। আহ্, এখন কিছুক্ষণের শান্তি। ফ্যানের গুঁতোয় স্বস্তি। কোণের দিকে একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ল। পকেট থেকে কালো বাচ্চাফোনটা বের করে প্লেলিস্টটা বন্ধ করল। এই গান শোনার কম্পালসিভ অভ্যেসটাও বাবাই ধরিয়েছিল। একের পর এক গান শুনে যেত লোকটা। কাওয়ালি থেকে কালীকীর্তন। লোপামুদ্রা থেকে লেনন। ওই একটাই নেশা করতো তো লোকটা।
তবু!
দুর্! দুর্! দুর্!
যেদিনই এই লোকটার কথা মনে পড়ে, সেদিন পুরো দিনটা কষটে মেরে যায়। সব কথা জোর করে ঝেড়ে ফেলতে হাঁক দিয়ে মণিদাকে ডেকে রোজকার ডিমভাত দিতে বললো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাকি লোকদের দেখে বাকি সময়টা কেটে যাবে। বেশিরভাগ লোকই তো ডেলি খদ্দের। অনেককেই চেনে ইমান। ওই লম্বা স্বাস্থ্যবান ভদ্রমহিলা। ওই ছোটো করে গিন্নিবান্নি মানুষটি, যাঁর শাড়ির ব্যাজে লেখা, “ওজন কমাতে চান? আমার সাথে যোগাযোগ করুন!” ফরসা সেলসম্যানটি। বাকি লোকগুলো পাল্টে পাল্টে যায়।
মণিদা ভাত দিয়ে গেল। পাঁপড়ভাজাটায় এক কামড় দিয়ে ভাতটা মাখতে শুরু করল — হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা একটু খুশি খুশি হয়ে গেল। আরেক চেনা লোক। একটা বুড়ো লোক, মাথায় একটা কাপড়ের টুপি। গোটা মুখে শ্বেতি। সেজন্যই বোধহয় ইনি কোনো টেবিলে বসলে টেবিলের বাকিরা একটু গা বাঁকিয়েচুরিয়ে বসে, যাতে গায়ে ছোঁয়া না লেগে যায়। তার ওপরে ইনি মানসিক ভারসাম্যহীন। সেটা নিয়েও কানাকানি হয়। কিন্তু লোকটাকে ইমানের বেশ ভালো লাগে। কারো সাতে পাঁচে কান দেন না। নিজের মতো আসেন, খান, চলে যান নিজের মতো।
আর না। এবার ফটাফট খেতে হবে। দেড়টার লেকচারের দেরি হয়ে যাবে এবার।

হঠাৎ সে শুনতে পেল ভাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে, কেউ একজন উল্টো টেবিল থেকে ওই টুপিওয়ালা লোকটাকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”

২.
অমল হালদার কোনোদিনই তেমন খারাপ ছেলে ছিল না। মানে পড়াশোনায়। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো না কোনোদিনই, কিন্তু স্যারেরা চিনতেন বুদ্ধিমান ছেলে হিসেবেই, নম্বরও ভালোই পেত। স্কুলজীবনে তার দুটো অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা এই পড়াশোনা নিয়েই ছিল। অন্যটা একটু বেশিই ব্যক্তিগত। আপশোষটা ছিল অঙ্ক পরীক্ষায় ১০০ তে ১০০ না পাবার। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ ছিল তার এই আপশোষটুকু। তার কারণ আছে।
বাবা রতন হালদার ছিলেন ব্যাঙ্কের সামান্য ক্যাশিয়ার। কিন্তু চলাচলতি সমাজের বেঁধে দেওয়া কর্মগত পরিচয়ে আটকে পড়বার মানুষ ছিলেন না তিনি। পুরোনো দিনের ফার্স্ট ক্লাস গ্র্যাজুয়েট রতনবাবুর নেশা ছিল অঙ্কের। সারাদিন ঘোরানো চেয়ারে বসে আট. থেকে আশির পাবলিকের গাল খাবার পর ঘরে এসেই বসতেন অঙ্ক নিয়ে। খাতার পর খাতা, ক্যালকুলেটরে খটাখট, বই আর ম্যাগাজিনের গাদা হয়ে থাকত একটা রুম। উৎসাহ কম ছিল না টাকমাথা বেঁটে লোকটার— নইলে কেউ সোমবার অফিসের পর বিকেলে কলুটোলা স্ট্রীটে গিয়ে ধুলোভরা অঙ্কবই ঘাঁটে!
এই লোকের ছেলে হয়ে সে কিনা অঙ্কে কোনোদিন ১০০ তে ১০০ পায়নি! মানে, ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল একটু। সে মাঝেমধ্যেই ছোটোখাটো পরীক্ষায় কুড়িতে কুড়ি, পঁচিশে পঁচিশ পেয়েছে। একবার তো সত্তরে সত্তরও পেয়েছিল। চাপটা ১০০ পার্সেন্টের ছিল না, ১০০ নম্বরের ছিল। এই জিনিসটা তার গোটা স্কুলজীবনে ধাঁধা হয়ে ছিল।
অবশ্য, স্কুলজীবনের শেষে আর কলেজজীবন শুরুর আগে এর থেকে অনেক বড় একটা ধাঁধা এসে ঘূর্ণিঝড়ের মতো তার আর তার মায়ের জীবনটাকে ওলটপালট করে দিল। অঙ্কপাগল মানুষটার অঙ্কই ভুল হয়ে গেল একদিন— তহবিল তছরুপের দায়ে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল ব্যাঙ্কে সবার সামনে থেকে।
বাড়ি ছাড়তে হল পাড়াপড়শিদের বাঁকাচোখের থেকে বাঁচতে। হঠাৎ এতোগুলো ধাক্কা অমল ঠিক সয়ে নিতে পারলো না — রাস্তায় বড় বড় বেশ কয়েকটা বাম্পার পরপর পড়লে গাড়ি যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে, সেও তেমনিই কেঁপে গেল। কলেজের সময়ে তাকে দেখা যেতে লাগল বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের সামনে। কখনো এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো সিকিউরিটি গার্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা দাদা, এখানকার ক্যাশিয়ার কে?” সিকিউরিটি গার্ডরাও চিনে গেল তাকে। দেখলেই তাড়িয়ে দেয় লাঠি উঁচিয়ে, খিস্তি করে মা-বোন দিয়ে।
মা অনেক চেষ্টা করতেন। টাকা জোগাড় করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও নিয়ে গেছলেন এক-দুবার। লাভ হয়নি। অমলের কলেজের অ্যাটেনডেন্স কমে যেতে লাগল, সেমেস্টারে সাপ্লি হতে শুরু করল। এর মাঝেই একদিন মা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। ডাক্তার বলেছিল, মাথার শিরাগুলো ফুলে উঠে ফেটে গেছে। ব্যাস, এটুকুই। তারপর থেকে অমল ভেসে বেড়াতে লাগল।
বয়সটা বাড়তে বাড়তে, এঘাট-ওঘাট-সেঘাটের জল খেতে খেতে, এই আত্মীয় সেই আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে থাকতে এখন অমল ৫৮। একটা ছোট্টো বাড়িতে বাবাকে নিয়েই থাকে। ওই সিকিউরিটি গার্ড হিসেবেই কাজ করে একটা ব্যাঙ্কের এটিএমে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ব্যাঙ্কে কাজ করি’। যা পায়, তার আর তার বাবার মোটামুটি চলে যায়।
অমল রোজ আসে এই ভাতের হোটেলটায়। এরা বড় যত্ন করে খাওয়ায়। গোটা দুনিয়ায় আত্মীয় অনেক থাকলেও আপনজন বলতে তো ওই জেলখাটা বুড়ো লোকটা; তাই যেখানে যেটুকু ভালোবাসা পাওয়া যায়, সেটাকেই জড়িয়েমড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে তার। তাই দুবেলাই এখানে খায়।
নিজেরটা খায়, আর একজনেরটা প্যাক করে নিয়ে যায়। দশ বছর একটা টুকরো ঘরে বেঁচে থাকার পর যে মানুষটার বাঁচার ইচ্ছেই শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য। দশটা কথা বললে একবার মাথা নাড়ে। ভাত তরকারি থালায় ঢেলে মেখে দিলে তবে হাত বাড়ায়। প্রতিদিন ওই দৃশ্যটা দেখলেই তার মনে পড়ে যায়, পড়ন্ত বিকেলে মাথা ঝুঁকে বসে খসখস করে পেন চালাচ্ছে এই লোক। এই একই লোক।
এই তো কদিন আগে কী হ্যাপাটাই গেল! মাঝরাতে ‘বুকে ব্যথা’ ‘বুকে ব্যথা’ বলে খাট থেকে পড়ে গেল! দৌড়াদৌড়ি, ডাকাডাকি, ভর্তি হওয়া। সবই হল। কিন্তু কর্তার মন গলল না এতে। মাত্র দুদিনের ছুটি ছাড়া তিনি আর কিছুই দিলেন না।
আজ সেই দ্বিতীয় দিন। যদিও ছুটির প্রয়োজন আর সত্যিই ছিল না। আজও খেতে এসেছে সে।
টেবিলে বসতেই বসতেই সে দেখল, চেনা দোকানদার বসে আছে। মণিদা থালাটা সামনে নামাতেই প্রশ্নটা আলতো করে সৌজন্যের ছোঁয়ায় ভাসিয়ে দিলেন সেই লোকটি।
“আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”
প্রথমে শুনতে পায়নি অমল। কমই শোনে আজকাল। তাও আন্দাজবশে চোখ তুলতেই ভদ্রলোক প্রশ্নটাকে ফিরিয়ে আনলেন আবার, এবার জোরগলায়।
অমল গলাটা ঝাড়ল একবার। গলার শ্বেতির দাগটা চুলকে নিল একবার। তারপর বলল, “আর ভর্তি নেই। মারা গেছেন তো। কালরাতে। ওই যে মুকেশের গানটা আছে না?

