মা দিবস

আজ সবাই মায়ের কথা বলবে। রান্না করে খাওয়ানো মা। টিফিন গুছিয়ে দেওয়া মা। রাত জেগে সেবা করা মা। পড়তে বসানো মা।
আজ সারাদিন মায়ের জয়জয়কার। হাউসওয়াইফ মা। যেসব মায়েরা বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকে জল এনে দেয় তড়িঘড়ি। যেসব মায়েরা বাবার ছেড়ে যাওয়া থালায় ভাত খায় রোজ। গৃহবধূ মায়েদের দল।
সিঁদুর, টিপ, ঘোমটা আর আঁচলের আড়ালে এখানে গোটা মানুষটাকে ঢেকে দেওয়া হয়। তার স্পর্শ মানেই স্নেহ, রান্না মানেই ভালোবাসা— এই বাইনারিতে তার পরিবারের প্রতি শ্রমটুকুই ফুটে ওঠে, মানুষটা হারিয়ে যায়। চাপিয়ে দেওয়া মাতৃত্বের তলায়।
এই সমাজ সচেতনভাবেই সেসব মায়েদের কথাই তুলে ধরে। যারা রাঁধেন-বাড়েন, যাঁরা জামার বোতাম সেলাই করে দেন, যাঁরা রাতের বিছানা তৈরি করে দেন। কিন্তু সমাজ সচেতনভাবেই তাদের শ্রমের অংশটুকু চেপে যায়। লুকিয়ে ফেলে ‘শ্রমের মর্যাদা’ দেবার প্রয়োজনবোধকে।

একজন গৃহবধূকে এই পরিবারব্যবস্থা যেভাবে শোষণ করে, তারপরেও এই ‘গৃহশ্রম’কে শুধুমাত্র স্নেহ-মমতা-প্রেমের দোহাই দিয়ে ব্যাখ্যা করা অনুচিত। ‘সংসারের দায়িত্ব’ শব্দবন্ধটুকুর আড়ালে যাঁরা গৃহবধূদের শারীরিক ও মানসিক শ্রমের দিকটিকে চেপে দিতে চাইছেন, তাঁদেরও সচেতন হবার সময় এসেছে।
সমাজের প্রতিটি ‘মা’য়ের কাছ থেকে প্রেমের দোহাই দিয়ে যেভাবে ‘গৃহশ্রম’টুকু নিংড়ে নেওয়া হয় ভোর থেকে রাত পর্যন্ত, তাতে নানাভাবে গৃহবধূ মাদেরকেই প্রশংসার উজ্জ্বল আলোকে দেখাতে চায় সবাই। গৃহবধূর পরিবারপ্রেম, পতিপ্রেম, সন্তানপ্রেমের কথাই বারবার তুলে আনা হবে। ভুলিয়ে দিতে চাইবে তার শ্রমের চরিত্র। ভুলিয়ে দিতে চাইবে তার একান্ত নিজস্ব অধিকারের দাবিগুলো।

পরিবারতন্ত্রের সুখী মুখোশের আড়ালে এসব নিষ্পেষিত শ্রমিকদের কথাও বলা হোক। বলার দরকার আছে।
যাতে, ‘মা কী করে’ প্রশ্নের উত্তরে ভর্তি ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী উত্তর না দেয়— ‘আমার মা কিছু করে না। হাউসওয়াইফ।’

শুভ মা দিবস।

যেমনটা কখনো হয়না

 

ছোটোবেলায় আমাদের একটা স্কুল ছিল। এই স্কুল শব্দটার সাথে ছোটোবেলাটাই মানায় ভালো। যেমন মানিয়ে যেত গরমকালের লম্বা আটঘন্টার দুপুরগুলো। টেনেটুনে এঁটেউঁটে খাপ খেয়ে যেত ঠিকই।
স্কুলটার স্কুল হবার সবরকমই যোগ্যতা ছিল। দুতিনটে মাঠ ছিল। পুরোনো বড় বড় ক্লাসরুম ছিল। চোরকাঁটার জঙ্গল ছিল, যেখানে ফুটবল আনতে গেলেই মোজা আর খাকি প্যান্ট ভর্তি হয়ে যেত চোরকাঁটায়। যেটাকে বলে জুরগুন্ডা। মাঠে প্রচুর ধুলো ছিল। সাইকেল করে বাড়ি ফেরার সময় জুতোয় কিচকিচ করতো। ভাঙা কোণের বাথরুমে ইঁটের লাল টুকরো দিয়ে অনেক কিছু লেখা ছিল। মনিটরদের নাম লেখা ছিল। শিক্ষক দিবসের বিকেলে ভারভারিক্কি স্যারের হাতে বিরাট ওভারবাউন্ডারি ছিল। নিলডাউন ছিল। পরীক্ষায় অঙ্ক ছেড়ে এসে কান্না ছিল। একটা হেডস্যারের অফিস ছিল। হেডমাস্টারকে আড়ালে হেডু বলা ছিল। একটা গোবরে ভর্তি সাইকেল স্ট্যান্ড ছিল; যাতে সাইকেল থাকতো কম, গরু থাকতো বেশি। একটা ক্লাসপালানোর আমতলা ছিল। একটা সাইকেল দিয়ে ঘিরে ক্রিকেট খেলার নিমতলা ছিল। একটা ভূতের গল্পজড়ানো শাল মেহগনির জঙ্গলও ছিল।
আর ছিল নানারকমের বন্ধু। উরেবাব্বা। ছোটোবেলায় যেদিন একসাথে এতোগুলো লোক গিয়ে ক্লাস থ্রির ঘরটায় বসে পড়লাম, সেদিন সবাইকে একইরকম মনে হয়েছিল। সব বেঞ্চে চারজন। আমি শেষ বেঞ্চে। কারণ শেষে এসেছি, দৌড়তে দৌড়তে। রিক্সাকাকু দেরি করে ফেলেছে। তাড়াতাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আবার জানালার পাল্লায় ধাক্কা খেয়েছি। প্রথমদিনেই। তাই প্রথমদিনেই সিকিমাথা আলু নিয়ে আমি বসে আছি শেষ বেঞ্চে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম চোখ গেলো ব্ল্যাকবোর্ডে। লেখা আছ‌ে, বড়ো বড়ো করে, ‘১০০ থেকে ১ লেখো উল্টোদিকে।’ আমি খাতা পেন বের করে ৭০ পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখলাম, তিননম্বর বেঞ্চ থেকে একটা পাতলা ছেলে উঠে গেল স্যারের কাছে। শুধু আমি না, গোটা ক্লাসই অবাক। স্যারও। পাশ থেকে কে একজন ফিসফিস করে বললো— ‘ঋজু সরকার। ফার্স্ট বয়। অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হয়েছে।’
প্রথমদিনেই একজন আলাদা হয়ে গেল।
নামতা, বানান, ব্যাকরণের ভিড়েই দিনগুলো কেটে যেত টুকটুক করে। ছোটোবেলা থেকেই ঘর ভালো লাগতো না। তখন ঘর পালিয়ে যাবার একমাত্র রাস্তা ছিল স্কুলবাড়িটা। প্রবল বর্ষাতেও ভিজতে ভিজতে স্কুল, আবার গ্রীষ্মের ছুটির আগে শেষ দিনের ক্রিকেটের জন্যও স্কুল।
ক্লাসমেটরাও আস্তে আস্তে বন্ধু হতে থাকলো। থ্রি থেকে ফোর। ফোর থেকে ফাইভ।
ততদিনে মাঝারি ছেলে হয়ে গেছি। মাঝামাঝি বেঞ্চে বসতাম। হাফিয়ার্লি হোক বা অ্যানুয়ালি, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড কোনোদিনই হতাম না। ভয় ছিল। পাছে স্ট্যান্ড করলে লোকে পরের বারও স্ট্যান্ড করতে বলে। আবার শেষবেঞ্চও তেমন টানতো না। ভয় ছিল। পাছে ফেল করে গেলে লোকে হাসে। তখন থেকেই আদর্শ মধ্যবিত্তের ভয় জাপটে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। শীতের দুপুরে কিপারের বাঁপাশে দাঁড়াবার সময় বেগুনি মাফলার যেমন প্যাঁচ মেরে কোমরে ঝুলত, সেরকমই সঙ্গী ছিল এই ভয়টা।
ফার্স্টবয় ছিল ঋজু সরকার। সেকেন্ড বয় উন্মেষ নামের একটা ছোট্টোখাট্টো ছেলে। ক্লাসে পড়া ধরতেন স্যার। একটা ড্যাম্প ধরা ক্লাসরুমে। বিকেল হলে একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসতো। আর আমরা পা দিয়ে ব্যাগের শেষ চেনে রাখা স্টাম্পার বলটাকে নাড়াতে নাড়াতে ভাবতাম, কখন সিক্সথ্ পিরিয়ডটা শেষ হবে। স্যারের কোশ্চেন জিজ্ঞেস করার বাই চাপলে সাঁৎলে নেমে যেতাম বেঞ্চের তলায়। মাঝে মাঝেই অতিবুদ্ধির জেরে জুটে যেতো কানচাপড় বা মাথায় চাঁটি। সেইসময়েও ঋজু, উন্মেষরা উত্তর দিয়ে যেতো। কতো কতো প্রশ্ন। তার সুন্দর গুছোনো উত্তর।
আর আমরা কাটাকুটি খেলতাম শেষ পাতায়। কেউ ক্রস। কেউ গোল্লা।
পিছনের বেঞ্চেও কতো কতো লোক ছিল। অমিত, বিপ্লব, গৌর। আরো কতো কারা। পিছনের দিকের নাম তো, ভুলে যাওয়া যায় সহজেই। কোনো অজুহাত ছাড়াই। তারা ছিল খারাপ ছেলে। অমিতকে সন্ধ্যের পর নাকি বাইকের পেছনে দেখা যেত। বিপ্লবের হোমওয়ার্কের খাতা স্যার একবার গোটা ক্লাসের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ কোম্পানির সেই জিলজিলে খাতা পড়েছিল ধুলোয় অনেকক্ষণ। সেই থেকে বিপ্লবের নাম হয়ে গেল চ্যালেঞ্জ। ওকে আর কেউ বিপ্লব বলে ডাকতো না।
বিপ্লব যখন স্কুলে ঢুকতো, তখন তার সাইকেলটাকে ঠেলে দিতো মাঠে ঢোকার সময়ই। সাইকেল একা আসত গড়গড়িয়ে গোটা মাঠ। বিপ্লব আসতো পেছনে হেঁটে। একদিনও প্রেয়ার করতো না। অমিত ইউনিট টেস্টে পেত কুড়ির মতো পাঁচ। স্যার বাঁকা হাসি ছাড়া ওর খাতা ফেরত দিতো না। কিন্তু সেই অমিতই লাট্টু খেলায় সবাইকে হারিয়ে দিত। গৌর মাসে তিরিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিন ক্লাসে আসতো। ডাইরিতে লম্বা লম্বা লাল দাগ পড়তো। কিন্তু ক্রিকেট টুর্নামেন্টের স্পিন বোলিংয়ে গৌর ছাড়া আর কেউ ছিল না!
ক্লাস বাড়তে লাগলো আমাদের। আমাদের বেঞ্চও মাঝ থেকে সরতে সরতে শেষের দিকে যেতে লাগলো।

এরকমই একটা ছেলে ছিল। পেছনের বেঞ্চে বসতো। মাসে দশদিন আসতো। ডাইরিও আনতো না। স্যার নামপ্রেজেন্টের পর ডাইরি না আনার কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ‘হারায় গেছে সার।’ বলেই চুপচাপ গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে যেত। স্যার রেগেমেগে বলতেন, ‘বাবাকে বলবি দেখা করতে। কালকেই। হেডমাস্টারের ঘরে।’ রাজশেখর বলতো, ‘আসতে পারবেক নাই সার। বাপ দুধ বেচে। সময় করতে পারবেক নাই দুফুরদিকে।’
হ্যাঁ, ছেলেটার নাম ছিল রাজশেখর। মনে আছে। কোঁকড়ানো চুল। কালো গায়ের রঙ। দাঁতগুলো সাদা। পড়তো বি সেকশনে। বি সেকশনের সাথে আবার আমাদের এ সেকশনের তেল-পিঁয়াজের সম্পর্ক। এমনিতে খুব ভালো ব্যবহার, কিন্তু গরম হলে চিড়বিড় করে ওঠে দুতরফই। বছরে গরম হওয়ার কয়েকটা বাঁধাধরা সময় ছিল। যেমন অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট। যেমন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। যেমন ফুটবল ম্যাচ।
সেরকমই একটা ক্রিকেট ম্যাচ। ক্লাস সেভেন তখন আমাদের। ডে স্কুল হয়ে গেছে। সাইকেল চেপে স্কুল আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। সেইসব সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে আমরা মাঠের ধারে বসে রয়েছি। এ সেকশন ব্যাটিং। বি সেকশন বোলিং। তিন ওভার হয়েছে। তাতেই ৪০ রান উঠে গেছে। অনীশ নামের একটা ছেলে লেগস্পিন করতে এসেছিল। তাকে দুটো ছয় আর একটা চার পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়েছে। আমাদের মন খুশি খুশি। আমরা স্কোরিং এর খাতায় তিন নম্বর ওভারের শেষ বলের ছয়টা লিখছি, ওমনি শুনি হইহই শব্দ গোটা মাঠে। দেখলাম ব্যাটিং এন্ডের মহারথী মুখ চেপে পিচে বসে পড়েছেন। শুনলাম নাকি ফোর্থ ওভারের প্রথম বলেই এক পেসার এসে সরাসরি বল ছুঁড়েছে ব্যাটসম্যানের থুতনি লক্ষ্য করে। আমরা তখন এরকম বলকে বলতাম ‘বিমার’। আমার দেখা প্রথম বিমার। সেই ওভারটাতেই তারপর প্রথম হ্যাট্রিক দেখলাম। একটা বোল্ড। উইকেটটা কিপারের পায়ের কাছ পর্যন্ত ছিটকে গেছল। পরের দুটো ক্যাচ। ম্যাচটা জিতে গেছল বি সেকশন। আমরা নক আউট হয়ে গেছলাম।
বি সেকশনের পরের ম্যাচ ছিল সেমিফাইনাল। ম্যাচটা হেরে গেছিল ওরা। হেরে যাবার পর ঘামে ভেজা জার্সি পরেই রাজীব প্রীতমরা অনেক গাল দিয়েছিল রাজশেখরকে। রাজশেখর আসেনি সেদিন। সবাই বার বার বলা সত্ত্বেও। বাপের সাথে দুধ বেচতে গেছল।
সেই প্রথম চিনলাম রাজশেখরকে।
তারপর আস্তে আস্তে ক্লাস পেরিয়ে যেতে থাকলো। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি। ছায়া প্রকাশনী, টিউশনি। মাধ্যমিক তখন আর একবছর। সবাই বলতো, ‘জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা বাবা। পড় এখন থেকে ভালো করে।’ রাজশেখরকে মাঝে মাঝে দেখতাম একা দুপুরের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তখন ম্যাপ পয়েন্টিং করতাম। অন্য কোনো দেশের মাঠে পেন্সিলের দাগ পড়তো।
রাজশেখরকে নিয়ে আবার একটা হইচই হল। ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ারলির পরেই। ফোর্থ পিরিয়ড শেষ করে বেরোতেই শুনলাম, রাজশেখরকে নাকি জঙ্গলের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। দিন দশ পর আবার যে কে সেই। জিজ্ঞেস করতে বললো নাকি একটা চারা পুঁততে গেছল পুকুরপাড়টায়।
হ্যাঁ, দুমাস আগেই হেডস্যারের নির্দেশে একটা পুকুর খোঁড়া হয়েছিল স্কুলে। শুনতাম নাকি মাছ চাষ হবে। রাজশেখরের মনে হয়েছিল, ‘পুকুরের পাশে গাছ না থাকলে ন্যাড়া লাগবেক নাই পুকুরটা?’

আমাদের মাধ্যমিক চলে এল। টেস্ট শেষ। টেস্টের খাতা দেখতে গেছলাম স্কুল। সাইকেলের তালা খুলবার সময় রাজশেখরের সঙ্গে দেখা। রাজশেখরের তখন টেনেটুনে সবে এইট। অ্যানুয়াল পরীক্ষা ওরও। বলল দেবে না। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘দিলি নাই। পরে দিব।’
তখন অতো মাথা ঘামাবার সময় কোথায়? টেস্টপেপার, প্র্যাকটিস চলছে। ঋজুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে আমিও যাচ্ছি। সবাই কঠিন কঠিন প্রশ্ন খোঁজে টেস্টপেপারে, কোশ্চেন ব্যাঙ্কে। উত্তরও।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। সবাই আস্তে আস্তে দুদলে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। ইঞ্জিনিয়ারিং নইলে মেডিক্যাল। অঙ্কটা পারতাম না তেমন, তাই আমিও ভিড়ে গেলাম মেডিক্যালের দলে। লোকজন আবার বলতে থাকল, ‘জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বাবা। সবচেয়ে ক্রুশিয়াল দুটো বছর।’ আবার শুরু হলো ভয় পাওয়া। জয়েন্ট বেসড কোচিং। প্রতিযোগিতা আর রেষারেষি চলতে থাকল সবার মধ্যেই। স্কুল যাওয়া কমিয়ে সবাই ঘরে পড়তে লাগলো বেশি বেশি করে। স্কুলে তেমন পড়া হয় না।
স্কুল গেলেও টিফিনের সময় আর কেউ ব্যাট বার করতো না। এমসিকিউ করতো মোটা বই বের করে। আমরা, মাঝারি বেঞ্চের দল, মাঝে মাঝে খেলতে নামতাম। লোক কম হতো। টিম ছোটো হতো। এরকমই একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা হল রাজশেখরের সাথে। দুধের ক্যান চাপিয়ে যাচ্ছে বেলগুমা পুলিশ লাইনের দিকে। দেখা হতেই সাইকেল থামিয়ে একগাল হাসি দিল। আমরা ৬-৭ জন একসাথে ফিরছিলাম। সবাই মিলে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন চলছে পড়াশুনো। বলল এবছর মাধ্যমিক। কিন্তু দেবে না। কারণটা বললো ভারি অদ্ভুত হেসে, ‘স্কুলটা ছাড়ি দিতে মন করছে নাই। স্কুলটাই ভালো লাগে।’
আমাদের উচ্চমাধ্যমিক। টেস্টের আগের শেষ দিন ক্লাস। অফিশিয়ালি, স্কুলে আমাদের শেষ দিন। মণীশ একটা ক্যামেরা এনেছে। সবার ছবি তুলে বেড়াচ্ছে ক্লাসজুড়ে।
আমি জানালা দিয়ে আনমনে দেখছিলাম, রাজশেখর কয়েকটা বাচ্চা ছেলের সাথে শর্টপিচ খেলছে। হঠাৎ আউট হয়ে গেল।

স্কুল শেষ হবার পরে সবাই বলে, ফিরে আসবো। কলেজের প্রথম কয়েক বছর ঘর এলে স্কুল যেতামও। সেই সাইকেলটা নিয়েই।
থার্ড ইয়ারে সেরকমই একবার স্কুল গেছলাম। স্যারদের সঙ্গে দেখা করে ফিরছি, দেখলাম মাঠের কোণে একটা নেভিব্লু সোয়েটার পরা ছেলে কার একটা সাইকেলের পাম্প খুলে দিচ্ছে। সামনে যেতেই ছেলেটা একগাল হাসলো। রাজশেখর। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছিস রে?’ বললো, ‘ছিলাটা আমার মাকে গাল দিয়েছে সবার সামনে। পাম্পটো খুলে দিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘তোর মা?’
বললো, ‘কবে মইরে গেছে। হায় করেছে।’
রাজশেখর তখনো ইলেভেনে পড়ে। আর্টস নিয়ে। ফেরার আগে বললো, ‘স্কুলটা ছাইড়ে কুথায় যাবো বল? তোরা আসবি, দেখা করবি। আমি ঠিক থেকে যাবো ইখানে।’

আমার বয়স হয়ে গেল ত্রিশ বছর। স্কুল যাইনা বহুদিন। সাইকেলটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল, বাবা কাকে একটা বিক্রি করে দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা সবাই আছে অবশ্য। ফেসবুকে দেখতে পাই প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করলে। আড্ডা মারাটা আর হয়না। সময়ই ম্যাচ করে না কারোর। কালেভদ্রে ঘর এলেও আর কাউকে ফোন করে ডাকা হয়ে ওঠেনা।
স্কুলটাও পাল্টে গেছে। স্যারেরা প্রায় কেউই আর নেই। সবাই নতুন মুখ। পুরোনো লাল ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিংগুলো ভেঙে নতুন বিল্ডিং উঠেছে। স্কুলের দেওয়ালে কাঁটাতার লেগেছে।
হঠাৎ একদিন স্কুলের সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে ফিরছি। দেখি একটা চেনা মুখ মেন গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করছে।
রাজশেখর বললো, ‘এখন ঘন্টি বাজাই স্কুলে। আমি ঘন্টি না দিলে স্কুল ছুটি হবেক নাই।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুলেই রয়ে গেলি?’
বললো, ‘স্কুলটা ছেড়ে কুথায় যাবো বল? স্কুলটা ছাড়তে মন করে নাই। তোরা সব চলে গেলি, স্কুলটাকে কে দেখবেক বল?’ বলেই হাসলো। একগাল হাসি।

আমি বাইক নিয়ে চলে এলাম।
পেছনদিক থেকে স্কুলের গেটটা বন্ধ হয়ে যাবার আওয়াজ পেলাম।

কাকস্নান

শীতকালে স্নান করার আটটি সহজ ধাপ:

এই পুরো ঘটনাক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশটি প্রথমেই রয়েছে। বিভিন্ন হিতৈষীগণ বলে থাকেন, তুরুপের তাস নামক মহার্ঘ্য বস্তুকে লুকিয়ে রাখতে হয় শেষপর্যন্ত। আমি আবার কূটকৌশলে কোনোদিনই তেমন পটু হয়ে উঠতে পারিনি, তাই ও আনন্দের স্বাদ আমার নাগালের বাইরে। তাই প্রধান নির্দেশটি প্রথমেই বলে দিই।
১২ দিন স্নান করবেন না। আপনি যদি এবিদ্যায় শিক্ষানবিশ হন, তবে ১০দিনেও নামতে পারেন। তবে তার কম কোনোমতেই না! ১২,১৪,১৫ যা ইচ্ছা হয় আপনার। যত দিনবৃদ্ধি, তত বেশি আনন্দ। আহা, ১০-১৫ দিন নির্জলা না থাকলে আপনি বুঝবেন কী করে যে, শীত আদৌ এসেছে কি না! আশেপাশের জীবকূলই বা তা টের পাবে কেমনে! আমার ২০ দিনের কৃতিত্বটি অতিক্রম করার দুঃসাহসও করে দেখতে পারেন। পারলে একখানা অতি কার্যকরী গন্ধ-বিতাড়ক আতর পুরষ্কারস্বরূপ দান করব।

এইবার আসুন, পরের ধাপে যাই। একটু কষ্ট করতে হবে আপনাকে এবার। শত অজুহাতের ঝুলি থেকে একটি গ্রহণ করুন। কোনো ব্যক্তি আপনার স্নানসাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেই এই হাত ছুঁড়িয়া মারবেন সপাটে। অজুহাত হতে পারে আপনার শয্যাসঙ্গিনীরূপী অলসতা, আপনার প্রিয় পোষ্য ঠান্ডার ধাত, বা নিতান্তই প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য মাথাব্যথা/জ্বরের অজুহাত। শেষেরটির ক্ষেত্রে সাবধান! চোখ কচলিয়ে লাল করে, চুল উস্কোখুস্কো করে, গলা সরু করে, ‘বাইরে সত্যিই বরফ পড়ছে’ বুঝিয়ে ওঠাবার ক্ষমতা রাখলে তবেই ও পথে পা বাড়ানো শ্রেয়। অজুহাত দিয়েই যান। দিয়েই যান। দিয়েই যান। তারপর, একসময় আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার দূর্গের প্রাচীর ধ্বসে পড়ছে। কামানের গোলা প্রতি বাক্যবর্ষণে আগুন ঝরাচ্ছে। মনে মনে বুঝবেন, সময় হয়ে এসেছে।

পরের ধাপ। সংগ্রাম। হ্যাঁ সাথী, এসময় বসন্তের নয়। শীতের। তাই এবার সংগ্রামের প্রস্তুতি নিন। আপনার বসতবাটী কীপ্রকারের?
যদি ঘর হয়, আপনার প্রতিপক্ষ আপনার আপন মাতা। হ্যাঁ বন্ধু, যে মাতা এতদিন স্নেহ ও প্রশ্রয়ের চক্ষে আপনাকে সহ্য করে চলেছিলেন, আজ তিনি ব্রুটাসরূপ ধারণ করবেন। এই যুদ্ধে তাঁর সাথে পদাতিক বাহিনী হিসেবে চোখপাকানো পিতা, হাইজিনিক জেষ্ঠ্যভ্রাতা, ফোড়নকারী কনিষ্ঠ ভ্রাতারা থাকতে পারেন। থাকিতে পারেন খুন্তি, চপ্পল, কড়াই, বেলনা প্রভৃতি রথী-মহারথীরা। পাঠক, সাবধান! এই যুদ্ধে আপনার পরাজয়ের সম্ভাবনা প্রবল। আপনার প্রধান বাধা হইয়া দাঁড়াতে পারে আপনার নিজস্ব দ্বান্দ্বিক মন। চারিদিকে ফরসা পরিস্কার মানুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ মনোবল হারানোই হতে পারে আপনার দূর্গ পতনের শেষ বিভীষণ।
যদি ছাত্রাবাস হয়, তবে আপনি কিছু সুবিধা পাবেন। ছাত্রাবাস। নামেই প্রকট, এই স্থানে কেবল ‘বাস’যুক্ত ছাত্ররাই থাকে। তাই আপনার আশেপাশের সহমর্মী মানুষগুলির গন্ধে আপনার কীর্তি লোকনাসিকার আড়ালে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। তাও, একসময় আপনার পাতের শাক শেষ হয়ে যাবে। আপনার পচনশীল মৎস্যটি লোকসমক্ষে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। তখন আপনাকে হতচকিত করে আশেপাশের বিনম্র বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষগুলি হুঙ্কারপ্রদানকারী মাংসাশী ব্যাঘ্রে পরিণত হবে অকস্মাৎ।
আপনার এই হতবাক হওয়াই নির্স্নান জীবনে আপনার শেষ অনুভূতি।

পরের দৃশ্য। আপনি পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলতে বাধ্য হবেন। পাঠক, লজ্জিত হবার কোনোরূপ কারণ নাই। ধবধবে নোংরা গামছাখানি দড়ি হইতে বিচ্যুত হয়ে চরিত্রের কোমরে স্থান পেয়েছে এতক্ষণে। ‘ধবধবে নোংরা’ শব্দবন্ধটি বিশ্লেষণ করে দিই জনস্বার্থে। ধবধবে, কারণ ১৫ দিন আগে আপনি উহা কেচে পরিষ্কার করে দড়িতে দোদুল্যমান করে রেখেছেন। কিন্তু নোংরা, কারণ এই ১৫ দিনে আপনি বেচারার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই।
যাই হোক, আপনি গামছা পরিধান করে ফেলুন। এবার একটু প্রতিশোধের পালা। চলভাষে ‘মাই নেম ইজ শীলা’ গানটি চালিয়ে বগলদেশ উন্মুক্ত করে খানিক নাচ করে আসুন সেই পাষণ্ড ব্যক্তির সামনে, যার জন্য এই সাইবেরিয়াসম শহরে আপনাকে স্নানদন্ডাদেশ মাথা পেতে নিতে হয়েছে। তাকে জড়িয়ে ধরে এক পোঁচ কালো গা গায়ে ঘষে সোহাগ করুন। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নাকভরে নিজের দেহের গন্ধ নিন আর মুখ বিকৃত করে ‘আহ্’ বলুন।

পরবর্তী ধাপ, পলায়ন। স্বাভাবিক, নয় কী? মরণশীল মানুষ মাত্রেই আপনার পশ্চাদ্ধাবন করবে এই অবস্থায়। আপনি গামছা সামলে (বা না সামলে) দৌড় দিন আপনার নিয়তি অভিমুখে। গামছা না সামলানো আপনার পক্ষেই যাবে, সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না।
স্নানঘরের চৌখুপির নিকটবর্তী আসামাত্র দৌড়ের গতিবেগ কমিয়ে দিন। রঙ্গরসিকতা অনেক হয়েছে। এবারে জীবনের এই গভীর সমস্যা আপনাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে ফেলুন। ভুরু কুঁচকে নিন। মুখে কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলুন। মনে রাখবেন সাথী, ইহা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কিছুই নহে।

এরপর স্নানঘরের দরজার সম্মুখে। একবার করুণ চোখে দেখে নিন জানালা দিয়ে আসা একফালি রোদ, ইউরিনালের সেই সুমধুর গন্ধ নাক ভরে নিয়ে নিন— কারণ আপনি এই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবেন কী না তা নিশ্চিত নয়। শেষমুহূর্তে চোখ বন্ধ করে হিসেব করে নিন জলের তাপমাত্রা, মেঝের তাপমাত্রা, শাওয়ারের হাতলের তাপমাত্রা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি।
তারপর ঢুকে পড়ুন স্নানচেম্বারে।

পরবর্তী ধাপ। ধাপ না বলে ধপ্ বলাই ভালো। মর্ত্য থেকে আপনার পতন ঘটবে নরকে। এইপ্রকার নরকে আপনাকে সোয়াবিন তেলের বদলে পরিশুদ্ধ গলনশীল বরফে চুবোনো হবে।
ইংরিজিতে একখান শব্দ রয়েছে। Acclimatization। এখানেও সে জিনিসটি করা খুব প্রয়োজনীয়। পাঠক, চোখ বন্ধ করে ফেলুন।
গামছা ঝুলিয়ে দিন কোথাও একটা। আর আপনি নগ্নদেহে উপভোগ করুন শৈত্যপ্রবাহের চুম্বন। দরকারে দুএকবার লাফিয়ে নিন। শাওয়ারের ঝারি থেকে কোন কৌণিক পদ্ধতিতে শীতল মৃত্যু নেমে আসবে আপনার দেহে, দেখে নিন। হাত দিয়ে ঘষে শাওয়ারের হাতলের উষ্ণতা বাড়িয়ে নিন।

এবার।
পদার্থবিদ্যা কী বলে? বলে, ঘর্ষণে তাপ সৃষ্টি হয়। আরো বলে, কার্যের ফলে তাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই চৌখুপিতে কী কার্য সম্ভব?
আমি জানি, আপনি জানেন।
শাওয়ারের হাতল ঘুরিয়ে দিন একঝটকায়। কোনোমতেই যেন ধীরগতিতে জল না পড়ে আপনার দেহে। আপনি কষে চোখ বন্ধ করে ফেলুন। মনে করুন, এটা বিজয়া দশমীর রাত। স্নানঘর নয়, এটা আসলে প্রতিমা বিসর্জনের ট্রাক। আর উপরে ওটা পায়রাসমেত ঘুলঘুলি মোটেই নয়, বাড়ির জানালা। সেখান থেকে আপনার প্রেমিকা তাকিয়ে আছেন।
উপর থেকে ঠান্ডা নেমে আসুক। আপনি পায়ের তালে স্নানঘরের মেঝে থেকে তাপ উৎপন্ন করুন। একসময়, অনুভব করতে পারবেন, দুইদিক থেকে উৎপন্ন দুই শক্তি আপনার নাভিতে এসে একে অপরকে শূন্য করছে।
এটা একটা সংকেত। আপনার তিননম্বর শক্তিকে রণক্ষেত্রে পাঠানোর। আপনার গর্দভকন্ঠকে দড়িছেঁড়া ছাগশিশুর মতো কচি মাঠে ছেড়ে দিন। পিঠে বর্ষার মত বারিধারা ঝরে যাক আর আপনি মনের সুখে গাইতে থাকুন— “ঝুমকা গিরা রে/বরেলি কে বাজার মে ঝুমকা গিরা রে”! আপনি যেহেতু আর কোনো কথা জানেন না এই গানটার, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান সুরে এই একই পংক্তি গেয়ে যান। আপনার বৈচিত্র্যময় কন্ঠকে সপ্তম সুরে চড়িয়ে গাইতে থাকুন। আশেপাশের সবাইকে জানিয়ে দিন আপনার স্নান করার শুভমুহূর্তের কথা। বৈচিত্র্যের জন্য কথা পাল্টে গেয়ে নিন— “ঠান্ডা গিরা রে/কলকাত্তা কে বাজার মে ঠান্ডা গিরা রে!” নেচে নেচে গাইতে থাকুন। স্নানের আনন্দে আত্মহারা হয়ে গাইতে থাকুন আর হাত ঘষতে ঘষতে দেহের যাবতীয় আবর্জনা সরিয়ে ফেলুন।

শেষ ধাপটা আপনি বুঝতে পারবেন না। ঠান্ডা জল যখন গাসওয়া হয়ে যাবে, তখন গান-নাচ-স্নানের আনন্দে সময় কোথা দিয়ে পেরিয়ে যাবে, বোঝা যাবে না। হঠাৎ আপনাকে হতচকিত করে দিয়ে দরজায় ক্রুদ্ধ আঘাতের ঘনঘটা শোনা যাবে। বাইরে থেকে শুনবেন, আপনার কাংস্যবিনিন্দিত কন্ঠের জেরে কপু আসছে অাপ্যায়ন করে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যেতে।
তখন আপনি শাওয়ার বন্ধ করবেন। গামছা নিয়ে সারাদেহ রগড়ে রগড়ে মুছবেন। এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন সাথী, আপনি পরবর্তী ১৫ দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই মহান কার্য সমাধা করার পর আপনি রাজার মতো চালে বেরিয়ে আসবেন স্নানঘর থেকে। তারপর ৩২ পাটি দাঁত বের করে একখানা রাজকীয় হাসি ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকবেন।
ঘরের লোকজন নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রূপের দ্বারা আপনাকে উত্তেজিত করার হীন চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু আপনি তখন সপ্তম স্বর্গে।

গামছা খুলে নতুন জামাকাপড় পরে ফেলুন।
স্নান করার অনির্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করুন জানালার ধারের মিষ্টি রোদে বসে।
আপনাকে স্বাগত আমাদের P.A.N.I (Person Water No Interaction) গ্রুপে!

রাতের কথা

তুই,
হ্যাঁ, তুই। তোকেই বলছি। শেষরাতের সব জড়ানো কথা তো আসলে তোকেই বলা। কারণ জানি, রাত বললেই তুই আর আমি চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে উঠবো। রাত বলতে মানুষ বোঝে শরীর। আর আমরা বুঝি রাজত্ব। তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, মানুষ মানুষকে খোঁজে না। তুই সিগারেটের ধোঁয়াটা মুখে রেখে তাকালি। আমি বললাম, খোঁজে স্মৃতি। তারপর তুই ব্যস্ত হয়ে পড়লি ধোঁয়া ছাড়তে, ঠিক যেমন করে মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায়। সত্যি। মানুষের নামে তো স্মৃতিই ধরে বেড়াই। একসাথে একটু পথ চলাও তাই তোর। দূর থেকে দেখতে পেয়ে চোখের ঝিলিকও তোর। এই শান্ত শহরের বেভুল পাগলামিও তোর নামে লেখা। তোর, বকলমে আমার।
রাস্তাগুলো দরকার। হাঁটা দরকার। রোদ দরকার। টপটপিয়ে ঘাম সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু সময়ে সময়ে লম্বা গাছগুলোর ছায়াটা বড্ডো বেশি নিজের প্রাপ্য ধরে নিই। তারা ত্যাগের আনন্দে লম্বা হতে থাকে, কিন্তু ছায়াগুলো থেকে যায় একইরকম। না বড়ো, না ছোটো। ছায়াদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কেন করি না আমরা? জানিনা তাদের ছাড়া কীভাবে জিরোতাম এই প্রতিদিনের রোদে। তাদের নরম বন্ধুত্ব পাতা হয়ে ঝরে পড়ে টুপটাপ। কিন্তু ছায়া বড়ো হয়ে অন্ধকার করে দেয় না চলার রাস্তা।
তুই জানিস। সব কথা বলতে হয় না। আবার কতো কথা বলতে হয়। যার সঙ্গে বলি “আমি মুটেমজুর মানুষ, কবিতা পোষায় না”, তার সাথেই পাশাপাশি বসে রাতের চাতালে নীরব কবিতা পড়ি। হয়, এসবও হয়। কতোবারই তো হয়ে এসেছে। ভালোবাসা বন্ধুত্বের সমাজ বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা হেলায় কেটেছি কতোবার। কখনো উত্তেজনায়, কখনো আত্মবিশ্বাসে, কখনো কেবলই মুহূর্তের তাগিদে। সবসময় হাত ধরতেও হয়নি। হাত ছেড়ে নিজের পায়ে হেঁটে যাওয়া তো শিখতে হয়। আর একলাপনার নেশায় সে ক্লাস কখনো আমার, কখনো তোর। তোর আমার হাতে হাত মানে ব্যারিকেড। সে হাতে কাস্তেও থাকে, হাতুড়িও। দুজনেই শিখি। গড়ি। তার থেকেও দরকারি, ভাঙি। হাতুড়িটা তাই খুব কাজের।
ভাঙতে তো হবেই। না ভাঙলে গড়বো কী করে? তাই ভেঙে যাই। পায়ের শব্দের আওয়াজ কমতে থাকলে বুঝি, বিশ্রাম শেষ। নতুন হাঁটার সময় এগিয়ে আসছে। এই এটুকু পথে কম হাত ধরলাম না। নরম হাত। শক্ত হাত। ভিজে হাত। শুকনো হাত। কিন্তু যখন যে হাত পেয়েছি, তাদের সাথেই ভাঙা-গড়ার খেলা করেছি। আদর্শবিরোধ, মতবিরোধ, পথবিরোধ এরকম শত শত বিরোধে পিছিয়ে যাইনি। এড়িয়ে যাইনি। দুজনেই হাতে তুলেছি হাতুড়ি। ঠকঠকাং শব্দে রাত ভরিয়েছি।
কিন্তু ওরকম রাতও কম কাটাইনি। স্মৃতিমেদুর বিলাসিতায় টুকরো টুকরো কথার রাত। যার বেশিরভাগটাই পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ। আর ঠান্ডা বাতাসে প্রাণখোলা হাসির দল সেসব রাতের গল্প নিয়ে চলে গেছে কাজে লাগবে না ভেবে। ভবিষ্যৎচারণের অলসতা, স্ববিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার আবেগ নিয়ে সেসব কথা বরং থাক।
কথায় বলে, যার কিছু নেই তার আশা আছে। আমি আর তুই জানি, আশাদত্যির বিরুদ্ধে সরু কঞ্চি জোগাড় করে রোগাপ্যাংলা ছেলেটাকেই যেতে হয় সাহস করে। তাই ভোররাতে সাহসের কথা হয়। আর, যার কঞ্চি নেই, তার গান আছে। ঠোঁটে ঠোঁটে, শিসে শিসে, চোখে চোখে আমার তোর গানে হাজার মানুষের ভালোবাসা নিজেদের লড়াই খুঁজে পায়। সেই গানগুলো বেঁচে থাক। আমরা বরং এগিয়ে চলি।

