কাকস্নান

শীতকালে স্নান করার আটটি সহজ ধাপ:

এই পুরো ঘটনাক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশটি প্রথমেই রয়েছে। বিভিন্ন হিতৈষীগণ বলে থাকেন, তুরুপের তাস নামক মহার্ঘ্য বস্তুকে লুকিয়ে রাখতে হয় শেষপর্যন্ত। আমি আবার কূটকৌশলে কোনোদিনই তেমন পটু হয়ে উঠতে পারিনি, তাই ও আনন্দের স্বাদ আমার নাগালের বাইরে। তাই প্রধান নির্দেশটি প্রথমেই বলে দিই।
১২ দিন স্নান করবেন না। আপনি যদি এবিদ্যায় শিক্ষানবিশ হন, তবে ১০দিনেও নামতে পারেন। তবে তার কম কোনোমতেই না! ১২,১৪,১৫ যা ইচ্ছা হয় আপনার। যত দিনবৃদ্ধি, তত বেশি আনন্দ। আহা, ১০-১৫ দিন নির্জলা না থাকলে আপনি বুঝবেন কী করে যে, শীত আদৌ এসেছে কি না! আশেপাশের জীবকূলই বা তা টের পাবে কেমনে! আমার ২০ দিনের কৃতিত্বটি অতিক্রম করার দুঃসাহসও করে দেখতে পারেন। পারলে একখানা অতি কার্যকরী গন্ধ-বিতাড়ক আতর পুরষ্কারস্বরূপ দান করব।

এইবার আসুন, পরের ধাপে যাই। একটু কষ্ট করতে হবে আপনাকে এবার। শত অজুহাতের ঝুলি থেকে একটি গ্রহণ করুন। কোনো ব্যক্তি আপনার স্নানসাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেই এই হাত ছুঁড়িয়া মারবেন সপাটে। অজুহাত হতে পারে আপনার শয্যাসঙ্গিনীরূপী অলসতা, আপনার প্রিয় পোষ্য ঠান্ডার ধাত, বা নিতান্তই প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য মাথাব্যথা/জ্বরের অজুহাত। শেষেরটির ক্ষেত্রে সাবধান! চোখ কচলিয়ে লাল করে, চুল উস্কোখুস্কো করে, গলা সরু করে, ‘বাইরে সত্যিই বরফ পড়ছে’ বুঝিয়ে ওঠাবার ক্ষমতা রাখলে তবেই ও পথে পা বাড়ানো শ্রেয়। অজুহাত দিয়েই যান। দিয়েই যান। দিয়েই যান। তারপর, একসময় আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার দূর্গের প্রাচীর ধ্বসে পড়ছে। কামানের গোলা প্রতি বাক্যবর্ষণে আগুন ঝরাচ্ছে। মনে মনে বুঝবেন, সময় হয়ে এসেছে।

পরের ধাপ। সংগ্রাম। হ্যাঁ সাথী, এসময় বসন্তের নয়। শীতের। তাই এবার সংগ্রামের প্রস্তুতি নিন। আপনার বসতবাটী কীপ্রকারের?
যদি ঘর হয়, আপনার প্রতিপক্ষ আপনার আপন মাতা। হ্যাঁ বন্ধু, যে মাতা এতদিন স্নেহ ও প্রশ্রয়ের চক্ষে আপনাকে সহ্য করে চলেছিলেন, আজ তিনি ব্রুটাসরূপ ধারণ করবেন। এই যুদ্ধে তাঁর সাথে পদাতিক বাহিনী হিসেবে চোখপাকানো পিতা, হাইজিনিক জেষ্ঠ্যভ্রাতা, ফোড়নকারী কনিষ্ঠ ভ্রাতারা থাকতে পারেন। থাকিতে পারেন খুন্তি, চপ্পল, কড়াই, বেলনা প্রভৃতি রথী-মহারথীরা। পাঠক, সাবধান! এই যুদ্ধে আপনার পরাজয়ের সম্ভাবনা প্রবল। আপনার প্রধান বাধা হইয়া দাঁড়াতে পারে আপনার নিজস্ব দ্বান্দ্বিক মন। চারিদিকে ফরসা পরিস্কার মানুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ মনোবল হারানোই হতে পারে আপনার দূর্গ পতনের শেষ বিভীষণ।
যদি ছাত্রাবাস হয়, তবে আপনি কিছু সুবিধা পাবেন। ছাত্রাবাস। নামেই প্রকট, এই স্থানে কেবল ‘বাস’যুক্ত ছাত্ররাই থাকে। তাই আপনার আশেপাশের সহমর্মী মানুষগুলির গন্ধে আপনার কীর্তি লোকনাসিকার আড়ালে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। তাও, একসময় আপনার পাতের শাক শেষ হয়ে যাবে। আপনার পচনশীল মৎস্যটি লোকসমক্ষে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। তখন আপনাকে হতচকিত করে আশেপাশের বিনম্র বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষগুলি হুঙ্কারপ্রদানকারী মাংসাশী ব্যাঘ্রে পরিণত হবে অকস্মাৎ।
আপনার এই হতবাক হওয়াই নির্স্নান জীবনে আপনার শেষ অনুভূতি।

পরের দৃশ্য। আপনি পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলতে বাধ্য হবেন। পাঠক, লজ্জিত হবার কোনোরূপ কারণ নাই। ধবধবে নোংরা গামছাখানি দড়ি হইতে বিচ্যুত হয়ে চরিত্রের কোমরে স্থান পেয়েছে এতক্ষণে। ‘ধবধবে নোংরা’ শব্দবন্ধটি বিশ্লেষণ করে দিই জনস্বার্থে। ধবধবে, কারণ ১৫ দিন আগে আপনি উহা কেচে পরিষ্কার করে দড়িতে দোদুল্যমান করে রেখেছেন। কিন্তু নোংরা, কারণ এই ১৫ দিনে আপনি বেচারার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই।
যাই হোক, আপনি গামছা পরিধান করে ফেলুন। এবার একটু প্রতিশোধের পালা। চলভাষে ‘মাই নেম ইজ শীলা’ গানটি চালিয়ে বগলদেশ উন্মুক্ত করে খানিক নাচ করে আসুন সেই পাষণ্ড ব্যক্তির সামনে, যার জন্য এই সাইবেরিয়াসম শহরে আপনাকে স্নানদন্ডাদেশ মাথা পেতে নিতে হয়েছে। তাকে জড়িয়ে ধরে এক পোঁচ কালো গা গায়ে ঘষে সোহাগ করুন। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নাকভরে নিজের দেহের গন্ধ নিন আর মুখ বিকৃত করে ‘আহ্’ বলুন।

পরবর্তী ধাপ, পলায়ন। স্বাভাবিক, নয় কী? মরণশীল মানুষ মাত্রেই আপনার পশ্চাদ্ধাবন করবে এই অবস্থায়। আপনি গামছা সামলে (বা না সামলে) দৌড় দিন আপনার নিয়তি অভিমুখে। গামছা না সামলানো আপনার পক্ষেই যাবে, সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না।
স্নানঘরের চৌখুপির নিকটবর্তী আসামাত্র দৌড়ের গতিবেগ কমিয়ে দিন। রঙ্গরসিকতা অনেক হয়েছে। এবারে জীবনের এই গভীর সমস্যা আপনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে ফেলুন। ভুরু কুঁচকে নিন। মুখে কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলুন। মনে রাখবেন সাথী, ইহা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কিছুই নহে।

এরপর স্নানঘরের দরজার সম্মুখে। একবার করুণ চোখে দেখে নিন জানালা দিয়ে আসা একফালি রোদ, ইউরিনালের সেই সুমধুর গন্ধ নাক ভরে নিয়ে নিন— কারণ আপনি এই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবেন কী না তা নিশ্চিত নয়। শেষমুহূর্তে চোখ বন্ধ করে হিসেব করে নিন জলের তাপমাত্রা, মেঝের তাপমাত্রা, শাওয়ারের হাতলের তাপমাত্রা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি।
তারপর ঢুকে পড়ুন স্নানচেম্বারে।

পরবর্তী ধাপ। ধাপ না বলে ধপ্ বলাই ভালো। মর্ত্য থেকে আপনার পতন ঘটবে নরকে। এইপ্রকার নরকে আপনাকে সোয়াবিন তেলের বদলে পরিশুদ্ধ গলনশীল বরফে চুবোনো হবে।
ইংরিজিতে একখান শব্দ রয়েছে। Acclimatization। এখানেও সে জিনিসটি করা খুব প্রয়োজনীয়। পাঠক, চোখ বন্ধ করে ফেলুন।
গামছা ঝুলিয়ে দিন কোথাও একটা। আর আপনি নগ্নদেহে উপভোগ করুন শৈত্যপ্রবাহের চুম্বন। দরকারে দুএকবার লাফিয়ে নিন। শাওয়ারের ঝারি থেকে কোন কৌণিক পদ্ধতিতে শীতল মৃত্যু নেমে আসবে আপনার দেহে, দেখে নিন। হাত দিয়ে ঘষে শাওয়ারের হাতলের উষ্ণতা বাড়িয়ে নিন।

এবার।
পদার্থবিদ্যা কী বলে? বলে, ঘর্ষণে তাপ সৃষ্টি হয়। আরো বলে, কার্যের ফলে তাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই চৌখুপিতে কী কার্য সম্ভব?
আমি জানি, আপনি জানেন।
শাওয়ারের হাতল ঘুরিয়ে দিন একঝটকায়। কোনোমতেই যেন ধীরগতিতে জল না পড়ে আপনার দেহে। আপনি কষে চোখ বন্ধ করে ফেলুন। মনে করুন, এটা বিজয়া দশমীর রাত। স্নানঘর নয়, এটা আসলে প্রতিমা বিসর্জনের ট্রাক। আর উপরে ওটা পায়রাসমেত ঘুলঘুলি মোটেই নয়, বাড়ির জানালা। সেখান থেকে আপনার প্রেমিকা তাকিয়ে আছেন।
উপর থেকে ঠান্ডা নেমে আসুক। আপনি পায়ের তালে স্নানঘরের মেঝে থেকে তাপ উৎপন্ন করুন। একসময়, অনুভব করতে পারবেন, দুইদিক থেকে উৎপন্ন দুই শক্তি আপনার নাভিতে এসে একে অপরকে শূন্য করছে।
এটা একটা সংকেত। আপনার তিননম্বর শক্তিকে রণক্ষেত্রে পাঠানোর। আপনার গর্দভকন্ঠকে দড়িছেঁড়া ছাগশিশুর মতো কচি মাঠে ছেড়ে দিন। পিঠে বর্ষার মত বারিধারা ঝরে যাক আর আপনি মনের সুখে গাইতে থাকুন— “ঝুমকা গিরা রে/বরেলি কে বাজার মে ঝুমকা গিরা রে”! আপনি যেহেতু আর কোনো কথা জানেন না এই গানটার, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান সুরে এই একই পংক্তি গেয়ে যান। আপনার বৈচিত্র্যময় কন্ঠকে সপ্তম সুরে চড়িয়ে গাইতে থাকুন। আশেপাশের সবাইকে জানিয়ে দিন আপনার স্নান করার শুভমুহূর্তের কথা। বৈচিত্র্যের জন্য কথা পাল্টে গেয়ে নিন— “ঠান্ডা গিরা রে/কলকাত্তা কে বাজার মে ঠান্ডা গিরা রে!” নেচে নেচে গাইতে থাকুন। স্নানের আনন্দে আত্মহারা হয়ে গাইতে থাকুন আর হাত ঘষতে ঘষতে দেহের যাবতীয় আবর্জনা সরিয়ে ফেলুন।

শেষ ধাপটা আপনি বুঝতে পারবেন না। ঠান্ডা জল যখন গাসওয়া হয়ে যাবে, তখন গান-নাচ-স্নানের আনন্দে সময় কোথা দিয়ে পেরিয়ে যাবে, বোঝা যাবে না। হঠাৎ আপনাকে হতচকিত করে দিয়ে দরজায় ক্রুদ্ধ আঘাতের ঘনঘটা শোনা যাবে। বাইরে থেকে শুনবেন, আপনার কাংস্যবিনিন্দিত কন্ঠের জেরে কপু আসছে অাপ্যায়ন করে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যেতে।
তখন আপনি শাওয়ার বন্ধ করবেন। গামছা নিয়ে সারাদেহ রগড়ে রগড়ে মুছবেন। এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন সাথী, আপনি পরবর্তী ১৫ দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই মহান কার্য সমাধা করার পর আপনি রাজার মতো চালে বেরিয়ে আসবেন স্নানঘর থেকে। তারপর ৩২ পাটি দাঁত বের করে একখানা রাজকীয় হাসি ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকবেন।
ঘরের লোকজন নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রূপের দ্বারা আপনাকে উত্তেজিত করার হীন চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু আপনি তখন সপ্তম স্বর্গে।

গামছা খুলে নতুন জামাকাপড় পরে ফেলুন।
স্নান করার অনির্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করুন জানালার ধারের মিষ্টি রোদে বসে।
আপনাকে স্বাগত আমাদের P.A.N.I (Person Water No Interaction) গ্রুপে!