পিতাহি পরমন্তপঃ

১.
প্রত্যেকটা মানুষের একটা একান্ত নিজস্ব শারীরিক অস্বস্তি থাকে। যেটা হয়তো শারীরিকের থেকেও অনেক বেশি মানসিক। ইমানের অন্তত এরকমটাই মনে হয়। যেমন তাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে সেই পানকাকুর দাঁত খোঁচানো। এখনো মনে আছে, সারাদিন গুমটিতে বসে বসে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁত খোঁচাতো লোকটা।
তার এরকম কিছু ছিল না। কিন্তু এই কলকাতায় এসে হিউমিডিটির ঠেলায় সবসময় কেবল মনে হয়, ঘাম হচ্ছে। অবশ্য ঘাম তার হয়ও প্রচুর! তার সঙ্গে জুন মাসের দুপুরে লেকচার ক্লাস। তাই, পকেটে দুটো রুমাল রাখে সে— যখনি মনে হয় কানের লতি বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, তখনই মুছে নেয় টপ্ করে।
অবশ্য এরকম ঘাম তো সেই লোকটারও হতো। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা লোকটা যখন ভেজা পিঠ আর চকচকে মুখ নিয়ে ঘর ঢুকতো, সিরিয়ালমগ্ন সামনের ঘর আর বইপত্রে ব্যস্ত মাঝের ঘরটা খুশি খুশি হয়ে উঠতো। হাঁকডাক করে পাড়া জাগিয়ে লোকটা ঘরে ঢুকতো। তারপর রুমাল বের করে ক্লান্তিটুকু মুছে নিতে নিতে পাশে বসত তার। তারপরই অফিস ব্যাগ থেকে কখনো বেরিয়ে আসত চিঁড়েভাজার প্যাকেট, কখনো রাতের জন্য বোঁদে; বের করার কায়দায় মনে হতো যেন একদুখানা সোনার পালক কুড়িয়েই পেয়েছে বোধহয়, মনে হতো পুরুলিয়া থেকে আড়ষা যাবার পথে হয়তো এল ডোরাডোও পড়ে। ওই লোকটাই তো তার নাম রেখেছিল ইমান— আশেপাশের অনেক ফিসফাসের তোয়াক্কা না করে। একজন মাসি বলতে এসেছিল “এরকম মুসলমান নাম রাখছেন…”, কথা শেষ না করতে দিয়ে বাবা বলেছিল, “ওসব নিয়ে ভাববেন না। নিজের নামটা হিন্দু রেখেছেন। তাতেই হবে।” এরকমই স্পষ্টবাদী ছিল।
কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না এসব ভাবতে। মনে মনেও আর ‘বাবা’ বলে না। ঠিক উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের কদিন আগে কয়েকদিনের রোগে চিরদিনের ছুটিতে চলে দেল মানুষটা। তাকে আর মাকে পুরুলিয়ার ওই দুকামরার ফ্ল্যাটটাকে একা রেখে। তারপরে কতকিছু হয়ে গেল। স্কুলের জুয়েল ছাত্র ইমান বসু জয়েন্টে যখন নীচুতলার, অত্যন্ত নীচুতলার একটা স্যাঁতসেঁতে র‍্যাঙ্ক করল, তখন তার পরিচিত বৃত্তের বেশিরভাগটাতেই একটা খুশির হাওয়া বয়ে গেল। তার কষ্টটা বুঝলেন কেবল স্কুলের কয়েকজন পুরোনো স্যার আর কাছের বন্ধুরা। তাঁরাই হড়কে পড়ে যাওয়া ইমানকে হাত ধরে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন এই মেডিক্যাল কলেজে।
ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিল ইমান। দুপুরবেলাটা এখানেই খাওয়াটা সুবিধা। মাকে সকালে উঠে অফিস যেতে হয়, তাই মা-ছেলের সংসারে দুপুরের খাবারটা বন্ধই থাকে। মা খায় রিসেপশনিষ্টের চেয়ারে বসে, আর ছেলে লেকচারের ফাঁকে চলে আসে এই ভাতের হোটেলে।
এসে গেছে। সুপ্রিয়া হিন্দু হোটেল। আহ্, এখন কিছুক্ষণের শান্তি। ফ্যানের গুঁতোয় স্বস্তি। কোণের দিকে একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ল। পকেট থেকে কালো বাচ্চাফোনটা বের করে প্লেলিস্টটা বন্ধ করল। এই গান শোনার কম্পালসিভ অভ্যেসটাও বাবাই ধরিয়েছিল। একের পর এক গান শুনে যেত লোকটা। কাওয়ালি থেকে কালীকীর্তন। লোপামুদ্রা থেকে লেনন। ওই একটাই নেশা করতো তো লোকটা।
তবু!
দুর্! দুর্! দুর্!
যেদিনই এই লোকটার কথা মনে পড়ে, সেদিন পুরো দিনটা কষটে মেরে যায়। সব কথা জোর করে ঝেড়ে ফেলতে হাঁক দিয়ে মণিদাকে ডেকে রোজকার ডিমভাত দিতে বললো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাকি লোকদের দেখে বাকি সময়টা কেটে যাবে। বেশিরভাগ লোকই তো ডেলি খদ্দের। অনেককেই চেনে ইমান। ওই লম্বা স্বাস্থ্যবান ভদ্রমহিলা। ওই ছোটো করে গিন্নিবান্নি মানুষটি, যাঁর শাড়ির ব্যাজে লেখা, “ওজন কমাতে চান? আমার সাথে যোগাযোগ করুন!” ফরসা সেলসম্যানটি। বাকি লোকগুলো পাল্টে পাল্টে যায়।
মণিদা ভাত দিয়ে গেল। পাঁপড়ভাজাটায় এক কামড় দিয়ে ভাতটা মাখতে শুরু করল — হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা একটু খুশি খুশি হয়ে গেল। আরেক চেনা লোক। একটা বুড়ো লোক, মাথায় একটা কাপড়ের টুপি। গোটা মুখে শ্বেতি। সেজন্যই বোধহয় ইনি কোনো টেবিলে বসলে টেবিলের বাকিরা একটু গা বাঁকিয়েচুরিয়ে বসে, যাতে গায়ে ছোঁয়া না লেগে যায়। তার ওপরে ইনি মানসিক ভারসাম্যহীন। সেটা নিয়েও কানাকানি হয়। কিন্তু লোকটাকে ইমানের বেশ ভালো লাগে। কারো সাতে পাঁচে কান দেন না। নিজের মতো আসেন, খান, চলে যান নিজের মতো।
আর না। এবার ফটাফট খেতে হবে। দেড়টার লেকচারের দেরি হয়ে যাবে এবার।

হঠাৎ সে শুনতে পেল ভাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে, কেউ একজন উল্টো টেবিল থেকে ওই টুপিওয়ালা লোকটাকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”

২.
অমল হালদার কোনোদিনই তেমন খারাপ ছেলে ছিল না। মানে পড়াশোনায়। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো না কোনোদিনই, কিন্তু স্যারেরা চিনতেন বুদ্ধিমান ছেলে হিসেবেই, নম্বরও ভালোই পেত। স্কুলজীবনে তার দুটো অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা এই পড়াশোনা নিয়েই ছিল। অন্যটা একটু বেশিই ব্যক্তিগত। আপশোষটা ছিল অঙ্ক পরীক্ষায় ১০০ তে ১০০ না পাবার। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ ছিল তার এই আপশোষটুকু। তার কারণ আছে।
বাবা রতন হালদার ছিলেন ব্যাঙ্কের সামান্য ক্যাশিয়ার। কিন্তু চলাচলতি সমাজের বেঁধে দেওয়া কর্মগত পরিচয়ে আটকে পড়বার মানুষ ছিলেন না তিনি। পুরোনো দিনের ফার্স্ট ক্লাস গ্র্যাজুয়েট রতনবাবুর নেশা ছিল অঙ্কের। সারাদিন ঘোরানো চেয়ারে বসে আট. থেকে আশির পাবলিকের গাল খাবার পর ঘরে এসেই বসতেন অঙ্ক নিয়ে। খাতার পর খাতা, ক্যালকুলেটরে খটাখট, বই আর ম্যাগাজিনের গাদা হয়ে থাকত একটা রুম। উৎসাহ কম ছিল না টাকমাথা বেঁটে লোকটার— নইলে কেউ সোমবার অফিসের পর বিকেলে কলুটোলা স্ট্রীটে গিয়ে ধুলোভরা অঙ্কবই ঘাঁটে!
এই লোকের ছেলে হয়ে সে কিনা অঙ্কে কোনোদিন ১০০ তে ১০০ পায়নি! মানে, ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল একটু। সে মাঝেমধ্যেই ছোটোখাটো পরীক্ষায় কুড়িতে কুড়ি, পঁচিশে পঁচিশ পেয়েছে। একবার তো সত্তরে সত্তরও পেয়েছিল। চাপটা ১০০ পার্সেন্টের ছিল না, ১০০ নম্বরের ছিল। এই জিনিসটা তার গোটা স্কুলজীবনে ধাঁধা হয়ে ছিল।
অবশ্য, স্কুলজীবনের শেষে আর কলেজজীবন শুরুর আগে এর থেকে অনেক বড় একটা ধাঁধা এসে ঘূর্ণিঝড়ের মতো তার আর তার মায়ের জীবনটাকে ওলটপালট করে দিল। অঙ্কপাগল মানুষটার অঙ্কই ভুল হয়ে গেল একদিন— তহবিল তছরুপের দায়ে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল ব্যাঙ্কে সবার সামনে থেকে।
বাড়ি ছাড়তে হল পাড়াপড়শিদের বাঁকাচোখের থেকে বাঁচতে। হঠাৎ এতোগুলো ধাক্কা অমল ঠিক সয়ে নিতে পারলো না — রাস্তায় বড় বড় বেশ কয়েকটা বাম্পার পরপর পড়লে গাড়ি যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে, সেও তেমনিই কেঁপে গেল। কলেজের সময়ে তাকে দেখা যেতে লাগল বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের সামনে। কখনো এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো সিকিউরিটি গার্ডকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা দাদা, এখানকার ক্যাশিয়ার কে?” সিকিউরিটি গার্ডরাও চিনে গেল তাকে। দেখলেই তাড়িয়ে দেয় লাঠি উঁচিয়ে, খিস্তি করে মা-বোন দিয়ে।
মা অনেক চেষ্টা করতেন। টাকা জোগাড় করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও নিয়ে গেছলেন এক-দুবার। লাভ হয়নি। অমলের কলেজের অ্যাটেনডেন্স কমে যেতে লাগল, সেমেস্টারে সাপ্লি হতে শুরু করল। এর মাঝেই একদিন মা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। ডাক্তার বলেছিল, মাথার শিরাগুলো ফুলে উঠে ফেটে গেছে। ব্যাস, এটুকুই। তারপর থেকে অমল ভেসে বেড়াতে লাগল।
বয়সটা বাড়তে বাড়তে, এঘাট-ওঘাট-সেঘাটের জল খেতে খেতে, এই আত্মীয় সেই আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে থাকতে এখন অমল ৫৮। একটা ছোট্টো বাড়িতে বাবাকে নিয়েই থাকে। ওই সিকিউরিটি গার্ড হিসেবেই কাজ করে একটা ব্যাঙ্কের এটিএমে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ব্যাঙ্কে কাজ করি’। যা পায়, তার আর তার বাবার মোটামুটি চলে যায়।
অমল রোজ আসে এই ভাতের হোটেলটায়। এরা বড় যত্ন করে খাওয়ায়। গোটা দুনিয়ায় আত্মীয় অনেক থাকলেও আপনজন বলতে তো ওই জেলখাটা বুড়ো লোকটা; তাই যেখানে যেটুকু ভালোবাসা পাওয়া যায়, সেটাকেই জড়িয়েমড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে তার। তাই দুবেলাই এখানে খায়।
নিজেরটা খায়, আর একজনেরটা প্যাক করে নিয়ে যায়। দশ বছর একটা টুকরো ঘরে বেঁচে থাকার পর যে মানুষটার বাঁচার ইচ্ছেই শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য। দশটা কথা বললে একবার মাথা নাড়ে। ভাত তরকারি থালায় ঢেলে মেখে দিলে তবে হাত বাড়ায়। প্রতিদিন ওই দৃশ্যটা দেখলেই তার মনে পড়ে যায়, পড়ন্ত বিকেলে মাথা ঝুঁকে বসে খসখস করে পেন চালাচ্ছে এই লোক। এই একই লোক।
এই তো কদিন আগে কী হ্যাপাটাই গেল! মাঝরাতে ‘বুকে ব্যথা’ ‘বুকে ব্যথা’ বলে খাট থেকে পড়ে গেল! দৌড়াদৌড়ি, ডাকাডাকি, ভর্তি হওয়া। সবই হল। কিন্তু কর্তার মন গলল না এতে। মাত্র দুদিনের ছুটি ছাড়া তিনি আর কিছুই দিলেন না।
আজ সেই দ্বিতীয় দিন। যদিও ছুটির প্রয়োজন আর সত্যিই ছিল না। আজও খেতে এসেছে সে।
টেবিলে বসতেই বসতেই সে দেখল, চেনা দোকানদার বসে আছে। মণিদা থালাটা সামনে নামাতেই প্রশ্নটা আলতো করে সৌজন্যের ছোঁয়ায় ভাসিয়ে দিলেন সেই লোকটি।
“আপনার বাবা মেডিক্যালে ভর্তি ছিলেন না? কেমন আছেন এখন?”
প্রথমে শুনতে পায়নি অমল। কমই শোনে আজকাল। তাও আন্দাজবশে চোখ তুলতেই ভদ্রলোক প্রশ্নটাকে ফিরিয়ে আনলেন আবার, এবার জোরগলায়।
অমল গলাটা ঝাড়ল একবার। গলার শ্বেতির দাগটা চুলকে নিল একবার। তারপর বলল, “আর ভর্তি নেই। মারা গেছেন তো। কালরাতে। ওই যে মুকেশের গানটা আছে না?

বলেই হোটেলভর্তি লোকের মাঝে চোখ তুলে আকাশে হাত উঠিয়ে গেয়ে উঠল খোলা গলায়,
” জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা, ইসকে শিবা যানা কাঁহা!”

৩.
হোয়াক্! হোয়াক্! গোটা টেবিলটা বমিতে ভেসে গেল। কোনোমতেই সামলাতে পারলো না ইমান। গোটা থালাটা ভরে তো গেলোই, নিজের জামাকাপড় গেল, সঙ্গে গেল উল্টোদিকে বসা ভদ্রলোকের প্যান্ট আর জুতো। কোনোমতে মুখে হাত চাপা দিয়ে রাস্তার ধারে বেসিনের কাছ পর্যন্ত গেল। তারপর আবার ভলকে্ ভলকে্ বমি বেরিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে সে প্রায় বসে পড়ল রাস্তার ধারে।
খেতে আসা প্রায় সবাই অবাকচোখে গান গাওয়া বুড়োটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু গান শুরু হওয়ার একটু পরেই এরকমভাবে টেবিলে বমি করতে দেখে সবার চোখ সেদিকে ঘুরে গেছে। মুখে বিরক্তি আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। হোটেলের দুটো চাকর সবাইকে বসতে বলছে, বালতি আর ন্যাকড়া নিয়ে এসে পরিষ্কার করতে শুরু করেছে।
ইমান জানে দুম্ করে এরকম কেন হলো। এই টুপিওয়ালা লোকটা অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। এমন সব স্মৃতি, যা ফিরে আসা উচিত ছিল না। এই একইরকমভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ গান গেয়ে উঠত বাবা। একইরকম চোখগুলো ঝকঝক করতো গান গাওয়ার সময়।
কিন্তু সেই ছবিটা ফুটে ওঠেনি তার চোখে। লোকটাকে দেখতে তার বাবার মত, কিন্তু সেই বাবাকে সে মনে রাখতে চায় না। বাবার শেষদিনগুলো কোনো এক সিন্দুকে ভরে নদীতে ফেলে দিতে পারলে ভালো হতো — রূপকথার গল্পের মত।
কিন্তু মনে পড়ে যায়। ন্যাড়ামাথা বাবা। পেট ফুলে যাওয়া বাবা। কাঠি কাঠি হাত পা বাবা। লিভার ক্যান্সার বাবা। শেষের দিনগুলোতে শুধু একটা বিছানায় শুয়ে থাকত আর হাত নেড়ে নেড়ে তাকে কাছে ডাকত লোকটা। আর মনে আছে শেষ দেখাটা। শেষ দেখাটা না দেখলেই ভালো হত বোধহয়, সবাই বারণও করেছিল প্রাণপণ। কিন্তু সে নিজের জেদে দেখেছিল।
বীভৎস ফুলে যাওয়া পেট। হাতে পায়ে কপালে ঘি মাখানো। মুখে তুলসীপাতা। বাঁশ মেরে ভেঙে দেওয়া পা এর অংশ।
আজ সেই ধোঁয়া ধোঁয়া দৃশ্যটাই ফিরে এসেছিল আবার। সে দেখেছিল, লিভার ক্যান্সারের একটা মড়া চেয়ারে বসে হাত উঠিয়ে গান গাইছে। ওঠানো হাতটায় সবুজ রঙের ঘি মাখানো।
হোয়াক্! শেষ বমির দমকে এতোটা গলা গলা খাবার আর জল বেরিয়ে এল।

তার পক্ষে আর লেকচারে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘর ফিরতে হবে। সে কোনোমতে একটা অটো খুঁজতে লাগল বড়রাস্তায় এসে। যে অটো তাকে তার ঘরে ফিরিয়ে দেবে।

৪.
বিশ্বনাথ নামটায় এখানে তাকে কেউ ডাকে না। বাপটা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন মাঝেমধ্যে বিশ্বনাথ বলে ডাকতো। তারপর থেকে আর কেউ না। স্বাভাবিক। মানুষ স্বভাবগতভাবে আলসে। কাজ কমাতে চায়। তারপরে আবার সে যেখানে বস্তিতে থাকে, সেখানে লোকজনের সারাদিন এতো কাজ— তাদের ফুরসত নেই যুক্তাক্ষরওয়ালা নাম বলবার। তাই বিশু। বিশে। বিশা। রেগে গেলে বিশুচোদা।
এটাতেই তার আপত্তি রয়েছে। ভাগ্যের ফেরে তাকে আজ অটো চালাতে হয়, কিন্তু সে এখনো অটোওয়ালা হয়ে উঠতে পারেনি। ওই মুখে পান, ঠোঁট উঠিয়ে কথা বলা, গাড়িতে মেয়ে উঠলেই মিরর অ্যাডজাস্ট করাটা এখনো আত্মস্থ করতে পারেনি। তার মনে এখনো দশ ক্লাস পাস বিশ্বনাথ দাসের ছাপ ভালোরকম আছে। ট্রাফিক পুলিশে নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘মাস্টার বিশ্বনাথ দাস’। কেন সব অটোড্রাইভারের নাম বিশু,পাঁচু,ঝন্টু হবে সে বুঝে উঠতে পারে না! আর ভালো নাম নেবে সব ওই ভদ্রচোদা মানুষগুলো। ওই যে, ওই ইউনিয়নের নেতা, নামখানা কী বাগিয়েছে! সৌ-গ-ত!
তার তো আজ অটো চালাবার আর হঠাৎ ক্রসিঙে পুলিশের থাপ্পড় খাবার কথা নয়। সে নৈহাটিতে থাকা মাঝারিমেধার ছেলে ছিল। বাবা মাকে নিয়ে থাকত। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশটাও করেছিল। তারপর কী যে হল—বাপটা একদিন রাতে মরে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো অভিযোগ ছাড়াই। কোনো দায়িত্ব ছাড়াই। ব্যাস, তারপর এইসব পরিবারের রোজগার করা মানুষটা মরে গেলে যা হয়,তাই হল।
বিশ্বনাথ কদিন পার্টি অফিসে ঘোরাঘুরি করল। দাদাদের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিনেপয়সার পিয়োন হওয়াটা ঠ্ক পোষালো না তার। দাদারা বলেছিল অবশ্য, “কটাদিন থাক বিশু। কোথাও না কোথাও ঠিক ঢুকে যাবি।” কিন্তু তার আর সইল না।
এর মধ্যেই একদিন সংসারের শেষ লোকটাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সংসার বলতে বোধহয় সে শুধু শাঁখা-পলাটুকুই বুঝতো! তাই আরেক সেট শাঁখা-পলার সন্ধানে রাত্রেবেলা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল সে, যাকে সে ছোটো থেকে মা বলে জড়িয়ে ধরে এসেছে স্কুল থেকে ফিরে। স্কুলও নেই। জড়িয়ে ধরার লোকও নেই। তাই বিশ্বনাথও বেরিয়ে পড়ল এক পরিচিতের হাত ধরে। আর ফিরল না।
এসে প্রথম চাকরি জুটল ওই পরিচিতেরই পরিচিতির জোরে। হ্যান্ডবিল বিলি করার চাকরি। সারাদিন ধরে মিকি মাউসের বেশে লোকজনকে, বিশেষ করে বাচ্চাদের হাতে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের খবর ধরিয়ে দাও গোলাপি কাগজে। উফ্, সে এক দিন গেছে! সারাদিন ধরে এসপ্ল্যানেডের বিশাল রোদে ওই ঢাউস সিনথেটিক সুট পরে এদিক-সেদিক করো। দিন গেলে ১৫০ টাকা। গোটা পিঠে ঘামাচি হয়ে যেত। গলায় আর বগলে ঘাম জমে জমে এতো বড়ো ঘা হয়ে গেছল। সারাদিন ধরে চুলকাতো। তবু এই চাকরিটা সে ছাড়তে পারেনি। বহুদিন করেছিল। বিয়ে করেছিল এসময়েই। বউদেরও পরিবারের অবস্থা খারাপ, তবে ভালো ঘরের মেয়ে। দুজনে মিলে কাজ করে কোনোমতে চালিয়ে নিত। একটা বাচ্চাও নিয়েছিল।
ভেবেছিল সামলে নিতে পারবে। কিন্তু কই আর পারলো! দুজনেই কাজ করতে বেরিয়ে যেত, আর বাচ্চাটা থাকত বন্ধ দরজার ওপারে। পাশের ঘরে একটা বুড়ি থাকত, তাকেই মাসে মাসে ৫০ টাকার জন্যে বলেছিল দেখতে। সে ইচ্ছে হলে দেখতো, নইলে দেখতো না। এমন অনেকদিন গেছে যেদিন কেউ একজন এসে দেখতে পেয়েছে বাচ্চা হাগা-মোতায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে, আর কাঁদছে।
ভালো করে খাবার দাবারও পেত না। যত্নটাও পেত না। কতদিন বড়লোকদের জন্মদিনের পার্টিতে গেছে — মিকি মাউস সেজে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। পার্টি শেষে, গভীর রাতে যখন কেকের টুকরো আর বেঁচে যাওয়া মাংস নিয়ে ঘরে ফিরতো, ততখন বাচ্চাটা গলা ডালভাত মাখা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। না একটু সবজি, না কিছু। দুজনে মিলেই গিলতো তখন। পেট বড়ো বালাই।
ঠং-ঠঙাক্! কী একটা পড়ে গেল শব্দ করে অটোর ড্যাশবোর্ড থেকে। মাথা ঘুরিয়ে খুঁজে পেল না বিশ্বনাথ। আবার পিঠ বাঁকিয়ে মাথা নামিয়ে হাতটা সিটের তলায় ঢুকিয়ে বের করল জিনিসটা। লোকনাথ বাবার মূর্তিটা! দুর্ শালা! ফালতু জিনিস সব। ওই ঘটনাটার পর যখন ভাড়ার অটো চালাতে শুরু করল, তখন বাকি সবার জোরাজুরিতে পুজোটুজো করানোর পরও এই মূর্তিটা ২৫টাকায় কিনে রেখেছিল গাড়িতে। লোকে বলেছিল এর ফলে ওরকম তো আর হবেই না, তার সঙ্গে উন্নতি হবে। সবই নাকি লোকনাথ বাবার দয়া! ভূপতি তো আবার বলেছিল সকাল-সন্ধ্যে ধূপটুপ দিতে। প্রথমে কয়েকদিন দিয়েওছিল, তারপর আর ভাল লাগত না। বিরক্ত লাগত। পয়সার দেখা নেই — অতো ভক্তি করে হবেটা কী! এখন ড্যাশবোর্ডের এককোণে নিজের মত পড়ে থাকে। ধুলোটুলো মেখে একাকার হয়ে গেছে। অবহেলায় সে ওটাকে তুলে একদিকে রেখে দিল।
ওই একটা ব্যাগ কাঁধে ছেলে আসছে। কলেজ স্টুডেন্ট বোধহয়। বিশ্বনাথ ডানহাতে গিয়ারটা চেঞ্জ করে হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে রাস্তায় নামলো। ছেলেটা উঠলে, ডানহাতেই দুটো হর্ন মেরে গাড়িতে স্পিড দিয়ে চলে গেল কালো ধোঁয়া উড়িয়ে।

একটাই হাত ওর। মিকিমাউসের দিনগুলোতেই একদিন ঘটনাটা ঘটে। হকারভর্তি ভিড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল। সামনে দিয়ে একটা বাস রাস্তার মাঝেই টার্ন নিচ্ছিল। সে দেখেনি, এমনটা নয়। দেখেছিল ঠিকই। কিন্তু স্কুলজীবনে ফিজিক্স শেখার সুযোগ পায়নি সেজন্য, নাকি দুটো চোখের ফুটো দিয়ে বাসের সাইজটা আন্দাজ করতে পারেনি সেজন্য, ঠিকসময়মতো বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিতে পারেনি। কনুই থেকে হাতটা ছিটকে রাস্তার একদিকে চলে যায়, আর সে অন্যদিকে। সেই থেকে তার পরিবারটাও দুদিকে চলে গেল। ‘নুলো’ লোকের সাথে থাকবে না বলে বউ বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে অনেক গালমন্দ শাপশাপান্ত করে, অনেক থুতু ফেলে চলে গেল অন্য পুরুষের হাত ধরে। আর সে হয়ে গেল বিশু অটোওয়ালা।
আরে আরে! শালা শুয়োরের বাচ্চা! গাড়ির সামনেটায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল! অদ্ভুত পাবলিক মাইরি! নেহাত সিগন্যালটা ছিল বলে বেঁচে গেল।

৫.
আবদুসের আর কিছু করার ছিল না। ওই ফুটটাতে একটা বুড়ো মোটামতন লোক ছিল, দেখেই মনে হচ্ছিল পয়সাওয়ালা মাল। এগুলোর সামনে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে অনেকসময় ১০ টাকার পাত্তিও ছুঁড়ে দেয়।
অতো সিগন্যাল মানলে তার চলবে? আজ সকালে পার্ক স্ট্রিটে একটা গাড়িতে একটা ডবকা মাগীকে দেখার পর থেকে ওর হিট উঠে আছে। মাগীটার কী বড় বড় মাইগুলো ছিল! লাল ড্রেস পরা চমকঠমকওয়ালা মাগী ছিল। গাড়িটার পাশে গিয়ে ‘আল্লাকে নামপে কুছ দে দিজিয়ে মেমসাব! ভুখা বাচ্চা হ্যায়, বিমার বাচ্চা হ্যায়! আল্লা ভালা করেগা আপকা’ বলতে না বলতেই একটা ১০ টাকার নোট ফেলে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। তা যাক, এরমধ্যেই যা দেখার দেখে নিয়েছে আবদুস।
একটা পাবলিক বাথরুমে ঢুকে লুঙ্গির ওপর থেকে হাত চালিয়েই একবার খেঁচে নিয়েছে দুপুরবেলা। কিন্তু এখনো চোখের সামনে ওই মাইদুটো দুলছে তার। রাতে একবার মাগীপাড়ায় যেতেই হবে!
কিন্তু তার জন্য আরো একশো তুলতে হবে তো! সময় তো আর মাত্র দু তিন ঘন্টা। সাতটা-আটটার দিকে বড়ো বড়ো খাওয়ার জায়গাগুলোর সামনে গেলে জোড়ায় জোড়ায় আসা মালগুলোর কাছ থেকে কিছু মালকড়ি পাওয়া যায় বটে অবশ্য। ওটুকুই ভরসা। তারপরে আর বাবুর ঘাগুলোও কেউ দেখতে পাবে না, আর নোংরা শুকনো শরীরটাও নজরে পড়বে না। দেখতে না পেলে টাকাও দেবে না কেউ। দিনের ভাড়াটা তো শেখের হাতে দিতে হবে!
শেখের সঙ্গে প্রথম দেখা হাসপাতালে। আবদুস এমার্জেন্সির সামনে থেবড়ে বসেছিল মাটিতে। ছেলেটার বেশ কদিন ধরে জ্বর। পেটটা ফুলে গেছে। বাকি হাত পাগুলো খ্যাংরাকাঠি হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেন! মাগীটা পালাবার পর থেকে তো নিদের মতই ঝুপড়িটায় পড়ে থাকে, যা পারে এদিকওদিক কুড়িয়েবাড়িয়ে খায়। আবদুস সারাদিন পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, তার সময় কোথায় দেখবার! কদিন ধরে প্রচণ্ড বমি আর পেটখারাপে নেতিয়ে গেছে দেখে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু টিপেটুপে দেখে জানালার ওপার থেকে হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আর বলল, ‘বুকের ছবিটা করিয়ে আন। খুব বাজে অবস্থা!’
সেইসময়েই একটা সিড়িঙ্গেমত লোক কোথা থেকে সুট করে এসে তার কাঁধে হাত রেখেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে চাচা? আমাকে বলো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” আবদুস উপায় না দেখে সব বলল তাকে। জ্বর, বমি, ঘা। হাতের কাগজটা ধরালো ওর হাতে। ওই লোকটাই সব দেখেশুনে তাকে শেখের কাছে নিয়ে গেছল। শেখ তাকে বলেছিল, এইড না কী একটা রোগ হয়েছে বাচ্চাটার। বেশিদিন নেই আর। তাই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, “ওটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে লাভ নাই। বরং আমার কাছে কাজ করো, নিজেও খেতে পাবে, বাচ্চাটাকেও খাওয়াতে পারবে।” তারপর থেকেই শুরু।
রোজ সকালে উঠে বাচ্চাটার গায়ে মেকআপ করে বড়ো বড়ো ঘা তৈরি করে। তারপর হাতঠেলাটাতে নোংরা তোষক-কাঁথাগুলো চাপায়। আর বেরিয়ে পড়ে বাবুকে নিয়ে। এই হচ্ছে রোজের রুটিন। তার জন্য প্রতিদিন একটা টাকার ভাগ দিতে হয় শেখকে।

এই কয়েকমাসে আবদুস শিখে গেছে অনেক কিছুই। গাড়ির কাঁচে হাত ঢুকিয়ে টাকা চাওয়া, মেয়েদের পাশে পাশে ঘ্যানঘ্যান করা, বাচ্চাদের হাতে খাবার দেখলে তাদের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করা আর খাবার চাওয়া, অন্য ভিখারিদের সঙ্গে মারামারি করা। আরো অনেককিছু।
রাত হয়ে আসছে।
ইমান একা তার খাটে বসে খাবার খাচ্ছে। মা এখনো ডিউটি থেকে ফেরেনি। আজকাল মাঝেমধ্যেই রাতে ফেরেনা, বলে ‘ডিউটি ছিল’।
অমল হালদার হাতে একটা লাঠি নিয়ে নীল উর্দিটা পরে ক্লান্ত পায়ে একটা এটিএমের দিকে হাঁটছে। আজ তার খুব ঘুম পাচ্ছে।
বিশ্বনাথ মোড়ের দোকানটার থেকে তড়কা-রুটি কিনে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে অটোটা গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
আবদুস পেটভর্তি বাংলা খেয়ে হাড়কাটায় ঢুকলো। তার পকেট থেকে একটা বিড়ি গড়িয়ে পড়ে গেল কাদায়।

কলকাতা, তার বাবা আর ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে, আরো একটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেল।

কম্ফর্ট জোন

কম্ফর্ট জোন একটা খুব ভয়ঙ্কর কথা। কম্ফর্ট মানে স্বাচ্ছন্দ্য। অন্য অনেককিছুর মতো সমাজ আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকাও ঠিক করে দেয়।
আমরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু, সেই পড়াশোনার সিলেবাস কোথায় ভুল, কেন ভুল তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারা কেন এইরকম শিক্ষানীতি তৈরি করে, যাতে প্রতি বছর হাজার হাজার চাকরিখোঁজি কালোচশমা মানুষ তৈরি হয়, সে নিয়ে কথা তুললেই অস্বস্তিবোধের উসখুস শুরু হয়।
আমরা বৌ-শাশুড়ির কোন্দল নিয়ে লেখা সামাজিক আহা উহুতে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু কেন একটা মেয়ে তার ফুলশয্যার রাতে ফুলের মালার দোহাই দিয়ে একটা অচেনা মানুষের কাছে নিজের শরীর পেতে দিতে বাধ্য হয় সেই কথা বলতে চাইনা।
আমরা বছর বছর ধরে নিজের ‘কেরিয়ার’ তৈরি করতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। কিন্তু কে সেই সাইকেলটা চালাচ্ছে, কোনদিকে চালাচ্ছে সেটা চোখ তুলে তাকাতে গেলেই একরাশ ভয়মেশানো লজ্জা এসে জড়িয়ে ধরে। এমডি পরীক্ষার সিট কম, তাই বছরের পর বছর ধরে কোচিং সেন্টারের পায়ের তলায় টাকা বিছিয়ে দিই, কিন্তু কেন এই সিট কম, কার দোষে কম জানতে গেলেই সবাই চোখ পাকিয়ে মুখে আঙুল দিতে বলে।
আমরা ‘কোটার ডাক্তার’দের কাছে আত্মীয়দের যেতে বারণ করি, কারণ তাতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কেন ‘কোটার’ ডাক্তারেরা অন্যদের সমান হয়ে উঠতে পারবে না, সে প্রশ্নটা করার অভ্যাসটাই তৈরি হলো না এখনো।
ছেলেদের যৌনতা আর হস্তমৈথুন অদ্ভুত যুক্তির সব ‘জোকস্’ এর মাধ্যমে খুব সহজেই সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু মেয়েদের যৌনতা বা হস্তমৈথুন নিয়ে কোনো কথা বললেই সবার ‘শালীনতা’ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ছেলেরা বাক্যের মধ্যে ৫টা খিস্তি ব্যবহার করে, আমরা তাতে অতিমাত্রায় স্বচ্ছন্দ—অথচ একটা মেয়ে সোশ্যাল সাইটে বোকাচোদা বললেও তার কাছে ৫টা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, বন্ধু ভেবে নয়, ‘রেন্ডি মাগী’ হিসেবে। কারণ, মেয়েদের মুখে গালিগালাজ আমাদের ‘পৌরুষের কাছে’ অস্বস্তিকর।
কাজের মাসি হঠাৎ একদিন কামাই করলে আমরা মাইনে কাটতে অভ্যস্ত। ওরা যেহেতু অশিক্ষিত, ওরা যেহেতু ‘নীচু’জাত, তাই ওদের কোনো বাঁধা পে-স্কেল বা ছুটি থাকতে পারে না! সেই আমরাই সরকারী কর্মচারীদের ডিএ বাড়াবার দাবিতে স্ট্রাইক করতে অভ্যস্ত। অথচ কাজের ‘মাসি’ দের সঙ্গে মুখমিষ্টি করে কাজ আদায় করে নিতে আর তাদের ন্যায্য দাবিকে পায়ের তলায় পিষে দিতে আমাদের একটুও অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয় না।

