অচেনা বিপ্লব

ধরুন আপনি একজন মাস্টার বা ডাক্তার বা উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার বা কেরানি বা ব্যাঙ্ক । যে কেউ। আপনি আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “বলো তো বাবু আমি কী করি?” আমি মুখ ভেংচিয়ে বললাম, “তুমি? তুমি সকালবেলা উঠে হাই তোলো, পিঠ চুলকাও, তারপর বৌয়ের তাড়া খেয়ে বাজার যাও, বাসে ঝুলতে ঝুলতে ঘেমে কালো ব্যাগ ঝুলিয়ে কোথায় একটা যাও, আর সন্ধ্যেবেলা হাক্লান্ত হয়ে ফিরে বাচ্চাদের পেটাও আর বউকে ধমকাও!”
কেমন লাগবে?
ঠিক সেরকমই ওদেরও মনে হয়। ওরাও প্রতিদিন এইরকম প্রশ্নচোখ সইতে সইতে ভাবে, ‘কেন? এরা বুঝছে না কেন? কেমন করে বোঝাই, আমি যেটা করছি সেটা করা প্রয়োজনীয়।’
আপনি যখন বিপ্লব মানে বলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ। যখন বিপ্লব বলতে বোঝেন একটা মিছিল। কিছু স্লোগান। আপনার যখন মনে হয়, বিপ্লব মানেই কিছু লম্বা চওড়া কথা আর কাঠবেকারদের স্বপ্নবিলাস, তখন তারাও অবাক হয়।
যখন রাস্তার মোড়ে তারা বসে পড়ে একের পর এক সাদা কাগজে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বড় বড় করে লিখতে থাকে, তখন তারাও আশায় থাকে— এই বুঝি কেউ বুঝতে পারলো তাদের কথা।
আপনি বিকেলবেলা বাসের জানালায় স্লোগানরত পায়ের ভিড় দেখে বিপ্লব বলে যেসব জিনিসকে চিহ্নিত করেন, বিপ্লব ঠিক সেই জিনিসগুলোই নয়।

দেখবেন ‘বিপ্লবী’দের সংসার? আসুন তবে।
দেখুন ওই ঘাসে গোল করে ঘিরে একদঙ্গল তরুণ-তরুণী বসে আছে। ওদের কথাবার্তায় কান পাতুন তো! কিছু একটা নিয়ে তর্ক হচ্ছে। কী নিয়ে? কিছু কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ শোনা যাচ্ছে — শিক্ষা, গ্যাটস্ চুক্তি, WTO, বেসরকারিকরণ।
হ্যাঁ, ওরা কথা বলছে সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে এবং তার ওপর বাজারি হাতের মুঠো শক্ত হচ্ছে, তাই নিয়ে। ভালো করে কান পাতলে অনেক লেখকের উদ্ধৃতি শুনতে পাবেন। শুনবেন অনেক ডকুমেন্টের কথা।
পাবেন। কারণ আমার আপনার মত এরা কেবল আনন্দবাজার পড়ে না। বিভিন্ন বই পড়ে, নানাদিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পুরো হাতিটাকেই দেখে। শুধু শুঁড়টা নয়।

ওই দেখুন, আরেক দল। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মিলে। আসুন কাছে যাই। এরা কথা বলছে কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীরে কেন সাধারণ মানুষ বারবার মারা যাচ্ছে, বারবার ছোটো বাচ্চাদের গালে এসে বাগছে উড়ন্ত বুলেট, কেন নালার পাশে মেয়েদের ছেঁড়াখোঁড়া লাশ পাওয়া যাচ্ছে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। একজন হঠাৎ বলে বসলো, ইন্ডিয়ান আর্মিই দোষী! যেমন আপনি বিশুর চায়ের দোকানে টেবিল চাপড়ে বলে ওঠেন। কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলো একেবারে অন্যরকম হলো এখানে। বাকি সবাই তাকে একের পর এক যুক্তি দিলো, নানা বইয়ের নাম বলল আর একজন তাকে একখানা ডকুমেন্টারি পাঠিয়ে দিল ফোনে। বললো, ‘দেখিস। ভালো করে জেনে বুঝে ভাবিস, কার দোষ? গরীব পরিবারের চাকরির খোঁজে আসা ছেলেগুলোর, নাকি সরকারের বিদেশনীতি আর রাজনৈতিক অক্ষমতার?’ তা কিছুদিন পরে, তারা সবাই মিলে একখানা ঘরোয়া মিটিঙে বসলো। সেখানে কয়েকজন কয়েকটা বই দেওয়ানেওয়া করলো, একজন ডকুমেন্টারিটা চেয়ে নিয়ে গেলো আর হান্দোয়ারার ঘটনাটা নিয়ে আবার কিছু কথা হলো।