এলাম। অতিনিজস্ব নিহিলিজমের ফাঁকে, ব্যস্ত প্রতিজ্ঞার অবসরে, পাল্টে যাওয়া দিনগুলোর জোরাজুরির মাঝে কোনো একদিন তোর মত ছায়া পেলে খুঁজেপেতে আমাদের ছায়াটাও বের করবো। মেলাবো না। কেবল পাশের ঘাসে পড়ে থাকবে।
ততদিন,
তোর কমরেড

প্যারালিম্পিকস

আসছিলাম ট্রেনে। প্রতিবারের মত এবারেও লেট করে ফেলেছি। উঠতে বাধ্য হয়েছি প্রতিবন্ধী কামরায়। বাধ্য হয়েছি, কারণ আমি সাধারণত জেনেরাল কামরাতেই উঠি।
সাধারণ কামরা আর প্রতিবন্ধী কামরার মধ্যে সেরকম দেখতে গেলে কোনো পার্থক্যই নেই, একটা ছোটো হ্যান্ডরেল ছাড়া। ওঠার জন্য স্লোপড পা দানি নেই, অ্যাটেনডেন্ট তো নেইই। প্রপার লাইটিং নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসিক্যালি কিছুই নেই।
একবার ছোটো বাথরুম যাবার দরকার হলো। আমি দরজাটা খুলে চাপে পড়ে গেলাম। একখানা কমোড আছে বটে, কিন্তু কাজ সারবো কেমনে? আলো নেই। রেলওয়ের ভারী দরজা পুরো বন্ধ করে দিলে অন্ধকারটাও দেখা যাচ্ছে না, এমন অন্ধকার। তার সাথে স্লিপারি মেঝে। নিজেকে সাপোর্ট দেবার মত কোনো অবলম্বন নেই। সব মিলিয়ে চমৎকার। আমি, একজন নিয়ার-পারফেক্ট প্রতিবন্ধী, প্যান্টের জিপ, পা আর গেট সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে গেলাম। ১০ মিনিটের চেষ্টায় সবকিছু সেরে বেরোলাম। বেরিয়ে ভাবছিলাম, যাদের প্রতিবন্ধকতার পরিমাণ আরোও বেশি, তাঁদের কী অবস্থা হয় এখানে!
প্রতিবছর রেল বাজেট হয়। একখানা বড় ফাইল নিয়ে একজন গম্ভীরমত মানুষ আসেন। অনেককিছু পড়ে শোনান। তা থেকে ভাড়া বৃদ্ধি বেরিয়ে আসে, নতুন ট্রেন বেরিয়ে আসে, এসির ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে, কেবল এই খোঁড়া-কানা-বোবা-অন্ধের দল রয়ে যায় অন্ধকারে।

অবশ্য রেলের কথা শুধু বলে লাভ কী?
আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা মেজরিটিকেই সুবিধা করে দিই, মাইনিরিটিদের মানিয়ে নিতে বলি। স্বাভাবিক। একটা সমাজ, তাতে বেশিরভাগই চৌকো; কয়েকটা খাপছাড়া লোক গোল, ত্রিভুজ, কেউ ট্যারাব্যাঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমি সব জিনিস চৌকৌদের মতন বানাবো। বাকিরা অ্যাডজাস্ট করে নেবে।
সবখানেই। স্কুল-কলেজে ব্রেইল বই পাওয়া যায় না। বলা হয়, ম্যানেজ করে নিন। কাজের জায়গায় স্লোপ বা লিফ্ট থাকে না। চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিবন্ধী। তাতে অবশ্য কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। ‘কোটায়’ পাওয়া লোক, তার জায়গায় একটা ‘নর্মাল’ লোক ঢুকলে বরং আরো প্রোডাক্টিভ হবে। কিছু বেসরকারি কর্মস্থল ছাড়া কোনো অফিস-কাছারিতেই প্রতিবন্ধীদের কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবাই হয় না। আজ. যদি কোনো সরকারি অফিসে হুইলচেয়ারে বসা কোনো মানুষ ক্ল্যারিক্যাল জব বা ম্যানেজারিয়াল জব করেন, লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে।
কারণ, আমরা প্রতিবন্ধীদের আলাদা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। এবং সেটা নীচু চোখ। একটা খোঁড়া লোক খুব বেশি হলে পিওনের চাকরি করতে পারে। কারণ, তার বেশি উঠলেই তার যে কোনো অক্ষমতায় প্রতিবন্ধকতার দোহাই টানা হবে।
রাষ্ট্রের এতো মাথাব্যথা নেই। রাস্তায় আলাদা লেন নেই। হ্যান্ডরেল নেই। পাবলিক বিল্ডিং, যেমন থানা, আদালত, স্কুল এসব জায়গায় ব্যবস্থা নেই। হুইলচেয়ারের মত প্রাথমিক চাহিদাগুলোর কথাও কেউ বলে না।
ভারত রাষ্ট্রে অন্য সব মাইনরিটির মত প্রতিবন্ধীরাও অবহেলিত। এবং তারা এভাবেই কন্ডিশনড। আজই দেখলাম, একজন অন্ধ, তিনি সিটে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিছুক্ষণ উসখুস করে মেঝেকে গিয়ে বসলেন। বহু বছরের বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তি মানুষকে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ শব্দটাই শেখায়।

প্রতিবন্ধীরা ‘রিজেক্টেড’ প্রপার্টি নয়।
তাদেরও নিজস্ব মেধা, দক্ষতা এবং আত্মসম্মান রয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে তাদেরও দাবি রয়েছে স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধার এবং সম আসনের।
৩ শতাংশ সংরক্ষণই মোক্ষ নয়।
সামনে আরো লড়াই রয়েছে।

সমাজের ভদ্র-সুশীল প্রতিনিধিদের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একগাদা ক্রাচ-প্রস্থেটিক-কালোচশমার লড়াই।
[ শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথাই বলা হয়েছে]

পুনশ্চ: আজ কী একটা হাস্যকর কথা কানে এলো রাস্তায়। প্যারালিম্পিকস না কী। হাঃ হাঃ হাঃ!

সহবৎ

একটা কুকুর পুষেছিলাম। এইটুকু বয়স থেকে আমি তাকে শাসন করতাম। কুকুরজাত তো, না শাসন করলে মাথায় ওঠে। রোজ ধমকাতাম, সহবৎ শেখাতাম। ভদ্রতা শেখাতাম ভালো করে। কোনটা সমাজ ভালো চোখে দেখে না, কোনটা পছন্দ করে না, এইসব। যাতে বিগড়ে না যায়, তাই ঘরে বন্দী করে রাখতাম। বলতাম, বেশি উড়নচন্ডী হলে সবাই অসভ্য বলবে। কোনোদিন ফাঁক বুঝে বেরিয়ে গেলে বেল্টপেটা করতাম। দুমাদ্দুম মারতাম— শাসনে রাখতে হবে তো নাকি! পেটানোর ভয়েই ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। তারপর কোথায় খাবে, কোথায় খেলবে সব ঠিক করে দিলাম। ঘরের কুকুর, বিগড়ে যেতে দেওয়া যায়? ওর ভালোর জন্যই ছিল এসব! না শুনলে পেটানোর দাওয়াই আছেই।
এমনি করে আস্তে আস্তে ভদ্র সভ্য হয়ে উঠল। আমার জন্যেই হল। এতোদিনের ট্রেনিং বলে কথা, ঠিক কিনা!
আমার পাশের বাড়িতে নন্দ মেসোও এরকমভাবে কুকুর পুষতো। তার পাশের বাড়িতে পোলকি মাসিও তাই। তার পাশে জন আঙ্কেল। মেহেবুব চাচা। আমার গোটা পাড়াই এরকমভাবে কুকুর পোষ মানাতো। বছরের পর বছর ধরে এরকমভাবেই তো কুকুরদের পোষ মানানো হয়! আমার পাড়ায়। পাশের পাড়া কুলডাঙাতে। নারাণপুরে।
আমরা সবাই তো এরকমভাবেই কুকুরদের পোষ মানাই। ভদ্রসভ্য করে তুলি। সমাজের উপযুক্ত করে তুলি। কত বছর ধরে এমনিই করে আসছি গো!

কী বললে? তোমার একটা মেয়ে আছে?
তা…

বলেছিলাম

আর বেশি সময় পাবো না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রচুর সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তোমার সাথে। আমার সাথেও। কিন্তু আমাকে তো কথাগুলো বলে যেতে হবে। নইলে তুমি ভাববে অন্য কোনো মানুষের প্রেমে তোমায় একা ফেলে চলে যাচ্ছি। ব্যাপারটা সেটা নয়। সেটা ছিল না কোনোদিনই। আমি বলেছিলাম আমি প্রেমে পড়িনা। আমি বলেছিলাম আমি সম্পর্কে পড়ি না। আমি তোমাকে বলিনি সম্পর্কে পড়লে সবাই ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যায় আর মারা যায়? তুমি হেসেছিলে। আর ঝালমুড়ির লঙ্কা বেছে বেছে ফেলছিলে। শোনোনি কেন? আমি তোমাকে তারাপদর কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, মানুষের বেশি কাছে এলে আমি গন্ধ পাই। মুখোশের গন্ধ। ভ্যাপসা, বোঁটকা গন্ধ। তোমরা পাবে কী করে? কোনোদিন মানুষের কাছে গিয়ে শুঁকে দেখোনি সে মরে গেছে, না বেঁচে আছে। তাই আমি চলে যাব। আমার পছন্দ হয় না কাছে আসা। তুমি আমার অজান্তেই গায়ে চেপে বসো। চারপাশের মানুষেরা গায়ে চেপে বসে আমার। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি নিশ্বাস নিতে চাই আর আবার, আবার সেই গন্ধটা নাকে ঢোকে। আমি তোমাকে বোঝাতে বলেছিলাম, কীভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কাছে শান্তি পায়। তুমি পারোনি। পারবেও না। মানুষ ছাড়া বাঁচোনি কোনোদিন। তাই এসব শুনলে তোমার কান্না আসে। কিন্তু আমার জামার হাতা নিজে নিজেই শুকিয়ে যায়, তোমার অপেক্ষা না রেখেই। আমিও একদিন তারাপদর মতই বেরিয়ে পড়ব। কোনো এক বজরায়। কোনো এক গ্রামে। আবার কোনো এক মায়ের আঁচল ফেলে রেখে অন্ধকার রাতে পালাবো। আমি পালাচ্ছি। তুমি মানুষদের নিয়ে ভালো থেকো। আমাকে খুব গালাগাল দিয়ো। পাগল বোলো। তোমার ওয়েভলেংথে বেঁচো। বহুদিন। একঘেয়েভাবে।
আচ্ছা, কোনোদিন কি সত্যিই বোঝোনি? আমার প্রেমের কবিতার নির্লিপ্ততায়? আমার নান্দনিকতার অভাবে? আমার সূক্ষ্মতার অপর্যাপ্ততায়? মনে খটকা লাগেনি? কিন্তু তবু আমি ভালো থাকি। তোমার চেয়ে অনেকটা বেশি। হয়তো ডিলিউশনে থাকি। কিন্তু সেটাও ভালো। তোমার মতো মানুষের ছায়া খুঁজি না। একটা মানুষ কী দিতে পারে? তার বুদ্ধি, মনন, কথা। সবই তো তরঙ্গে ভেসে আসে। আসে না? তবে কাছে গিয়ে তার সাথে লেপটে যেতে চাও কেন? তোমার গায়েও ঘাম, তার গায়েও ঘাম। আর, ঘামে ঘাম মেলাতেই হয় যদি, তবে শরীর মেলাও। তার বেশি কিছু না।

হ্যাঁ, ভালো থেকো।
টিমপ্লেয়ার হও। ম্যাচ খেলো। ঘাম জমুক।
আমি গ্যালারিতে বসি আয়েশ করে। খেলা দেখে আনন্দ পাই।
আর একধাপ করে ওপরদিকে উঠতে থাকি।
আস্তে আস্তে…

তুমি

থরে থরে সাজানো অভিমানের ঠেলা থেকে কয়েকটা বেছে নিয়েছিলে তুমিও। নাওনি বলো? তরতাজা সদ্যজাত অভিমানগুলো থলিতে নির্দ্বিধায় ভরার সময় তাচ্ছিল্যে তার দাম মিটিয়ে আসোনি? ফেরার পথে মুঠো শক্ত করে পেছনে না তাকিয়েই তো বলেছিলে, ‘আমি ঠিক বুঝে নেব।’ ফিরে তাকাওনি। পায়ের শব্দের প্রত্যাশাও করোনি।
ভালো তো। আমি তো পইপই করে বলেছিলাম, নিজের জিনিসের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। অন্যরা নেয় না। নেওয়ার ভান করে মাত্র। তাই, তোমার চলে যাওয়া দেখে ভারী গর্ব হয়েছিল। বুকভরা স্বস্তি নিয়ে আমি দাঁতের পেছনে বলেছিলাম, ‘এ জিতে যাবে। এ বেঁচে যাবে।’
কিন্তু ব্যাগে রেখেছিলে শুধু আবেগ আর অভিমান। আবেগ জিনিসটা, আর যাই হোক, মনের জোরের জন্ম দেয় না। কাঁচের মত জিনিস। কেটে দেয় খুব সহজে, গভীর ক্ষতও সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু ভেঙেও যায় বড় তাড়াতাড়ি। তাও আবেগের জোরে লম্বা রাস্তা বাছার ভুলটা করলে। ব্যাকপ্যাকে জল নেই, শুকনো খাবার নেই, শুধু কিছু শুকনো অভিমান ভরে হাঁটতে শুরু করলে!
মনে পড়েনি যে মাঝরাস্তায় পথের ধারে ব্যাগ খুললে কিছু বাসি অভিমান ছাড়া কিছুই পাবে না। বড়জোর দুচারটে কালো পিঁপড়ে। আবেগটা ব্যাগের চেনের ফাঁক দিয়ে উবে গেছে।

ভয় পেয়োনা ভয় পেয়োনা, তোমায় আমি ফেরাবো না। আমি মানুষ ফেরাই না। পাশে থাকার অস্বস্তির চেয়ে আমার ঢের বেশি পছন্দ রাস্তার শেষে ছোটো হতে থাকা তোমার কালো অবয়বটা।
ব্যাগে এক কৌটো আত্মবিশ্বাস ভরো। এক প্যাকেট একাকীত্ব। ছোটো শিশিটায় একটু স্মৃতি। আর এক বোতল ঘৃণা। বোতলের ছিপিটা আঁটো ভালো করে। পড়ে না যায়। ঠিক হ্যায়?

দুগ্গা দুগ্গা।

মুহূর্তরা

—একটা মানুষকে সবথেকে বেশি কী দিতে পারিস?
—রাত আড়াইটের ময়দানের গেট টপকে ঢুকে খুঁজে পাওয়া বিশাল আকাশ আর তার নীচের ঠান্ডা ঘাসের ডগায় নীরবতা, যে আকাশ বুকে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো যায়।
— তার সঙ্গে?
— সারাদিন সভ্যতার দাবি মেনে চুপ করে নির্জীব পড়ে থাকা এসপ্ল্যানেড চত্বরের বুক খাঁ-খাঁ করা পাগলামোর হাসি, যা একবার শুনতে পেলে বাকি জীবন বুকের মধ্যে রিনরিন করে।
—এইটুকুই?
—কালো জলে নেড়িকুকুরের চিৎকার গুলে দেওয়া গঙ্গার ঘাটে বসে গাছের পাতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা, কখন তার হাসি পায় তার অপেক্ষা।
— শেষ?
— প্রথম রাত, মাঝরাত, শেষরাত এই তিনটে রঙের শেডকে চোখে রেখে মড়ার মত শুয়ে থাকা কোনো এক ঠান্ডা বেদীতে আর খেরোখাতায় রাতের হিসেব।
— সত্যি এসব দিবি?
— নাহ্। নিজে গিয়ে রাতের দালালের কাছে ভাড়া দিয়ে ঢুকিস দেহোপজীবিনী কলকাতার ঘরে। মায়াবিনী বেশ্যাবুড়ির বয়স কমতে শুরু করে রাত বাড়লেই। সারাদিন সে লুকিয়ে থাকে নিজের ঝুপড়িতে, বেরোয় না। তার অসূর্যম্পশ্যা শরীরে দিনের আলো লাগলেই চামড়া আরো কুঁচকে যায়, গাল ঝুলে যায় আর বয়স বাসা বাঁধে। তাই সে লুকিয়ে থাকে দিনমানে। রাত বাড়তে শুরু করলেই তার মায়াজালের কুহকে সময়ের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে। গভীর রাতে যখন সে খদ্দেরের মাথা চিবোবার জন্য কালো চিকচিকি শাড়ি পরে দরজার বাইরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, আর আঁচলের খুঁট থাকে মুখে, তখন সে লাস্যময়ী যুবতী। কোমর পর্যন্ত কালো চুল, শাড়ির ফাঁকে মসৃণ পেটের আভিজাত্য, ঠোঁটে টকটকে লাল পান আর চোখে সেই মায়া। সবাই সহ্য করতে পারে না। কেউ দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, কেউ সাহস করে সামনে চলে এসে তার হাতের সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে মরে। শহরবুড়িও জানে, তার শরীর নিয়ে যে কেউ খেলা করতে পারে না। আঙুল পুড়ে যায়। তাই সেও সুগভীর নাভি, উন্নত স্তন আর আবেদনে ভরা দৃষ্টি নিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে চুড়ি পরে পরস্ত্রীর নিষিদ্ধ কামনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাতের ভবঘুরের অপেক্ষায়, যে তার নিজের ছন্নছাড়া শরীরের অশান্তিটুকু তাকে দিয়ে শান্ত করবে নিজের শরীরের নিচে।
আর কলকাতার দালালরা সোডিয়াম ভেপার আলোর নীচে ফাঁকা রাস্তার গোপনতায় দাঁড়িয়ে থাকে কমিশনের আশায়।

যাস্ একদিন।

ডিলিউশন

Delusion: An idiosyncratic belief or impression maintained despite being contradicted by reality or rational argument, typically as a symptom of mental disorder.
ডিল্যুশন, একটি মানসিক অসুখ। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস, যা বাস্তবতা বা যৌক্তিক তর্ক দ্বারা পরাজিত হলেও অবচেতনে গেঁথে বসে থাকে, তাকে ডিল্যুশন বলে।
সবচেয়ে সহজলভ্য উদাহরণ? আপনার, আমার প্রত্যেকের ঘরেই পাবেন।
একটি ছোটো মেয়ে। নবজাতকের প্রথম এক-দুবছর তার সাথে অন্য শিশুদের কোনো পার্থক্য থাকে না। তারপরেই আস্তে আস্তে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে থাকে দায়িত্ববোধ। আপনি বলবেন, দায়িত্ববোধ? সে তো ভালো জিনিস! সবার শেখা উচিত। কিন্তু না কত্তা, এই যে দায়িত্ববোধ প্রতিদিন ২ মিলিগ্রাম ডোজে শিরায় ঢেলে দেওয়া হয়, তাতে ‘সংসার’ নামে এক অলীক বস্তু মিশে থাকে। তার ডলপুতুলের মধ্যে দিয়ে তাকে মাতৃত্বের পাঠ দেওয়া হয়, শেখানো হয় সেই অবলা পুতুলশিশুর সব দায়িত্ব তার। তাকে খাওয়ানোর। ঘুম পাড়ানোর। নিজের সাথে সাথে বাকি সবার দায়িত্বপালনের নামই তো নাকি ‘সংসার’।
মেয়ে বড়ো হয়। রান্নাবাটি খেলে। সেখান থেকেই শেখে, স্বামী ঘরে এলে রান্না করতে হয়। ঘরের কাজ করতে হয়। অফিস যাওয়া তো খুদে স্বামীটির কাজ! তার ‘দায়িত্ব’ ঘর সামলানো।

এপ্রসঙ্গে মনে পড়লো, আমি তখন ছোট। পুঁচকি বয়স। ছোটো থেকেই আমি ছিলাম আমার ছোটত্বে অসন্তুষ্ট, চেষ্টা করতাম বড়োদের দলে ভিড়বার। তাই সব আদেশকে ‘বড়ো কাজের দায়িত্ব’ ভেবে পালন করার অভ্যেস ছিল। এভাবেই, ছাদে গিয়ে রোদে বসে আচার পাহারা দিতাম, একা গিয়ে দোকান থেকে জিনিস কিনে আনতাম। আর এভাবেই আমাকে দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নেওয়া যেত।
এভাবেই ছোটোবেলা থেকে আমাদের সমাজেও শিখিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের। ‘সংসার’ সামলানোর ‘দায়িত্ব’ তো আসলে মেয়েদেরই। মিথ্যে রঙের ফানুস সাজানো হয় এই বলে, যে ছেলেরা তো ‘উড়নচন্ডী’, ছেলেরা ‘বহির্মুখী’, ছেলেরা ‘অমনোযোগী’ — তারা আবার ‘সংসারের গুরুদায়িত্ব’ কী সামলাবে! মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়, তারা এই ‘সংসারের কর্ত্রী’। তাদের মনে এই ভুল ধারণাকে জোরদার করে গেঁথে দেবার জন্য বিয়ের দিনই আঁচলে বেঁধে দেওয়া ঘরের চাবি। ওই ঘরের চাবির মূলো নাকের সামনে ঝুলিয়ে গৃহবধূদের দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সংসার নামক এক অসংজ্ঞাত বস্তুর দিকে।
স্বাভাবিক। একটা ছোটো মেয়ে, যে ছোটোবেলা থেকে বারণ, নিষেধ, আর চোখরাঙানি ছাড়া কিছু পায়নি, তাকে টোপ দেওয়া হয়, “চল মেয়ে তুই সংসার পাবি। নিজের সংসার। সেখানে তুই রানি। তোর টাকা। তোর চাবি। তোর দায়িত্ব। তুইই সবকিছু সেখানে।”
বেচারা মেয়ে, সে বেনারসীর জবড়জং নিয়ে ‘সংসারে’ এসে দেখে, আলমারির চাবির ঝুনঝুনি আর রান্নাঘরের দায়টুকু ছাড়া সে কিছুই পায়নি।
দায়িত্ব নয়। দায়। সকালে উঠে টিফিন গুছিয়ে দেবার দায়, ভাত বেড়ে দেবার দায়, বাচ্চার ব্যাগ গুছোনোর দায়।
এভাবে ‘সংসারটা মেয়েরাই বাঁধে’ টাইপ কথাবার্তা দিয়ে ছেলেদের ছোটোবেলা থেকে খোদার খাসি করে তোলা হয়। রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গ্যাস জ্বালাতে দেওয়া হয় না। জামাকাপড় কাচতে শেখানো হয় না। ইস্ত্রিতে হাত দিলেই হাত পুড়ে যাবে মনোভাব নিয়ে ইস্ত্রি ব্যান করে দেওয়া হয়। ফলে, সে আর মানুষ. তৈরি হয় না, তৈরি হয় একটি ফিমেল-ডিপেন্ডেন্ট ঢ্যাঁড়শ। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই ছেলে বিয়ে করলে জন্ম দেয় আরেকটা ‘সংসারের’।

পরিবার আর সংসার। পার্থক্য আছে।
পরিবারটা সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে। আর ‘সংসার’ ধারণায় খেটে মরে কেবল মেয়েটা।
মেয়েদের দায়িত্ব কেবল ‘সংসার সামলানো’ নয়।
আর ছেলেদের দায়িত্ব কেবল সকাল নটায় উঠে অফিস দৌড়নো নয়।
আসুন, ভাগ করে নিতে শিখি আমরা।
ভেঙে ফেলি পিতৃতান্ত্রিক ‘সংসার’ ধারণাটা।
পরিবার গড়ে তুলি সবাই মিলে।