বলি কি, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের বৃত্তটুকুতে কেবল হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা মালিকসুলভ মনোভাবটুকুকে স্থান দেবেন না। বৃত্তটা আঁকার চক আপনারই হাতে—তাতে একটু যুক্তিবোধ মেশান, একটু শিক্ষার ফোড়ন দিন। কোন কথাগুলো নিয়ে কথা বলা খুব প্রয়োজন সেবিষয়ে খুব স্পষ্ট হোন। সামাজিকতার ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে যে কথাগুলো বলতে পারছেন না, সেই কথাগুলোই এই পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজ আপনাকে দিয়ে বলাতে চায় না। অনেক অনেক বছর ধরে যে সামাজিক শোষণ চলে আসছে আপনার আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ‘অসভ্য’ ‘অশালীন’ ‘অসামাজিক’ ‘অভদ্র’ ট্যাগ লেগে যাবার ভয় দেখিয়ে, তাকে একসাথেই চিনতে হবে।

আসুন। কথা বলুন। কথা বলুন যৌনতার অধিকার নিয়ে, কথা বলুন রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন বেশ্যাদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন মেথরদের অধিকার নিয়ে, কথা বলুন কর্মক্ষেত্রে নিজের সুরক্ষা আদায়ের জন্য, কথা বলুন কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য, কথা বলুন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবহেলার বিরুদ্ধে, কথা বলুন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের হাত বাড়ানো নিয়ে। কথা বলুন স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করেই। কারণ, কথাগুলো পৌঁছনো প্রয়োজন সব স্থানে, সব কালে, সব পাত্রে।
নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের বৃত্তে একটু অস্বাচ্ছন্দ্য আনুন।
নিজের কম্ফর্ট জোনে একটু ডিসকম্ফর্ট আনুন।
এতো ভালো থাকবেন না।

এতো ভালো থাকা ভালো নয়। 🙂

সেকেলে প্রেম

জানিস, আমার আর তোর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে।
সেই ব্যাপারটার জন্যই,

তোর ওই পিঠছোঁয়া ঘন কালো চুলে বা তোর দুর্গাপুজোর শখে খোঁচা খোঁচা বয়কাটে বিলি কেটে দিতে ভালো লাগে;

…যখন থুথথুরি বুড়ি হয়ে যাবি,তোর পাতলা হয়ে যাওয়া ছাই রঙের চুলের গুছিতেও একইভাবে বিলি কেটে দেবো।

তোর হঠাৎ ইচ্ছেয় তৈরি করা ব্যানানা চকলেট পুডিং খেতে খেতে যেমন চোখে চোখ পড়লে ৩২ পাটি বের করে দি;
…তেমনি বিয়ের পর আলুনি বাঁধাকপির তরকারি খেতে খেতে ‘কেমন হয়েছে’ জিজ্ঞেস করলে হিহি করে হেসে ফেলবো।

তোর ওই টিপটপ বাঁধাচুল কানের দুল শাড়িতে ঝলমলে চোখমুখ দেখলে মনটা হঠাৎই ভালো হয়ে যায়;
…কিন্তু ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা বাসিচোখ উস্কোখুস্কো চুল আর লালা লেগে থাকা ঠোঁটের কোণে একটা চুমু না খেলে আমার দিন ভালো যায় না।

সবুজ ঘাসে বসে ছোট্টো একটা কথায় তোর মাথা ঝাঁকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসি যেরকম মুগ্ধতা নিয়ে দেখি;
…মেডিকেল কলেজের লেবার রুমে সবুজ কাপড় আর নীল চাদরের মাঝে তোর ঘামে ভেজা মুখ আর অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকারেও একইরকম অদ্ভুত মুগ্ধতা খুঁজে পাবো।

একদিন দুজনে একসাথে ঘুরতে ঘুরতে বাজি ধরে রাস্তার মোড়ে ফুচকাকাকুর কাছে ৪৫টা করে ফুচকা খেয়েছিলাম;
…একদিন আমি আর তুই পাশাপাশি বেতের ইজিচেয়ারে বসে ফোকলা দাঁতে দুধ-মুড়ি খাওয়ার কম্পিটিশন করবো।

সেদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার সময় হঠাৎই তোর ব্রেসিয়ারের তলায় উন্নত স্তনের স্পর্শ লজ্জাজড়ানো ভালোবাসা ডেকে এনেছিল;
…৪৪ বছর বয়সে মাসিকের কষ্টকর পেটব্যথার দিনে অপটু হাতে বানানো রুটিতে তোকে সেই ভালেবাসাটাই এনে দেব।

আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুচকি হাসিতে তোর গালের টোলটা চিকমিক করে ওঠে রোদ পড়ে, তখন খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করে;
…তোর-আমার গোল্ডেন জুবিলিতে তোকে অবাক করে একখানা লাল ফিতে বাঁধা টেডি বিয়ার নিয়ে ঘর এলে তুই হেসে ফেলবি, তখন তোকে সেই ডিউ থাকা চুমুটা খাবো।

ক্লাসবেঞ্চে পাশাপাশি বসে তোর সঙ্গে এক ইয়ারফোনে হ্যারি বেলাফন্টে শুনতে শুনতে যেভাবে হাতের ওপর হাত রেখে চুপটি করে বসে থাকি;
… রিটায়ারমেন্টের পর ঝমঝম বৃষ্টির সন্ধ্যাবেলা মুখোমুখি বসে “তোমার তখন একুশ বছর বোধহয়” শুনতে শুনতে সেই আঙুলগুলোকেই আঁকড়ে ধরবো বারবার।

