যেমনটা কখনো হয়না

 

ছোটোবেলায় আমাদের একটা স্কুল ছিল। এই স্কুল শব্দটার সাথে ছোটোবেলাটাই মানায় ভালো। যেমন মানিয়ে যেত গরমকালের লম্বা আটঘন্টার দুপুরগুলো। টেনেটুনে এঁটেউঁটে খাপ খেয়ে যেত ঠিকই।
স্কুলটার স্কুল হবার সবরকমই যোগ্যতা ছিল। দুতিনটে মাঠ ছিল। পুরোনো বড় বড় ক্লাসরুম ছিল। চোরকাঁটার জঙ্গল ছিল, যেখানে ফুটবল আনতে গেলেই মোজা আর খাকি প্যান্ট ভর্তি হয়ে যেত চোরকাঁটায়। যেটাকে বলে জুরগুন্ডা। মাঠে প্রচুর ধুলো ছিল। সাইকেল করে বাড়ি ফেরার সময় জুতোয় কিচকিচ করতো। ভাঙা কোণের বাথরুমে ইঁটের লাল টুকরো দিয়ে অনেক কিছু লেখা ছিল। মনিটরদের নাম লেখা ছিল। শিক্ষক দিবসের বিকেলে ভারভারিক্কি স্যারের হাতে বিরাট ওভারবাউন্ডারি ছিল। নিলডাউন ছিল। পরীক্ষায় অঙ্ক ছেড়ে এসে কান্না ছিল। একটা হেডস্যারের অফিস ছিল। হেডমাস্টারকে আড়ালে হেডু বলা ছিল। একটা গোবরে ভর্তি সাইকেল স্ট্যান্ড ছিল; যাতে সাইকেল থাকতো কম, গরু থাকতো বেশি। একটা ক্লাসপালানোর আমতলা ছিল। একটা সাইকেল দিয়ে ঘিরে ক্রিকেট খেলার নিমতলা ছিল। একটা ভূতের গল্পজড়ানো শাল মেহগনির জঙ্গলও ছিল।
আর ছিল নানারকমের বন্ধু। উরেবাব্বা। ছোটোবেলায় যেদিন একসাথে এতোগুলো লোক গিয়ে ক্লাস থ্রির ঘরটায় বসে পড়লাম, সেদিন সবাইকে একইরকম মনে হয়েছিল। সব বেঞ্চে চারজন। আমি শেষ বেঞ্চে। কারণ শেষে এসেছি, দৌড়তে দৌড়তে। রিক্সাকাকু দেরি করে ফেলেছে। তাড়াতাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আবার জানালার পাল্লায় ধাক্কা খেয়েছি। প্রথমদিনেই। তাই প্রথমদিনেই সিকিমাথা আলু নিয়ে আমি বসে আছি শেষ বেঞ্চে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম চোখ গেলো ব্ল্যাকবোর্ডে। লেখা আছ‌ে, বড়ো বড়ো করে, ‘১০০ থেকে ১ লেখো উল্টোদিকে।’ আমি খাতা পেন বের করে ৭০ পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখলাম, তিননম্বর বেঞ্চ থেকে একটা পাতলা ছেলে উঠে গেল স্যারের কাছে। শুধু আমি না, গোটা ক্লাসই অবাক। স্যারও। পাশ থেকে কে একজন ফিসফিস করে বললো— ‘ঋজু সরকার। ফার্স্ট বয়। অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হয়েছে।’
প্রথমদিনেই একজন আলাদা হয়ে গেল।
নামতা, বানান, ব্যাকরণের ভিড়েই দিনগুলো কেটে যেত টুকটুক করে। ছোটোবেলা থেকেই ঘর ভালো লাগতো না। তখন ঘর পালিয়ে যাবার একমাত্র রাস্তা ছিল স্কুলবাড়িটা। প্রবল বর্ষাতেও ভিজতে ভিজতে স্কুল, আবার গ্রীষ্মের ছুটির আগে শেষ দিনের ক্রিকেটের জন্যও স্কুল।
ক্লাসমেটরাও আস্তে আস্তে বন্ধু হতে থাকলো। থ্রি থেকে ফোর। ফোর থেকে ফাইভ।
ততদিনে মাঝারি ছেলে হয়ে গেছি। মাঝামাঝি বেঞ্চে বসতাম। হাফিয়ার্লি হোক বা অ্যানুয়ালি, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড কোনোদিনই হতাম না। ভয় ছিল। পাছে স্ট্যান্ড করলে লোকে পরের বারও স্ট্যান্ড করতে বলে। আবার শেষবেঞ্চও তেমন টানতো না। ভয় ছিল। পাছে ফেল করে গেলে লোকে হাসে। তখন থেকেই আদর্শ মধ্যবিত্তের ভয় জাপটে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। শীতের দুপুরে কিপারের বাঁপাশে দাঁড়াবার সময় বেগুনি মাফলার যেমন প্যাঁচ মেরে কোমরে ঝুলত, সেরকমই সঙ্গী ছিল এই ভয়টা।
ফার্স্টবয় ছিল ঋজু সরকার। সেকেন্ড বয় উন্মেষ নামের একটা ছোট্টোখাট্টো ছেলে। ক্লাসে পড়া ধরতেন স্যার। একটা ড্যাম্প ধরা ক্লাসরুমে। বিকেল হলে একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসতো। আর আমরা পা দিয়ে ব্যাগের শেষ চেনে রাখা স্টাম্পার বলটাকে নাড়াতে নাড়াতে ভাবতাম, কখন সিক্সথ্ পিরিয়ডটা শেষ হবে। স্যারের কোশ্চেন জিজ্ঞেস করার বাই চাপলে সাঁৎলে নেমে যেতাম বেঞ্চের তলায়। মাঝে মাঝেই অতিবুদ্ধির জেরে জুটে যেতো কানচাপড় বা মাথায় চাঁটি। সেইসময়েও ঋজু, উন্মেষরা উত্তর দিয়ে যেতো। কতো কতো প্রশ্ন। তার সুন্দর গুছোনো উত্তর।
আর আমরা কাটাকুটি খেলতাম শেষ পাতায়। কেউ ক্রস। কেউ গোল্লা।
পিছনের বেঞ্চেও কতো কতো লোক ছিল। অমিত, বিপ্লব, গৌর। আরো কতো কারা। পিছনের দিকের নাম তো, ভুলে যাওয়া যায় সহজেই। কোনো অজুহাত ছাড়াই। তারা ছিল খারাপ ছেলে। অমিতকে সন্ধ্যের পর নাকি বাইকের পেছনে দেখা যেত। বিপ্লবের হোমওয়ার্কের খাতা স্যার একবার গোটা ক্লাসের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ কোম্পানির সেই জিলজিলে খাতা পড়েছিল ধুলোয় অনেকক্ষণ। সেই থেকে বিপ্লবের নাম হয়ে গেল চ্যালেঞ্জ। ওকে আর কেউ বিপ্লব বলে ডাকতো না।
বিপ্লব যখন স্কুলে ঢুকতো, তখন তার সাইকেলটাকে ঠেলে দিতো মাঠে ঢোকার সময়ই। সাইকেল একা আসত গড়গড়িয়ে গোটা মাঠ। বিপ্লব আসতো পেছনে হেঁটে। একদিনও প্রেয়ার করতো না। অমিত ইউনিট টেস্টে পেত কুড়ির মতো পাঁচ। স্যার বাঁকা হাসি ছাড়া ওর খাতা ফেরত দিতো না। কিন্তু সেই অমিতই লাট্টু খেলায় সবাইকে হারিয়ে দিত। গৌর মাসে তিরিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিন ক্লাসে আসতো। ডাইরিতে লম্বা লম্বা লাল দাগ পড়তো। কিন্তু ক্রিকেট টুর্নামেন্টের স্পিন বোলিংয়ে গৌর ছাড়া আর কেউ ছিল না!
ক্লাস বাড়তে লাগলো আমাদের। আমাদের বেঞ্চও মাঝ থেকে সরতে সরতে শেষের দিকে যেতে লাগলো।

এরকমই একটা ছেলে ছিল। পেছনের বেঞ্চে বসতো। মাসে দশদিন আসতো। ডাইরিও আনতো না। স্যার নামপ্রেজেন্টের পর ডাইরি না আনার কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ‘হারায় গেছে সার।’ বলেই চুপচাপ গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে যেত। স্যার রেগেমেগে বলতেন, ‘বাবাকে বলবি দেখা করতে। কালকেই। হেডমাস্টারের ঘরে।’ রাজশেখর বলতো, ‘আসতে পারবেক নাই সার। বাপ দুধ বেচে। সময় করতে পারবেক নাই দুফুরদিকে।’
হ্যাঁ, ছেলেটার নাম ছিল রাজশেখর। মনে আছে। কোঁকড়ানো চুল। কালো গায়ের রঙ। দাঁতগুলো সাদা। পড়তো বি সেকশনে। বি সেকশনের সাথে আবার আমাদের এ সেকশনের তেল-পিঁয়াজের সম্পর্ক। এমনিতে খুব ভালো ব্যবহার, কিন্তু গরম হলে চিড়বিড় করে ওঠে দুতরফই। বছরে গরম হওয়ার কয়েকটা বাঁধাধরা সময় ছিল। যেমন অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট। যেমন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। যেমন ফুটবল ম্যাচ।
সেরকমই একটা ক্রিকেট ম্যাচ। ক্লাস সেভেন তখন আমাদের। ডে স্কুল হয়ে গেছে। সাইকেল চেপে স্কুল আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। সেইসব সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে আমরা মাঠের ধারে বসে রয়েছি। এ সেকশন ব্যাটিং। বি সেকশন বোলিং। তিন ওভার হয়েছে। তাতেই ৪০ রান উঠে গেছে। অনীশ নামের একটা ছেলে লেগস্পিন করতে এসেছিল। তাকে দুটো ছয় আর একটা চার পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়েছে। আমাদের মন খুশি খুশি। আমরা স্কোরিং এর খাতায় তিন নম্বর ওভারের শেষ বলের ছয়টা লিখছি, ওমনি শুনি হইহই শব্দ গোটা মাঠে। দেখলাম ব্যাটিং এন্ডের মহারথী মুখ চেপে পিচে বসে পড়েছেন। শুনলাম নাকি ফোর্থ ওভারের প্রথম বলেই এক পেসার এসে সরাসরি বল ছুঁড়েছে ব্যাটসম্যানের থুতনি লক্ষ্য করে। আমরা তখন এরকম বলকে বলতাম ‘বিমার’। আমার দেখা প্রথম বিমার। সেই ওভারটাতেই তারপর প্রথম হ্যাট্রিক দেখলাম। একটা বোল্ড। উইকেটটা কিপারের পায়ের কাছ পর্যন্ত ছিটকে গেছল। পরের দুটো ক্যাচ। ম্যাচটা জিতে গেছল বি সেকশন। আমরা নক আউট হয়ে গেছলাম।
বি সেকশনের পরের ম্যাচ ছিল সেমিফাইনাল। ম্যাচটা হেরে গেছিল ওরা। হেরে যাবার পর ঘামে ভেজা জার্সি পরেই রাজীব প্রীতমরা অনেক গাল দিয়েছিল রাজশেখরকে। রাজশেখর আসেনি সেদিন। সবাই বার বার বলা সত্ত্বেও। বাপের সাথে দুধ বেচতে গেছল।
সেই প্রথম চিনলাম রাজশেখরকে।
তারপর আস্তে আস্তে ক্লাস পেরিয়ে যেতে থাকলো। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি। ছায়া প্রকাশনী, টিউশনি। মাধ্যমিক তখন আর একবছর। সবাই বলতো, ‘জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা বাবা। পড় এখন থেকে ভালো করে।’ রাজশেখরকে মাঝে মাঝে দেখতাম একা দুপুরের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তখন ম্যাপ পয়েন্টিং করতাম। অন্য কোনো দেশের মাঠে পেন্সিলের দাগ পড়তো।
রাজশেখরকে নিয়ে আবার একটা হইচই হল। ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ারলির পরেই। ফোর্থ পিরিয়ড শেষ করে বেরোতেই শুনলাম, রাজশেখরকে নাকি জঙ্গলের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। দিন দশ পর আবার যে কে সেই। জিজ্ঞেস করতে বললো নাকি একটা চারা পুঁততে গেছল পুকুরপাড়টায়।
হ্যাঁ, দুমাস আগেই হেডস্যারের নির্দেশে একটা পুকুর খোঁড়া হয়েছিল স্কুলে। শুনতাম নাকি মাছ চাষ হবে। রাজশেখরের মনে হয়েছিল, ‘পুকুরের পাশে গাছ না থাকলে ন্যাড়া লাগবেক নাই পুকুরটা?’