বলেই হোটেলভর্তি লোকের মাঝে চোখ তুলে আকাশে হাত উঠিয়ে গেয়ে উঠল খোলা গলায়,
” জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা, ইসকে শিবা যানা কাঁহা!”

৩.
হোয়াক্! হোয়াক্! গোটা টেবিলটা বমিতে ভেসে গেল। কোনোমতেই সামলাতে পারলো না ইমান। গোটা থালাটা ভরে তো গেলোই, নিজের জামাকাপড় গেল, সঙ্গে গেল উল্টোদিকে বসা ভদ্রলোকের প্যান্ট আর জুতো। কোনোমতে মুখে হাত চাপা দিয়ে রাস্তার ধারে বেসিনের কাছ পর্যন্ত গেল। তারপর আবার ভলকে্ ভলকে্ বমি বেরিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে সে প্রায় বসে পড়ল রাস্তার ধারে।
খেতে আসা প্রায় সবাই অবাকচোখে গান গাওয়া বুড়োটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু গান শুরু হওয়ার একটু পরেই এরকমভাবে টেবিলে বমি করতে দেখে সবার চোখ সেদিকে ঘুরে গেছে। মুখে বিরক্তি আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। হোটেলের দুটো চাকর সবাইকে বসতে বলছে, বালতি আর ন্যাকড়া নিয়ে এসে পরিষ্কার করতে শুরু করেছে।
ইমান জানে দুম্ করে এরকম কেন হলো। এই টুপিওয়ালা লোকটা অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। এমন সব স্মৃতি, যা ফিরে আসা উচিত ছিল না। এই একইরকমভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ গান গেয়ে উঠত বাবা। একইরকম চোখগুলো ঝকঝক করতো গান গাওয়ার সময়।
কিন্তু সেই ছবিটা ফুটে ওঠেনি তার চোখে। লোকটাকে দেখতে তার বাবার মত, কিন্তু সেই বাবাকে সে মনে রাখতে চায় না। বাবার শেষদিনগুলো কোনো এক সিন্দুকে ভরে নদীতে ফেলে দিতে পারলে ভালো হতো — রূপকথার গল্পের মত।
কিন্তু মনে পড়ে যায়। ন্যাড়ামাথা বাবা। পেট ফুলে যাওয়া বাবা। কাঠি কাঠি হাত পা বাবা। লিভার ক্যান্সার বাবা। শেষের দিনগুলোতে শুধু একটা বিছানায় শুয়ে থাকত আর হাত নেড়ে নেড়ে তাকে কাছে ডাকত লোকটা। আর মনে আছে শেষ দেখাটা। শেষ দেখাটা না দেখলেই ভালো হত বোধহয়, সবাই বারণও করেছিল প্রাণপণ। কিন্তু সে নিজের জেদে দেখেছিল।
বীভৎস ফুলে যাওয়া পেট। হাতে পায়ে কপালে ঘি মাখানো। মুখে তুলসীপাতা। বাঁশ মেরে ভেঙে দেওয়া পা এর অংশ।
আজ সেই ধোঁয়া ধোঁয়া দৃশ্যটাই ফিরে এসেছিল আবার। সে দেখেছিল, লিভার ক্যান্সারের একটা মড়া চেয়ারে বসে হাত উঠিয়ে গান গাইছে। ওঠানো হাতটায় সবুজ রঙের ঘি মাখানো।
হোয়াক্! শেষ বমির দমকে এতোটা গলা গলা খাবার আর জল বেরিয়ে এল।

তার পক্ষে আর লেকচারে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘর ফিরতে হবে। সে কোনোমতে একটা অটো খুঁজতে লাগল বড়রাস্তায় এসে। যে অটো তাকে তার ঘরে ফিরিয়ে দেবে।

৪.
বিশ্বনাথ নামটায় এখানে তাকে কেউ ডাকে না। বাপটা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন মাঝেমধ্যে বিশ্বনাথ বলে ডাকতো। তারপর থেকে আর কেউ না। স্বাভাবিক। মানুষ স্বভাবগতভাবে আলসে। কাজ কমাতে চায়। তারপরে আবার সে যেখানে বস্তিতে থাকে, সেখানে লোকজনের সারাদিন এতো কাজ— তাদের ফুরসত নেই যুক্তাক্ষরওয়ালা নাম বলবার। তাই বিশু। বিশে। বিশা। রেগে গেলে বিশুচোদা।
এটাতেই তার আপত্তি রয়েছে। ভাগ্যের ফেরে তাকে আজ অটো চালাতে হয়, কিন্তু সে এখনো অটোওয়ালা হয়ে উঠতে পারেনি। ওই মুখে পান, ঠোঁট উঠিয়ে কথা বলা, গাড়িতে মেয়ে উঠলেই মিরর অ্যাডজাস্ট করাটা এখনো আত্মস্থ করতে পারেনি। তার মনে এখনো দশ ক্লাস পাস বিশ্বনাথ দাসের ছাপ ভালোরকম আছে। ট্রাফিক পুলিশে নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘মাস্টার বিশ্বনাথ দাস’। কেন সব অটোড্রাইভারের নাম বিশু,পাঁচু,ঝন্টু হবে সে বুঝে উঠতে পারে না! আর ভালো নাম নেবে সব ওই ভদ্রচোদা মানুষগুলো। ওই যে, ওই ইউনিয়নের নেতা, নামখানা কী বাগিয়েছে! সৌ-গ-ত!
তার তো আজ অটো চালাবার আর হঠাৎ ক্রসিঙে পুলিশের থাপ্পড় খাবার কথা নয়। সে নৈহাটিতে থাকা মাঝারিমেধার ছেলে ছিল। বাবা মাকে নিয়ে থাকত। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশটাও করেছিল। তারপর কী যে হল—বাপটা একদিন রাতে মরে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো অভিযোগ ছাড়াই। কোনো দায়িত্ব ছাড়াই। ব্যাস, তারপর এইসব পরিবারের রোজগার করা মানুষটা মরে গেলে যা হয়,তাই হল।
বিশ্বনাথ কদিন পার্টি অফিসে ঘোরাঘুরি করল। দাদাদের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিনেপয়সার পিয়োন হওয়াটা ঠ্ক পোষালো না তার। দাদারা বলেছিল অবশ্য, “কটাদিন থাক বিশু। কোথাও না কোথাও ঠিক ঢুকে যাবি।” কিন্তু তার আর সইল না।
এর মধ্যেই একদিন সংসারের শেষ লোকটাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সংসার বলতে বোধহয় সে শুধু শাঁখা-পলাটুকুই বুঝতো! তাই আরেক সেট শাঁখা-পলার সন্ধানে রাত্রেবেলা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল সে, যাকে সে ছোটো থেকে মা বলে জড়িয়ে ধরে এসেছে স্কুল থেকে ফিরে। স্কুলও নেই। জড়িয়ে ধরার লোকও নেই। তাই বিশ্বনাথও বেরিয়ে পড়ল এক পরিচিতের হাত ধরে। আর ফিরল না।
এসে প্রথম চাকরি জুটল ওই পরিচিতেরই পরিচিতির জোরে। হ্যান্ডবিল বিলি করার চাকরি। সারাদিন ধরে মিকি মাউসের বেশে লোকজনকে, বিশেষ করে বাচ্চাদের হাতে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের খবর ধরিয়ে দাও গোলাপি কাগজে। উফ্, সে এক দিন গেছে! সারাদিন ধরে এসপ্ল্যানেডের বিশাল রোদে ওই ঢাউস সিনথেটিক সুট পরে এদিক-সেদিক করো। দিন গেলে ১৫০ টাকা। গোটা পিঠে ঘামাচি হয়ে যেত। গলায় আর বগলে ঘাম জমে জমে এতো বড়ো ঘা হয়ে গেছল। সারাদিন ধরে চুলকাতো। তবু এই চাকরিটা সে ছাড়তে পারেনি। বহুদিন করেছিল। বিয়ে করেছিল এসময়েই। বউদেরও পরিবারের অবস্থা খারাপ, তবে ভালো ঘরের মেয়ে। দুজনে মিলে কাজ করে কোনোমতে চালিয়ে নিত। একটা বাচ্চাও নিয়েছিল।
ভেবেছিল সামলে নিতে পারবে। কিন্তু কই আর পারলো! দুজনেই কাজ করতে বেরিয়ে যেত, আর বাচ্চাটা থাকত বন্ধ দরজার ওপারে। পাশের ঘরে একটা বুড়ি থাকত, তাকেই মাসে মাসে ৫০ টাকার জন্যে বলেছিল দেখতে। সে ইচ্ছে হলে দেখতো, নইলে দেখতো না। এমন অনেকদিন গেছে যেদিন কেউ একজন এসে দেখতে পেয়েছে বাচ্চা হাগা-মোতায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে, আর কাঁদছে।
ভালো করে খাবার দাবারও পেত না। যত্নটাও পেত না। কতদিন বড়লোকদের জন্মদিনের পার্টিতে গেছে — মিকি মাউস সেজে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। পার্টি শেষে, গভীর রাতে যখন কেকের টুকরো আর বেঁচে যাওয়া মাংস নিয়ে ঘরে ফিরতো, ততখন বাচ্চাটা গলা ডালভাত মাখা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। না একটু সবজি, না কিছু। দুজনে মিলেই গিলতো তখন। পেট বড়ো বালাই।
ঠং-ঠঙাক্! কী একটা পড়ে গেল শব্দ করে অটোর ড্যাশবোর্ড থেকে। মাথা ঘুরিয়ে খুঁজে পেল না বিশ্বনাথ। আবার পিঠ বাঁকিয়ে মাথা নামিয়ে হাতটা সিটের তলায় ঢুকিয়ে বের করল জিনিসটা। লোকনাথ বাবার মূর্তিটা! দুর্ শালা! ফালতু জিনিস সব। ওই ঘটনাটার পর যখন ভাড়ার অটো চালাতে শুরু করল, তখন বাকি সবার জোরাজুরিতে পুজোটুজো করানোর পরও এই মূর্তিটা ২৫টাকায় কিনে রেখেছিল গাড়িতে। লোকে বলেছিল এর ফলে ওরকম তো আর হবেই না, তার সঙ্গে উন্নতি হবে। সবই নাকি লোকনাথ বাবার দয়া! ভূপতি তো আবার বলেছিল সকাল-সন্ধ্যে ধূপটুপ দিতে। প্রথমে কয়েকদিন দিয়েওছিল, তারপর আর ভাল লাগত না। বিরক্ত লাগত। পয়সার দেখা নেই — অতো ভক্তি করে হবেটা কী! এখন ড্যাশবোর্ডের এককোণে নিজের মত পড়ে থাকে। ধুলোটুলো মেখে একাকার হয়ে গেছে। অবহেলায় সে ওটাকে তুলে একদিকে রেখে দিল।
ওই একটা ব্যাগ কাঁধে ছেলে আসছে। কলেজ স্টুডেন্ট বোধহয়। বিশ্বনাথ ডানহাতে গিয়ারটা চেঞ্জ করে হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে রাস্তায় নামলো। ছেলেটা উঠলে, ডানহাতেই দুটো হর্ন মেরে গাড়িতে স্পিড দিয়ে চলে গেল কালো ধোঁয়া উড়িয়ে।

একটাই হাত ওর। মিকিমাউসের দিনগুলোতেই একদিন ঘটনাটা ঘটে। হকারভর্তি ভিড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল। সামনে দিয়ে একটা বাস রাস্তার মাঝেই টার্ন নিচ্ছিল। সে দেখেনি, এমনটা নয়। দেখেছিল ঠিকই। কিন্তু স্কুলজীবনে ফিজিক্স শেখার সুযোগ পায়নি সেজন্য, নাকি দুটো চোখের ফুটো দিয়ে বাসের সাইজটা আন্দাজ করতে পারেনি সেজন্য, ঠিকসময়মতো বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিতে পারেনি। কনুই থেকে হাতটা ছিটকে রাস্তার একদিকে চলে যায়, আর সে অন্যদিকে। সেই থেকে তার পরিবারটাও দুদিকে চলে গেল। ‘নুলো’ লোকের সাথে থাকবে না বলে বউ বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে অনেক গালমন্দ শাপশাপান্ত করে, অনেক থুতু ফেলে চলে গেল অন্য পুরুষের হাত ধরে। আর সে হয়ে গেল বিশু অটোওয়ালা।
আরে আরে! শালা শুয়োরের বাচ্চা! গাড়ির সামনেটায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল! অদ্ভুত পাবলিক মাইরি! নেহাত সিগন্যালটা ছিল বলে বেঁচে গেল।

