অশুচি

তারপর আমরা একদিন পুরোনো হয়ে যাব। প্রত্যেকটা পরিবারের কিছু ছোটোবেলার গল্প থাকে, যেগুলো বারবার উঠে আসে কোনো এক ছুটির বিকেলে। সেই গল্পগুলোর মতো একঘেয়ে হয়ে যাব আমরা। বহুদিন আগেই বিকেলের রোদ আর ছাদের কোণকে ন্যাকামি বলে থুতু ফেলেছিলাম। জিভের ফাঁক দিয়ে ফেলা সেই থুতুটা একসময় ঘা হয়ে যাবে। খুব সরল বোঝাবুঝির মধ্যে দিয়েই আর সেদিকে তাকিয়ে থাকার মানে থাকবে বা। বরং হাঁটা যাক। দূরে, আরো দূরে।
একঘেয়ে সিনেমার মতই হয়ত পেছনে লালচে সূর্যও থাকবে একটা। কিন্তু তার বিদ্রূপ কানে বাজবে তোমার, প্রিয়তমা।
আর সবকিছু কালো হয়ে যাবার পরই আমার খুব বমি হবে। দমকে দমকে রক্তবমিতে বিপ্লবের ছিঁটেফোঁটা বেরিয়ে আসবে।
লাল আর কালোতে মিশে কী রং হয়, কমরেড?

একটি সাম্প্রদায়িক লেখা

দুটো ইদ। এই দুটো দিনে লোকের হেব্বি প্রেম জেগে ওঠে। হিন্দু-মুসলিম একসাথে জিলিপি খাওয়ার গল্প, একসাথে বিরিয়ানি সেমুই খাওয়ার গল্প, বাচ্চা-ধাড়ি বয়সে এক শালপাতায় প্রসাদ খাওয়ার গল্পে চারদিক ছেয়ে যায়। দেখে মনে হবে, আহা একদম হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই গো! চুম্মাচাটিই না হয়ে যায় কোনোদিন!
তারপর আবার যদি এই ইদ আর রথ পরপর দিনে পড়েছে! নে ভাই, কত গলাগলি দেখবি দেখে নে! রথের চাকা, জগন্নাথের মুখ, ইদের চাঁদ মিলিয়ে পুরো সিক্সটি-নাইন হয়ে যায়।

লোকজন সমাজে মুখ দেখাবার জন্য কত কীই না করে! ধপাধপ্ ইদ মুবারকের স্ট্যাটাস পড়ছে। অথচ জানতে চায় না এটা কোন ইদ, কেন ইদ।
সারাবছর খিস্তিই খিস্তি। দাড়ি নিয়ে খিস্তি, টুপি নিয়ে খিস্তি, পাঞ্জাবি নিয়ে খিস্তি।
ধরুন, আমার কালো জামা পছন্দ। বিগবাজার থেকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে গেলাম। ঘর যেতেই খিস্তি। সবাই মিলে ঘিরে ধরে “মুসলমানদের মত জামা কিনেছিস কেন? ছিঃ!”
ওই ‘ছিঃ’টা যদি একবার শোনেন, আপনি আস্তিক-নাস্তিক যাই হোন না কেন, গা গুলিয়ে বমি আসবে। এতোটা ঘেন্না মেশানো থাকে ওই ছিঃতে।
তারপর সাদা পাঞ্জাবি। ফতুয়াতে আপত্তি নেই। সাদা পাঞ্জাবি পরলেই “এবার একটা মুসলিম বিয়ে করে ফেল, আর কী!” বা, “সঙ্গে টুপি কিনলি না একটা?” তাও তো আমার বাড়িতে মুসলিম, মুসলাতেই আটকে থাকে। কাটার বাচ্চা, নেড়ের বাচ্চাটা ঘরে কখনো শুনতে হয়নি।
আসুন দাড়িতে। দাড়ির খাঁজে খাঁজে, পাকে পাকে ধর্ম লুকিয়ে! জানতামই না। বাবা চাপদাড়ি রাখে। বাবার দেখে দেখে আমারও ইচ্ছে, রাখবো। হেব্বি উৎসাহ নিয়ে দাড়ি জমাচ্ছি গালে। এতো বড়ো অনর্থ ঘটে গেছে বুঝতেই পারিনি! বুঝলাম ঘরে এসে মায়ের চিৎকারে। গালের থেকে গলকম্বলে বেশি দাড়ির সমাবেশ হয়েছে। সে কী চিৎকার—”দ্যাখো, মুসলমানদের মতো লম্বা লম্বা দাড়ি রেখেছে! ছিছিছিছিছি ছিঃ! এমনি দাড়িও কেউ রাখে! কাট এক্ষুনি! ষা কেটে আয় ভদ্র হয়ে!”
ঘরে বাজার থেকে যে ফল আসে, তা মুসলিমদের কাছ থেকে আসে। কেননা, মুসলিমরাই সবাই ফলওয়ালা হয়। ফলগুলো এসেই চলে যায় রান্নাঘরের সিঙ্কে। কেন?
“আরে মুসলাগুলো কী নোংরা থাকে! কী নোংরা কী নোংরা বাবা! সারাদিন ওই একটাই লুঙ্গি পরে বসে আছে! হাগতে গিয়ে ধোয়াধুয়ি নেই, একটাই কাপড়ে থাকে!”
আপনি যান দিকি আর্গুমেন্টে! সোজা বলে দেবে, “যা তুই মুসলিম বিয়ে করে আলাদা হয়ে যা! ঘরে ঢুকতে দেব না আর! আশাও করিস না!”
কবীর সুমনকে টিভিতে দেখলেও ‘টাকলা’, ‘নির্লজ্জ’বলে গাল দেয়! না না, গান শুনে নয়, পলিটিক্যাল খচড়ামি দেখেও নয়, জাস্ট হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছে বলে।
“কি সুন্দর চ্যাটার্জি ছিল! উঁচু জাত ছিল। তা না, কুকুরের মতো ভৌভৌ করতে করতে কবীর হয়ে গেল!” তার সঙ্গে অ্যাডিশনাল খিস্তি, “মুসলিমগুলো কেমন জানিস? লোককে মুসলিম করাবে, নিজেরা হিন্দু হবে না!”
কালকে গেছলাম এক দোকানে। এক ভদ্রলোক মুসলিমদেরকে নিয়ে বলতে বলতে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ছাড়া অন্যকিছু সম্বোধনই করতে পারছিলেন না। ভাবতে কেবল অবাক নয়, ঘেন্নাও করে যে সেই ভদ্রলোকই আজ ঘটা করে বলবেন ‘ইদ মুবারক’!

জানেন। আপনিও জানেন। কত পরতে কত কেজি ঘেন্না জমে আছে, খুব ভালো করে জানেন। ওই ভদ্রতা আর সামাজিকতা এই দুটো আপদের দায়ে পড়ে আপনাকেও কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখতে হয় আপনার নোংরামিগুলো। যে সাদা পাঞ্জাবির পাশ দিয়ে গেলে আতরের গন্ধে আপনার গা বেঁকে যায়, নাক কুঁচকে যায়, সেই সাদা পাঞ্জাবিকে মুখোশের খাতিরে ‘ইদ মুবারক’ বলে জড়িয়ে ধরতে যাবেন না। ওটা ভন্ডামি।
ওই পায়খানার প্যানে লেগে থাকা দাগের মতো লেগে থাকা ঘেন্নাটাকে আলাদা করে চিনতে শিখুন। সন্ত্রাসবাদের আলোয় দাঁড়িয়ে ধর্মটাকে ঘেন্না করতেই পারেন, ধর্মগ্রন্থগুলোকেও, ধর্মের নিয়মগুলোকেও, কিন্তু ধর্মের মানুষগুলোকে আগে মানুষ বলে চিনতে শিখুন।
ভালোবাসা অনেক, অনেক দূরের কথা। যতদিন না কুটকুটে চিটপিটে ঘেন্নাটাকে সরিয়ে অন্ততপক্ষে নির্লিপ্ততাটুকু আনতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত আপনার ভন্ড ইদের শুভেচ্ছার প্রতি রইল
আমার মাঝের আঙুলটা। দুটো হাতেরই।