একটি পৈশাচিক গল্প

দৃশ্য ১:

সতীশের বাবা বিরাট উকিল। বিরাট মানে, সত্যি বিরাট। পাতি পাবলিকের গাদাগুচ্ছের অ্যাপয়েন্টমেন্টের দরখাস্তগুলো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায় তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো কালো কাঁচের ভিআইপি গাড়িগুলোকে দেখে। কোর্টে দাঁড়িয়ে যখন তিনি গলা ঝেড়ে ‘ইয়োর অনার!’ হাঁক দেন, তখন শুধু আসামী না, জজের বুকটাও একটু কেঁপে ওঠে।

এতোক্ষণ তাঁর কাজের পরিচয় পেয়ে চোখের সামনে যে মানুষটা ভেসে উঠছে, রমণীমোহনবাবু ঠিক সেরকমই। লম্বা-চওড়া, ফিটফাট, মুখে সবসময় ধমক, আর বাড়ির বারান্দা দিয়ে যখন হেঁটে যান তখন পিঁপড়েগুলোও ভয়ে ফুটোতে ঢুকে পড়ে। এমনকি, লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার ওপারে বসে বাবার গাঁদাঝোলানো ছবির সামনে যখন বাঁহাতে সাদা খামগুলো নেন, তখনও মুখে গাম্ভীর্য ছেয়ে থাকে।
তা এমন মানুষকে ছোটোবেলা থেকে চোখের সামনে দেখলে অন্ধ অনুসরণ ছাড়া আর উপায়ই কী! বিশালত্বের মুগ্ধতায় বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে ট্রাইসাইকেল চালানোর বয়স থেকে জ্যান্ত সুপারম্যানকে দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া সতীশ তাই কখনো মুখ ফুটে বলে উঠতেই পারলো না যে, তার ইংরেজি সাহিত্য পড়তে খুব ভালো লাগে। সেটা নিয়ে পড়তে পারলে তার খুব ভালো লাগবে।

বলতেই পারলো না। তাই, ২৪ বছরের সতীশ এখন নামীদামী কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করে বাবার জুনিয়র হয়েই কোর্টে যায়। কালো কোট আর মোটা বইয়ের তাগাদায় শেলী-কীটসরা কীটদের কবলে পড়েই প্রাণ হারিয়েছে।
যাই হোক। একদিন কোর্ট থেকে ফেরার সময় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মরে আসা বিকেলে গাড়ির নরম গদিতেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা উঠলো। গাড়ির ড্রাইভার, ওহ্ সরি, শোফার নিপুকাকা রাস্তার দিকে চোখ রেখে যেটুকু শুনতে পেয়েছিল, সেটুকুই তুলে দিলাম—
– “তোমার বিয়ের কথা চলছে, বুঝলে? তোমার মা মেয়ে-টেয়ে দেখছেন।”
– “বিয়ে? এখনিই? হঠাৎ?”
– “হঠাৎ মানে! চল্লিশে গিয়ে বিয়ে হবে নাকি!
তোমার আপত্তির তো কোনো কারণ দেখছি না।”
– “ইয়ে..
– “কি? কোনো মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছ নাকি? তাই বলি, কদিন ধরে ব্রিফগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না কেন!”
– “না না বাবা! ওসব কিছু নয়! সেরকম কেউ নেই।”
– “না থাকলেই ভালো। যাকে-তাকে তো ধরে এনে ফ্যামিলিতে ঢুকিয়ে দিতে পারি না!”

ব্যাস। সতীশের মা মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। সতীশ প্রতিদিনের মতো কোর্ট যেতে লাগল। কথাটা সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
দৃশ্য ২:
নিকিতা খুব ভালো মেয়ে। মা-বাবার খুব বাধ্য। পড়াশুনো করে, গান শেখে, ওরিগ্যামি শিখেছে নিজের উৎসাহে। কেবল তার একটাই লজ্জা। সে কালো। আর, কালো মেয়েদের যে বিয়ে হওয়া মুশকিল, একথা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে।
তাই সরকারি চাকুরে ভালোমানুষ বাবার কাঁধের বোঝা হবার লজ্জায় সে চেষ্টা করে যতটা সম্ভব লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে। তার জীবনে ছেলেবন্ধু নেই, প্রেম নেই, সিসিডি নেই, সাউথ সিটি নেই। শুধু আছে হলুদ, দই, বেসন আর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির একগাদা চ্যাপটা টিউব।