৫.
আবদুসের আর কিছু করার ছিল না। ওই ফুটটাতে একটা বুড়ো মোটামতন লোক ছিল, দেখেই মনে হচ্ছিল পয়সাওয়ালা মাল। এগুলোর সামনে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে অনেকসময় ১০ টাকার পাত্তিও ছুঁড়ে দেয়।
অতো সিগন্যাল মানলে তার চলবে? আজ সকালে পার্ক স্ট্রিটে একটা গাড়িতে একটা ডবকা মাগীকে দেখার পর থেকে ওর হিট উঠে আছে। মাগীটার কী বড় বড় মাইগুলো ছিল! লাল ড্রেস পরা চমকঠমকওয়ালা মাগী ছিল। গাড়িটার পাশে গিয়ে ‘আল্লাকে নামপে কুছ দে দিজিয়ে মেমসাব! ভুখা বাচ্চা হ্যায়, বিমার বাচ্চা হ্যায়! আল্লা ভালা করেগা আপকা’ বলতে না বলতেই একটা ১০ টাকার নোট ফেলে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। তা যাক, এরমধ্যেই যা দেখার দেখে নিয়েছে আবদুস।
একটা পাবলিক বাথরুমে ঢুকে লুঙ্গির ওপর থেকে হাত চালিয়েই একবার খেঁচে নিয়েছে দুপুরবেলা। কিন্তু এখনো চোখের সামনে ওই মাইদুটো দুলছে তার। রাতে একবার মাগীপাড়ায় যেতেই হবে!
কিন্তু তার জন্য আরো একশো তুলতে হবে তো! সময় তো আর মাত্র দু তিন ঘন্টা। সাতটা-আটটার দিকে বড়ো বড়ো খাওয়ার জায়গাগুলোর সামনে গেলে জোড়ায় জোড়ায় আসা মালগুলোর কাছ থেকে কিছু মালকড়ি পাওয়া যায় বটে অবশ্য। ওটুকুই ভরসা। তারপরে আর বাবুর ঘাগুলোও কেউ দেখতে পাবে না, আর নোংরা শুকনো শরীরটাও নজরে পড়বে না। দেখতে না পেলে টাকাও দেবে না কেউ। দিনের ভাড়াটা তো শেখের হাতে দিতে হবে!
শেখের সঙ্গে প্রথম দেখা হাসপাতালে। আবদুস এমার্জেন্সির সামনে থেবড়ে বসেছিল মাটিতে। ছেলেটার বেশ কদিন ধরে জ্বর। পেটটা ফুলে গেছে। বাকি হাত পাগুলো খ্যাংরাকাঠি হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেন! মাগীটা পালাবার পর থেকে তো নিদের মতই ঝুপড়িটায় পড়ে থাকে, যা পারে এদিকওদিক কুড়িয়েবাড়িয়ে খায়। আবদুস সারাদিন পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, তার সময় কোথায় দেখবার! কদিন ধরে প্রচণ্ড বমি আর পেটখারাপে নেতিয়ে গেছে দেখে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু টিপেটুপে দেখে জানালার ওপার থেকে হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আর বলল, ‘বুকের ছবিটা করিয়ে আন। খুব বাজে অবস্থা!’
সেইসময়েই একটা সিড়িঙ্গেমত লোক কোথা থেকে সুট করে এসে তার কাঁধে হাত রেখেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে চাচা? আমাকে বলো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” আবদুস উপায় না দেখে সব বলল তাকে। জ্বর, বমি, ঘা। হাতের কাগজটা ধরালো ওর হাতে। ওই লোকটাই সব দেখেশুনে তাকে শেখের কাছে নিয়ে গেছল। শেখ তাকে বলেছিল, এইড না কী একটা রোগ হয়েছে বাচ্চাটার। বেশিদিন নেই আর। তাই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, “ওটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে লাভ নাই। বরং আমার কাছে কাজ করো, নিজেও খেতে পাবে, বাচ্চাটাকেও খাওয়াতে পারবে।” তারপর থেকেই শুরু।
রোজ সকালে উঠে বাচ্চাটার গায়ে মেকআপ করে বড়ো বড়ো ঘা তৈরি করে। তারপর হাতঠেলাটাতে নোংরা তোষক-কাঁথাগুলো চাপায়। আর বেরিয়ে পড়ে বাবুকে নিয়ে। এই হচ্ছে রোজের রুটিন। তার জন্য প্রতিদিন একটা টাকার ভাগ দিতে হয় শেখকে।

এই কয়েকমাসে আবদুস শিখে গেছে অনেক কিছুই। গাড়ির কাঁচে হাত ঢুকিয়ে টাকা চাওয়া, মেয়েদের পাশে পাশে ঘ্যানঘ্যান করা, বাচ্চাদের হাতে খাবার দেখলে তাদের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করা আর খাবার চাওয়া, অন্য ভিখারিদের সঙ্গে মারামারি করা। আরো অনেককিছু।
রাত হয়ে আসছে।
ইমান একা তার খাটে বসে খাবার খাচ্ছে। মা এখনো ডিউটি থেকে ফেরেনি। আজকাল মাঝেমধ্যেই রাতে ফেরেনা, বলে ‘ডিউটি ছিল’।
অমল হালদার হাতে একটা লাঠি নিয়ে নীল উর্দিটা পরে ক্লান্ত পায়ে একটা এটিএমের দিকে হাঁটছে। আজ তার খুব ঘুম পাচ্ছে।
বিশ্বনাথ মোড়ের দোকানটার থেকে তড়কা-রুটি কিনে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে অটোটা গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
আবদুস পেটভর্তি বাংলা খেয়ে হাড়কাটায় ঢুকলো। তার পকেট থেকে একটা বিড়ি গড়িয়ে পড়ে গেল কাদায়।

কলকাতা, তার বাবা আর ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে, আরো একটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেল।

একটা বুড়ো বয়সের গল্প

 

প্রিয়া আজকাল সবসময় জ্বলেই থাকে। কড়াইয়ের তেলে পেঁয়াজ আর ফোড়নগুলো দিলেই যেমন ঝ্যাঁস্ করে ওঠে, সেরকম চিড়বিড় করে ওঠে। স্বাগতর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে প্রায় ১২ বছর আগে। লোকে বলে, বউ যতই দজ্জাল হোক, বিয়ের ১০ বছরের মধ্যে সব সহ্য হয়ে যায়। সে মুখঝামটা হোক, বা ঝাঁটার ঝাপটা।
কিন্তু এই আপদটা নতুন।
তিনটে মানুষের জীবন বেশ ফ্লুইড চলছিল। মিষ্টির রসের মত মিষ্টি, কিন্তু প্যাচপেচে না। ক্লাস ২ এর বিষাণকে রেডি করা, স্কুলে পাঠানো, স্বাগতর ভাত বেড়ে দেওয়া, তারপর ওম্ শান্তি! কোনো হ্যাপা নেই গোটা দিনটায়। মাঝে মাঝে বাবুর প্রেম চাপলে একটু আগে চলে আসতেন, একটু হুটোপুটি হত দুজনের। নির্ঝঞ্ঝাট নির্দায় জীবন কেটে যাচ্ছিল।

হঠাৎ চাপে ফেলে দিলেন স্বাগতর বাবা। মানে, পূজনীয় শ্বশুরমশাই। “শ্বশুরমশাই না হাতি! বিয়ের সময় দুহাতে দুটো পাতলা চুড়ি পরিয়ে দায় সেরে দিয়েছিল। তার আবার শ্ব-শু-র-ম-শা-ই! হেঁহ!”, এখনো সেই প্রসঙ্গ উঠলে প্রিয়া গলার ভেতরে কথাগুলো আওড়ায়। ঠোঁটে আনে না অবশ্য। বেকার বেকার মরা মানুষটার কথা বলে ভালোমানুষ বরটাকে জ্বালাবার কোনো মানে হয় না।
হ্যাঁ, ঠিক দুবছর আগে, সাহেবি কেতার ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাক নামক শৌখিন রোগটিতে টুক করে ওপারে রওনা দিলেন। আর, তাঁর ৩২ বছরের ‘চাপ’ মালতীদেবীকে স্বাগত-প্রিয়ার কাঁধে ‘ফেলে’ দিলেন। ব্যাস!
গরমের দুপুর। পুরোনো গলি। আইসক্রিমের গাড়ি। কাঠের ব্যাট। ঝমঝম বৃষ্টি। ছাদ। বাঙালি জাতটার ন্যাকা নস্টালজিয়া নামক দুঃখবিলাসের উপাদান ‘বাংলা মায়ের আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে’ লুকিয়ে আছে। সেরকমই আরেক জিনিস হল এই দাদু-ঠাকুমার প্রজাতিটা! এখন প্রিয়ার মনে একদম বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, এই ৬০-৮০ এজ গ্রুপের লোকগুলোর অ্যান্টিক ভ্যালু ছাড়া আর কোনোরকম ভ্যালু নেই!
হবে নাই বা কেন! অন্য সব বুড়ির মতো কোথায় হরিনাম করবে, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাবে, সকালে বিকালে টুকু হাঁটবে আর দুধ-খই আর দুধ-মুড়ির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে, তা না! ৭২ হতে চলল, হাই সুগারের পেশেন্ট, চোখে দেখতে পায় না বললেই চলে—তবু মোটা মোটা বই পড়া চাই! আর তেমনি স্পিড আছে বটে! দুদিনে বই শেষ করে দেয়! সপ্তায় দুবার করে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে বই পাল্টে এনে দিতে হয়। তাক লেগে যায় প্রিয়ার। পাতলা ওই ‘সুখী গৃহকোণ’টা শেষ করতেই ওর ১৫-২০ দিন লেগে যায়!

সে পড়ছে পড়ুক। যা ইচ্ছে করুক। কিন্তু হ্যাপা কী আর একটা! যখন উনি মারা গেছলেন, তখন সরল মনে মালতীদেবীকে এনে উপরের তলায় তুলেছিল ওরা। কিন্তু দিনকয়েক বাদেই বুঝতে পারল প্রিয়া, মালতীদেবীর নাকটি আর কাজ করে না। অন্তত পেচ্ছাবের ক্ষেত্রে। সুগারের পেশেন্ট, দিনে ত্রিশবার করে পেচ্ছাব করতে যায়, আর জলটুকু পর্যন্ত মনে করে দেয় না! অদ্ভুত! সারা ঘর যে গন্ধে ম-ম করে, যে গন্ধে খেতে বসার আগে দুবার ফিনাইল না দিলে বমি চলে আসে, সেই গন্ধটা ওনার নাকেও যায়না! গন্ধের কথা বললেই বলেন, “ওসব তোমার মনের ভুল বৌমা!” শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। সেটার সুরাহা করতেই অবশ্য এই মাসছয়েক আগেই নিচের তলায় নামিয়ে দিয়েছে বুড়িকে। ওখানে যা ইচ্ছে করুকগে! এখন নিচের তলাটায় নামা যায় না। কোনোমতে খাবারটা আর বইটইগুলো নামিয়ে দিয়ে পালায় প্রিয়া।
জঞ্জাল যত জীবনে! দুপুরবেলার সুখ-শান্তি সব নষ্ট হয়েছে এখন! বুড়ির ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায়। আর তেমনি খেতে পারে বটে! অ্যাতোটা ভাত, মাছ, তিনটে তরকারি, দই, চাটনি অনায়াসে সাঁটিয়ে দেয় এই বয়সেও! পেট খারাপের ভয়ে কদিন খাবার কমিয়ে দিয়েছিল প্রিয়া, তাতে স্বাগতকে একদিন ডেকে কীসব বলে টাকা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। পারে বটে!
স্বাগত বুঝেছিল ব্যাপারটা। আস্তে করে বলেছিল, “পুরোনো দিনের মানুষ। বেশি খেতে পারে। বেশি করেই দিয়ো, ভয় পেও না।” তারপর থেকে ওমনিই দেয়। চূড় করে সাজিয়ে দেয়। মরুকগে!
তো এতো খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেলে আর ল্যাদের সময় কোথায় পাওয়া সম্ভব? জাহান্নামে গেছে সব। ল্যাদ, আড্ডা, সিনেমা, সব!

বুড়ির আরেক বাতিক আছে। বুড়ি কীসের যেন অপেক্ষা করে! প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারতো না প্রিয়া, কেন একটা বুড়ো মানুষ সপ্তাহে দুতিনদিন জিজ্ঞেস করে তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা! যেখানে সারা মাসে চিঠি বলতে এলআইসির একদুটো, শেয়ারের কোম্পানির দুতিনটে চিঠি আর বিলগুলো ছাড়া আর কিছুই আসে না, সেখানে ব্যাপারটা অদ্ভুত বইকি!
প্রথমে প্রথমে ভাবতো পেনশন। তারপর একদিন জিজ্ঞেস করলো স্বাগতকে। স্বাগত প্রথমে “ওসব জেনে কী করবে, ছেড়ে দাও না” বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল, পরে চাপাচাপি করতে খুলে বলল। নাকি কলেজে মালতীদেবীদের কয়েকজন মিলে একটা প্ল্যান বানিয়েছিলেন। স্বাগতর ভাষায়, “মায়ের একখানা হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড ছিল। কি একটা নাম, ভুলে গেছি। সে আর তার বন্ধুরা মিলে একখানা প্ল্যান বানিয়েছিল, যে তারা তাদের বুড়ো বয়সে একসঙ্গে সবাই মিলে মস্তিতে থাকবে। একখানা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করবে সে। তারপর সব বন্ধুকে ডেকে নেবে বুড়ো বয়সে। সেখানে নাকি মোটেও টিপিক্যাল বুড়ো বুড়ো জিনিসপত্র হবে না। সবাই আড্ডা দেবে, পছন্দের জিনিসে মন দেবে, বই পড়বে, গান গাইবে একসাথে, সিনেমা দেখবে, ঘুরতে যাবে। শেষবয়সে সবাই মিলে ভালো থাকবে।” শুনে প্রিয়া অবাক! জিজ্ঞেস করেছিল, “আর ৪০ বছর পরে ঠিকানা পাবে কোথায়?” স্বাগত বলেছিল, “অ্যাই! এক্কেবারে! আমিও এই প্রশ্নটাই করেছিলাম মাকে। মা বলেছিল, ওই লোক নাকি সব পারে! বোঝো!”
প্রিয়া শুনে ঠোঁট উল্টেছিল। হুঁহু্! পাগলামি যত্ত! বৃদ্ধাশ্রমে হইহুল্লোড়! এই আজগুবি প্ল্যানটা মনে পড়লেই ফিক্ করে হেসে ফেলে প্রিয়া। তারপরেই ভাবে, “না বাবা। আমার বাবুটা আমাকে যত্নে রাখবে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না কক্ষনো!”

এখন তো বুড়ি নীচের তলায়। তাই বেশি কথাও হয়না। আছে নিজের মতন। এমনকি পেপারটাও আলাদা করে দিয়েছে এখন। পেপার এলেই খুঁটিয়ে পড়া অভ্যাস বুড়ির, তখন চাইতে গেলেই বিরক্ত হয়। তাই একটা আনন্দবাজার গেটের ফাঁক দিয়ে নীচের তলায়, আর একটা ছুঁড়ে উপরের তলায়। শান্তি!
হঠাৎ, একদিন রবিবার সকাল নটায় ঘুম ভাঙলো প্রিয়ার। উঠেই চমকে গেল! এতো দেরি হয়ে গেল তবু জলখাবারের তাড়া আসেনি নীচ থেকে? অবাক কান্ড তো!! তাড়াহুড়ো করে এগোতে গেল সে। পায়ে ঠেকলো দড়িবাঁধা আনন্দবাজারটা।
হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা হলুদ লিফলেট।
তাতে অবাক একটা বিজ্ঞাপন।
“দি কলেজ রকার্স”
[বঙ্গবাসী কলেজ, ১৯৬৬ ব্যাচ, ইংলিশ অনার্স। মনে পড়ে শেষদিনের আড্ডায় করা প্রমিসগুলো? আমি কিন্তু আমার প্রমিস রেখেছি। আমি, আশিস, বিবেক আর শর্মিলা এই চারজন এখন আছি। বাকিরাও চলে আয় তাড়াতাড়ি।
জমিয়ে আড্ডা হবে আবার। অনেক গল্প জমে।]
নিচে একটা অ্যাড্রেস। রাজাবাজারের। অ্যাড্রেসটা আর পড়ার চেষ্টা করলো না প্রিয়া। নিচেও গেল না আর। জানে টেবিলের ওপর লাইব্রেরির শেষ ইস্যু করা বইগুলো আর টেবিলের নীচে কাল রাতের এঁটো খাবারের থালাটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

দ্যাটস্ নট ক্রিকেট

মাঠের অর্ধেকটা প্যাচপেচে গরমকাল, বাকি অর্ধেকটা মাটিফাটা গরমকাল। 

হিউমিডিটি এন্ড থেকে লম্বা রানআপ নিয়ে ছুটে আসছেন কলকাতা চ্যাটার্জি।
উইকেটের সামনে মুখে গামছা জড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়া মাহাতো।

প্রথম বল। আঙুল-টাঙুল বেঁকিয়ে কায়দা করে বলটা ছাড়লেন। বোঁদে।
ঠকাং। কড়া একটা পুল। বল দড়ির ওপারে।
পা ঘষতে ঘষতে ফিরে গেলেন কলকাতা চ্যাটার্জি। হঠাৎ মনের মধ্যে চমক খেলে গেল। এই বলটা তো করা যেতেই পারে।
মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে ছোট্টো রানআপ নিয়ে তিনি বলটা করে ফেললেন।
হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছিল। আলুপোস্ত লেংথে পড়ে গেল। তার সঙ্গে আবার নো বল। অতি উত্তেজনায় পাটা বাইরে পড়ে গেছিল আর কি!
স্টেপআউট। এবং ভটাশ্ করে একটা জায়ান্ট ছক্কা। বলটা জায়ান্ট স্ক্রিনের ওপর দিয়ে কোথায় উড়ে গেল, কেউ দেখতেও পেল না।
পুরুলিয়া মাহাতো আস্তে আস্তে হেলমেটটা খুললেন, নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যভরা ‘সিঁক’ আওয়াজ করলেন, একবার কলকাতার দিকে আড়চোখে তাকালেন। তারপর এগিয়ে এসে ক্রিজে ব্যাটটা ঠুকঠুক করে দুবার ঠুকলেন। প্রতীকী।

অ্যাতো অপমান! ওই পুঁচকে পুরুলিয়ার এতো স্পর্ধা! আর সইতে পারলেন না তিনি।
শক্ত করে মুঠোর মধ্যে বলটাকে চেপে ধরলেন। এবার হয় এসপার নয় ওসপার!
রানআপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বলটার গায়ে বুড়ো আঙুলের নখটা দিয়ে গভীর একটা দাগ কেটে দিলেন। এই ট্যাম্পারিংটা কাজে লাগবেই, এটুকু নিশ্চিত।

বল করলেন। ঠান্ডা একভাঁড় রাবড়ির লেংথে পড়ে আসছিল বলটা। হঠাৎ হাওয়ার মধ্যে একটা বনেদী বাড়ির ফাঁকা ছাদের দক্ষিণী হাওয়ার বাঁক খেয়ে গেল।
বিষাক্ত ছোবল। মাঝখানের স্টাম্পটা মাটির থেকে আলগা হয়ে গেল নিমেষে।

ক্লিন বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে যেতে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করলেন পুরুলিয়া মাহাতো, “ইটা কিরিকেট লয় বাপ। ইটা লয়।”

©জন্মজ্যাঠা অনিকেত

বৃষ্টিরা

তারপর একদিন ঝুপ্পুস বৃষ্টি পড়ল। লালচে আকাশটা ছাই-সাদা হয়ে গেল গোটা বিকেল জুড়ে। সরু গাছের কান্ডগুলোর নীচে হাওয়া বইল। লালে সবুজে হলুদে মেশানো বুড়ো অকেজো পাতাগুলো দূরে সরে গেল। উথালপাথাল হাওয়ায় তারা আর এই সমাজের যোগ্যতামান পেরোতেই পারলো না। শনশনিয়ে ঠান্ডা, শীতল বাতাসেরা কানে কানে বলে গেল, ‘তোমরা ইনভ্যালিড।’ আর তারপর গিয়ে ধাক্কা মারলো খ্যাক খ্যাক করে দাঁত হাসতে থাকা লাল ইঁটগুলোর পোড়ামুখে।
শেষে বৃষ্টি নামলো। জড়ো হওয়া অসংলগ্ন অশক্ত পাতাগুলোর চোখ বেয়ে নামলো, তাদেরই মৃত্যুপরোয়ানা হাতে। গোটা শহরটা ধূসর রং থেকে সাদা হয়ে গেল। শহরটা ভেবেই পাচ্ছিল না এমনি কেন হলো। কিন্তু ব্যাপারটা তার হাতে ছিল না। এতো বড়ো শক্তিশালী শহর আস্তে আস্তে নেশায় বুঁদ হয়ে তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললো। আর বৃষ্টিরা তার সমস্ত শরীরের আশপাশ দিয়ে ঢুকে পড়ছিল। শহরের অনিচ্ছাতেই তারা অনুপ্রবেশ করলো তার শরীরের ভেতরে। অসহায় হয়ে চুপচুপে ভেজা কলকাতা দেখলো তার গোপন সমস্ত অঙ্গ বেয়ে জল পড়ছে। সে শিউরে শিউরে উঠছিল। এতদিনের জমে থাকা পাপ তার হাইড্রান্টের কালো জল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একমাথা ভেজা চুলে নিজের শাস্তি শুনছিল সেই শহর। সাক্ষী ছিল কেবল কয়েকটা পালকভেজা চড়ুই আর অবাক কিছু মানুষ।

মানুষের একটাই দোষ। সে সবসময় যেন কী একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মুরগি যেমন মাথা নীচু করে মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়, মানুষও সারাটা জীবন তাই করে গেল অন্য মুরগিগুলোকে দেখে দেখে। সাহস করে কোনোদিন আকাশের দিকে সোজা মুখ তুলে তাকাতেই পারলো না, পাছে চোখে বৃষ্টির ফোঁটারা পড়ে তাকে কাঁদিয়ে ফেলে!
এই মানুষটাও বৃষ্টিদের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। সে বৃষ্টির মধ্যে খুঁজছিল তার ফেলে আসা গ্রামের ছেলেবেলা আর ভেজা হাফপ্যান্ট পরা বন্ধুদের। বৃষ্টিদের আয়নায় নিজেকে দেখে সে জানতে চাইছিল, কিসের সন্ধানে সে এসেছিল? জীবন খুঁজতে কি কেউ জীবনের বাইরে আসে? কিন্তু জলের দাগ পড়ে পড়ে পুরোনো আয়নায় দাগ হয়ে গেছল গোল গোল, তাই আর তাকে উত্তরগুলো কেউ বললো না।
তারপরেই কাট। এবং প্যান করে আরেকটা মানুষ। সেও কিছু চায়। ভেজানো জলের বিন্দুগুলো তার মাথার জুড়েমুড়ে যাওয়া চুলগুলো ভিজিয়ে পালাতে পালাতে জানতে চাইছিল, তার এতো দুঃখ কীসের। বৃষ্টিটা তার দুঃখ দেখে তার থুতনি ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
তখন মানুষটার গল্প নীল রঙের টিনের ছাদে টং টং করে রাগতস্বরে আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগলো। আর তার জীবনের ব্যর্থতা গলে গিয়ে টিনের চালের বাঁকগুলো বেয়ে পড়ে গেল, মানুষটার তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু যে ব্যর্থতা জড়িয়ে বেঁচে থাকে, ব্যর্থতা ভাঙিয়ে খায়, তার কাছ থেকে গল্পগুলো চুরি করে নিলে কীইবা বেঁচে থাকে, বলো? তাই সে মেঘলা আকাশের নীচে বৃষ্টিকে তাড়িয়ে দিল। তার গল্পটাও না বলা হয়েই রয়ে গেল। যদি কোনোদিন সে বলে ফেলে, তার আশায় বৃষ্টিরা আবার দিন গুণতে লাগলো।

এতোক্ষণ ধরে একটা মানুষ একাএকা ছাদের ট্যাঙ্কের ওপর বসে ছিল। সে ভিজছিল না। কিন্তু সে ভিজে যাচ্ছিল। চুল বেয়ে, কালো জামা বেয়ে তাকে আরো ছেঁকে ধরছিল বৃষ্টির দল। তবু সে একটুল নড়ছিল না। কারণ বোধহয় তার বৃষ্টির কাছ থেকে কিছু নেবার ছিলনা। সে আজকের আকাশ দেখে কিছুই আশা করেনি। কেবল বয়ে যাওয়া সোঁদাগন্ধ বাতাসে ডাস্টবিনের মতো সে তার কালো অংশটুকু উড়িয়ে দিচ্ছিলো। ঠান্ডা ভেজা বাতাসেরা অনায়াসেই তার কাছ থেকে সবকিছু শুষে নিচ্ছিল, শহরের অন্যপ্রান্তে অন্য কাউকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাই তার কাছে বৃষ্টিরা পাত্তা পাচ্ছিল না। তার লম্বা দাড়ি বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটারা লাস্যময়ী নায়িকার মতো চুমু খেয়ে যাচ্ছিল এক অসহায় আকুতিতে, আর সে কেবলই তাদের বেশ্যাবৃত্তিকে নির্বিকারভাবে গা বেয়ে পেরিয়ে যেতে দিচ্ছিল।
আমি নিচে নেমে গেলাম। একটু লিখতে হবে।

আস্তিক

আমি থাকি হোস্টেলে। জ্ঞানীগুণীরা জানেন, হোস্টেলের খাবার কী চিজ। আমি দুবলাপাতলা লোক, তায় দুমাস ধরে শসাদার খাবার খেয়ে না-কাটা চাপদাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল নিয়ে যখন বাড়ি যাই, তখন ঘরের লোক সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবে, না ঘরেই ডাক্তার ডাকবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না!
তাই আমি নাকি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারিনা, এরকম একটা ভুয়ো অপবাদ মার্কেটে ছড়িয়ে গেছে। আমি নাকি সুস্থ থাকার মিনিমাম চেষ্টাটুকুও করিনা। তো, এইসব করিনা-ক্যাটরিনার চক্কর ছেড়ে আজকাল একটা হোটেলে খাওয়া শুরু করেছি।

বেশ ভালো হোটেল। ছোটোখাট্টো। নাম হচ্ছে সুপ্রিয়া, কিন্তু আপনি কোথাও নামটা খুঁজে পাবেন না। চার-পাঁচটি পুরনো চটে যাওয়া বেঞ্চি পাতা আছে। মাঝেমধ্যেই গিয়ে খালি হবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একজন উড়িয়াকাকুই হচ্ছে ওখানের সবকিছু— ভাত বেড়ে দেওয়া থেকে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানো, মণিদা নইলে চলে না!
দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা কিন্তু এক্কেবারে সত্যি। তরকারি ফেললে যেমন ‘সব্জি ফেললে চলব?’ শুনতে হয়, তেমনি পাতের শেষে চাটনিটা মেখে যখন শেষ মুঠো ভাতটা চেটেপুটে খাই, তখন একহারা লম্বা মানুষটার সাদা দাঁতের হাসি দেখে পেটের সাথে মনটাও ভরে যায়।
তা বেশ। আজ রাতে খেতে গেছি। প্রায় সব টেবিলই ভর্তি। দাঁড়িয়ে আছি বাইরে, হঠাৎ একদিকে চোখ গেল। আমার এটা খুব বাজে অভ্যাস জানেন তো, চোখ আর কানগুলো কুটকুট করে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করে। যা দেখলাম, একটু অবাক হলাম।
দেওয়ালের দিকে মুখ করে এক বুড়োমানুষ বসে আছেন। সামনে থালা। আর পাশে বসে মণিদা। এক এক করে থালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে যাচ্ছে, “এটা ভাতঅ। এটা মাছঅ।ভাতে ডাল দিয়ে মেখে নিন। তাপ্পর খান।” বুঝলাম, আধময়লা জামা পরা মানুষটা সম্ভবত মানসিক প্রতিবন্ধী। বা হয়তো বয়সজনিত কারণেই বিস্মৃতি ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্কের কোষগুলোর।
টেবিল খালি হলো। বসলাম তাঁর থেকে একটু দূরেই। খেতে খেতে দেখছিলাম আড়চোখে। হাত কাঁপছে মানুষটার। ভাত-তরকারির গোল্লা থেকে কিছুটা অংশ পড়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে কালো কর্ডের প্যান্টের ওপর। মণিদা ঠায় বসে ছিল পাশে। হাতে থাকা ন্যাকড়াটা দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ দাদু ডালভাত মাখা দুহাত তুলে চেয়ারে বসা মালিকের দিকে মুখ করে বললেন, “বুড়ো মানুষকে বড়ো যত্ন করে খাওয়ালে বাবা। ক্ষুধার্ত মানুষকে যত্ন করে খাওয়াও তোমরা—বড়ো পুণ্য করো। বড়ো ভালো করো। ভগবান ভালো করবেন!”

কেউ দেখলো না, আমি টুক করে দেখে ফেললাম, মণিদা একবার বুড়োমানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা উঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল।

খাওয়া শেষ হয়ে গেল। আমারও। উঠে রাস্তায় বেরিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। দেখলাম, কোনোমতে উঠলেন বুড়ো লোকটা। মণিদা ধরে ধরে সিঁড়িটা নামিয়ে দিল।
এটা গল্প হলে হয়তো এবার গরীব মণিদা ততোধিক গরীব এই লোকটার খাবারের দাম দিয়ে দিত। বলত, “মুখটঅ আমার বাপের মত দেখতে অছি।”
কিন্তু গল্প আমি লিখতে পারি না যে। আমি শুধু বেসিনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলাম, ডান পাটা প্রচন্ড ফুলে আছে তাঁর। কালো হয়ে আছে। পেটটাও প্রচন্ড ফুলে উঠেছে। বোধহয় সিরোসিস।
জামার পকেট থেকে টাকা বের করে দাম মেটালেন। মণিদার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “বড়ো যত্ন করে খাওয়াও বাবা। ভগবানের সেবা করো তোমরা। ভগবান ভালো করবেন।” জানি, আপনাদের মনে হচ্ছে এসব তো পর্দার ওপারে হয়। কিন্তু আর কেউ দেখুক না দেখুক, আলো-আঁধারিতে বুড়োমানুষটার গালে জলের ফোঁটা আমি দেখেছিলাম। বোধকরি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা মণিদাও দেখেছিল।

বুড়োমানুষটা কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন অন্ধকার বেয়ে।
হোস্টেলের দিকে যেতে যেতে একটা কথাই মনে হল, এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোই আমাকে কোনোদিন নাস্তিক হতে দেবে না।

প্রবাসে

বিধুভূষণের কাছে জানতে চাইলাম, বিদেশে না গিয়ে প্রবাসের স্বাদ কীভাবে পাওয়া যায়?