উচ্চমাধ্যমিকের সময় যেমন একসাথে তোর সেই পুরোনো বাড়িতে বসে ফিজিক্সের টেস্টপেপার সলভ্ করতাম;
…তেমনি নীলসাদা ইউনিফর্মে সিস্টারদিদি হয়ে যখন নাইট ডিউটিতে যাবি, আমাদের পুঁচকিটার সব প্রবলেম সলভ্ করবো।

মাঝরাতের উন্মাদনাপূর্ণ চরম শরীরী আদরে তোকে পুরুষের পেলবতা উপহার দেবো বড়ো যত্নে;
… আবার শান্ত বয়ে যাওয়া বিকেলে কানে কানে ফিসফিস করে লালনের একতারা পৌঁছে দেব আস্তে আস্তে।

হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজে হঠাৎ ভালোলাগার কথায় তোর ‘অসভ্য একটা’ বলাতে নিজের মনে হাসবো;
… দশ নম্বর অ্যানিভার্সারিতে রুপোলি মোড়কে চেতন ভগতের হাফ গার্লফ্রেন্ড উপহার দিয়ে তোর ‘হারামি’ খিস্তিতে জড়িয়ে ধরে চুমুও খাবো।

তোর গালের নিচে ছোট্টো কালো তিলটার দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যেই যেমন নিজেকে হারিয়ে ফেলি;
…দস্যি পুঁচকিটার আসার পর কোনো এক বিয়েবাড়ির রাতে শাড়ির ফাঁকে তোর লম্বা স্ট্রেচমার্কেও তোকে সেভাবেই খুঁজে নেবো।

আমার তোর এই ব্যাপারটাকে দুনিয়া প্রেম বলে কি না, আমি জানতে চাইনা।
আমরা এটাকে বন্ধুত্বই বলবো, কেমন? আমাদের সমস্ত অসম্পূর্ণতা, অসহায়তা, অসৌন্দর্য আর অপ্রেমের সারল্য দিয়ে জীবনের ফাঁকফোঁকরগুলো বুজিয়ে দুজনায় মিলে থাকবো।

চল এগিয়ে যাই।

মুরগি লড়াই

—মুরগি লড়াই জানিস?
— সেটা কী? মুরগিরাও আবার লড়ে? একে-৪৭ নিয়ে নাকি!
— না। পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার গ্রামগুলোতে হয়। দুটো মুরগিকে লড়ানো হয় নিজেদের মধ্যে, আর চারপাশ থেকে সবাই সেটা দেখে মস্তি নেয়।
— আরেব্বাস! এতো পুরো বুলফাইট রে!
— অনেকটা তাই। দুজন তাদের ট্রেইন করা মোরগ নিয়ে আসে। সবাই গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ায়। ওদের পায়ে ধারালো ব্লেডের মত জিনিস দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়।
— তারপর?
— তারপর আর কী! লাগ্ লাগ্ লাগ্ ভেলকি! তবে এটায় একটা সাবোটাজ টাইপের ব্যাপার আছে।
— সেটা কীরকম?
— কেউ কেউ তার মুরগির ব্লেডে বিষাক্ত পাতা বেটে লাগিয়ে দেয়। অন্য মুরগিটার একটু কেটে গেলেও সে আর খেলতে পারে না বিষের চোটে।
—বটে!
— হুম। যতক্ষণ না একটা মুরগি মরে যাচ্ছে, ততক্ষণ তক্ক খেলা চলে। একটা মরে গেলেই অন্যটা জয়ী, মরা মুরগিটা দিয়ে ভোজ হয়।
— এটা কি শুধু খেলাই? নাকি..
— খাঁটি ধরেছিস! বেটিং হয়। লোকে বাজি ধরে হেভি স্টেকে, আর সেটার থেকে লাভও করে প্রচুর।
— বাহ্! দারুণ জিনিস তো!
[সাময়িক স্তব্ধতা]
— আচ্ছা, এটার সঙ্গে আমাদের সমাজের একটা কেমন অবাক মিল আছে না? আমরা নিজেদের মধ্যে মুরগিদের মতো লড়ে যাচ্ছি, আর কিছু মানুষ আমাদের মুরগি বানিয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি-খেয়োখেয়ি করতে বাধ্য করছে!
আমাদের বিষাক্ত ব্লেড নিয়ে আমরাও মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছি, শত্রু মনে করে বসিয়ে দিচ্ছি সেই ব্লেড অন্যজনের গায়ে। আসলে সেও কিন্তু আমার মতই পুঁজিবাদী সমাজের তলায় চেপটে যাওয়া শোষিত শ্রেণির লোক। সেও আমার লড়াইয়ের সাথী হতে পারতো।
কিন্তু, ওই চারপাশে ঘিরে থাকা পুঁজিপতি আর রাজনীতিকের দল আমাদের একে অপরের শত্রু বলে দেগে দিয়েছে। আমাদের আলাদা আলাদা দলে ভেঙে দিয়েছে। আর পায়ে বেঁধে দিয়েছে বিষাক্ত ব্লেড।
আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরছি, আর উপর থেকে সেই দেখে খুশিতে হাততালি দিচ্ছে সেই শোষক প্যারাসাইটগুলো, যে পরজীবী প্রাণীগুলো আমাদেরই এই লড়াই থেকে নিজেদের পকেট বোঝাই করে কালো টাকায় আর সুইজারল্যান্ডে ম্যানসন বানায়।
শুনতে কেমন অদ্ভুত লাগছে না?

মেথরদের ছোঁয়া যায় না। মুচিদের হাতে পয়সা দেবার সময় উপর থেকে দিতে হয়। কাজের মাসি চা খায় আলাদা কালো কানাভাঙা গ্লাসে। রঙের মিস্ত্রি ঘরে এলে চেয়ারে না, মাটিতে বসে। ডিমচাচা ঘরে ঢোকে না, বাইরে থেকেই ধরিয়ে দেয় ডিমের ঠোঙা।
আমরা মুরগি হতে হতে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে আলাদা আলাদা স্তর বানিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছি। আর দুর্বল হয়ে পড়ছি ক্রমাগত।
এভাবে, আর কতোদিন?