আমাদের মাধ্যমিক চলে এল। টেস্ট শেষ। টেস্টের খাতা দেখতে গেছলাম স্কুল। সাইকেলের তালা খুলবার সময় রাজশেখরের সঙ্গে দেখা। রাজশেখরের তখন টেনেটুনে সবে এইট। অ্যানুয়াল পরীক্ষা ওরও। বলল দেবে না। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘দিলি নাই। পরে দিব।’
তখন অতো মাথা ঘামাবার সময় কোথায়? টেস্টপেপার, প্র্যাকটিস চলছে। ঋজুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে আমিও যাচ্ছি। সবাই কঠিন কঠিন প্রশ্ন খোঁজে টেস্টপেপারে, কোশ্চেন ব্যাঙ্কে। উত্তরও।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। সবাই আস্তে আস্তে দুদলে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। ইঞ্জিনিয়ারিং নইলে মেডিক্যাল। অঙ্কটা পারতাম না তেমন, তাই আমিও ভিড়ে গেলাম মেডিক্যালের দলে। লোকজন আবার বলতে থাকল, ‘জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বাবা। সবচেয়ে ক্রুশিয়াল দুটো বছর।’ আবার শুরু হলো ভয় পাওয়া। জয়েন্ট বেসড কোচিং। প্রতিযোগিতা আর রেষারেষি চলতে থাকল সবার মধ্যেই। স্কুল যাওয়া কমিয়ে সবাই ঘরে পড়তে লাগলো বেশি বেশি করে। স্কুলে তেমন পড়া হয় না।
স্কুল গেলেও টিফিনের সময় আর কেউ ব্যাট বার করতো না। এমসিকিউ করতো মোটা বই বের করে। আমরা, মাঝারি বেঞ্চের দল, মাঝে মাঝে খেলতে নামতাম। লোক কম হতো। টিম ছোটো হতো। এরকমই একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা হল রাজশেখরের সাথে। দুধের ক্যান চাপিয়ে যাচ্ছে বেলগুমা পুলিশ লাইনের দিকে। দেখা হতেই সাইকেল থামিয়ে একগাল হাসি দিল। আমরা ৬-৭ জন একসাথে ফিরছিলাম। সবাই মিলে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন চলছে পড়াশুনো। বলল এবছর মাধ্যমিক। কিন্তু দেবে না। কারণটা বললো ভারি অদ্ভুত হেসে, ‘স্কুলটা ছাড়ি দিতে মন করছে নাই। স্কুলটাই ভালো লাগে।’
আমাদের উচ্চমাধ্যমিক। টেস্টের আগের শেষ দিন ক্লাস। অফিশিয়ালি, স্কুলে আমাদের শেষ দিন। মণীশ একটা ক্যামেরা এনেছে। সবার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে ক্লাসজুড়ে।
আমি জানালা দিয়ে আনমনে দেখছিলাম, রাজশেখর কয়েকটা বাচ্চা ছেলের সাথে শর্টপিচ খেলছে। হঠাৎ আউট হয়ে গেল।

স্কুল শেষ হবার পরে সবাই বলে, ফিরে আসবো। কলেজের প্রথম কয়েক বছর ঘর এলে স্কুল যেতামও। সেই সাইকেলটা নিয়েই।
থার্ড ইয়ারে সেরকমই একবার স্কুল গেছলাম। স্যারদের সঙ্গে দেখা করে ফিরছি, দেখলাম মাঠের কোণে একটা নেভিব্লু সোয়েটার পরা ছেলে কার একটা সাইকেলের পাম্প খুলে দিচ্ছে। সামনে যেতেই ছেলেটা একগাল হাসলো। রাজশেখর। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছিস রে?’ বললো, ‘ছিলাটা আমার মাকে গাল দিয়েছে সবার সামনে। পাম্পটো খুলে দিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘তোর মা?’
বললো, ‘কবে মইরে গেছে। হায় করেছে।’
রাজশেখর তখনো ইলেভেনে পড়ে। আর্টস নিয়ে। ফেরার আগে বললো, ‘স্কুলটা ছাইড়ে কুথায় যাবো বল? তোরা আসবি, দেখা করবি। আমি ঠিক থেকে যাবো ইখানে।’

আমার বয়স হয়ে গেল ত্রিশ বছর। স্কুল যাইনা বহুদিন। সাইকেলটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল, বাবা কাকে একটা বিক্রি করে দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা সবাই আছে অবশ্য। ফেসবুকে দেখতে পাই প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করলে। আড্ডা মারাটা আর হয়না। সময়ই ম্যাচ করে না কারোর। কালেভদ্রে ঘর এলেও আর কাউকে ফোন করে ডাকা হয়ে ওঠেনা।
স্কুলটাও পাল্টে গেছে। স্যারেরা প্রায় কেউই আর নেই। সবাই নতুন মুখ। পুরোনো লাল ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিংগুলো ভেঙে নতুন বিল্ডিং উঠেছে। স্কুলের দেওয়ালে কাঁটাতার লেগেছে।
হঠাৎ একদিন স্কুলের সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে ফিরছি। দেখি একটা চেনা মুখ মেন গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করছে।
রাজশেখর বললো, ‘এখন ঘন্টি বাজাই স্কুলে। আমি ঘন্টি না দিলে স্কুল ছুটি হবেক নাই।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুলেই রয়ে গেলি?’
বললো, ‘স্কুলটা ছেড়ে কুথায় যাবো বল? স্কুলটা ছাড়তে মন করে নাই। তোরা সব চলে গেলি, স্কুলটাকে কে দেখবেক বল?’ বলেই হাসলো। একগাল হাসি।

আমি বাইক নিয়ে চলে এলাম।
পেছনদিক থেকে স্কুলের গেটটা বন্ধ হয়ে যাবার আওয়াজ পেলাম।

কেয়ামত

আমরা সবাই স্বপ্ন আর লক্ষ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। তারপর সেটাকে নাড়াতেই থাকি। অনেকক্ষণ ধরে। আর টেস্টটিউবের নীচে যে থকথকে অপ্রাপ্তিগুলো জমে থাকে, সেগুলোকে যতই খোঁচা মারি, মিশতে চায় না। নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের অভিমানে একঘরে থাকতেই পছন্দ করে।
তারপর হঠাৎ একসময় খেয়াল করি, সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। ঘাড় ওঠাই ঘড়ির দিকে। ঘড়িটা হোহো করে হেসে ওঠে। তখনই আশেপাশের সব লোকগুলোও তাদের টেস্টটিউব হাতে নিয়ে হোহো করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে।
আমি খুব ভয় পেয়ে দেখি, সবার হাতে ধরা তরলের রঙ গোলাপি। গাড় গোলাপি।
আমারটা হাত থেকে ঠকাস্ করে পড়ে ভেঙে যায়।

চোখ বন্ধ হবার আগে দেখতে পাই, জানালার বাইরেও আস্তে আস্তে গোলাপি পরত পড়ছে।

পিতাহি পরমন্তপঃ

১.
প্রত্যেকটা মানুষের একটা একান্ত নিজস্ব শারীরিক অস্বস্তি থাকে। যেটা হয়তো শারীরিকের থেকেও অনেক বেশি মানসিক। ইমানের অন্তত এরকমটাই মনে হয়। যেমন তাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে সেই পানকাকুর দাঁত খোঁচানো। এখনো মনে আছে, সারাদিন গুমটিতে বসে বসে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁত খোঁচাতো লোকটা।
তার এরকম কিছু ছিল না। কিন্তু এই কলকাতায় এসে হিউমিডিটির ঠেলায় সবসময় কেবল মনে হয়, ঘাম হচ্ছে। অবশ্য ঘাম তার হয়ও প্রচুর! তার সঙ্গে জুন মাসের দুপুরে লেকচার ক্লাস। তাই, পকেটে দুটো রুমাল রাখে সে— যখনি মনে হয় কানের লতি বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, তখনই মুছে নেয় টপ্ করে।
অবশ্য এরকম ঘাম তো সেই লোকটারও হতো। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা লোকটা যখন ভেজা পিঠ আর চকচকে মুখ নিয়ে ঘর ঢুকতো, সিরিয়ালমগ্ন সামনের ঘর আর বইপত্রে ব্যস্ত মাঝের ঘরটা খুশি খুশি হয়ে উঠতো। হাঁকডাক করে পাড়া জাগিয়ে লোকটা ঘরে ঢুকতো। তারপর রুমাল বের করে ক্লান্তিটুকু মুছে নিতে নিতে পাশে বসত তার। তারপরই অফিস ব্যাগ থেকে কখনো বেরিয়ে আসত চিঁড়েভাজার প্যাকেট, কখনো রাতের জন্য বোঁদে; বের করার কায়দায় মনে হতো যেন একদুখানা সোনার পালক কুড়িয়েই পেয়েছে বোধহয়, মনে হতো পুরুলিয়া থেকে আড়ষা যাবার পথে হয়তো এল ডোরাডোও পড়ে। ওই লোকটাই তো তার নাম রেখেছিল ইমান— আশেপাশের অনেক ফিসফাসের তোয়াক্কা না করে। একজন মাসি বলতে এসেছিল “এরকম মুসলমান নাম রাখছেন…”, কথা শেষ না করতে দিয়ে বাবা বলেছিল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না। নিজের নামটা হিন্দু রেখেছেন। তাতেই হবে।” এরকমই স্পষ্টবাদী ছিল।
কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না এসব ভাবতে। মনে মনেও আর ‘বাবা’ বলে না। ঠিক উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের কদিন আগে কয়েকদিনের রোগে চিরদিনের ছুটিতে চলে দেল মানুষটা। তাকে আর মাকে পুরুলিয়ার ওই দুকামরার ফ্ল্যাটটাকে একা রেখে। তারপরে কতকিছু হয়ে গেল। স্কুলের জুয়েল ছাত্র ইমান বসু জয়েন্টে যখন নীচুতলার, অত্যন্ত নীচুতলার একটা স্যাঁতসেঁতে র‍্যাঙ্ক করল, তখন তার পরিচিত বৃত্তের বেশিরভাগটাতেই একটা খুশির হাওয়া বয়ে গেল। তার কষ্টটা বুঝলেন কেবল স্কুলের কয়েকজন পুরোনো স্যার আর কাছের বন্ধুরা। তাঁরাই হড়কে পড়ে যাওয়া ইমানকে হাত ধরে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন এই মেডিক্যাল কলেজে।
ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিল ইমান। দুপুরবেলাটা এখানেই খাওয়াটা সুবিধা। মাকে সকালে উঠে অফিস যেতে হয়, তাই মা-ছেলের সংসারে দুপুরের খাবারটা বন্ধই থাকে। মা খায় রিসেপশনিষ্টের চেয়ারে বসে, আর ছেলে লেকচারের ফাঁকে চলে আসে এই ভাতের হোটেলে।
এসে গেছে। সুপ্রিয়া হিন্দু হোটেল। আহ্, এখন কিছুক্ষণের শান্তি। ফ্যানের গুঁতোয় স্বস্তি। কোণের দিকে একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ল। পকেট থেকে কালো বাচ্চাফোনটা বের করে প্লেলিস্টটা বন্ধ করল। এই গান শোনার কম্পালসিভ অভ্যেসটাও বাবাই ধরিয়েছিল। একের পর এক গান শুনে যেত লোকটা। কাওয়ালি থেকে কালীকীর্তন। লোপামুদ্রা থেকে লেনন। ওই একটাই নেশা করতো তো লোকটা।
তবু!
দুর্! দুর্! দুর্!
যেদিনই এই লোকটার কথা মনে পড়ে, সেদিন পুরো দিনটা কষটে মেরে যায়। সব কথা জোর করে ঝেড়ে ফেলতে হাঁক দিয়ে মণিদাকে ডেকে রোজকার ডিমভাত দিতে বললো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাকি লোকদের দেখে বাকি সময়টা কেটে যাবে। বেশিরভাগ লোকই তো ডেলি খদ্দের। অনেককেই চেনে ইমান। ওই লম্বা স্বাস্থ্যবান ভদ্রমহিলা। ওই ছোটো করে গিন্নিবান্নি মানুষটি, যাঁর শাড়ির ব্যাজে লেখা, “ওজন কমাতে চান? আমার সাথে যোগাযোগ করুন!” ফরসা সেলসম্যানটি। বাকি লোকগুলো পাল্টে পাল্টে যায়।
মণিদা ভাত দিয়ে গেল। পাঁপড়ভাজাটায় এক কামড় দিয়ে ভাতটা মাখতে শুরু করল — হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা একটু খুশি খুশি হয়ে গেল। আরেক চেনা লোক। একটা বুড়ো লোক, মাথায় একটা কাপড়ের টুপি। গোটা মুখে শ্বেতি। সেজন্যই বোধহয় ইনি কোনো টেবিলে বসলে টেবিলের বাকিরা একটু গা বাঁকিয়েচুরিয়ে বসে, যাতে গায়ে ছোঁয়া না লেগে যায়। তার ওপরে ইনি মানসিক ভারসাম্যহীন। সেটা নিয়েও কানাকানি হয়। কিন্তু লোকটাকে ইমানের বেশ ভালো লাগে। কারো সাতে পাঁচে কান দেন না। নিজের মতো আসেন, খান, চলে যান নিজের মতো।
আর না। এবার ফটাফট খেতে হবে। দেড়টার লেকচারের দেরি হয়ে যাবে এবার।

হঠাৎ সে শুনতে পেল ভাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে, কেউ একজন উল্টো টেবিল থেকে ওই টুপিওয়ালা লোকটাকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”

২.
অমল হালদার কোনোদিনই তেমন খারাপ ছেলে ছিল না। মানে পড়াশোনায়। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো না কোনোদিনই, কিন্তু স্যারেরা চিনতেন বুদ্ধিমান ছেলে হিসেবেই, নম্বরও ভালোই পেত। স্কুলজীবনে তার দুটো অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা এই পড়াশোনা নিয়েই ছিল। অন্যটা একটু বেশিই ব্যক্তিগত। আপশোষটা ছিল অঙ্ক পরীক্ষায় ১০০ তে ১০০ না পাবার। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ ছিল তার এই আপশোষটুকু। তার কারণ আছে।
বাবা রতন হালদার ছিলেন ব্যাঙ্কের সামান্য ক্যাশিয়ার। কিন্তু চলাচলতি সমাজের বেঁধে দেওয়া কর্মগত পরিচয়ে আটকে পড়বার মানুষ ছিলেন না তিনি। পুরোনো দিনের ফার্স্ট ক্লাস গ্র্যাজুয়েট রতনবাবুর নেশা ছিল অঙ্কের। সারাদিন ঘোরানো চেয়ারে বসে আট. থেকে আশির পাবলিকের গাল খাবার পর ঘরে এসেই বসতেন অঙ্ক নিয়ে। খাতার পর খাতা, ক্যালকুলেটরে খটাখট, বই আর ম্যাগাজিনের গাদা হয়ে থাকত একটা রুম। উৎসাহ কম ছিল না টাকমাথা বেঁটে লোকটার— নইলে কেউ সোমবার অফিসের পর বিকেলে কলুটোলা স্ট্রীটে গিয়ে ধুলোভরা অঙ্কবই ঘাঁটে!
এই লোকের ছেলে হয়ে সে কিনা অঙ্কে কোনোদিন ১০০ তে ১০০ পায়নি! মানে, ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল একটু। সে মাঝেমধ্যেই ছোটোখাটো পরীক্ষায় কুড়িতে কুড়ি, পঁচিশে পঁচিশ পেয়েছে। একবার তো সত্তরে সত্তরও পেয়েছিল। চাপটা ১০০ পার্সেন্টের ছিল না, ১০০ নম্বরের ছিল। এই জিনিসটা তার গোটা স্কুলজীবনে ধাঁধা হয়ে ছিল।
অবশ্য, স্কুলজীবনের শেষে আর কলেজজীবন শুরুর আগে এর থেকে অনেক বড় একটা ধাঁধা এসে ঘূর্ণিঝড়ের মতো তার আর তার মায়ের জীবনটাকে ওলটপালট করে দিল। অঙ্কপাগল মানুষটার অঙ্কই ভুল হয়ে গেল একদিন— তহবিল তছরুপের দায়ে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল ব্যাঙ্কে সবার সামনে থেকে।
বাড়ি ছাড়তে হল পাড়াপড়শিদের বাঁকাচোখের থেকে বাঁচতে। হঠাৎ এতোগুলো ধাক্কা অমল ঠিক সয়ে নিতে পারলো না — রাস্তায় বড় বড় বেশ কয়েকটা বাম্পার পরপর পড়লে গাড়ি যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে, সেও তেমনিই কেঁপে গেল। কলেজের সময়ে তাকে দেখা যেতে লাগল বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের সামনে। কখনো এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো সিকিউরিটি গার্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা দাদা, এখানকার ক্যাশিয়ার কে?” সিকিউরিটি গার্ডরাও চিনে গেল তাকে। দেখলেই তাড়িয়ে দেয় লাঠি উঁচিয়ে, খিস্তি করে মা-বোন দিয়ে।
মা অনেক চেষ্টা করতেন। টাকা জোগাড় করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও নিয়ে গেছলেন এক-দুবার। লাভ হয়নি। অমলের কলেজের অ্যাটেনডেন্স কমে যেতে লাগল, সেমেস্টারে সাপ্লি হতে শুরু করল। এর মাঝেই একদিন মা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। ডাক্তার বলেছিল, মাথার শিরাগুলো ফুলে উঠে ফেটে গেছে। ব্যাস, এটুকুই। তারপর থেকে অমল ভেসে বেড়াতে লাগল।
বয়সটা বাড়তে বাড়তে, এঘাট-ওঘাট-সেঘাটের জল খেতে খেতে, এই আত্মীয় সেই আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে থাকতে এখন অমল ৫৮। একটা ছোট্টো বাড়িতে বাবাকে নিয়েই থাকে। ওই সিকিউরিটি গার্ড হিসেবেই কাজ করে একটা ব্যাঙ্কের এটিএমে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ব্যাঙ্কে কাজ করি’। যা পায়, তার আর তার বাবার মোটামুটি চলে যায়।
অমল রোজ আসে এই ভাতের হোটেলটায়। এরা বড় যত্ন করে খাওয়ায়। গোটা দুনিয়ায় আত্মীয় অনেক থাকলেও আপনজন বলতে তো ওই জেলখাটা বুড়ো লোকটা; তাই যেখানে যেটুকু ভালোবাসা পাওয়া যায়, সেটাকেই জড়িয়েমড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে তার। তাই দুবেলাই এখানে খায়।
নিজেরটা খায়, আর একজনেরটা প্যাক করে নিয়ে যায়। দশ বছর একটা টুকরো ঘরে বেঁচে থাকার পর যে মানুষটার বাঁচার ইচ্ছেই শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য। দশটা কথা বললে একবার মাথা নাড়ে। ভাত তরকারি থালায় ঢেলে মেখে দিলে তবে হাত বাড়ায়। প্রতিদিন ওই দৃশ্যটা দেখলেই তার মনে পড়ে যায়, পড়ন্ত বিকেলে মাথা ঝুঁকে বসে খসখস করে পেন চালাচ্ছে এই লোক। এই একই লোক।
এই তো কদিন আগে কী হ্যাপাটাই গেল! মাঝরাতে ‘বুকে ব্যথা’ ‘বুকে ব্যথা’ বলে খাট থেকে পড়ে গেল! দৌড়াদৌড়ি, ডাকাডাকি, ভর্তি হওয়া। সবই হল। কিন্তু কর্তার মন গলল না এতে। মাত্র দুদিনের ছুটি ছাড়া তিনি আর কিছুই দিলেন না।
আজ সেই দ্বিতীয় দিন। যদিও ছুটির প্রয়োজন আর সত্যিই ছিল না। আজও খেতে এসেছে সে।
টেবিলে বসতেই বসতেই সে দেখল, চেনা দোকানদার বসে আছে। মণিদা থালাটা সামনে নামাতেই প্রশ্নটা আলতো করে সৌজন্যের ছোঁয়ায় ভাসিয়ে দিলেন সেই লোকটি।
“আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”
প্রথমে শুনতে পায়নি অমল। কমই শোনে আজকাল। তাও আন্দাজবশে চোখ তুলতেই ভদ্রলোক প্রশ্নটাকে ফিরিয়ে আনলেন আবার, এবার জোরগলায়।
অমল গলাটা ঝাড়ল একবার। গলার শ্বেতির দাগটা চুলকে নিল একবার। তারপর বলল, “আর ভর্তি নেই। মারা গেছেন তো। কালরাতে। ওই যে মুকেশের গানটা আছে না?

বলেই হোটেলভর্তি লোকের মাঝে চোখ তুলে আকাশে হাত উঠিয়ে গেয়ে উঠল খোলা গলায়,
” জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা, ইসকে শিবা যানা কাঁহা!”

৩.
হোয়াক্! হোয়াক্! গোটা টেবিলটা বমিতে ভেসে গেল। কোনোমতেই সামলাতে পারলো না ইমান। গোটা থালাটা ভরে তো গেলোই, নিজের জামাকাপড় গেল, সঙ্গে গেল উল্টোদিকে বসা ভদ্রলোকের প্যান্ট আর জুতো। কোনোমতে মুখে হাত চাপা দিয়ে রাস্তার ধারে বেসিনের কাছ পর্যন্ত গেল। তারপর আবার ভলকে্ ভলকে্ বমি বেরিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে সে প্রায় বসে পড়ল রাস্তার ধারে।
খেতে আসা প্রায় সবাই অবাকচোখে গান গাওয়া বুড়োটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু গান শুরু হওয়ার একটু পরেই এরকমভাবে টেবিলে বমি করতে দেখে সবার চোখ সেদিকে ঘুরে গেছে। মুখে বিরক্তি আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। হোটেলের দুটো চাকর সবাইকে বসতে বলছে, বালতি আর ন্যাকড়া নিয়ে এসে পরিষ্কার করতে শুরু করেছে।
ইমান জানে দুম্ করে এরকম কেন হলো। এই টুপিওয়ালা লোকটা অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। এমন সব স্মৃতি, যা ফিরে আসা উচিত ছিল না। এই একইরকমভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ গান গেয়ে উঠত বাবা। একইরকম চোখগুলো ঝকঝক করতো গান গাওয়ার সময়।
কিন্তু সেই ছবিটা ফুটে ওঠেনি তার চোখে। লোকটাকে দেখতে তার বাবার মত, কিন্তু সেই বাবাকে সে মনে রাখতে চায় না। বাবার শেষদিনগুলো কোনো এক সিন্দুকে ভরে নদীতে ফেলে দিতে পারলে ভালো হতো — রূপকথার গল্পের মত।
কিন্তু মনে পড়ে যায়। ন্যাড়ামাথা বাবা। পেট ফুলে যাওয়া বাবা। কাঠি কাঠি হাত পা বাবা। লিভার ক্যান্সার বাবা। শেষের দিনগুলোতে শুধু একটা বিছানায় শুয়ে থাকত আর হাত নেড়ে নেড়ে তাকে কাছে ডাকত লোকটা। আর মনে আছে শেষ দেখাটা। শেষ দেখাটা না দেখলেই ভালো হত বোধহয়, সবাই বারণও করেছিল প্রাণপণ। কিন্তু সে নিজের জেদে দেখেছিল।
বীভৎস ফুলে যাওয়া পেট। হাতে পায়ে কপালে ঘি মাখানো। মুখে তুলসীপাতা। বাঁশ মেরে ভেঙে দেওয়া পা এর অংশ।
আজ সেই ধোঁয়া ধোঁয়া দৃশ্যটাই ফিরে এসেছিল আবার। সে দেখেছিল, লিভার ক্যান্সারের একটা মড়া চেয়ারে বসে হাত উঠিয়ে গান গাইছে। ওঠানো হাতটায় সবুজ রঙের ঘি মাখানো।
হোয়াক্! শেষ বমির দমকে এতোটা গলা গলা খাবার আর জল বেরিয়ে এল।

তার পক্ষে আর লেকচারে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘর ফিরতে হবে। সে কোনোমতে একটা অটো খুঁজতে লাগল বড়রাস্তায় এসে। যে অটো তাকে তার ঘরে ফিরিয়ে দেবে।

৪.
বিশ্বনাথ নামটায় এখানে তাকে কেউ ডাকে না। বাপটা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন মাঝেমধ্যে বিশ্বনাথ বলে ডাকতো। তারপর থেকে আর কেউ না। স্বাভাবিক। মানুষ স্বভাবগতভাবে আলসে। কাজ কমাতে চায়। তারপরে আবার সে যেখানে বস্তিতে থাকে, সেখানে লোকজনের সারাদিন এতো কাজ— তাদের ফুরসত নেই যুক্তাক্ষরওয়ালা নাম বলবার। তাই বিশু। বিশে। বিশা। রেগে গেলে বিশুচোদা।
এটাতেই তার আপত্তি রয়েছে। ভাগ্যের ফেরে তাকে আজ অটো চালাতে হয়, কিন্তু সে এখনো অটোওয়ালা হয়ে উঠতে পারেনি। ওই মুখে পান, ঠোঁট উঠিয়ে কথা বলা, গাড়িতে মেয়ে উঠলেই মিরর অ্যাডজাস্ট করাটা এখনো আত্মস্থ করতে পারেনি। তার মনে এখনো দশ ক্লাস পাস বিশ্বনাথ দাসের ছাপ ভালোরকম আছে। ট্রাফিক পুলিশে নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘মাস্টার বিশ্বনাথ দাস’। কেন সব অটোড্রাইভারের নাম বিশু,পাঁচু,ঝন্টু হবে সে বুঝে উঠতে পারে না! আর ভালো নাম নেবে সব ওই ভদ্রচোদা মানুষগুলো। ওই যে, ওই ইউনিয়নের নেতা, নামখানা কী বাগিয়েছে! সৌ-গ-ত!
তার তো আজ অটো চালাবার আর হঠাৎ ক্রসিঙে পুলিশের থাপ্পড় খাবার কথা নয়। সে নৈহাটিতে থাকা মাঝারিমেধার ছেলে ছিল। বাবা মাকে নিয়ে থাকত। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশটাও করেছিল। তারপর কী যে হল—বাপটা একদিন রাতে মরে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো অভিযোগ ছাড়াই। কোনো দায়িত্ব ছাড়াই। ব্যাস, তারপর এইসব পরিবারের রোজগার করা মানুষটা মরে গেলে যা হয়,তাই হল।
বিশ্বনাথ কদিন পার্টি অফিসে ঘোরাঘুরি করল। দাদাদের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিনেপয়সার পিয়োন হওয়াটা ঠ্ক পোষালো না তার। দাদারা বলেছিল অবশ্য, “কটাদিন থাক বিশু। কোথাও না কোথাও ঠিক ঢুকে যাবি।” কিন্তু তার আর সইল না।
এর মধ্যেই একদিন সংসারের শেষ লোকটাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সংসার বলতে বোধহয় সে শুধু শাঁখা-পলাটুকুই বুঝতো! তাই আরেক সেট শাঁখা-পলার সন্ধানে রাত্রেবেলা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল সে, যাকে সে ছোটো থেকে মা বলে জড়িয়ে ধরে এসেছে স্কুল থেকে ফিরে। স্কুলও নেই। জড়িয়ে ধরার লোকও নেই। তাই বিশ্বনাথও বেরিয়ে পড়ল এক পরিচিতের হাত ধরে। আর ফিরল না।
এসে প্রথম চাকরি জুটল ওই পরিচিতেরই পরিচিতির জোরে। হ্যান্ডবিল বিলি করার চাকরি। সারাদিন ধরে মিকি মাউসের বেশে লোকজনকে, বিশেষ করে বাচ্চাদের হাতে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের খবর ধরিয়ে দাও গোলাপি কাগজে। উফ্, সে এক দিন গেছে! সারাদিন ধরে এসপ্ল্যানেডের বিশাল রোদে ওই ঢাউস সিনথেটিক সুট পরে এদিক-সেদিক করো। দিন গেলে ১৫০ টাকা। গোটা পিঠে ঘামাচি হয়ে যেত। গলায় আর বগলে ঘাম জমে জমে এতো বড়ো ঘা হয়ে গেছল। সারাদিন ধরে চুলকাতো। তবু এই চাকরিটা সে ছাড়তে পারেনি। বহুদিন করেছিল। বিয়ে করেছিল এসময়েই। বউদেরও পরিবারের অবস্থা খারাপ, তবে ভালো ঘরের মেয়ে। দুজনে মিলে কাজ করে কোনোমতে চালিয়ে নিত। একটা বাচ্চাও নিয়েছিল।
ভেবেছিল সামলে নিতে পারবে। কিন্তু কই আর পারলো! দুজনেই কাজ করতে বেরিয়ে যেত, আর বাচ্চাটা থাকত বন্ধ দরজার ওপারে। পাশের ঘরে একটা বুড়ি থাকত, তাকেই মাসে মাসে ৫০ টাকার জন্যে বলেছিল দেখতে। সে ইচ্ছে হলে দেখতো, নইলে দেখতো না। এমন অনেকদিন গেছে যেদিন কেউ একজন এসে দেখতে পেয়েছে বাচ্চা হাগা-মোতায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে, আর কাঁদছে।
ভালো করে খাবার দাবারও পেত না। যত্নটাও পেত না। কতদিন বড়লোকদের জন্মদিনের পার্টিতে গেছে — মিকি মাউস সেজে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। পার্টি শেষে, গভীর রাতে যখন কেকের টুকরো আর বেঁচে যাওয়া মাংস নিয়ে ঘরে ফিরতো, ততখন বাচ্চাটা গলা ডালভাত মাখা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। না একটু সবজি, না কিছু। দুজনে মিলেই গিলতো তখন। পেট বড়ো বালাই।
ঠং-ঠঙাক্! কী একটা পড়ে গেল শব্দ করে অটোর ড্যাশবোর্ড থেকে। মাথা ঘুরিয়ে খুঁজে পেল না বিশ্বনাথ। আবার পিঠ বাঁকিয়ে মাথা নামিয়ে হাতটা সিটের তলায় ঢুকিয়ে বের করল জিনিসটা। লোকনাথ বাবার মূর্তিটা! দুর্ শালা! ফালতু জিনিস সব। ওই ঘটনাটার পর যখন ভাড়ার অটো চালাতে শুরু করল, তখন বাকি সবার জোরাজুরিতে পুজোটুজো করানোর পরও এই মূর্তিটা ২৫টাকায় কিনে রেখেছিল গাড়িতে। লোকে বলেছিল এর ফলে ওরকম তো আর হবেই না, তার সঙ্গে উন্নতি হবে। সবই নাকি লোকনাথ বাবার দয়া! ভূপতি তো আবার বলেছিল সকাল-সন্ধ্যে ধূপটুপ দিতে। প্রথমে কয়েকদিন দিয়েওছিল, তারপর আর ভাল লাগত না। বিরক্ত লাগত। পয়সার দেখা নেই — অতো ভক্তি করে হবেটা কী! এখন ড্যাশবোর্ডের এককোণে নিজের মত পড়ে থাকে। ধুলোটুলো মেখে একাকার হয়ে গেছে। অবহেলায় সে ওটাকে তুলে একদিকে রেখে দিল।
ওই একটা ব্যাগ কাঁধে ছেলে আসছে। কলেজ স্টুডেন্ট বোধহয়। বিশ্বনাথ ডানহাতে গিয়ারটা চেঞ্জ করে হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে রাস্তায় নামলো। ছেলেটা উঠলে, ডানহাতেই দুটো হর্ন মেরে গাড়িতে স্পিড দিয়ে চলে গেল কালো ধোঁয়া উড়িয়ে।

একটাই হাত ওর। মিকিমাউসের দিনগুলোতেই একদিন ঘটনাটা ঘটে। হকারভর্তি ভিড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল। সামনে দিয়ে একটা বাস রাস্তার মাঝেই টার্ন নিচ্ছিল। সে দেখেনি, এমনটা নয়। দেখেছিল ঠিকই। কিন্তু স্কুলজীবনে ফিজিক্স শেখার সুযোগ পায়নি সেজন্য, নাকি দুটো চোখের ফুটো দিয়ে বাসের সাইজটা আন্দাজ করতে পারেনি সেজন্য, ঠিকসময়মতো বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিতে পারেনি। কনুই থেকে হাতটা ছিটকে রাস্তার একদিকে চলে যায়, আর সে অন্যদিকে। সেই থেকে তার পরিবারটাও দুদিকে চলে গেল। ‘নুলো’ লোকের সাথে থাকবে না বলে বউ বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে অনেক গালমন্দ শাপশাপান্ত করে, অনেক থুতু ফেলে চলে গেল অন্য পুরুষের হাত ধরে। আর সে হয়ে গেল বিশু অটোওয়ালা।
আরে আরে! শালা শুয়োরের বাচ্চা! গাড়ির সামনেটায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল! অদ্ভুত পাবলিক মাইরি! নেহাত সিগন্যালটা ছিল বলে বেঁচে গেল।

৫.
আবদুসের আর কিছু করার ছিল না। ওই ফুটটাতে একটা বুড়ো মোটামতন লোক ছিল, দেখেই মনে হচ্ছিল পয়সাওয়ালা মাল। এগুলোর সামনে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে অনেকসময় ১০ টাকার পাত্তিও ছুঁড়ে দেয়।
অতো সিগন্যাল মানলে তার চলবে? আজ সকালে পার্ক স্ট্রিটে একটা গাড়িতে একটা ডবকা মাগীকে দেখার পর থেকে ওর হিট উঠে আছে। মাগীটার কী বড় বড় মাইগুলো ছিল! লাল ড্রেস পরা চমকঠমকওয়ালা মাগী ছিল। গাড়িটার পাশে গিয়ে ‘আল্লাকে নামপে কুছ দে দিজিয়ে মেমসাব! ভুখা বাচ্চা হ্যায়, বিমার বাচ্চা হ্যায়! আল্লা ভালা করেগা আপকা’ বলতে না বলতেই একটা ১০ টাকার নোট ফেলে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। তা যাক, এরমধ্যেই যা দেখার দেখে নিয়েছে আবদুস।
একটা পাবলিক বাথরুমে ঢুকে লুঙ্গির ওপর থেকে হাত চালিয়েই একবার খেঁচে নিয়েছে দুপুরবেলা। কিন্তু এখনো চোখের সামনে ওই মাইদুটো দুলছে তার। রাতে একবার মাগীপাড়ায় যেতেই হবে!
কিন্তু তার জন্য আরো একশো তুলতে হবে তো! সময় তো আর মাত্র দু তিন ঘন্টা। সাতটা-আটটার দিকে বড়ো বড়ো খাওয়ার জায়গাগুলোর সামনে গেলে জোড়ায় জোড়ায় আসা মালগুলোর কাছ থেকে কিছু মালকড়ি পাওয়া যায় বটে অবশ্য। ওটুকুই ভরসা। তারপরে আর বাবুর ঘাগুলোও কেউ দেখতে পাবে না, আর নোংরা শুকনো শরীরটাও নজরে পড়বে না। দেখতে না পেলে টাকাও দেবে না কেউ। দিনের ভাড়াটা তো শেখের হাতে দিতে হবে!
শেখের সঙ্গে প্রথম দেখা হাসপাতালে। আবদুস এমার্জেন্সির সামনে থেবড়ে বসেছিল মাটিতে। ছেলেটার বেশ কদিন ধরে জ্বর। পেটটা ফুলে গেছে। বাকি হাত পাগুলো খ্যাংরাকাঠি হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেন! মাগীটা পালাবার পর থেকে তো নিদের মতই ঝুপড়িটায় পড়ে থাকে, যা পারে এদিকওদিক কুড়িয়েবাড়িয়ে খায়। আবদুস সারাদিন পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, তার সময় কোথায় দেখবার! কদিন ধরে প্রচণ্ড বমি আর পেটখারাপে নেতিয়ে গেছে দেখে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু টিপেটুপে দেখে জানালার ওপার থেকে হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আর বলল, ‘বুকের ছবিটা করিয়ে আন। খুব বাজে অবস্থা!’
সেইসময়েই একটা সিড়িঙ্গেমত লোক কোথা থেকে সুট করে এসে তার কাঁধে হাত রেখেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে চাচা? আমাকে বলো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” আবদুস উপায় না দেখে সব বলল তাকে। জ্বর, বমি, ঘা। হাতের কাগজটা ধরালো ওর হাতে। ওই লোকটাই সব দেখেশুনে তাকে শেখের কাছে নিয়ে গেছল। শেখ তাকে বলেছিল, এইড না কী একটা রোগ হয়েছে বাচ্চাটার। বেশিদিন নেই আর। তাই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, “ওটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে লাভ নাই। বরং আমার কাছে কাজ করো, নিজেও খেতে পাবে, বাচ্চাটাকেও খাওয়াতে পারবে।” তারপর থেকেই শুরু।
রোজ সকালে উঠে বাচ্চাটার গায়ে মেকআপ করে বড়ো বড়ো ঘা তৈরি করে। তারপর হাতঠেলাটাতে নোংরা তোষক-কাঁথাগুলো চাপায়। আর বেরিয়ে পড়ে বাবুকে নিয়ে। এই হচ্ছে রোজের রুটিন। তার জন্য প্রতিদিন একটা টাকার ভাগ দিতে হয় শেখকে।

এই কয়েকমাসে আবদুস শিখে গেছে অনেক কিছুই। গাড়ির কাঁচে হাত ঢুকিয়ে টাকা চাওয়া, মেয়েদের পাশে পাশে ঘ্যানঘ্যান করা, বাচ্চাদের হাতে খাবার দেখলে তাদের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করা আর খাবার চাওয়া, অন্য ভিখারিদের সঙ্গে মারামারি করা। আরো অনেককিছু।
রাত হয়ে আসছে।
ইমান একা তার খাটে বসে খাবার খাচ্ছে। মা এখনো ডিউটি থেকে ফেরেনি। আজকাল মাঝেমধ্যেই রাতে ফেরেনা, বলে ‘ডিউটি ছিল’।
অমল হালদার হাতে একটা লাঠি নিয়ে নীল উর্দিটা পরে ক্লান্ত পায়ে একটা এটিএমের দিকে হাঁটছে। আজ তার খুব ঘুম পাচ্ছে।
বিশ্বনাথ মোড়ের দোকানটার থেকে তড়কা-রুটি কিনে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে অটোটা গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
আবদুস পেটভর্তি বাংলা খেয়ে হাড়কাটায় ঢুকলো। তার পকেট থেকে একটা বিড়ি গড়িয়ে পড়ে গেল কাদায়।

কলকাতা, তার বাবা আর ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে, আরো একটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেল।

শনির দশা

—কী? কী চাই? হজমি? লাগবে না লাগবে না!
— না না স্যার, হজমি নয়! এটা একটা অদ্ভুত প্রোডাক্ট। এই বড়িটা…
— না না বড়ি টড়ি লাগবে না!
— স্যার একবার শুনেই দেখুন! শুনতে তো পয়সা লাগে না।
— আমি কিনবো না। কেন ফালতু নিজের সময় নষ্ট করছ?
— স্যার, শুনে তো দেখুন! এই সাদা বড়িটা আপনার পকেটে রাখলেই আপনার আর একটুও গরম লাগবে না!
— বিক্রি করার জন্য যাই তাই একটা বলে দিলেই হলো?
— একদম ১০০% সত্যি স্যার! এই ঘাম প্যাচপেচে রোদে আপনি অফিস বেরোবেন, কিন্তু থাকবেন একদম ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল!
— জাদুমন্তর নাকি? দ্যাখো আমি যাদবপুর থেকে ফিজিক্সে এমএসসি। ওসব বুজরুকি আমাকে শোনাতে এসো না!
— আপনার বিশ্বাস না হয় তো আপনি ইউজ করে দেখুন স্যার! একদম দেশি পদ্ধতিতে তৈরি। আমার নিজের আবিষ্কার!
— ওইসব শুনছি না! এসব জোচ্চুরি না করে গায়েগতরে খেটে খাও না। নাকি পুলিশে খবর দেব?
— না না স্যার! পুলিশে খবর দেবেন না! আ-আমি চলে যাচ্ছি স্যার! কিন্তু জিনিসটা ভালো ছিল, একবার যদি পকেটে রেখে দেখতেন!
— গেট আউট! গেট আউট! ভরদুপুরে যত উল্টোপাল্টা সেলসম্যান জ্বালাতে আসে!
লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলা থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হতাশায় একবার টাকটা চুলকে নিলেন প্রৌঢ় প্রফেসর। তারপর চলতে শুরু করলেন পরের বাড়ির দিকে।

পোষা রোগা বেড়ালটা ম্যাঁও শব্দ করে থাবা দিয়ে মুখটা মুছে চলতে শুরু করল পেছন পেছন।

নাম দেওয়া হল না

আমার বিছানাটা একটু আলাদা হয়ে গেছে এই কদিন। না না, প্রেমে-টেমে পড়েনি, ধ্যাত!

আমি আসলে অপত্য স্নেহে এই কলকাতার মানুষপোড়া গরমে আমার বেচারা তোষকটার গায়ে একখানা প্লাস্টিকের জামা পরিয়ে দিয়েছি। পাগল ভাবছেন তো! প্লাস্টিক মানেই বেশি তাপ ধরে রাখবে, চ্যাটচ্যাট করবে। কিন্তু, কী করি বলুন তো? রোদে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে আমার যে রেটে ঘাম প্রোডাকশন আর ডিসপ্যাচ হয়, ঝালমুড়ি আর ফুচকাওয়ালারা যে রেটে পেঁয়াজ কাটে, আমার মাশুলওলা রুমমেট যে হারে ফচাৎ ফচাৎ করে ডন মারে, সেইরকম দুরন্ত হারে আমার কাঠের খাটের খাঁজে খাঁজে-ভাঁজে ভাঁজে ছারপোকারা সেক্স করে আর হ্যাল খায়।
আর, রাত হলেই আমি তাদের জন্য নিয়ে আসি আমার ৫৪ কেজির আ-লা-কার্তে!
কাজেই, রাত্রেবেলা ট্যাঙ্গো নাচ নাচার থেকে মানুষমুসল্লম হওয়াটাই সুবিধার বলে এই ব্যবস্থা করে ফেলেছি। কাঠের খাট, তারওপর জ্যালজেলে প্লাস্টিক, তারপর প্লাস্টিকমোড়া তোষক আর সবার ওপরে একখানা কম্বল।

যাইহোক, এরকমই এক রাত। চ্যাটচেটে গরম। আমার পেট আর পিঠ দিয়ে নীলনদ বয়ে যাচ্ছে হুহু করে। বিছানার তো এমন অবস্থা যে, এবার বোধহয় ছত্রাক জন্মানো শুরু হবে! জানলাটাও খুলতে পারিনি—যদি কেউ হাত বাড়িয়ে টুক করে ফোনটা নিয়ে চলে যায়! তাছাড়া, ইয়ে, মানে ছোটোবেলা থেকেই আমার কিনা এট্টুখানি ‘একাকীত্বের ভয়’ আছে। মানে, ওই বুঝছেন তো, ওই একা থাকলে যেসব ভয়-টয় পায় লোকজন, সেই আর কি!
হেঁহেঁ। তো আমি শুয়ে আছি। শুয়ে আছি ঠিক হরিবোল স্টাইলে। মানে, চৈতন্যদেব নামসংকীর্কনের সময় দুটো হাত রাখতেন মাথার ওপর, সেরকম। সেই পোজিশনে হাত দুটো ড্যাংডেঙিয়ে ঝুলছে উপরের কিনারা থেকে।
আর, আমি ইদিকে আমার চিন্তাটাকে কেবল পরীক্ষায় ফেল করলে কী হবে-বাঘের সংখ্যা কমছে কেন-মানুষের চারটে পা হলে কেমন হত-একটু পানু দেখলে কেমন হয়, এরকম গম্ভীর সব চিন্তায় ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কারণ একটিবার যদি আমার চিন্তার রিকশাটা ঠুনঠুন করতে করতে আত্মহত্যা-খুন-মড়ার দিকে চলে যায়, ব্যাস! সেরাতের জন্য আমার নিদ্রাদেবী গোঁসাঘরে খিল দেবেন।

হঠাৎ, বাঘ থেকে মনে পজ়ল জঙ্গল, জঙ্গল থেকে গাছ, গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে চলে এলো খাট, আর তারপরেই মনভোলানো হাসি নিয়ে এই চিন্তা মাথায় এন্ট্রি নিলো, “যদি কেউ খাটের নিচে থাকে? যদি সে আমায় হাত বাড়িয়ে টুক করে ছুঁয়ে দেয়?”
ব্যাস। যুক্তিবাদী মেডিক্যাল ছাত্র পোর্শনটা পাঁইপাঁই করে দৌড়ে পালিয়ে গেল—বোল্টীয় গতিতে ছাতটাত ফুঁড়ে পাড়ি দিল অজ্ঞাতবাসে। পড়ে রইল যুক্তিহীন ভীতু মিনমিনে ছেলেটা। সে একদুবার আমতা-আমতা করে বলার চেষ্টা করলো, “মোস্ট প্রবাবলি কেউ নেই। থাকার তো কথা নয়।”
কে শোনে কার কথা! আমি সুড়ুৎ করে আমার হাতদুটোকে কয়েক ইঞ্চি নিজের দিকে সরিয়ে আনলাম। সেফ থাকাই ভালো বাবা! দুম্ করে আমার হার্টটা পাশমার্ক না পেলে সঘোরেই মারা যেতে হবে। কিন্তু ওই যে কথা আছেনা, ‘হর্নস অফ এ ডাইলেমা!’ সেই ডাইলেমা এবার আমায় শিং দিয়ে আরামসে গুঁতোতে লাগল।
অনেকগুলো শিং বাপু! কখনো মনে হচ্ছে, হাতের দিকটাই ছুঁতে বেশি পছন্দ করবে। তখন হাতদুটোকে আরো সরিয়ে আনছি নিজের দিকে। কখনো মনে হচ্ছে, না, পায়ের দিকটাতেই সুড়সুড়ি দেবার বেশি চান্স! তখন পাদুটো একটু বাঁকিয়ে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসছি।

এই করতে করতে যখন প্রায় একখানা মাংসের গোল্লায় পরিণত হব হব অবস্থা, তখনই ঘটে গেল কেসটা! আমার ফোনের চার্জারের তারটা অবহেলায় একপাশে পড়ে ছিল নিজের মনে—হঠাৎ আমার কড়ে আঙুলের নখটা তাকে আলতো করে চুমু খেলো একটা!
তাপমোচী বিক্রিয়ায় এটুকু অনুঘটকেরই কমতি ছিল! সঙ্গে সঙ্গে একখানা মিনি-চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি খাটের মাঝখানে!

মেডিক্যাল কলেজ মেইন বয়েজ হোস্টেলের রুম নং ১০৭ এর মাঝের বেডে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ফার্স্ট ইয়ারের সৌম্যদীপ রক্ষিত। পয়লা বৈশাখে ফার্স্ট ইয়ারে ছুটি দেয়নি বারবার বলা সত্ত্বেও। সেই দুঃখে সে অর্ডার করে চিলিচিকেন-রুটি পেটভরে খেয়ে সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ শেষরাতে ক্যাঁচাৎ করে পাশের খাটটা একটা বিশাল আওয়াজ করে নড়ে উঠতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ফাঁকা বিছানাটার দিকে তাকিয়ে ভারি অবাক হলো সে। গোটা কম্বলটা এলোমেলো হয়ে কুঁচকে আছে। অবাক হয়েে সে ভাবলো, “অনিকেতদা কি ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে বিছানা-তোষকটা গুছিয়েও যায়নি?”
যাইহোক, ঘুমচোখে কে আর অত ভাবে! চুপচাপ সে আবার উল্টে পড়ল বিছানায়।
পরদিন বেলা ১২টায় ঘুম থেকে উঠে সে খবরটা পেল।
অনিকেত কাল রাতে ঘুমের মধ্যেই অজানা এক কারণে মারা গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, তার চোখদুটো বড়ো বড়ো করে খোলা ছিল—যেন কোনো কিছু দেখে সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে!

নড়নচড়ন

আলু আর ঈশু দুই ভাই। মা-বাবা দুজনকেই প্রতি সপ্তায় ১০টাকা করে দ্যান। বয়েস হয়েছে, কিছু হাতখরচ প্রাপ্য বইকি! তা, তারা খুব ভালো ছেলে বটে। দুমদাম খরচ করে দেয় না, জমিয়ে রাখে বেশিরভাগটাই।
সেদিন তাদের মধ্যে বিশাল তর্ক। ইশু বলে, ‘ভাঁড়টা প্রায় ভর্তি। কতদিন ধরে জমছে বলতো?’ আলুর দাবি, ‘দুর্! মাঝেমাঝেই তো চামচ দিয়ে তুলে আনি। পুরো ভর্তি হবে না নিশ্চই! ‘ কিছুক্ষণ কথাকাটাকাটি হল।
তারপর আলু বলে উঠল, ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার কেন?’ দুজনেই একসঙ্গে উঠে পড়লো। দুহাতে ধরে ভাঁড়টাকে কষে ঝাঁকালো উপর-নীচে।
ঝঁকরঝঁকর শব্দে ভাঁড়টা জানান দিল, কানায় কানায় ভরে এসেছে। ভেঙে ফেলার সময় হয়ে এসেছে আর কী!

কলকাতার লোকেরা ভয় পেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো দলে দলে।

একটি পৈশাচিক গল্প

দৃশ্য ১:

সতীশের বাবা বিরাট উকিল। বিরাট মানে, সত্যি বিরাট। পাতি পাবলিকের গাদাগুচ্ছের অ্যাপয়েন্টমেন্টের দরখাস্তগুলো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায় তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো কালো কাঁচের ভিআইপি গাড়িগুলোকে দেখে। কোর্টে দাঁড়িয়ে যখন তিনি গলা ঝেড়ে ‘ইয়োর অনার!’ হাঁক দেন, তখন শুধু আসামী না, জজের বুকটাও একটু কেঁপে ওঠে।

এতোক্ষণ তাঁর কাজের পরিচয় পেয়ে চোখের সামনে যে মানুষটা ভেসে উঠছে, রমণীমোহনবাবু ঠিক সেরকমই। লম্বা-চওড়া, ফিটফাট, মুখে সবসময় ধমক, আর বাড়ির বারান্দা দিয়ে যখন হেঁটে যান তখন পিঁপড়েগুলোও ভয়ে ফুটোতে ঢুকে পড়ে। এমনকি, লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপারে বসে বাবার গাঁদাঝোলানো ছবির সামনে যখন বাঁহাতে সাদা খামগুলো নেন, তখনও মুখে গাম্ভীর্য ছেয়ে থাকে।
তা এমন মানুষকে ছোটোবেলা থেকে চোখের সামনে দেখলে অন্ধ অনুসরণ ছাড়া আর উপায়ই কী! বিশালত্বের মুগ্ধতায় বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে ট্রাইসাইকেল চালানোর বয়স থেকে জ্যান্ত সুপারম্যানকে দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া সতীশ তাই কখনো মুখ ফুটে বলে উঠতেই পারলো না যে, তার ইংরেজি সাহিত্য পড়তে খুব ভালো লাগে। সেটা নিয়ে পড়তে পারলে তার খুব ভালো লাগবে।

বলতেই পারলো না। তাই, ২৪ বছরের সতীশ এখন নামীদামী কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করে বাবার জুনিয়র হয়েই কোর্টে যায়। কালো কোট আর মোটা বইয়ের তাগাদায় শেলী-কীটসরা কীটদের কবলে পড়েই প্রাণ হারিয়েছে।
যাই হোক। একদিন কোর্ট থেকে ফেরার সময় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মরে আসা বিকেলে গাড়ির নরম গদিতেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা উঠলো। গাড়ির ড্রাইভার, ওহ্ সরি, শোফার নিপুকাকা রাস্তার দিকে চোখ রেখে যেটুকু শুনতে পেয়েছিল, সেটুকুই তুলে দিলাম—
– “তোমার বিয়ের কথা চলছে, বুঝলে? তোমার মা মেয়ে-টেয়ে দেখছেন।”
– “বিয়ে? এখনিই? হঠাৎ?”
– “হঠাৎ মানে! চল্লিশে গিয়ে বিয়ে হবে নাকি!
তোমার আপত্তির তো কোনো কারণ দেখছি না।”
– “ইয়ে..
– “কি? কোনো মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছ নাকি? তাই বলি, কদিন ধরে ব্রিফগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না কেন!”
– “না না বাবা! ওসব কিছু নয়! সেরকম কেউ নেই।”
– “না থাকলেই ভালো। যাকে-তাকে তো ধরে এনে ফ্যামিলিতে ঢুকিয়ে দিতে পারি না!”

ব্যাস। সতীশের মা মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। সতীশ প্রতিদিনের মতো কোর্ট যেতে লাগল। কথাটা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
দৃশ্য ২:
নিকিতা খুব ভালো মেয়ে। মা-বাবার খুব বাধ্য। পড়াশুনো করে, গান শেখে, ওরিগ্যামি শিখেছে নিজের উৎসাহে। কেবল তার একটাই লজ্জা। সে কালো। আর, কালো মেয়েদের যে বিয়ে হওয়া মুশকিল, একথা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে।
তাই সরকারি চাকুরে ভালোমানুষ বাবার কাঁধের বোঝা হবার লজ্জায় সে চেষ্টা করে যতটা সম্ভব লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে। তার জীবনে ছেলেবন্ধু নেই, প্রেম নেই, সিসিডি নেই, সাউথ সিটি নেই। শুধু আছে হলুদ, দই, বেসন আর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির একগাদা চ্যাপটা টিউব।

অাশ্চর্যজনকভাবে, নিকিতাদের দোতলা বাড়ির সামনেই একদিন রমণীমোহনের হুন্ডাইটা এসে ঘ্যাঁস করে দাঁড়ালো। অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার! কোথায় হাইকোর্টের দুঁদে উকিল রমণীমোহন সমাদ্দার, আর কোথায় রাইটার্সের সামান্য অফিসার প্রতাপ ভট্টাচার্য!
প্রতাপবাবুও প্রথমে খবরটা পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলেন। আনন্দবাজারে গত তিনমাস ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সাড়া যে পাচ্ছিলেন না তা নয়, কিন্তু কোনোটাই আর পাকাপাকি স্থির হচ্ছিল না। কারও হতাশা ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’ মেয়েকে ‘শ্যামবর্ণা’ মনে হওয়ায়, কারও নাকউঁচু গয়নার ভরিগুলো কম হওয়াতে, কারও বা ‘পরে খবর দেব পছন্দ হলে’ বুলিতে স্পষ্ট ভদ্রতায় মোড়া প্রত্যাখানের ছাপ।
হঠাৎ রমণীমোহনের ফোন, সামান্য কিছু খোঁজখবর আর ডেট ফিক্স করে মেয়ে দেখতে আসা! অবশ্য ডেট ফিক্স করার কিছু ছিল না। রমণীমোহন ‘তাহলে ৬ তারিখ বিকেল ৫টায় আপনার ঘরে আসছি’ আর ‘রাখলাম’ কথাদুটোর মধ্যে বেশিক্ষণ ফাঁক রাখেননি।

যাই হোক। কথা হলো, সিঙাড়া হলো, মেয়ের গান হলো, ওরিগ্যামির কাজ দ‌েখা হলো। উকিল সাহেবের মেয়ে পছন্দও হলো। তার আসল কারণটা কী, জানা ভারি মুশকিল!
মেয়ের গায়ের রঙের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা টাকার থোকটা কল্পনা করে, নাকি যৌবনের কাঁচামাথার প্রেম কালো হরিণ চোখের কথা মনে পড়ায় মন দুর্বল হয়ে গেছল, তা জানা যাবে না হয়তো কোনদিনই।
দৃশ্য ৩:
বিয়ে হল। ধুমধাম হল। প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে বৌ নিকিতার গাভর্তি গয়না হলো। সতীশ ওয়েডস নিকিতা লেখা গাড়ি হলো। উকিলবাবুর ক্লোজ সার্কেলে ঢুকুঢুকু হলো। বাসররাতে আদিরসাত্মক চুটকি হলো। অর্থাৎ, যা যা হবার তাই হলো।
সতীশ কী চায়, সেটা অবশ্য কেউ জানতে চাইল না। প্রয়োজনও ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই তাকে নতুন খেলনা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পেয়েছে, তাই খেলনা পেয়ে ভুলে থাকতে সে জানে।

নতুন বিয়ের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। অন্তত উপর উপর দেখলে তাই মনে হতো। সতীশের গালে নতুন চেকনাই, নিকিতার মুখে ঝুলিয়ে রাখা হাসি আসল অবস্থাটা কিছুতেই কাউকে বুঝতে দিতো না।
রমণীমোহনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজকে কপি করতে চাওয়া সতীশ যে কীরকমভাবে নিজের সারাজীবনের ফ্রাস্টেশনগুলো বের করতে পারে, বন্ধ বেডরুমের দরজাটা ছাড়া সেকথা আর কেউ জানতো না।
কথায় কথায় বিদ্রূপ, গায়ের রঙ নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় ব্যঙ্গ আর হাসি, পান থেকে চুন খসলেই মানসিক নির্যাতন এসব তো চলতোই। ভদ্রবাড়ির ছেলে তো, শারীরিক নির্যাতন সরাসরি কখনোই করতো না। সেটা শুরু হতো রাতের বিছানায় বিভিন্ন পজিশন আর বেশ্যার মত নিকিতার দেহকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে, আর শেষ হতো সকালবেলা বাথরুমের দরজার ওপারে নিকিতীর নিশ্চুপ কান্নায়। তারপর, কান্না মুছে, হ্যাঙ্গার থেকে ব্রেসিয়ারটা আর মুচকি হাসিটা নিয়ে পরতো— এভাবেই দিন শুরু হতো তার।

এরকমই চলছিল। থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। একবছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। নিকিতার ওজন আর চোখের কালির পরিধির সঙ্গে সতীশের কেরিয়ারের উন্নতি সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলল।
এবার একটা নতুন দিক থেকে চাপ শুরু হল। রমণীমোহনের ইচ্ছে হল একটি নাতিলাভের। কে জানে, তাঁর হয়তো পরিবারে আরেকজন উকিল প্রয়োজন ছিল। প্রথমে তিনি পুত্রবধূকে ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন। ইঙ্গিতগুলো প্রথমে মৃদু হলেও, আস্তে আস্তে কথাগুলো জোরের সঙ্গেই শোনাতে শুরু করলেন।
খাওয়ার টেবিলে অনাগত পৌত্রের নামকরণের আলোচনা, তার কেরিয়ার নির্ধারণের আলোচনাগুলোতে পরিবারের বাকি সবাই সোৎসাহে অংশগ্রহণ করতো, কেবল নিকিতা ভয়ে সিঁটকে থাকত এককোণের চেয়ারে।

এটাকেই বোধহয় পারফরমেন্স প্রেশার বলে, তাই না?
দৃশ্য ৪:
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নিকিতার পেটে ছেলে এল না। মেয়েও এল না। নামকরা নার্সিং হোমের গাইনিকোলজি স্পেশালিস্ট লেডি ডাক্তার বললেন, ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রবলেম আছে, তাই নিকিতা কোনোদিনই স্বাভাবিকভাবে মা হতে পারবে না।
মানে, ঠিক এতোটা সহজভাষায় বলেননি। কিন্তু মেডিক্যাল টার্মগুলো বাদ দিয়ে পাড়ার কাকিমাদের পিএনপিসি করার ভাষায় বললে এটাই দাঁড়ায়।
এরপর যা যা হবার তাই হলো। সবার থমথমে মুখ, শাশুড়ির গজগজ, শ্বশুরের খোঁটা আর সতীশের মুখখিস্তি সহ্য করে একদিন নিকিতা সতীশের হাত ধরে দাঁড়ালো ফার্টিলিটি সেন্টারের কাঁচের দরজার মুখোমুখি।
হলো না। কিছুই হলো না। অসংখ্য ম্যাগাজিন, এসি আর সাদা সাদা চেয়ারগুলোতে সিটিং আর অপেক্ষার পর যখন টেবিলের ওপার থেকে ‘অ্যাডপশন’ শব্দটা শুনতে পেল, তখনই নিকিতার মুখখানা একধাক্কায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

এরপর থেকেই কেমন যেন বদলে গেল ঘরের পরিবেশটা। সতীশ আর খারাপ ব্যবহার করে না, শাশুড়ি চুপ, রমণীমোহনকে তো দেখতেই পাওয়া যায় না। এমনিভাবে ২দিন,৩ দিন, এক সপ্তাহ চলে গেল। নিকিতা বুঝতে পারছিল এরকমই কিছু একটা হবে, কিন্তু এই দমবন্ধ পরিবেশে তার গা গুলিয়ে উঠছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে সে নিজের কপালের লিখনকে গালিগালাজ করতো, কান্নাকাটি করতো আর তারপরে নিজেকে ভোলাতে ডুব দিত ঘরকন্নার কাজে।
ঘরের অবস্থা যে কে সেই। মাঝে মাঝে ফুসফুস গুজগুজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে, সে ঘরে ঢুকলেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার সঙ্গে কেবল দরকারের কথাটুকু বাদ দিয়ে কোনো কথা হত না।
মাঝে একদিন হঠাৎ শাশুড়িমা তার সামনেই সতীশকে ডেকে বললেন, “রান্নাঘরের গ্যাসের নবটা একটু ডিস্টার্ব করছে, বুঝলি? একটু সারাবার ব্যবস্থা করিস তো।”
সময়টা সকালবেলা। সতীশ খেলার পাতা পড়ছিল। রমণীমোহন এডিটোরিয়াল। দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
সতীশ বললো, “আচ্ছা। দেখছি।”

তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা। নিকিতা ভাতটা সবেমাত্র চাপিয়েছে কি চাপায়নি, তার নাকে কেমন একটা গন্ধ লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে তার চোখে পড়ল, সিলিন্ডারের মুখটা কে যেন হাঁ করে খুলে রেখেছে! বাইরে খট্ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে। পাগলের মতো সে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
দরজা আর খুললো না।

কয়েক মিনিটের ব্যাপার। ঘরের ভেতর থেকে পাশবিক চিৎকারটা ১০ মিনিট মতন শুনে তবেই দরজা খুললেন রমণীমোহন। জল-টল সব রেডিই ছিল। আগুন নেভালেন কোনোমতে। তারপরে হাঁকডাক শুরু করলেন।
দৃশ্য ৫:
স্থান মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট। থার্ড সেমেস্টারের ছাত্রদের সার্জারি ওয়ার্ড চলছে। আজই প্রথম দিন। একদল অ্যাপ্রন পরা উৎসাহী ছাত্রছাত্রীকে পেছনে নিয়ে আরএমও ঢুকলেন। তাঁর পেছন পেছন দুজন পিজিটি, মানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি।
এসি চলছে। ঘরটা একদম ঠান্ডা।আরএমও এগিয়ে গেলেন তিন নম্বর বেডের দিকে। কেস হিস্ট্রিটা হাতে এগিয়ে দিলেন একজন জুনিয়র ডাক্তার।
পেছনের ভিড়টার দিকে ফিরে তিনি বলতে শুরু করলেন, “এদিকে তাকাও। এটা হচ্ছে একটা বার্ন কেস। এটা কত পার্সেন্ট বার্ন হয়েছে বলতো? কেউ জানো, কিভাবে শরীরে বার্নের পার্সেন্টেজ ক্যালকুলেট করা হয়?”
গোল গোল চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি একজন পিজিটির দিকে ইশারা করলেন। সে শুরু করল, “দ্যাখ, এটাকে রুল অফ নাইন বলে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মাথা ৯%, পুরো বুক নয় দুগুণে ১৮%, পিঠও ১৮%, হাত দুটো ৯% করে, প্রতি পায়ের সামনেটা ৯ আর পেছনেরটা ৯, আর শেষে পেরিনিয়াম মানে জেনিটাল এরিয়াটা ১%।” এই বলে সে থামল।
আরএমও তখন বললেন, “এই কেসে এটা ৯৯% বার্ন হয়েছে। জেনিটাল এরিয়াটা বেঁচে গেছে। আচ্ছা কেউ বলতে পারবে, এটা কতো ডিগ্রি বার্ন?”
একজন পড়ুয়া ছাত্র তখন পেছন থেকে উত্তর দিলো, “স্যার, এটা বোধহয় সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন। কারণ এপিডারমিস ডারমিস দুটোই পুড়েছে।”

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে কালো হয়ে যাওয়া বীভৎস দেখতে শরীরটা অনেক কষ্টে উঠে বসলো বেডের উপর। আত্মীয়স্বজন যারা বেডের পাশে ছিল, তারা চোখের জল মুছে তাকালো। গোঁগোঁ করতে করতে নিকিতা কীসব বলতে লাগল, কেউ বুঝে উঠতে পারল না। খুব কষ্ট করে কান পেতে বোঝা গেল, ও বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছে, “শাস্তি দিন ওকে ডাক্তারবাবু। পুড়িয়ে মারল আমাকে। আগুন আগুন। গোটা গা জ্বলে গেল। শাস্তি দিন ডাক্তারবাবু।”
এসবের মাঝে একজন ছাত্র অবাক হয়ে ফিসফিস করে ইন্টার্ন দাদাকে জিজ্ঞেস করল, “এতটা পুড়েও বেঁচে যাবে!?”
দাদা ঠোঁট উল্টে বলল, “না না। পাগল নাকি! আজই তো ভর্তি হল। কাল পরশুই ডিহাইড্রেশন বা সেকেন্ডারি ইনফেকশনে মারা যাবে।”
দৃশ্য ৬:
দুদিন পরের ঘটনা। নিকিতা মারা গেছে। নিকিতা এখন আর নিকিতা নয়। ঘরের লোকজনের কাছে ‘ও’, ডাক্তারদের কাছে ‘বডি’ আর ডোমদের কাছে ‘লাশ’। তো, সেই ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ এখন মেডিকেল কলেজের মর্গে।
রাতের বেলা। ঠান্ডা মর্গে নিকিতার ডেডবডি শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। হয়তো সে প্রতীক্ষা করছে এক সুন্দর সকালের। যেখানে তার চামড়া খসে যাওয়া বডিটা কেটেকুটে পোস্টমর্টেম করবে হেড ডোমরা, আর পাশে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকবেন ফরসা ডাক্তারবাবুরা।

হঠাৎ সেই মড়ার আর প্রতীক্ষা সহ্য হলো না। রাতের অন্ধকারে মড়াখেকো ইঁদুর আর নাম না জানা পাখির ডাককে সাক্ষী রেখে উঠে বসল সেই মড়া!
অপঘাতে মৃত দেহের সৎকারের পূর্বেই তার প্রেতত্বপ্রাপ্তি হলে সেই অতৃপ্ত আত্মাকে পিশাচ বলে। পিশাচেরা নিজের অপূর্ণ কাজ শেষ করার জন্যই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
সাদা মার্বেলপাথরের টেবিলের ওপর সোজা হয়ে বসল ভয়ঙ্কর এই প্রেতাত্মা। তার চোখের কোটরদুটো কালো। গোটা গায়ের চামড়া কিছু খসে পড়েছে, কিছু কালো হয়ে গেছে, আর কিছু জায়গায় রয়ে গেছে।
উঠে বসে সে একখানা হাড়হিমকরা চিৎকার করল! পাশবিক সেই চিৎকার লাল দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে গেল। শুনতে পেল শুধু একখানা কালো প্যাঁচা। সে তাল মিলিয়ে ‘হু-হু-হুউউউ’ করে চিৎকার করে উঠল।

এবার টেবিলের মড়া মাটিতে নামলো। সাদা চাদর হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল একদিকে। সে হেঁটে বেড়াতে লাগল মর্গের এদিক থেকে ওদিক। তার অস্থির দৃষ্টি যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটা জিনিস তার চাই, যার সাহায্যে তাকে তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে। নইলে প্রেতদশা থেকে তার মুক্তি নেই।
খুঁজে পেল! খুঁজে পেয়েছে সে সেই জিনিস!
দেশলাইয়ের একটা বাক্স। বিকেলবেলা হেড ডোম শিবজী আর তার চেলারা বিড়ি ফুঁকছিল মনের সুখে এককোণে বসে। তারাই মনের ভুলে ফেলে গেছে।
বাক্সটা পেয়ে মড়ার চোখের কোটরে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠল।

সে দেশলাই বের করে তাকালো নিজের নিরাবরণ দেহের দিকে।
তারপর অক্লেশে পাশবিক এক প্রতিহিংসায় আগুন লাগিয়ে দিল নিজের যৌনাঙ্গে!
গোটা দেহে মাখিয়ে রাখা মোমজাতীয় পদার্থের প্রলেপের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে বিক্রিয়া করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তার দেহের একমাত্র অবিকৃত অংশটুকু।
পটপট শব্দে পুড়ে যেতে লাগল তার যৌনকেশরাশি।
রক্তজলকরা পাশবিক কন্ঠে সেই পিশাচ চেঁচিয়ে উঠল, “নে! ১% ও আর বাকি রইল না! পোড়ালি যখন, পুরোটাই পুড়িয়ে ফেল! জ্বালিয়ে দে আমায়! মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন, ১০০ ভাগ না জ্বালিয়ে ছেড়ে দিবি কেন?! জ্বলুক! সব ছাই হয়ে যাক!”
অসহ্য যন্ত্রণায় ভরা পৈশাচিক সেই কন্ঠ শুধু চেঁচিয়ে যাচ্ছিল ‘আহ্! জ্বলে গেলাম!’ ‘পুড়ে গেলাম’ ‘আহ! কী শান্তি!’ ‘পুড়িয়ে শান্তি পেলি এবার?’

আস্তে আস্তে জীবন্ত মড়া আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
দূরে তখন কোনো এক রাতজাগা ছাত্রের ঘরে বেজে চলেছে, “ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে…”
(সমাপ্ত)

জানালাটা

আমার নাম ননা। বাপ মায়ে একটা নাম রেখেছিল বটে, কিন্তু দুটো ন এর মাঝে একটা র উচ্চারণ করতে কেমন জড়িয়ে যায় না? তাই এই নতুন শহরটার কাছে আমি হয়ে গেছি ননা।

পশ্চিম মিদনাপুরের একটা না-গাঁ-না-শহর জায়গায় আমার বাড়ি। ভালোই ছিলাম। জগন্নাথ বিদ্যামন্দিরে পড়তাম। বাপ কাজ করতো লেদ কারখানায়। হঠাৎ একদিন লোকটা দুপুরবেলা ঘর চলে এল। উঠানেই বসে পড়তে যাচ্ছিল, আমি আর মা মিলে ঘরে নিয়ে আসতে গিয়ে দেখি চোখ দুটা কটকটা লাল আর শরীরটা যেন আগুন। জামিলকাকারা বললো, ‘হিটস্টোক’ না কি যেন হয়েছে। ভবা ডাক্তারকে ডাকার আগেই শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
মা আছাড়িপিছাড়ি করে অনেক কাঁদলো। তাতে আর কিই বা হয়! আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, আর পড়াশোনা হবে না আমার দ্বারা। মায়ের পাতলা যেকটা গয়না ছিল, তা দিয়ে কয়েক মাস চলল। তারপরেই শুরু হল পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা। মা বাড়ি বসে শায়া-বেলাউজ তৈরি করে কিছু কিছু পেত।
একদিন দেখলাম পাড়ার গণেশকাকা মাকে এসে কি একটা বলছে, আর মা ঘাড় নেড়ে ‘ঠিকই তো, ঠিকই তো’ বলে যাচ্ছে।
আমি হাবেভাবে বুঝলাম জিনিসটা কি। বললাম না কিছুই। জানতামই এটাই হবে!
তার তিনদিন পরে একটা বিরাট ট্রাঙ্ক ঘষটাতে ঘষটাতে হাওড়া স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখে শুনে চোখ টেরিয়ে গেল! এই না কি কলকাতা! কত ভ্যাঁ-ভোঁ, ঠনরঠনর, খচাৎ খচাৎ- জায়গা বটে একখানা!
কাজ হলো একটা ঘুঁজঘুঁজে অন্ধকার ছাপাখানায়। সকাল ৬টার থেকে ১২ টা তক্ক, আবার ১টা থেকে ৫টা। মাইনে মোটামুটি, তবে প্রথম ছমাস হাফ মাইনে- তখন কাজ শিখতে হবে। একটা জিনিস দেখলাম ভালো, থাকাটার ব্যবস্থা করে রেখেছে। একটা কালোকুলো মেসবাড়ি, ওই বউবাজার মোড়টায় ডাক্তারি হস্টেলটার পিছনে। খারাপ লাগল না, দেশের বাড়িটাও তো এমনিই ছিল।

কাজ শুরু হল. ভোর ৫টায় উঠতে হয়। কয়েকদিন পরই সকালবেলা মুখ ধুতে ধুতে হঠাৎ চোখে পড়ল, এখান থেকে হোস্টেলের বাথরুমটা পরিষ্কার দেখা যায়।
আস্তে আস্তে বাথরুমের জানালাটা আমাকে বেশি বেশি করে টানতে লাগল। ভোরে উঠে দেখতাম, আধভাঙা পাল্লাটা হাট করে খোলা। দাঁত মাজতে মাজতে তাকিয়ে থাকতাম। কাজ থেকে ফিরে এসেও আমাদের রেলিংওয়ালা নড়বড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনজরে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে রাতেরবেলা রান্না করার সময় উনুনের ধোঁয়াতে জানলাটা ঝাপসা হয়ে যেত, চোখ জ্বালা করত; তবু ঘাড় তুলে তুলে দেখতাম।
ওটা যেন আমার বন্ধু হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। কতোজন চান করতে আসতো ওখানে! শুধু ছেলে আর ছেলে। ভোর ৫ টা ১৫তে রোজ একটা মোটামত ছেলে চান করত,পৈতে পরা। চানের পর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানলা দিয়ে গলা বের করে উপর দিকে তাকিয়ে সূর্যমন্ত্র পড়ত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা,ওর চান বাদ পড়ত না। ভাবতাম ওর কি শরীর খারাপ ও করে না!
আরও অনেককে দেখতাম।
বেশিরভাগই দুপুরদিকে চান করত, যখন খেতে আসতাম। আমিও চান করতাম, ওরাও করত। নিজেদের কেমন একই মনে হতো। ওরা যেমনভাবে হাত তুলে সাবান মাখতো, আমিও সেটা দেখে নকল করতাম! একটা খোঁড়া ছেলে ছিল, সে আবার শাওয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে চান করত। একজন ছিল ফরসা, একদম পাতলা করে- সে শীতকালে মাঝে মাঝে আসত চান করতে, আর খুউব লাফাত ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে!
আমরা অনেকেই সেটা দেখে হাসতাম।

কেউ কেউ শুধু গামছা পরে আসতো, কয়েকজন আবার ঢুকে দরজা বন্ধ করে সব খুলে রাখতো। সব দেখে দেখে কেমন মুখস্থ হয়ে গেছিল। সপ্তাহের কোনদিনে কেমন লাইন পড়ে, লোকজন কিভাবে কলের হাতল ভেঙে ফেলে গোবেচারা মুখ করে বেরিয়ে যায় এরকম সব!
মাঝে মাঝে রাত ১টা ২টোর সময় ঘুম না এলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। কোনো কোনোদিন দেখতাম সিগারেটের পুঁটকি আলো আর মোবাইলের আলো দেখা যাচ্ছে। ছেলে হয়েও ছেলেদের এইসব কাজ দেখতে আমার খারাপ লাগত না! চাঁদের আবছা আলোয় আমি সবই বুঝতে পারতাম, কিন্তু ওরা বুঝতেও পারতো না।
মাঝে মাঝে কাউকে বিড়বিড় করে বইহাতে ঘুরতেও দেখতাম। তখন বুঝতে পারতাম, পরীক্ষা চলছে। রাত্রে মোবাইলের আলোজ্বলা বেড়ে যেত। একদিন মেডিকেল কলেজেও যেতে হল, পায়খানার জায়গাটায় প্রচন্ড ব্যথা করছিল; ২টাকা দিয়ে দেখিয়ে ফ্রি ওষুধ নিয়ে এলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে জ্বর-পেটব্যথা হলেই যেতাম, ওখানে অ্যাপ্রন পরা লোকগুলোকে বেশ নিজের মনে হত। যেন সবাই ওই হোস্টেলে থাকে আর সবাই ওই বাথরুমটাতেই চান করে!
এভাবেই ওই জানলাটুকু যেন এই অচেনা শহরে আমার একমাত্র চেনা জায়গা হয়ে উঠেছিল।

এমনিভাবেই একদিন সন্ধ্যেবেলা রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছাপাখানা সেদিন বন্ধ। মালিকের কোথায় যেন বিয়েবাড়ি, তাই আমাদেরও ছুটি।
বেশ ভালো হাওয়া দিচ্ছিল। অভ্যাসবশে তাকিয়েছিলাম ওইদিকে, আর মায়ের কথা ভাবছিলাম। মা কালই ফোন করে বলছিল, নাকি কদিন ধরেই পেটের বাঁদিকে একটা খিঁচ ধরা ব্যথা উঠছে। ভাবছিলাম, এনে একবার দেখিয়ে দেব নাকি এখানে। সে আবার অনেক টাকার ধাক্কা!
হঠাৎ দেখলাম অন্ধকারে একটা ছেলে ঢুকলো। সিগারেট জ্বালালো একটা। তারপর আরেকটা। আরেকটা। আরেকটা।
প্রথমে পাত্তা দিইনি, তারপর প্রায় চল্লিশ মিনিট পরেও দেখলাম জানালার ধারে একটা আগুন জ্বলছে!
অবাক লাগল বেশ। এতোসময় তো কেউ থাকে না। পাগলটাগল নাকি! আস্তে আস্তে দেখলাম, সিগারেটের আগুনটা ছোটো হতে হতে একই জায়গায় নিবে গেল. কেউ ছুঁড়ে ফেলল না! অদ্ভুত ব্যাপার তো! আমার যেন কেমন কেমন লাগছিল। আমি কৌতুহলটা মনে চেপে রেখেই রান্না করতে বসলাম। মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে তাকাচ্ছিলাম ঝুল-কালোর মধ্যে দিয়ে যদি কিছু বোঝা যায়!

রাত্রেবেলা ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়, আমি হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ার ১৫ মিনিট মতন পরেই, দুমম্ করে একটা বিকট আওয়াজ শুনলাম!
ঠিক যেন একটা বিরাট ভারী জিনিস উঁচু থেকে পড়ে গেল!
আমাদের মেসের সবাই বারান্দায় জড়ো হয়ে গেল। দেখি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সবাই বাথরুমে এসে গেছে। প্রচুর আলো জ্বলে উঠেছে। দেখলাম, ভিড়ের সবাই ধরাধরি করে গলায় পেঁচিয়ে থাকা দড়ি সমেত একটা ছেলেকে টানাটানি করে বাথরুমের বাইরে নিয়ে গেল! অনেক হইচই, হট্টগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। শাওয়ারের রডটা থেকে একটু দড়ি তখনো ঝুলছিল।
পরের দিন সকালে মুখে মুখে শুনলাম, নাকি পড়ার আর পরীক্ষার অমানুষিক চাপ সইতে পারেনি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটা। আমারই বয়েসী হবে হয়তো। বাথরুমে ঢুকে ৫টা সিগারেট টেনে মনের জোর জোগাড় করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিল। সেই জীবনটা, যেখানে খুব পরীক্ষা; অনেক পড়তে হয়।
শেষ দেড়ঘন্টা ও একাই ঝুলছিল।

আমি আর জানালাটার দিকে তাকাইনা। ইচ্ছে করে না আর। জানালাটার দিকে তাকালে আমার আর ঘরের কথা মনে পড়ে না।