সে বললে, জানো অনিকেতদা, সেদিন রাতে হোস্টেলের খাটে বসে আছি। রাত প্রায় দেড়টা হবে। ঘড়ি-টড়ি দেখিনি। সামনে সেমেস্টার, দুলে দুলে ড্রাগের নাম মুখস্থ করছি।
হঠাৎ টক্-টক্ জানালায়। খটাস্ করে ছিটকিনিটা উঠিয়ে তাকাতেই দেথি, একটা মোটা হাত। একগাল হেসে সায়ন্তন মুখুটি গরাদের ওপাশে। আমি ভাবলুম বুঝি রাতবিরেতে পেটে আগুন জ্বলেছে, তাই নুলো বাড়িয়েছে। আমি বলতেই যাচ্ছিলাম, না বাপু কিচ্ছু নেই, সব ড্রয়ার ধুধু ফাঁকা।
তখনই আমাকে চমকে দিয়ে ও বলল, ‘নে নাড়ু খা! আজ ঘর থেকে ফিরলাম সকালে। মা দিলো সঙ্গে।’ এই বলে চলে গেল হাতে দুটো নাড়ু ধরিয়ে!
তা বেশ। আমরা হোস্টেলবাসীরা খাবার পেলেই তাকে যথাস্থানে রেখে দিই, মানে পেটে আর কী!
ঘরের খাবার তো পান্তাভাতের পর ক্যাভিয়ার খাবার সমান! আমিও জানালা বন্ধ করে জমিয়ে বসলাম। দুমাস ঘর যাইনি। পরীক্ষা শেষ হলে যাবো। এসময়ে যেটুকু ঘরের ঘাস পেয়েছি, সেটাকে ভালো করে জাবর কাটতে হবে তো!
কানে ইয়ারফোন লাগালাম। বই আর হাইলাইটার রইল টেবিলল্যাম্পের ছায়ায় পড়ে। চোখ বুজে কামড় বসালাম।
হঠাৎ এফএমের গানটা পাল্টে গেল। আচমকাই। বিনা নোটিশে। আমাকে না বলেকয়েই।
একজন তরুণ, তার ঢেউওঠানো উথালপাথাল গলায় আমার নীল ইয়ারফোনদুটোতে সমুদ্র এনে দিচ্ছিল না চাইতেই। আমি ভেসে যাচ্ছিলাম।

তখন মনে হচ্ছিল, সত্যি বড্ডো বেশি দূরে আছি ঘর থেকে। অনেক দূরে। ট্রেনে করে আর কোনোদিন পৌঁছতে পারবো না। ট্রেনগুলো শুধু স্টেশন ছুঁয়ে চলে যাবে, আমি দৌড়ব, কিন্তু গার্ড আর ট্রেন থামাবেন না। কেনই বা থামাবেন? টাইমটেবিলে সময় পেরিয়ে গেছে। যখন ঘরে ফিরতে পারতাম, তখন অভিমান করে বসেছিলাম একা। একাকীত্বের গর্বে ঘাড় উঁচু করে হনহনিয়ে চলে গেছিলাম। আজ আর ঘর ফেরা হবে না। বাথরুমের শ্যাওলাস্তরে আঁকা অস্ট্রেলিয়া আর জানালার পাল্লায় আঁকা গুপ্তধনের ম্যাপগুলো আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাবে, কিন্তু সে আর ফিরবে না। ঘর যাকে একবার ফিরিয়ে দেয়, সে কী আর ফেরে? সে প্রবাসেই ভালো থাকে। একলাটি।

তখনও কানের কাছে বয়ে চলেছে,
ওহে হারাই হারাই/ সদা হয় ভয়/ হারাইয়া ফেলি চকিতে/ আশ না মিটিতে হারাইয়া/পলক না পড়িতে হারাইয়া/ হৃদয় না জু়ড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে…..’

এভাবেই সেদিন বিদেশী হয়ে গেলুম। একনিমেষে।”

জগন্নাথ ভোজনালয়

— কলকাতার একটা পুরোনো গলিতে ঢালু নালার ওপরে তৈরি ছোট্টো ভাতের হোটেলে একটা ফাটাফাটি পাবদা মাছের ঝোল-ভাত খেতে সবচেয়ে বেশী কী জরুরি বলুন তো?
— টাটকা পাবদা মাছ?
— উঁহু।
—ধোঁয়াওঠা ধবধবে সাদা দেরাদুন রাইস?
— ধ্যার মশাই! ভাতের হোটেলে দেরাদুন রাইস? টমেটোর চাটনি দিয়ে তন্দুরি? এয়ার্কি?
— তবে আর কী! পেটজুড়ে চনচনে খিদে?
— এ তো জেনেরালাইজড উত্তর হয়ে গেল গো। ভাবো টুকু!
— পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা?
— হলো না, হলো না, ফেল!
—আর পারছি না বাপু বকবক করতে। বলবে তো বলো, নইলে আমি এলাম!
— উফফ্! এতো অসহিষ্ণুতা দেশজুড়ে!
শোনো তবে। তোমার জন্য প্রায়োরিটি ওয়াইজ সাজিয়ে বলি।
নম্বর ১, কড়া গ্রীষ্মের ঘামঝরা দুপুরের ক্লান্তি।
নম্বর ২, সকালে অফিস যাওয়ার পথে হঠাৎ মায়ের ফোন।
নম্বর ৩, হোটেলের বাইরে লেজনাড়া খেঁকি কুকুর।তার লেজে একদুটো মাছি।
নম্বর ৪, স্টিলের থালায় সবুজ কলাপাতা আর তার জলের ফোঁটার লাজুক দৃষ্টি।
নম্বর ৫,ঘ্যাঁটের স্তূপের পাশে কুড়কুড়ে আলুভাজার মিষ্টি লুকোচুরি।
নম্বর ৬, ফ্যানের বদলে দরজা দিয়ে মাঝে মাঝে বকুলের পাতার ঠান্ডা ঝিরঝিরে হাওয়ার ডোজ।
নম্বর ৭, কাউন্টারে বসা টাকমাথা হাসিমুখ ভুঁড়িকাকু।
নম্বর ৮,সেই কাউন্টারেই ভাজা মৌরি আর গোটা মৌরির সহাবস্থান।
নম্বর ৯, এদিক ওদিক চরকিপাক খেতে থাকা বছর সতেরোর ফাজিল ছোকরা।

আর, নম্বর ১০এ, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, একজন মাঝবয়েসী বেঁটে মোটা মানুষ, যার ঠোঁটের ডগায় সেদিনের মেনু সবসম়য় তৈরী থাকে, সব টেবিলের সব অর্ডার মনে রাখতে এককুচি কাগজও লাগে না, অসাধারণ গতিতে টেবিলে টেবিলে মাছ ভাতের থালা পৌঁছে দিতে যার জুড়ি নেই, আর মুখে একটুকরো অভিভাবকস্বরূপ হাসি যার সবসময় লেগেই থাকে।
মানুষটাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়।
ছোটোবেলায় জ্বর হলে বাবা মাঝেমধ্যে খাইয়ে দিতো। আমিও সেই হোটেলটায় মাঝে মাঝেই যাই।

বেশি না।