প্ল্যান বিয়ের গপ্পো

প্ল্যান ‘এ’ হচ্ছে বিয়ে-টিয়ে করবো না। কারণ আছে। 

কারণ ১:চরম লেভেলের বিবাগী মনোভাব। ঘর-সংসারের দিকে টানটা এমনিতেই কম। অবরে সবরে ঘর যাই। চেনা পরিচিত মুখগুলোর হাসির থেকে অচেনা মুখের বিস্ময় দেখতেই আগ্রহটা বেশি। তারপর একদিন বাবা আমার নামের মানে বলতে গিয়ে আওড়েছিল—
“মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবেনা মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দুবিঘার পরিবর্তে।”
সেদিনই একটা ঢ্যারা পড়ে গেছিল। অবস্থাটা ঠিক টেনে রাখা গার্ডারের মতো। পেছনের হাতটার সঙ্গে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছি। কাজেই, বিয়ে-বউ-বাচ্চায় বাঁচা হবে না আমার।
কারণ ২: অদ্ভুত একটা সমাজবিতৃষ্ণা। জানি সবারই থাকে। শালির বাচ্চার জন্মদিনে গিফট কিনতে যেতে সবারই বিরক্ত লাগে, মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়ে হেঁহেঁ করতে সবারই ক্লান্ত লাগে—কিন্তু আমার মতো এতোটা জন্ডিস কেস বোধহয় না!
আমার যেকোনো সম্পর্কেই অ্যালার্জি আছে। নতুন কারো সঙ্গে আলাপ/বন্ধুত্ব হলে প্রথম প্রথম ভালো লাগে, তারপর যদি দেখি আমি তার কাছে থেকে কিছুই পাচ্ছিনা, তখন মানে মানে পালাই! অথবা, বাধ্যাবস্থায় সয়ে নি কোনোমতে। মা-বাবা-বন্ধু টাইপের ফেভিকলসম্পর্কগুলোর প্রতিও আমার তেমন আদিখ্যেতা নেই। ওই থাকতে হয়, আছে। ব্যস।
তো এরকম লোকের সঙ্গে খুব বেশি লোকের পটে না, বোঝাই যাচ্ছে! লোকে আড়ালে-আবডালে পাগল বলে, কেউ আবার মুখের ওপরেই বলে দেয়!
আর, দুজন নইলে তো বিয়ে হয় না!

এই তো গেল প্ল্যান ‘এ’। এবার আসি প্ল্যান ‘বি’ এর কথায়—মানে, বিয়ের কথায়। ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারি, আত্মবিশ্বাস দিয়ে দুপকেট আর পাছার পকেট ভর্তি করেও হাতে একমুঠো বাকি থাকতে পারে, তা বলে মেগালোম্যানিয়াক তো নই! জানি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে, কর্তব্যের দায়ে, কোনো একদিন বিয়ে করতে হতেই পারে। হতেই পারে।
তাই, একটু ছকে রেখেছি আমার ‘আদর্শ বিয়ে’টাকে। ছকে রাখা ভালো। কাজে দেয়।
একে একে আসি।

°আদর্শ পথসঙ্গী°
১. মগজে একটু কড়া উইট, হিউমার আর স্যাটায়ার।
২. অন্যাকা তথা বাস্তববাদী।
৩. সিম্পুল লিভিং, হাই থিঙ্কিং।
৪. এটাই একটু দাবি গোছের। তিনটে জিনিসের মধ্যে যেকোনো দুটোয় চরম লেভেলের আগ্রহ থাকতে হবে।
বই, গান বা দেশবিদেশে সফর।
ব্যাস। ছোটোখাটো ডিটেইলসে যাচ্ছিনা—কেবল বিরক্ত করাই হবে। বেসিক্যালি, এই গুণগুলো আমি সবার মধ্যেই খুঁজে বেড়াই। যাদের মধ্যে পাই, তারাই আমার পেয়ারের লোক হয়ে যায়। কাজেই, এই মানুষটার মধ্যে তো খুঁজবোই!
এবার, আসি অন্যগুলোর কথায়।

°আদর্শ বিয়েস্থান°
অবভিয়াসলি ডেস্টিনেশন ওয়েডিং! আর কিছু না হোক, ওই P.C.Chandraএর অ্যাডটা দেখেছেন? ওরকম হলেও চলবে!
(হেঁহেঁ, নোংরা পুঁজিবাদী চিন্তা। মাঝে মাঝে ইনফিলট্রেট করে যায় আর কী!)

এবারে, মূল পার্ট। মানে, বিবাহ পরবর্তী জীবনের কিছু রুলজ অ্যান্ড রেগুলেশনজ। না না এভাবে বলবো না। লোকে আবার কিসব কিসব বলে বসবে। বরং বলা যাক, কোড অফ এথিক্স। বা বলতে পারেন, আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসলে, আমার পাঞ্জাবির কলারের ট্যাগে এগুলোই “*T&C apply” হিসেবে লেখা থাকবে!
যাই হোক, সেগুলো একে একে বলি।

°সাংসারিক সংবিধান°
১. বিয়ের পরের ৬ মাস/১ বছর হচ্ছে ট্রেনিং পিরিয়ড। ওইসময় আমাকে রান্না করাটা শিখিয়ে দিতে হবে। সপ্তাহে সাড়ে তিনদিন রান্নার দায়িত্ব নিতে আমার তরফ থেকে আগ্রহই থাকবে।
২.ঘরের বাকি সব কাজই মোটামুটি পারি। ঘর মোছা, ঝাঁট দেওয়া, জামাকাপড় কাচা, বাসন মাজা এইসব কাজগুলো ভালোই পারি বলে মনে হয়। সেটা মনোমত না হলে এই সময়ের মধ্যে শিখিয়ে নিতে হবে। এইসব কাজকে আমি বাজে কাজ বলে মনে করি না, বরং ভালোইবাসি করতে।
৩. নিজস্ব পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। মিউচ্যুয়ালি। একের ওপর অন্যের পছন্দ চাপানো(ইমোশনালি জোর করে হলেও) খুব বাজে জিনিস। সকালে আমি চা ভালোবাসি আর তুমি কফি, সেখানে তুমি বলতেই পারো যে, “তোমার চা আমি বানাব না। নিজে করে খাও।” তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু, ‘আমিও খাচ্ছি তুমিও খাও না’ টাইপের আবদার চলবে না।
৪. নানা রকমের ফান্ড এর ব্যবস্থা থাকবে। তা থেকে দুজনেই খরচ দেবে এবং নেবে। এবং মাসের শেষে ক্লিন অডিট দেওয়া হবে। এবং কোনখাতে খরচ বেশি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা হবে।
৫. ছোটো বা বড়, সবাইকে তর্ক করতে জানতে হবে। যুক্তি দিয়ে ঠিকঠাক তর্ক করতে জানতে হবে। আবেগ দিয়ে তর্ক বা কুযুক্তিওয়ালা তর্ক একদমই আনচলেবল্।
৬. ঘরের সব সদস্যকে নিয়ে প্রতি শনিবার রাতে আদালত বসবে। সবার অভিযোগ কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই শোনা হবে এবং হাতভোট, জুরি সিস্টেম প্রভৃতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচার হবে। জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সদস্য জরুরি মিটিং ডাকতে পারে।
৭. যেকোনো ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলতে এবং প্রশ্ন করতে জানতে হবে। তা ব্যাপারটা যতই লজ্জার, রাগের বা অস্বস্তির হোক না কেন! যেকোনো প্রশ্ন,পছন্দ-অপছন্দ এবং সমালোচনা মুখের ওপর বলাটাই অ্যাপ্রিশিয়েট করা হবে। এমনকি খিস্তিও।
৮. সেকেন্ড এডিশনগণের আবির্ভাব হলেই জীবনকে বিরিয়ানি থেকে পান্তাভাত করে দিতে হবে, এমন দাবি চলবে না। ৪০ বছর বয়সেও হাত ধরা যায়, ৪০ বছর বয়সেও একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, ৪০ বছর বয়সেও চুমু খাওয়া যায়। লোকহাসির ভয় আমি এখনো করিনা, তখনো করবো না।
৯. একাকীত্বের দাবিকে মান্যতা দিতে হবে। আমার মাঝে মাঝে একা হাঁটতে বেরোতে ইচ্ছা হতেই পারে। গভীর রাতে একা টেবিলল্যাম্পে গল্পের বই পড়তেই পারি। একা কোথাও ঘুরতে বা ট্রেক করতেও যেতে পারি। পকেট ধরে ঝুলে পড়া চলবে না।
১০. শেষত, সাংসারিক বৃত্তের যাবতীয় দায়িত্ব, কর্তব্য এবং তাদের ফলাফলের বোঝা দুজনের ওপর সমানভাবে পড়বে। পড়বেই। এবং সেটা এড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে বড়জোর সিমবায়োসিস চলতে পারে, প্যারাসাইটিজম নেভারস্য নেভারম!

পুনশ্চ: ওদিক থেকেও আমি এরকম একটা লিস্টি শুধুমাত্র আশাই করবো না, ইনসিস্টও করবো। না দিলে, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে।

4 thoughts on “প্ল্যান বিয়ের গপ্পো

  1. ওই যে আদালত বসবে লিখেছেন না ওই ব্যাপারটি হুমায়ুন আহমেদের একটি বইয়ে একটি বাড়িতে ঘটত।
    ভালো লাগলো আপনার শর্তাবলী নিয়মকানুন।
    দেখুন একদিন লিস্টিতে লিস্টিতে মাইল যাবে।
    😛

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান