১ নম্বর

আর বেশি সময় পাবো না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রচুর সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তোমার সাথে। আমার সাথেও। কিন্তু আমাকে তো কথাগুলো বলে যেতে হবে। নইলে তুমি ভাববে অন্য কোনো মানুষের প্রেমে তোমায় একা ফেলে চলে যাচ্ছি। ব্যাপারটা সেটা নয়। সেটা ছিল না কোনোদিনই। আমি বলেছিলাম আমি প্রেমে পড়িনা। আমি বলেছিলাম আমি সম্পর্কে পড়ি না। আমি তোমাকে বলিনি সম্পর্কে পড়লে সবাই ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যায় আর মারা যায়? তুমি হেসেছিলে। আর ঝালমুড়ির লঙ্কা বেছে বেছে ফেলছিলে। শোনোনি কেন? আমি তোমাকে তারাপদর কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, মানুষের বেশি কাছে এলে আমি গন্ধ পাই। মুখোশের গন্ধ। ভ্যাপসা, বোঁটকা গন্ধ। তোমরা পাবে কী করে? কোনোদিন মানুষের কাছে গিয়ে শুঁকে দেখোনি সে মরে গেছে, না বেঁচে আছে। তাই আমি চলে যাব। আমার পছন্দ হয় না কাছে আসা। তুমি আমার অজান্তেই গায়ে চেপে বসো। চারপাশের মানুষেরা গায়ে চেপে বসে আমার। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি নিশ্বাস নিতে চাই আর আবার, আবার সেই গন্ধটা নাকে ঢোকে। আমি তোমাকে বোঝাতে বলেছিলাম, কীভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কাছে শান্তি পায়। তুমি পারোনি। পারবেও না। মানুষ ছাড়া বাঁচোনি কোনোদিন। তাই এসব শুনলে তোমার কান্না আসে। কিন্তু আমার জামার হাতা নিজে নিজেই শুকিয়ে যায়, তোমার অপেক্ষা না রেখেই। আমিও একদিন তারাপদর মতই বেরিয়ে পড়ব। কোনো এক বজরায়। কোনো এক গ্রামে। আবার কোনো এক মায়ের আঁচল ফেলে রেখে অন্ধকার রাতে পালাবো। আমি পালাচ্ছি। তুমি মানুষদের নিয়ে ভালো থেকো। আমাকে খুব গালাগাল দিয়ো। পাগল বোলো। তোমার ওয়েভলেংথে বেঁচো। বহুদিন। একঘেয়েভাবে।
আচ্ছা, কোনোদিন কি সত্যিই বোঝোনি? আমার প্রেমের কবিতার নির্লিপ্ততায়? আমার নান্দনিকতার অভাবে? আমার সূক্ষ্মতার অপর্যাপ্ততায়? মনে খটকা লাগেনি? কিন্তু তবু আমি ভালো থাকি। তোমার চেয়ে অনেকটা বেশি। হয়তো ডিলিউশনে থাকি। কিন্তু সেটাও ভালো। তোমার মতো মানুষের ছায়া খুঁজি না। একটা মানুষ কী দিতে পারে? তার বুদ্ধি, মনন, কথা। সবই তো তরঙ্গে ভেসে আসে। আসে না? তবে কাছে গিয়ে তার সাথে লেপটে যেতে চাও কেন? তোমার গায়েও ঘাম, তার গায়েও ঘাম। আর, ঘামে ঘাম মেলাতেই হয় যদি, তবে শরীর মেলাও। তার বেশি কিছু না।

হ্যাঁ, ভালো থেকো।
টিমপ্লেয়ার হও। ম্যাচ খেলো। ঘাম জমুক।
আমি গ্যালারিতে বসি আয়েশ করে। খেলা দেখে আনন্দ পাই।
আর একধাপ করে ওপরদিকে উঠতে থাকি।
আস্তে আস্তে…

টমগার্ল

আমি ছোটোবেলা থেকে অনেক মেয়ে দেখেছি। সারি সারি সংখ্যায় তারা মুখ নামিয়ে পেরিয়ে যায়। দুঃখের মেয়ে। কষ্টের মেয়ে। তার অপমানিত চোখ। তার ভীতু পা। দুর্বল হাত। নিয়মের দড়ি বেঁধে তার অভ্যাস। গায়ে লাল লাল ছোপ পড়ে গেছে। সূর্যের আলোর অভাবে তার গায়ের ফর্সা চামড়া স্যাঁতসেঁতে। তাতে গুঁড়ি গুঁড়ি অবহেলার ছত্রাক জন্মেছে নরম ভেজা আবহাওয়ায়।
আমি। ছোটোবেলা থেকে। অনেক মেয়ে দেখেছি। তারা কখনো শুধুই মেয়েমানুষ। কখনো বউ। কখনো বোন। সমাজের ভেতরেও সমাজ, বৃত্তের মধ্যেও বৃত্ত তৈরি করে তারা। শেষে গোল দাগ কাটতে কাটতে এইটুকু মাটি পড়ে থাকে। কোনোমতে দুপা আঁটে তাতে। তাতে কী লজ্জা! কী লজ্জা! ও মেয়ের পায়ের পাতা লক্ষণরেখার মধ্যে আঁটে না। ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে সেই মেয়ে আরও গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে। সেই বৃত্তের মধ্যে। ছোটো হতে হতে, নীচু হতে হতে হারিয়ে যায়।
জানো, আমি মেয়েদের দেখেছি। তারা কথা বলতে পারে না। চোখ তুলে তাকাতে লজ্জা পায়। ওড়নার স্কেল দিয়ে তারা সম্মান মাপে। তাদের সাইকেলের পাশাপাশি সাইকেল চালালে তারা লজ্জা পায়। তুমি তাদের দেখেছো? যারা ক্লাস এইট থেকে ফেসবুক করে, কিন্তু নিজের একটাও ছবি তাতে দেয় না। তাদের ওই মিথ্যে ডলপুতুলের ছবিতে তোমার অস্বস্তি হয় না? মনে হয় না ছিঁড়ে ফেলে দি ওই ছবি?
আমার দুর্ভাগ্য। আমি মেয়েদের চোখে শুধু ভয় দেখেছি। লজ্জা দেখেছি। অপমান দেখেছি। চুলের ঝুঁটি ধরে মার দেখেছি। প্রেম করার জন্য ঘরবন্দী হতে দেখেছি। মাসের পর মাস। নিজের প্রতি নিজের, পরিবারের, প্রেমিকের, আর সমাজের অবহেলা দেখেছি। আমি রোগা রোগা মেয়েদের চোখ থেকে স্বপ্ন কেড়ে তাতে অ্যানিমিয়া ভরে দিতে দেখেছি।
সেই জন্যই। আজ যখন ওই হাজার হাজার নামহীন সাদাকালো মুখের মাঝে একদুটো রঙীন মুখ দেখি, হাতে স্বপ্নের নিশান নিয়ে তাদের হাঁটতে দেখি, তখন খুব ভালো লাগে। খুব আনন্দ হয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে। তারা কতো সবল। কতো স্বনির্ভর। কতোটা নির্ভীক। সমাজের বাঁধন ছেড়ে তারা নিজেদের পথে হাঁটছে।
বিশ্বের ক্ষেত্রে আমার দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠলে যেমন ঠোঁটদুটো নড়ে ওঠে, আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপে, চোখ নরম হয়ে আসে, তেমনি এইসব মেয়েদের জন্যও ভেতরটা ভরে ওঠে। এরাই যেন সেই সূর্য, যার ছোঁয়ায় প্রতিটা রান্নাঘরের কালো ধোঁয়া কেটে যাবে। মেয়েদের জীবন আর ঠিক করে দেবে না পুরুষেরা। তারাও নিজেদের ইচ্ছেমতো বিষয় নিয়ে পড়বে, নিজেদের পছন্দের ক্ষেত্রে চাকরি করবে, ঘুরতে যাবে ইচ্ছেমতো। মেয়েরা স্বাধীন হবে। সব মেয়েরা।

এই আবেগ নিয়েই নারীবাদের পক্ষে কথা বলি।
তোমার কাছে হয়তো হাজারো ‘ইস্যু’র ভেতরে একটা।
কিন্তু আমার কাছে নারীবাদ মানে আবেগ। যে আবেগে হৃদয় ভরে আসে। আমার মত বাচাল মানুষও কথা ভুলে যায়। চোখের কোণে জল চিকচিক করে। সেরকমই এক নির্বোধ, দুঃসাহসী আবেগ।

চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
দেখি আমার দামাল, দজ্জাল, দুরন্ত মেয়েরা নারী হয়ে উঠেছে। হাতে হাত ধরে এগিয়ে আসছে।
সমাজের টমগার্লরা।

টিরেনযাত্রা

ট্রেনে বসে আছি। ১২টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম। লোকে ঘুম থেকে উঠে হাই তোলে, আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলি। যত ভোর ভোরই উঠি না কেন, এই নীল-সাদা পেষ্ট দিয়ে মিনিমাম আধ ঘন্টা দাঁত না মাজলে আমার ঠিক ঘুমটা ভাঙতে চায় না। তাই উঠতে লেট। ফলে খেতে লেট। ফলে বেরোতে লেট।
এইরকম সারি সারি ইকুয়েশন পেরিয়ে এসে ঝোলাকাঁধে জিভটিভ বের করে হাওড়া পৌঁছে দেখি, ট্রেনবাবু এসে হেঁহেঁপর্ব, ভদ্রতাপর্ব, মিষ্টিপর্ব শেষে চাপর্বে প্রবেশ করেছেন। মানে, আমার ভদ্রভাবে ট্রেনযাত্রার আশাটুকু ওই মিষ্টিসাঁটানো প্লেটে পড়ে থাকা রসের মতোই অকিঞ্চিৎকর।
উঠলাম জেনারেল কামরাতে। দেখি কত্তো ফাঁকা সিট! মনে হল, আহা, দুনিয়ায় এখনো ভালো মানুষ আছেন, ভগবান আছেন,যারা সান্তাক্লস আছেন, এমনকি জানালা দিয়ে তাকালে বোধহয় দু-চারটি কল্পতরু গাছটাছও দেখতে পেয়ে যাব! আহ্লাদী গলায় সামনের কানল্যাজাসমন্বিত তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা এই সিটটায় কি কেউ আছে?”
তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে এককথায় উত্তর দিলেন, “রিজার্ভেশন।”
ব্যাস। হয়ে গেল। চুপচাপ নেমে পড়লাম। দেখি, এটা সবে ডি-১। বুঝলাম, ডিল্লি অভি দূর হ্যায়। রেল কোম্পানির নিয়মটা আবার উলটো। পিছিয়ে পড়া, সর্বহারা মানুষের জন্য জেনারেল কামরা আর উপরের স্তরের মানুষদের জন্য রিজার্ভেশন। তাই, জেনারেল কামরাগুলোও পেছনদিকে পড়ে আছে অবহেলায়।
ডি-১ থেকে ডি-৭ পাড়ি দিলাম। পৌঁছে দেখি, ভর্তি। খুব স্বাভাবিক।এটার নিয়মটা খুব ঠোঁটকাটা। ট্রেন স্টেশনে হাজিরা দেবার আগেই তোমায় হাজির থাকতে হবে।নিজের রুমাল, নিউজপেপার, বোতল, ব্যাগ, দরকার হলে জাঙ্গিয়া (যা কিছু জানালা দিয়ে গলে যাওয়া সম্ভব) ট্রেন দাঁড়াবার আগেই সিটে রাখতে হবে। নইলে ফক্কা!
উঠে বাথরুমের কাছে দাঁড়ালাম। উল্টো গেটের সামনে লুঙ্গি পেতে বসে থাকা ফুল ব্যবসায়ী আমাকে একটু ফ্রি উদেশ প্যাকেটে মুড়ে ধরিয়ে দিলেন—
ফু- আপ ইঁহা খড়া মত রহিয়ে। দুসরে কমরে মে দেখিয়ে না!
আ- দেখেছি। নেই। (বাংলাতেই)
ফু- আপ যাইয়ে একবার দেখকে তো আইয়ে। নেহি দেখেঙ্গে তো মিলেগা ক্যায়সে? ‘বিকলাঙ্গ’ মে যাইয়ে!
আ- দেখেছি গো! ওটাও ভর্তি!
ফু- সব অ্যারাগ্যারা আদমি ওঁয়াহা ব্যৈঠা রহতা হ্যায়! আপ যাকে বোলিয়ে, উঠ যায়েগা!
[কথাটা সত্যি। যত আজেবাজে লোকে জায়গাটা ভর্তি থাকে। কিন্তু, আমার বদভ্যাসের দরুণ আমিও সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরিনা। কাজেই আমারও কোনো ভ্যালিড গ্রাউন্ড নেই।]
আমি আর বকবক না করে চুপচাপ মেঝেতে বসে পড়লাম। লোকটা বোধহয় এটা ঠিক হজম করে নিতে পারলো না, তাই পিটপিট করে খানিকক্ষণ দেখল। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে ছিলাম অবশ্য। প্রায় তিন ঘন্টা নীচে আনন্দবাজার ছাড়াই একটা হাফ নোংরা শার্ট আর ততোধিক নোংরা জিন্স পরে মাটিতে বসে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেন একটাও আধুলি ফেলে গেল না, এটা আমাকে ভাবাচ্ছিল। পরে অবশ্য বুঝলাম, নতুন জুতোটাই একমাত্র কারণ।
যাই হোক, উপার্জনহীনতার দুঃখ মনেই চেপে রেখে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। লোক-টোক দেখলাম(ওই বাথরুমের সামনে না বসলে আপনি কোনোদিনই ভ্যারাইটি লোক দেখতে পাবেন না), গান শুনলাম, পোকেমন দেখলাম।
হ্যাঁ, এই পোকেমন দেখাটা নতুন নেশা। পোকেমন গো গেমটা যখন বেরোলো, তখন থেকেই। গেমটা বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলছিলাম তখন। লোকে অবশ্য পুঁজিবাদী-টুঁজিবাদী বলে প্যাঁক দিচ্ছিল টুকটাক। কিন্তু নিন্দুকদের কথায় কান দিয়ে আর কে কবে বড় কাজ করতে পেরেছে! ওসব শুনতে নেই। হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যাওয়া লোকের পর্যন্ত ইস্পেশাল দুব্বলতা থাকে, আর আমি তো নেহাত চুনোপুঁটি! তাই, পোকেমন সিরিজ দর্শন।
কিন্তু, মানুষের অন্যের সুখ সহ্য হয় না। একটা সময় লোকটারও সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল আমার এই নির্লিপ্ততা। আমাকে বলল, ‘চলিয়ে ম্যাঁয় আপকো সিট দিলাতা হুঁ।’ চোখেমুখে আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখে বাধ্য হয়ে বললাম, ‘চলিয়ে’।

সেই থেকে এই সিটে বসে। একখানা বিস্কুট প্যাকেট ওঠার আগে ব্যাগে পুরতে পেরেছিলাম, তাকেই সসম্মানে পেটে ঠাঁই দিলাম। কিন্তু তাতেও হলো না। সময়ও কাটছে না, তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে খিদেও পাচ্ছে। কেমনতরো ট্রেন রে বাবা! অন্য ট্রেন হলে ছঘন্টায় মিনিমাম ছটা ঝালমুড়ি উঠতো। এটাতে তিনখানা জুতো পালিশ আর তিনখানা ইঁদুরের বিষ উঠেছে।
খিদের জ্বালায় দ্বিতীয়টাকেই ডাক দেবো কিনা বিবেচনা করছি, এসময়েই দূর থেকে একখান মধুর ডাক কানের গলিতে ঠুনঠুন করে রিকশার ঘন্টি বাজাতে বাজাতে মরমে প্রবেশ করল। মরমে যেন মলমের প্রলেপ বইয়ে দিলো কেউ। শুনতে পেলাম— “লেবু-মশলা-সরবত, অ্যাই লেবুউউ-মশলা-শঅঅরবঅঅত! পাঁচ টাকা!
আহা! চটপট প্রণাম ঠুকতে গেলাম খাবারের দেবতা কে। কিন্তু, নামটা আর হাতড়ে খুঁজে পেলাম না! শেষে মদনদেবকেই প্রণাম জানালাম করজোড়ে! এই চরম খিদেও তো কামের মতই তীব্র দেহজ চাহিদা, নাকি! আর, রঙিন পানীয়র ব্যাপার যখন, তখন উনিই প্রাথমিক পছন্দ।
ডাকলাম সাততাড়াতাড়ি। হেলতে দুলতে তিনি এলেন। সঙ্গে সঙ্গে, ভিড় রেলকামরার ইন্ডাকশন সূত্র অনুযায়ী আরো পাঁচখানা নোলা এগিয়ে এল। তাদেরও চাই!
বাবু তাঁর রহস্যময় ডিব্বার নল খুলে একখানা মোটা কাগজের কাপ ভর্তি করে দিলেন পানীয়ে। পয়সা নিয়ে চলে গেলেন। টাটানগর স্টেশনে তখন ট্রেনবাবু জিরোচ্ছেন।
আমিও এই তাল বুঝে পানীয়তে চুমুক দিলাম। আহা। ঠান্ডা। মশলাদার। মিষ্টি মিষ্টি। সোডা বা শরবতের প্রতিটি গুণ বিদ্যমান।
ধীরে সুস্থে পুরো কাপ শেষ করে শান্তি পেলাম! দেখলাম কাগজের কাপ, তাই অসীম দক্ষতায় এবং প্রশান্তিতে কাপটাকে মুড়তে মুড়তে এইটুকু করে ফেল্লাম। তারপর টুক করে ফেলে দিলাম ট্রেন আর স্টেশনের মাঝে।
পেট আর জিভ ঠান্ডা হওয়া মাত্রই কেমন একটু খটকা লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় ভুলটা হচ্ছে। মানিব্যাগ বের করে দেখলাম, ঠিকঠাক টাকাই দিয়েছি। দশের বদলে একশোর নোট দিইনি। তবে?

ট্রেন নড়তে শুরু করল। ট্রেন চলতে শুরু করল। স্টেশন ছাড়তে শুরু করল।
তখন শুনতে পেলাম, জানালা দিয়ে ডাক ভেসে আসছে—
“অ্যাই লেবু-মশলা-চা! অ্যাই গরম মশলা চা! পাঁচ টাকা!”

যৌনতা

জীবনের প্রথম দশকের মধ্যেই যৌনপ্রশ্নগুলোর সমাধান সহজভাবে শিশুর কাছে রাখতে না পারাটা একটা দাম্পত্য অক্ষমতা হিসেবে ধরা উচিত। এই ‘পাকা’ প্রশ্নগুলির আপাতসরল কৌতূহলের পেছনে যে কী অতলান্তিক অস্থিরতা লুকিয়ে থাকে, তা বয়সের আতিশয্যে পরিবারের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অনুধাবন করে উঠতে পারেন না। সম্ভবও নয়। দ্বাদশ শ্রেণির ক্যালকুলাসরত ছাত্র যেভাবে চতুর্থ শ্রেণির ত্রৈরাশিক দেখে অজান্তেই নাসিকা কুঞ্চিত করে ফেলে, সেভাবেই তাঁদের অবচেতনেই অবজ্ঞাভাব প্রভাব বিস্তার করে। যৌনাঙ্গকে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ থেকে পৃথক করে দেখার অসমতা এখান থেকেই শুরু হয়। সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির ওপর বাধানিষেধের বেড়া শুরু হয় কোনোরকম কৌতূহল নিরসনের চেষ্টা না করেই। এই আপাতসরল দমননীতির মধ্যে দিয়েই শিশুর প্রথম মানসিক পরিবর্তন ঘটানো হয়। সে মলত্যাগ, মূত্রত্যাগকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে শেখে। লোকদৃষ্টির আড়ালে তার জননাঙ্গকে রক্ষা করার এক মনোভাব গড়ে ওঠে, যা আসলে ক্ষতিকর। এইভাবে প্রথম কয়েক বছর নিজের দেহের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় কিছু অসম্পূর্ণ,অর্ধসত্য ধারণা গড়ে ওঠে এবং বারংবার পিতামাতার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কৌতূহলগুলিকে ভাষা দেওয়া বন্ধ করে।
এর পরবর্তী ধাপটি আরো ক্ষতিকর হয়। শিশুর কাছেও, এবং সমাজের কাছেও। এই পর্যায়ে শিশু বিপরীত লিঙ্গের পরিচিতি পায়। বিপরীত লিঙ্গের ধারণা প্রাথমিক বছরগুলি থেকেই বিদ্যমান থাকলেও সেই লিঙ্গের নিজস্বতা সম্পর্কে প্রশ্নগুলি এই বয়স থেকেই উঁকি দিতে শুরু করে। অপর লিঙ্গের প্রতিনিধিদের যৌনাঙ্গ, অন্তর্বাস, কিছু ক্ষেত্রে রজঃস্রাব ইত্যাদি সম্পর্কে অপধারণা গড়ে উঠতে থাকে। এবং আমাদের সমাজব্যবস্থা প্রতিটি ধাপে এই অপধারণাকে প্রশ্রয় দেয়। কখনো জ্ঞাতসারে, কখনো বা অজ্ঞাতসারে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করার উন্নাসিকতা দেখিয়ে সমাজ প্রয়োজন বোধ করে না তাকে কোনোরকম যুক্তিসম্মত বোধপ্রদানের। বরং খুশি রাখতে চায় সামান্য মোহকথায়। এটাই কালনীতি হয়ে দাঁড়ায়। এবং বিকৃতকামের ধারণা গড়ে ওঠে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।
বয়স আসে আত্মরমণের। অপর লিঙ্গ সম্পর্কে এক আড়ষ্ট, অসম্পূর্ণ এবং একমুখীন দৃষ্টিভঙ্গি ততদিনে মননে-চিন্তনে গেঁথে যায়। চিরাচরিত ভুল-ঠিকের ধারণা সমাজ প্রবেশ করিয়ে দেয় অন্তরে এবং মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। অসহায় সেই মানবশিশু যৌনতাকে কেবলই উপভোগের দৃষ্টিতে, কেবলই নিষিদ্ধতার ছায়ায়, কেবলই লজ্জার আলোআঁধারিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তার বাসনা হয়ে পড়ে কেবলই শরীরকেন্দ্রিক। তমোগুণের যৌনআকাঙ্খা তার সম্ভাবনাগুলিকে একে একে হত্যা করে। স্বাভাবিকতার কামনা হারিয়ে গিয়ে লালসাপূর্ণ রতিক্রিয়াই তখন মোক্ষ হয়ে ওঠে।
যৌনতা তখন কেবলই এক সাদা-কালোর দ্বিমুখীন পথে পরিণত হয়।

যৌনতা, তুমি বর্ণময় হয়ে উঠতে পারলে না?

কেয়ামত

আমরা সবাই স্বপ্ন আর লক্ষ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। তারপর সেটাকে নাড়াতেই থাকি। অনেকক্ষণ ধরে। আর টেস্টটিউবের নীচে যে থকথকে অপ্রাপ্তিগুলো জমে থাকে, সেগুলোকে যতই খোঁচা মারি, মিশতে চায় না। নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের অভিমানে একঘরে থাকতেই পছন্দ করে।
তারপর হঠাৎ একসময় খেয়াল করি, সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। ঘাড় ওঠাই ঘড়ির দিকে। ঘড়িটা হোহো করে হেসে ওঠে। তখনই আশেপাশের সব লোকগুলোও তাদের টেস্টটিউব হাতে নিয়ে হোহো করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে।
আমি খুব ভয় পেয়ে দেখি, সবার হাতে ধরা তরলের রঙ গোলাপি। গাড় গোলাপি।
আমারটা হাত থেকে ঠকাস্ করে পড়ে ভেঙে যায়।

চোখ বন্ধ হবার আগে দেখতে পাই, জানালার বাইরেও আস্তে আস্তে গোলাপি পরত পড়ছে।