ওই দেখুন। ওরা কয়েকজন চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলছে। আপনি জানেন চা বাগানের শ্রমিকদের কথা? জানেন না, তাই তো? কারণ আনন্দবাজারে এই খবরগুলো বেরোয়ই না! বেরোবেও না। তাই আপনি জানবেন না, কিভাবে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর মানুষগুলো অনাহারে মারা যাচ্ছে। কীভাবে তারা মেঠো ইঁদুর আর গাছের পাতা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। খবরের চ্যানেলের বুম আর মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টারের আড়ালেই ওরা মারা গেছে। যাচ্ছে।
কিছুদিন পরে এই গার্গী, মৃন্ময়, শ্রীতমা, শুভঙ্কর, অম্লানদেরকেই দেখা গেল শিয়ালদার এক পোড়ো বিকেলে লোকজনের কাছে চা বাগানের অবস্থা জানিয়ে সাহায্যের জন্য টাকা চাইতে। তারাই কিছুদিন পরে মেডিক্যাল কলেজের কিছু বন্ধুকে নিয়ে যৎসামান্য চেষ্টায় কিছু ত্রিপল আর শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে ট্রেনে চেপে গেছিল উপরের দিকে।
অবভিয়াসলি, আপনি এসব দেখেননি। আপনার অনেক কাজ। এদের তো পড়াশোনাও নেই, কাজকম্মোটুকুও নেই।

আরে! ওই দেখুন! ওই ‘বিপ্লবী’ ছেলেটা ইউনিভার্সিটি টপারের পদক নিচ্ছে মঞ্চে উঠে। এবার এই দেখুন, ওই চশমাপরা মেয়েটার এই পেপারটা এই সেদিনই পাবলিশ হয়েছে। আর সেই যে ছেলেটা হেল্থক্যাম্পে বসে বসে ব্লাড প্রেশার মাপছিল, সে অর্থোপেডিকসে এমএস পেয়েছে ভারতের তিননম্বর মেডিক্যাল কলেজে।

ভুল বুঝবেন না মশাই। আমরা এতোটাও খারাপ নই। ভুলভ্রান্তি আপনারও হয়, আমাদেরও হয়। কিন্তু আমাদের কম বয়স, গরম রক্ত আর মুঠো করা হাত দেখেই বাতিলের দলে ফেলে দেবেন না। আমরা এই সমাজকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখি। যেমন হোককলরব। যেমন বর্ধমান। যেমন জেএনইউ। যেমন হায়দ্রাবাদ। যেমন এনআইটি শ্রীনগর। আপনাকেও চাই পাশে। বাসের জানালা থেকে, পাশের ফুটপাথ থেকে, প্রাইভেট কারের স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বড় বড় তাচ্ছিল্যমাখা চোখে নয়, চাই আপনাকে তর্কে-আলোচনায়-কথাবার্তায়। আসুন না, একসঙ্গে মিলেই দানি সেই প্রয়োজনীয় ঘটনাগুলো, যেগুলো রাষ্ট্র আমার-আপনার চোখের কাছে নিষিদ্ধ বলে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে।
আসুন, আওয়াজ তুলি। কথা বলি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রচলিত পচাগলা সমাজের উল্টোদিকে।
আসুন, কথা বলি কেন মেয়েরা এখনো সুরক্ষিত নয়। কেন সেক্সিস্ট জোক চলবে ইন্টারনেটে। কেন পাঞ্জাবিদের পাঁইয়া বলাটা ভালো নয়। আসুন জানি। কাশ্মীর নিয়ে। সেনা নিয়ে। সোনি সোরি নিয়ে। কোরান নিয়ে। জামাত নিয়ে। আরএসএস নিয়ে।
ভয় পাবেন না। সাহস আমরা ধার দেব। পরিবর্তে চেয়ে নেব আপনার, আপনাদের অভিজ্ঞতা।

এসো, কমরেড। 🙂

3 thoughts on “অচেনা বিপ্লব

  1. অসাধারণ লেখা।মননের সংকটে খন্ডিত নয়;দুর্দমনীয় আবেগে প্রদীপ্ত।এ-রকম লেখাই আমাদের আক্রান্ত করে; নাড়া দেয় ,সাড়া জাগায় ভিতরে-বাইরে।এই কলম চিরজীবী হোক্॥

    Liked by 1 person

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান