ট্রেনে বসে আছি। ১২টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম। লোকে ঘুম থেকে উঠে হাই তোলে, আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলি। যত ভোর ভোরই উঠি না কেন, এই নীল-সাদা পেষ্ট দিয়ে মিনিমাম আধ ঘন্টা দাঁত না মাজলে আমার ঠিক ঘুমটা ভাঙতে চায় না। তাই উঠতে লেট। ফলে খেতে লেট। ফলে বেরোতে লেট।
এইরকম সারি সারি ইকুয়েশন পেরিয়ে এসে ঝোলাকাঁধে জিভটিভ বের করে হাওড়া পৌঁছে দেখি, ট্রেনবাবু এসে হেঁহেঁপর্ব, ভদ্রতাপর্ব, মিষ্টিপর্ব শেষে চাপর্বে প্রবেশ করেছেন। মানে, আমার ভদ্রভাবে ট্রেনযাত্রার আশাটুকু ওই মিষ্টিসাঁটানো প্লেটে পড়ে থাকা রসের মতোই অকিঞ্চিৎকর।
উঠলাম জেনারেল কামরাতে। দেখি কত্তো ফাঁকা সিট! মনে হল, আহা, দুনিয়ায় এখনো ভালো মানুষ আছেন, ভগবান আছেন,যারা সান্তাক্লস আছেন, এমনকি জানালা দিয়ে তাকালে বোধহয় দু-চারটি কল্পতরু গাছটাছও দেখতে পেয়ে যাব! আহ্লাদী গলায় সামনের কানল্যাজাসমন্বিত তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা এই সিটটায় কি কেউ আছে?”
তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে এককথায় উত্তর দিলেন, “রিজার্ভেশন।”
ব্যাস। হয়ে গেল। চুপচাপ নেমে পড়লাম। দেখি, এটা সবে ডি-১। বুঝলাম, ডিল্লি অভি দূর হ্যায়। রেল কোম্পানির নিয়মটা আবার উলটো। পিছিয়ে পড়া, সর্বহারা মানুষের জন্য জেনারেল কামরা আর উপরের স্তরের মানুষদের জন্য রিজার্ভেশন। তাই, জেনারেল কামরাগুলোও পেছনদিকে পড়ে আছে অবহেলায়।
ডি-১ থেকে ডি-৭ পাড়ি দিলাম। পৌঁছে দেখি, ভর্তি। খুব স্বাভাবিক।এটার নিয়মটা খুব ঠোঁটকাটা। ট্রেন স্টেশনে হাজিরা দেবার আগেই তোমায় হাজির থাকতে হবে।নিজের রুমাল, নিউজপেপার, বোতল, ব্যাগ, দরকার হলে জাঙ্গিয়া (যা কিছু জানালা দিয়ে গলে যাওয়া সম্ভব) ট্রেন দাঁড়াবার আগেই সিটে রাখতে হবে। নইলে ফক্কা!
উঠে বাথরুমের কাছে দাঁড়ালাম। উল্টো গেটের সামনে লুঙ্গি পেতে বসে থাকা ফুল ব্যবসায়ী আমাকে একটু ফ্রি উদেশ প্যাকেটে মুড়ে ধরিয়ে দিলেন—
ফু- আপ ইঁহা খড়া মত রহিয়ে। দুসরে কমরে মে দেখিয়ে না!
আ- দেখেছি। নেই। (বাংলাতেই)
ফু- আপ যাইয়ে একবার দেখকে তো আইয়ে। নেহি দেখেঙ্গে তো মিলেগা ক্যায়সে? ‘বিকলাঙ্গ’ মে যাইয়ে!
আ- দেখেছি গো! ওটাও ভর্তি!
ফু- সব অ্যারাগ্যারা আদমি ওঁয়াহা ব্যৈঠা রহতা হ্যায়! আপ যাকে বোলিয়ে, উঠ যায়েগা!
[কথাটা সত্যি। যত আজেবাজে লোকে জায়গাটা ভর্তি থাকে। কিন্তু, আমার বদভ্যাসের দরুণ আমিও সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরিনা। কাজেই আমারও কোনো ভ্যালিড গ্রাউন্ড নেই।]
আমি আর বকবক না করে চুপচাপ মেঝেতে বসে পড়লাম। লোকটা বোধহয় এটা ঠিক হজম করে নিতে পারলো না, তাই পিটপিট করে খানিকক্ষণ দেখল। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে ছিলাম অবশ্য। প্রায় তিন ঘন্টা নীচে আনন্দবাজার ছাড়াই একটা হাফ নোংরা শার্ট আর ততোধিক নোংরা জিন্স পরে মাটিতে বসে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেন একটাও আধুলি ফেলে গেল না, এটা আমাকে ভাবাচ্ছিল। পরে অবশ্য বুঝলাম, নতুন জুতোটাই একমাত্র কারণ।
যাই হোক, উপার্জনহীনতার দুঃখ মনেই চেপে রেখে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। লোক-টোক দেখলাম(ওই বাথরুমের সামনে না বসলে আপনি কোনোদিনই ভ্যারাইটি লোক দেখতে পাবেন না), গান শুনলাম, পোকেমন দেখলাম।
হ্যাঁ, এই পোকেমন দেখাটা নতুন নেশা। পোকেমন গো গেমটা যখন বেরোলো, তখন থেকেই। গেমটা বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলছিলাম তখন। লোকে অবশ্য পুঁজিবাদী-টুঁজিবাদী বলে প্যাঁক দিচ্ছিল টুকটাক। কিন্তু নিন্দুকদের কথায় কান দিয়ে আর কে কবে বড় কাজ করতে পেরেছে! ওসব শুনতে নেই। হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যাওয়া লোকের পর্যন্ত ইস্পেশাল দুব্বলতা থাকে, আর আমি তো নেহাত চুনোপুঁটি! তাই, পোকেমন সিরিজ দর্শন।
কিন্তু, মানুষের অন্যের সুখ সহ্য হয় না। একটা সময় লোকটারও সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল আমার এই নির্লিপ্ততা। আমাকে বলল, ‘চলিয়ে ম্যাঁয় আপকো সিট দিলাতা হুঁ।’ চোখেমুখে আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখে বাধ্য হয়ে বললাম, ‘চলিয়ে’।
সেই থেকে এই সিটে বসে। একখানা বিস্কুট প্যাকেট ওঠার আগে ব্যাগে পুরতে পেরেছিলাম, তাকেই সসম্মানে পেটে ঠাঁই দিলাম। কিন্তু তাতেও হলো না। সময়ও কাটছে না, তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে খিদেও পাচ্ছে। কেমনতরো ট্রেন রে বাবা! অন্য ট্রেন হলে ছঘন্টায় মিনিমাম ছটা ঝালমুড়ি উঠতো। এটাতে তিনখানা জুতো পালিশ আর তিনখানা ইঁদুরের বিষ উঠেছে।
খিদের জ্বালায় দ্বিতীয়টাকেই ডাক দেবো কিনা বিবেচনা করছি, এসময়েই দূর থেকে একখান মধুর ডাক কানের গলিতে ঠুনঠুন করে রিকশার ঘন্টি বাজাতে বাজাতে মরমে প্রবেশ করল। মরমে যেন মলমের প্রলেপ বইয়ে দিলো কেউ। শুনতে পেলাম— “লেবু-মশলা-সরবত, অ্যাই লেবুউউ-মশলা-শঅঅরবঅঅত! পাঁচ টাকা!
আহা! চটপট প্রণাম ঠুকতে গেলাম খাবারের দেবতা কে। কিন্তু, নামটা আর হাতড়ে খুঁজে পেলাম না! শেষে মদনদেবকেই প্রণাম জানালাম করজোড়ে! এই চরম খিদেও তো কামের মতই তীব্র দেহজ চাহিদা, নাকি! আর, রঙিন পানীয়র ব্যাপার যখন, তখন উনিই প্রাথমিক পছন্দ।
ডাকলাম সাততাড়াতাড়ি। হেলতে দুলতে তিনি এলেন। সঙ্গে সঙ্গে, ভিড় রেলকামরার ইন্ডাকশন সূত্র অনুযায়ী আরো পাঁচখানা নোলা এগিয়ে এল। তাদেরও চাই!
বাবু তাঁর রহস্যময় ডিব্বার নল খুলে একখানা মোটা কাগজের কাপ ভর্তি করে দিলেন পানীয়ে। পয়সা নিয়ে চলে গেলেন। টাটানগর স্টেশনে তখন ট্রেনবাবু জিরোচ্ছেন।
আমিও এই তাল বুঝে পানীয়তে চুমুক দিলাম। আহা। ঠান্ডা। মশলাদার। মিষ্টি মিষ্টি। সোডা বা শরবতের প্রতিটি গুণ বিদ্যমান।
ধীরে সুস্থে পুরো কাপ শেষ করে শান্তি পেলাম! দেখলাম কাগজের কাপ, তাই অসীম দক্ষতায় এবং প্রশান্তিতে কাপটাকে মুড়তে মুড়তে এইটুকু করে ফেল্লাম। তারপর টুক করে ফেলে দিলাম ট্রেন আর স্টেশনের মাঝে।
পেট আর জিভ ঠান্ডা হওয়া মাত্রই কেমন একটু খটকা লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় ভুলটা হচ্ছে। মানিব্যাগ বের করে দেখলাম, ঠিকঠাক টাকাই দিয়েছি। দশের বদলে একশোর নোট দিইনি। তবে?
ট্রেন নড়তে শুরু করল। ট্রেন চলতে শুরু করল। স্টেশন ছাড়তে শুরু করল।
তখন শুনতে পেলাম, জানালা দিয়ে ডাক ভেসে আসছে—
“অ্যাই লেবু-মশলা-চা! অ্যাই গরম মশলা চা! পাঁচ টাকা!”