অাশ্চর্যজনকভাবে, নিকিতাদের দোতলা বাড়ির সামনেই একদিন রমণীমোহনের হুন্ডাইটা এসে ঘ্যাঁস করে দাঁড়ালো। অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার! কোথায় হাইকোর্টের দুঁদে উকিল রমণীমোহন সমাদ্দার, আর কোথায় রাইটার্সের সামান্য অফিসার প্রতাপ ভট্টাচার্য!
প্রতাপবাবুও প্রথমে খবরটা পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলেন। আনন্দবাজারে গত তিনমাস ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সাড়া যে পাচ্ছিলেন না তা নয়, কিন্তু কোনোটাই আর পাকাপাকি স্থির হচ্ছিল না। কারও হতাশা ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’ মেয়েকে ‘শ্যামবর্ণা’ মনে হওয়ায়, কারও নাকউঁচু গয়নার ভরিগুলো কম হওয়াতে, কারও বা ‘পরে খবর দেব পছন্দ হলে’ বুলিতে স্পষ্ট ভদ্রতায় মোড়া প্রত্যাখানের ছাপ।
হঠাৎ রমণীমোহনের ফোন, সামান্য কিছু খোঁজখবর আর ডেট ফিক্স করে মেয়ে দেখতে আসা! অবশ্য ডেট ফিক্স করার কিছু ছিল না। রমণীমোহন ‘তাহলে ৬ তারিখ বিকেল ৫টায় আপনার ঘরে আসছি’ আর ‘রাখলাম’ কথাদুটোর মধ্যে বেশিক্ষণ ফাঁক রাখেননি।

যাই হোক। কথা হলো, সিঙাড়া হলো, মেয়ের গান হলো, ওরিগ্যামির কাজ দ‌েখা হলো। উকিল সাহেবের মেয়ে পছন্দও হলো। তার আসল কারণটা কী, জানা ভারি মুশকিল!
মেয়ের গায়ের রঙের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা টাকার থোকটা কল্পনা করে, নাকি যৌবনের কাঁচামাথার প্রেম কালো হরিণ চোখের কথা মনে পড়ায় মন দুর্বল হয়ে গেছল, তা জানা যাবে না হয়তো কোনদিনই।
দৃশ্য ৩:
বিয়ে হল। ধুমধাম হল। প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে বৌ নিকিতার গাভর্তি গয়না হলো। সতীশ ওয়েডস নিকিতা লেখা গাড়ি হলো। উকিলবাবুর ক্লোজ সার্কেলে ঢুকুঢুকু হলো। বাসররাতে আদিরসাত্মক চুটকি হলো। অর্থাৎ, যা যা হবার তাই হলো।
সতীশ কী চায়, সেটা অবশ্য কেউ জানতে চাইল না। প্রয়োজনও ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই তাকে নতুন খেলনা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পেয়েছে, তাই খেলনা পেয়ে ভুলে থাকতে সে জানে।

নতুন বিয়ের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। অন্তত উপর উপর দেখলে তাই মনে হতো। সতীশের গালে নতুন চেকনাই, নিকিতার মুখে ঝুলিয়ে রাখা হাসি আসল অবস্থাটা কিছুতেই কাউকে বুঝতে দিতো না।
রমণীমোহনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজকে কপি করতে চাওয়া সতীশ যে কীরকমভাবে নিজের সারাজীবনের ফ্রাস্টেশনগুলো বের করতে পারে, বন্ধ বেডরুমের দরজাটা ছাড়া সেকথা আর কেউ জানতো না।
কথায় কথায় বিদ্রূপ, গায়ের রঙ নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় ব্যঙ্গ আর হাসি, পান থেকে চুন খসলেই মানসিক নির্যাতন এসব তো চলতোই। ভদ্রবাড়ির ছেলে তো, শারীরিক নির্যাতন সরাসরি কখনোই করতো না। সেটা শুরু হতো রাতের বিছানায় বিভিন্ন পজিশন আর বেশ্যার মত নিকিতার দেহকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে, আর শেষ হতো সকালবেলা বাথরুমের দরজার ওপারে নিকিতীর নিশ্চুপ কান্নায়। তারপর, কান্না মুছে, হ্যাঙ্গার থেকে ব্রেসিয়ারটা আর মুচকি হাসিটা নিয়ে পরতো— এভাবেই দিন শুরু হতো তার।

এরকমই চলছিল। থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। একবছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। নিকিতার ওজন আর চোখের কালির পরিধির সঙ্গে সতীশের কেরিয়ারের উন্নতি সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলল।
এবার একটা নতুন দিক থেকে চাপ শুরু হল। রমণীমোহনের ইচ্ছে হল একটি নাতিলাভের। কে জানে, তাঁর হয়তো পরিবারে আরেকজন উকিল প্রয়োজন ছিল। প্রথমে তিনি পুত্রবধূকে ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন। ইঙ্গিতগুলো প্রথমে মৃদু হলেও, আস্তে আস্তে কথাগুলো জোরের সঙ্গেই শোনাতে শুরু করলেন।
খাওয়ার টেবিলে অনাগত পৌত্রের নামকরণের আলোচনা, তার কেরিয়ার নির্ধারণের আলোচনাগুলোতে পরিবারের বাকি সবাই সোৎসাহে অংশগ্রহণ করতো, কেবল নিকিতা ভয়ে সিঁটকে থাকত এককোণের চেয়ারে।

এটাকেই বোধহয় পারফরমেন্স প্রেশার বলে, তাই না?
দৃশ্য ৪:
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নিকিতার পেটে ছেলে এল না। মেয়েও এল না। নামকরা নার্সিং হোমের গাইনিকোলজি স্পেশালিস্ট লেডি ডাক্তার বললেন, ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রবলেম আছে, তাই নিকিতা কোনোদিনই স্বাভাবিকভাবে মা হতে পারবে না।
মানে, ঠিক এতোটা সহজভাষায় বলেননি। কিন্তু মেডিক্যাল টার্মগুলো বাদ দিয়ে পাড়ার কাকিমাদের পিএনপিসি করার ভাষায় বললে এটাই দাঁড়ায়।
এরপর যা যা হবার তাই হলো। সবার থমথমে মুখ, শাশুড়ির গজগজ, শ্বশুরের খোঁটা আর সতীশের মুখখিস্তি সহ্য করে একদিন নিকিতা সতীশের হাত ধরে দাঁড়ালো ফার্টিলিটি সেন্টারের কাঁচের দরজার মুখোমুখি।
হলো না। কিছুই হলো না। অসংখ্য ম্যাগাজিন, এসি আর সাদা সাদা চেয়ারগুলোতে সিটিং আর অপেক্ষার পর যখন টেবিলের ওপার থেকে ‘অ্যাডপশন’ শব্দটা শুনতে পেল, তখনই নিকিতার মুখখানা একধাক্কায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

এরপর থেকেই কেমন যেন বদলে গেল ঘরের পরিবেশটা। সতীশ আর খারাপ ব্যবহার করে না, শাশুড়ি চুপ, রমণীমোহনকে তো দেখতেই পাওয়া যায় না। এমনিভাবে ২দিন,৩ দিন, এক সপ্তাহ চলে গেল। নিকিতা বুঝতে পারছিল এরকমই কিছু একটা হবে, কিন্তু এই দমবন্ধ পরিবেশে তার গা গুলিয়ে উঠছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে সে নিজের কপালের লিখনকে গালিগালাজ করতো, কান্নাকাটি করতো আর তারপরে নিজেকে ভোলাতে ডুব দিত ঘরকন্নার কাজে।
ঘরের অবস্থা যে কে সেই। মাঝে মাঝে ফুসফুস গুজগুজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে, সে ঘরে ঢুকলেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার সঙ্গে কেবল দরকারের কথাটুকু বাদ দিয়ে কোনো কথা হত না।
মাঝে একদিন হঠাৎ শাশুড়িমা তার সামনেই সতীশকে ডেকে বললেন, “রান্নাঘরের গ্যাসের নবটা একটু ডিস্টার্ব করছে, বুঝলি? একটু সারাবার ব্যবস্থা করিস তো।”
সময়টা সকালবেলা। সতীশ খেলার পাতা পড়ছিল। রমণীমোহন এডিটোরিয়াল। দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
সতীশ বললো, “আচ্ছা। দেখছি।”

তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা। নিকিতা ভাতটা সবেমাত্র চাপিয়েছে কি চাপায়নি, তার নাকে কেমন একটা গন্ধ লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে তার চোখে পড়ল, সিলিন্ডারের মুখটা কে যেন হাঁ করে খুলে রেখেছে! বাইরে খট্ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে। পাগলের মতো সে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
দরজা আর খুললো না।

কয়েক মিনিটের ব্যাপার। ঘরের ভেতর থেকে পাশবিক চিৎকারটা ১০ মিনিট মতন শুনে তবেই দরজা খুললেন রমণীমোহন। জল-টল সব রেডিই ছিল। আগুন নেভালেন কোনোমতে। তারপরে হাঁকডাক শুরু করলেন।
দৃশ্য ৫:
স্থান মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট। থার্ড সেমেস্টারের ছাত্রদের সার্জারি ওয়ার্ড চলছে। আজই প্রথম দিন। একদল অ্যাপ্রন পরা উৎসাহী ছাত্রছাত্রীকে পেছনে নিয়ে আরএমও ঢুকলেন। তাঁর পেছন পেছন দুজন পিজিটি, মানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি।
এসি চলছে। ঘরটা একদম ঠান্ডা।আরএমও এগিয়ে গেলেন তিন নম্বর বেডের দিকে। কেস হিস্ট্রিটা হাতে এগিয়ে দিলেন একজন জুনিয়র ডাক্তার।
পেছনের ভিড়টার দিকে ফিরে তিনি বলতে শুরু করলেন, “এদিকে তাকাও। এটা হচ্ছে একটা বার্ন কেস। এটা কত পার্সেন্ট বার্ন হয়েছে বলতো? কেউ জানো, কিভাবে শরীরে বার্নের পার্সেন্টেজ ক্যালকুলেট করা হয়?”
গোল গোল চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি একজন পিজিটির দিকে ইশারা করলেন। সে শুরু করল, “দ্যাখ, এটাকে রুল অফ নাইন বলে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মাথা ৯%, পুরো বুক নয় দুগুণে ১৮%, পিঠও ১৮%, হাত দুটো ৯% করে, প্রতি পায়ের সামনেটা ৯ আর পেছনেরটা ৯, আর শেষে পেরিনিয়াম মানে জেনিটাল এরিয়াটা ১%।” এই বলে সে থামল।
আরএমও তখন বললেন, “এই কেসে এটা ৯৯% বার্ন হয়েছে। জেনিটাল এরিয়াটা বেঁচে গেছে। আচ্ছা কেউ বলতে পারবে, এটা কতো ডিগ্রি বার্ন?”
একজন পড়ুয়া ছাত্র তখন পেছন থেকে উত্তর দিলো, “স্যার, এটা বোধহয় সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন। কারণ এপিডারমিস ডারমিস দুটোই পুড়েছে।”

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে কালো হয়ে যাওয়া বীভৎস দেখতে শরীরটা অনেক কষ্টে উঠে বসলো বেডের উপর। আত্মীয়স্বজন যারা বেডের পাশে ছিল, তারা চোখের জল মুছে তাকালো। গোঁগোঁ করতে করতে নিকিতা কীসব বলতে লাগল, কেউ বুঝে উঠতে পারল না। খুব কষ্ট করে কান পেতে বোঝা গেল, ও বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছে, “শাস্তি দিন ওকে ডাক্তারবাবু। পুড়িয়ে মারল আমাকে। আগুন আগুন। গোটা গা জ্বলে গেল। শাস্তি দিন ডাক্তারবাবু।”
এসবের মাঝে একজন ছাত্র অবাক হয়ে ফিসফিস করে ইন্টার্ন দাদাকে জিজ্ঞেস করল, “এতটা পুড়েও বেঁচে যাবে!?”
দাদা ঠোঁট উল্টে বলল, “না না। পাগল নাকি! আজই তো ভর্তি হল। কাল পরশুই ডিহাইড্রেশন বা সেকেন্ডারি ইনফেকশনে মারা যাবে।”
দৃশ্য ৬:
দুদিন পরের ঘটনা। নিকিতা মারা গেছে। নিকিতা এখন আর নিকিতা নয়। ঘরের লোকজনের কাছে ‘ও’, ডাক্তারদের কাছে ‘বডি’ আর ডোমদের কাছে ‘লাশ’। তো, সেই ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ এখন মেডিকেল কলেজের মর্গে।
রাতের বেলা। ঠান্ডা মর্গে নিকিতার ডেডবডি শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। হয়তো সে প্রতীক্ষা করছে এক সুন্দর সকালের। যেখানে তার চামড়া খসে যাওয়া বডিটা কেটেকুটে পোস্টমর্টেম করবে হেড ডোমরা, আর পাশে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকবেন ফরসা ডাক্তারবাবুরা।

হঠাৎ সেই মড়ার আর প্রতীক্ষা সহ্য হলো না। রাতের অন্ধকারে মড়াখেকো ইঁদুর আর নাম না জানা পাখির ডাককে সাক্ষী রেখে উঠে বসল সেই মড়া!
অপঘাতে মৃত দেহের সৎকারের পূর্বেই তার প্রেতত্বপ্রাপ্তি হলে সেই অতৃপ্ত আত্মাকে পিশাচ বলে। পিশাচেরা নিজের অপূর্ণ কাজ শেষ করার জন্যই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
সাদা মার্বেলপাথরের টেবিলের ওপর সোজা হয়ে বসল ভয়ঙ্কর এই প্রেতাত্মা। তার চোখের কোটরদুটো কালো। গোটা গায়ের চামড়া কিছু খসে পড়েছে, কিছু কালো হয়ে গেছে, আর কিছু জায়গায় রয়ে গেছে।
উঠে বসে সে একখানা হাড়হিমকরা চিৎকার করল! পাশবিক সেই চিৎকার লাল দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে গেল। শুনতে পেল শুধু একখানা কালো প্যাঁচা। সে তাল মিলিয়ে ‘হু-হু-হুউউউ’ করে চিৎকার করে উঠল।

এবার টেবিলের মড়া মাটিতে নামলো। সাদা চাদর হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল একদিকে। সে হেঁটে বেড়াতে লাগল মর্গের এদিক থেকে ওদিক। তার অস্থির দৃষ্টি যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটা জিনিস তার চাই, যার সাহায্যে তাকে তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতেই হবে। নইলে প্রেতদশা থেকে তার মুক্তি নেই।
খুঁজে পেল! খুঁজে পেয়েছে সে সেই জিনিস!
দেশলাইয়ের একটা বাক্স। বিকেলবেলা হেড ডোম শিবজী আর তার চেলারা বিড়ি ফুঁকছিল মনের সুখে এককোণে বসে। তারাই মনের ভুলে ফেলে গেছে।
বাক্সটা পেয়ে মড়ার চোখের কোটরে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠল।

সে দেশলাই বের করে তাকালো নিজের নিরাবরণ দেহের দিকে।
তারপর অক্লেশে পাশবিক এক প্রতিহিংসায় আগুন লাগিয়ে দিল নিজের যৌনাঙ্গে!
গোটা দেহে মাখিয়ে রাখা মোমজাতীয় পদার্থের প্রলেপের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে বিক্রিয়া করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তার দেহের একমাত্র অবিকৃত অংশটুকু।
পটপট শব্দে পুড়ে যেতে লাগল তার যৌনকেশরাশি।
রক্তজলকরা পাশবিক কন্ঠে সেই পিশাচ চেঁচিয়ে উঠল, “নে! ১% ও আর বাকি রইল না! পোড়ালি যখন, পুরোটাই পুড়িয়ে ফেল! জ্বালিয়ে দে আমায়! মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন, ১০০ ভাগ না জ্বালিয়ে ছেড়ে দিবি কেন?! জ্বলুক! সব ছাই হয়ে যাক!”
অসহ্য যন্ত্রণায় ভরা পৈশাচিক সেই কন্ঠ শুধু চেঁচিয়ে যাচ্ছিল ‘আহ্! জ্বলে গেলাম!’ ‘পুড়ে গেলাম’ ‘আহ! কী শান্তি!’ ‘পুড়িয়ে শান্তি পেলি এবার?’

আস্তে আস্তে জীবন্ত মড়া আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
দূরে তখন কোনো এক রাতজাগা ছাত্রের ঘরে বেজে চলেছে, “ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে…”
(সমাপ্ত)